বিপিনকে এক হাতে শক্ত করে ধরে, প্রাণপণে ছুটছে নীলা। বুনো মহিষের দল তাড়া করেছে যেনো ওদের! মুখে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা, পাতলা শরীর, হাতে চাপাতির মতো দেখতে ধারালো কোন অস্ত্র উঁচিয়ে ওদের পেছন পেছন দৌঁড়ে আসছে একজন! শুনশান রাস্তা। হঠাৎ হঠাৎ দু'পাশ থেকে দ্রুতগতির কিছু যান ছুটে চলেছে ওদের পাশ ঘেঁষে। উন্মুক্ত রাস্তায় কী ঘটছে, কেউ মরে পরে আছে কিনা এ নিয়ে কারো যেন কোন হেলদোল নেই। যে যার মতো ছুটে চলেছে শহরতলী, দুরপাল্লা, মালবাহী ট্রাক, প্রাইভেট কারগুলো। মনে হবে এ ধরনের ঘটনা আকছারই ঘটে এখানে। তীব্রবেগে একটি প্রাইভেট কারকে ছুটে আসতে দেখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গাড়িটিকে থামানোর চেষ্টা করলো নীলা। অস্ফুট স্বরে অনুনয় করতে থাকলো, প্লিজ, আমাদের বাঁচান। ভীষণ বিপদে পড়েছি আমরা। প্লিজ, একটিবারের জন্য বাঁচান আমাদের।
গাড়ীর চালক শুনতে পেলো কিনা বোঝা গেলো না! কিছুদূরে চাপাতি ধরা লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। গাড়ির গতি শ্লথ হলো কিছু সময়ের জন্য। কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলো যেন নীলা! হঠাৎই কি মনে করে গাড়িটি ওদের পাশ কেটে আবার দ্রুতবেগে ছুটে গেলো হাইওয়ে ধরে! গাড়িটা চলে যেতেই ওদের একজন বিপিনের শার্টের কলার ধরে ফেলল পেছন থেকে! এতক্ষণে নীলা খেয়াল করলো ওরা একজন নয় বেশ ক'জন। অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো আরো দু'জন। চাপাতি ধরা লোকটিসহ ওরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো ওদের। কীসব বলে বিপিনকে রাজি করিয়ে ফেললো ওরা। নীলা ভাবছিলো, ওর কি দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত! বিপিনকে এভাবে একা ফেলে ছুটে যাওয়া কি ঠিক হবে ওর? তাছাড়া একা সে ওদের সাথে ঠিক পেরে উঠবে বলে তো মনে হয় না। মাথা শূন্য হয়ে গেছে ওর। শরীরের সব শক্তিও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। একরকম বাধ্য হয়ে শরীরটাকে টেনে নিয়ে ওদের পেছন পেছন চললো বিপিন ও নীলা।
ওদের নিয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পরলো ওরা। মুহুর্তেই নীলা বুঝে গেলো, ওরা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিপিনকে ষণ্ডামার্কা একজন ধমকের সুরে বলে ওঠলো, ভালোয় ভালোয় কইতাছি, কি কি আছে সব বাইর কইরা দ্যায়। বেশী উল্টাপাল্টা করবি তো, এই ছুরি দিয়া নাড়িভুঁড়ি সব টাইন্যা বাইর কইরা নিয়া আমু। এই বলে চাপাতি ধরা লোকটি বিপিনের পিঠে, উরুতে ধারালো চাপাতির কোণা দিয়ে দাগ কাটতে লাগলো! দরদর করে বেরিয়ে আসা রক্তে ভিজে গেল ওর পেছন দিক। তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠলো ও। নীলা হাঁটু গেড়ে একজনের পা ধরে অনুনয় করতে লাগলো, আপনারা ওকে এভাবে মারছেন কেনো? আমাদের কাছে যা ছিলো সব তো দিয়েই দিয়েছি! প্লিজ, আমাদের এবার ছেড়ে দিন এবার। ওদেরই একজন দেঁতো হাসি হাসতে হাসতে বললো, এই পাখি কয় কী? কদ্দিন ধইরা এই লাইনে আইছো? ওই ব্যাটারে আনন্দ দিছো, আমগোরে আনন্দ না দিয়া যাইব্যা গিয়া? আমরা কী দোষ করছি, কও-এই বলে ঝুঁকে পরে মুখটাকে নীলার মুখ বরাবর এনে হাসতে হাসতে পাঁচ আঙুলে পিষতে থাকলো ওর কোমর!
ঝোপঝাড়ের জন্য কেমন অস্থস্তিকর অন্ধকার চেপে আছে ভেতরটা। আশপাশটা বেশ আবছা হয়ে আছে! শুধুমাত্র রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো জ্বলজ্বল করে উঠছিল হঠাৎ হঠাৎ করে। দেঁতো হাসির লোকটির হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যরাও খিক খিক করে হেসে উঠলো সমস্বরে। হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়লো ওরা। অপমানে, কষ্টে নীলা থম মেরে বসে রইলো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু; মাটির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা আগাছাগুলোকে আরও সতেজ করে তুললো যেনো! লোকটি নীলার বাহু খামচে ধরে তীব্রবেগে টেনে ওঠালো ওকে। এই প্রথম আবছা আলোয় লোকটিকে দেখতে পেলো ও। শুকনো, ভাঙাচোরা মুখ। নোংরা দাঁতগুলো যেনো কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। অন্যদের আলতো ধক্কা দিয়ে সরিয়ে নীলাকে আরো ঝোপের ভেতর নিয়ে এলো। আশ্বস্তের ভঙ্গিতে বললো, আমারে বিশ্বাস করো। ওরা কেউ কিছু করতে পারবো না তোমারে। আগে কও হেই ব্যাডা কি লাগে তুমার। এরপরেই তুমগরে ছাইড়্যা দিমু। কাছাকাছি ঝোপের আড়াল থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দে থমথমে হয়ে গেলো আশপাশ।
-ও আমার হাজব্যান্ড। ঝড়ো বেগে মিথ্যে কথাটি বলে গেলো নীলা।
-কিন্তু ওর এ কথাটা যেন ঠিক মনঃপুত হলো না; এমন ভাব করে লোকটি ওর হাতটিকে সামান্য মুচড়ে বললো, মিছা কতা কওয়ার লাগছো, না!
পেছন থেকে চিমসে মতোন আরো একটি লোক এসে দাঁড়ালো। শরীরটাকে বেঁকেচুরে হাসতে হাসতে বললো, ওই, তোর শ্বশুরের নাম কি?
কিন্তু নীলার জবাবকে এক ধাক্কায় দুরে ঠেলে দিয়ে একসাথে বলে ওঠলো, সব মিছা কতা, মিছা কতা কইতাছে। এগুলা কইয়া এইহান থ্যাইককা যাইতে পাইরবি মনে করছোস, মাগি!
হঠাৎ মুখে কাপড় দেয়া লোকটি মুখ খিঁচিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে ধমক দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল, তুই যা, আমি কতা কইতাছি বালা লাগে না, না? হালার পো। এরপর নীলাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, কেউ কিছু করবো না তুমার লগে। তুমি শুধু আমারে আনন্দ দাও, সোনা। আমি নিজে তুমগোরে ছাইড়্যা দিমু, কইলাম তো।
কিছু দূর থাকা একজন যেনো ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো, 'ওই, তুই ছাইড়্যা দ্যায়ার ক্যা রে?' মুখ বাঁধা লোকটি পেছন ফিরে কিছু একটা ইশারা করতেই চুপ হয়ে গেলো লোকটি। তড়িঘড়ি করে জিন্সের জিপার খুলে জোরসে মাটিতে ফেলে দিলো নীলাকে। যন্ত্রণায় কোঁকাতে লাগলো ও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাপটে ধরলো ওকে। ফরফর করে জামার বোতাম ছিঁড়ে ফেলে শরীরের বিভিন্ন অংশে হিংস্রভাবে কামড়াতে লাগলো নীলাকে। এরপর ওয়াক ওয়াক করে একদলা শ্লেষ্মা মেশানো থুতু ছুঁড়ে ফেলে; জিপার বন্ধ করে ওঠে দাঁড়াতেই আরো একজন এসে উপস্থিত।
-আপনি না বললেন, আমাদের ছেড়ে দেবেন? অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো নীলা।
হাসতে হাসতে শরীর দোলাতে দোলাতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো লোকটি। দ্রুতবেগে উপস্থিত লোকটি এক হাতে চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ঘষটাতে থাকলো ওর মাথা। আর অন্য হাতে মুখটাকে খামচে ধরে কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলে ওঠলো, একটা কতা কইল্যে এইহানে লাশ ফালাইয়্যা দিমু, শালার মাগি!
মাটিকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে খামচে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাঁদতে থাকলো ও। হেডলাইটের আলো জ্বালিয়ে সাঁ সাঁ করে এক একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে আর নীলা নীরবে নিঃশব্দে গুনতে থাকে- এক...দুই...তিন...চার... পাঁচ....এরপর...।
তিরতির করে কেঁপে ওঠে ওর ঠোঁট। শরীরের সমস্ত শক্তিকে এক করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় নীলা। উদ্ভ্রান্তের মতো ঝোপঝাড় পার হতে থাকে ও। খালি পা। জামার বোতাম ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই যেন ওর। বিপিন নীলার ওড়নাটিকে খুলে ঢেকে দিলো ওর ওপরের অংশ। তুমি ঠিক আছো তো, কেমন লাগছে তোমার? ভয়ানক কিছু করেনি তো ওরা তোমার সাথে? কি হলো! এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে? কথা বলো?
ওর মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না! বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না, কত দূর থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো। কে, কাকে উদ্দেশ্য করে বলছে এ কথাগুলো! অন্ধকারে ছুটে চলা গাড়িগুলোকে এক একটি ভৌতিক আত্মার মতো মনে হতে থাকলো ওর।
এক টুকরো নির্মল সবুজের লোভে ছুটে এসেছিল যে নর-নারী সেই চেনা জায়গা আজ বড় অপরিচিত হয়ে ধরা দিল ওদের কাছে। যেন সবুজের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা হায়েনার দল শিকারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। হাতের নাগালে পেলে ছিঁড়ে ফেরে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে সেই শিকারটিকে। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছিলো 'জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে'। ঢাকার অদূরে এমন লোভনীয় সবুজের ছোঁয়া থেকে কে আর বঞ্চিত হতে চায়!
শীতের মৌসুমে পরিযায়ী পাখি দর্শন, পহেলা বৈশাখ, এরকম নানা উপলক্ষ্য নিয়ে বারবার ছুটে চলে আসতো নীলা। যতবার এসেছে ততবারই একরকম নির্জনতা, ঠাণ্ডা ও শীতল আমেজ জড়িয়ে থাকতো এই জায়গাটিকে ঘিরে। হৈ-হুল্লোড় আর ঝাঁ চকচকে জীবন সবসময় অপছন্দের ছিলো নীলার। বিপিনও ঘুরতে পছন্দ করতো তাই ওর সাথে একধরনের খাপ খাইয়ে গিয়েছিল ওর। কিন্তু সবুজের মাঝে কুণ্ডলী পাকিয়ে সরীসৃপের মতো বিষাক্ত ফণা নিয়ে বিপদ যে আড়ালে আবডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে;আগুন্তকদের কাছে অজানা থেকে গিয়েছিলো এতদিন।
বিপিন বেরোতে চায়নি। নীলাই একরকম চাপ দিয়ে ওকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল। বেশ ক'দিন ধরে অফিস-বাড়ি, বাড়ি-অফিস করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেছিলো ও। বিপিন চাকরি ছেড়েছে বেশ ক'দিন হলো। তাই এমন অস্বস্তি কাটাতে সবুজের কাছাকাছি যাওয়া জরুরি। নিজেদের মতো একান্ত কিছু সময় কাটানো গেলো, এমনই ভাবনাই ছিলো নীলার! শেষমেশ ও-ই ঠিক করলো জাহাঙ্গীর নগর ক্যাম্পাসে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে তো আর নয়!
বিধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে নীলা। পাশে বিপিন। একটু পর পর মনে হচ্ছে ঐ ঝোপঝাড় থেকে আর কোন হায়েনার দল বেরিয়ে আসছে না তো। চারপাশের অন্ধকার যেনো আরও গাঢ় হয়ে এসেছে এরই মধ্যে। অনেকক্ষণ পর নীলাই কথা বলে উঠলো। স্থির ও ক্ষীণ কণ্ঠে বিপিনকে জিজ্ঞাসা করলো, কয়টা বাজে এখন? সাড়ে দশ। ক্যাম্পাসের তোরণের মুখে বেশ কয়েকটি রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে এখনো। বিপিন নিজেই রিক্সা ঠিক করলো। রিক্সাচালক এক মুহুর্তের জন্যে নীলাকে দেখেই চমকে উঠলো। কি দেখতে পেলো কে জানে! এরপরই প্যাডেলে পা দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে আসলো গন্তব্যে। বিপিনের প্যান্টের পকেটে খুচরো কিছু ছিলো বোধ হয়, তাই দিয়ে ভাড়া মেটালো ও। সব তো নিয়েই নিয়েছে। এমনকি এ্যান্টিকাটারও। ফল কাটার জন্য নীলার ব্যাগে থাকতো সবসময়, তাছাড়া নানা কাজেও লাগতো বেশ।
টিএসসিতে বিপিন ওর পরিচিত কয়েকজনকে পেয়ে গেলো। ওদের সাথে কিসব কথা বললো ও। ওদেরই ক'জন ভূত দেখার মতো শুরু থেকেই নীলাকে দেখে যাচ্ছিলো। বিপিন কিছু টাকা, টি শার্ট আর একজোড়া চটি স্যান্ডেল নিয়ে তড়িঘড়ি বিদায় নিলো ওদের কাছ থেকে।
ওদেরই একজন খুব জোর করছিলো বিপিনকে, আপাকে আমরা মেয়েদের হলে থাকার ব্যবস্থা করে দেই। বাসায় যেতে যেতে তো বেশ রাত হয়ে যাবে। কালই বরঞ্চ ঢাকায় যান, ভাই।
নীলার দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। মনে হচ্ছিলো, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু গাছগুলো এমন মুখ হা করে আছে যেনো মুহুর্তেই ওকে গিলে খাবে! পুরো শরীর ব্যাথায় যন্ত্রণায় চুড়চুড় হয়ে ভেঙে পড়তে চাইলো যেনো।
ঘড়িতে রাত এগারো। দূরপাল্লার গাড়ীগুলো পাল্লা দিয়ে শহরতলী ছেড়ে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। রাস্তায় ঢাকাগামী বাসের সংখ্যাও বেশ কমে গেছে। বহুকষ্টে একটি বাস পাওয়া গেলো ঠিকই। কিন্তু বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো যাত্রীদের মধ্যে। কে কার আগে উঠবে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না।
হেলপারও এই সুযোগটা নিয়ে নিলো পুরো দস্তুর। লাষ্ট বাস! লাষ্ট বাস! এরপর আর কোন বাস পাইবেন না। আমিন বাজার, টেকনিক্যাল,কল্যানপুর, শ্যামলী, ধামমণ্ডি, প্রেসক্লাব, গুলিস্থান...। আসেন ভাই, আসেন। ঢাকা...ঢাকা। একনাগাড়ে সুর মিলিয়ে চেঁচিয়ে গেলো লোকটি।
অনেক কষ্টে ড্রাইভারের সিটের পেছনে লাগোয়া একটা সিটে বসে পড়লো নীলা। কিন্তু আরেকজন যাত্রী কখন যে ওকে ঠেলে, ওর পাশে এসে বসলো খেয়ালই হলো না ওর। উদ্ভ্রান্তের মতো বসে আছে ও। শূন্য দৃষ্টি। দেখে মনে হতে পারে হিংস্র কোন জানোয়ারের তাড়া খেয়ে দিকভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছে নিরীহ কোন প্রাণী। মুখোমুখি শীর্ণকায় এক প্রৌঢ়, চোখ দুটো কোটরে ঢুকে পড়ায় আরো অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। অবাক দৃষ্টি ফেলে দেখে যাচ্ছে নীলাকে। কিন্তু এ নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। বুকের ভেতর কী যেনো দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে অনেকক্ষণ ধরে। মাথার পেছনেটা ভীষণ ভারি হয়ে আছে। মাঝেমধ্যে দেয়ালে পেরেক ঠোকার মতো তীব্র ঘা মারছে। বুকের ভেতরটা এমন হু হু করে উঠছে কেনো! আর কত সময় লাগবে? খোলা বাতাসে হাঁটা দরকার। কেমন জ্বরজ্বরও লাগছে! জ্বর আসবে মনে হয়।মনে মনে আওড়ে যায় নীলা।
বিপিনের হাতের ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফিরে পেলো যেনো ও।
-আমরা কোথায় এখন? অস্ফুট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো নীলা।
-কল্যানপুরে। চলো এখানেই নেমে পড়ি। বললো বিপিন।
-এখানে কেনো? বাসায় যাবো না। অবাক হয়ে জানতে চাইলো নীলা।
-বাস থেকে নেমে সিন্ধান্ত নেই, এখন উঠো। এই বলে বাস থেকে নামার উদ্যোগ করলো ও। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ওঠে পড়লো নীলা।
-বাস থেকে নেমেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লো বিপিন। চেয়ারে বসেই এক নাগাড়ে কথা ক'টি বলে গেলো ও, শোন, আমার একটা কথা রাখো তুমি। আজ তুমি বাসায় যেও না। আজকের দিনটা একা থাকা নিরাপদ না তোমার জন্য।
-তাহলে...? বিষন্ন কণ্ঠে বলে ওঠলো নীলা।
-কোথায় যে যাওয়া যায়...তাই ভাবছি। তোমার পরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারবে এখন? চিন্তিত ভঙ্গিতে নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিপিন।
-আমার মাথা কাজ করছে না। তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো। গোজ হয়ে বসে থাকে নীলা।
পরে ঠিক করা হলো বিপিনের এক পরিচিত আপার বাসায় উঠবে ওরা। আপার সাথে কথাও বলে নিলো বিপিন।
রাত বারোটা। আপার পরিবারের সবাই জেগে আছে এখনো। আপার সাথে পরিচয়ের এক পর্যায়ে ওনার অবাক করা চাহনি নীলার চোখ কিছুতেই এড়িয়ে গেলো না। তবে উনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, সহজেই সবকিছু স্বাভাবিক করে নিলেন। 'বেশ রাত হয়েছে। এখন আর চা না করি, বিপিন! তোরা ফ্রেশ হয়ে নেয়। আমরা এখনো ডিনার করি নি। তোরা আসবি তাই আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। যাও, নীলা তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। বলেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন আপা।
স্নানঘরে ঢুকেই হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো নীলা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সিলিং-এ একনাগাড়ে তাকিয়ে রইল ও। মিনিট বিশেক পর টলমলে পায়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে ফুল স্পিডে ঝর্না ছেড়ে দিয়ে আবার ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লো ও। ছড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে পানি পড়ে অমনি ছ্যাৎছ্যাৎ করে ওঠলো! সারা শরীরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখতে লাগলো ও।
অনেকক্ষণ পর হঠাৎই হুঁ হুঁ কেঁদে উঠলো নীলা। এমন কেনো হলো আমার, কেন আমার সাথে এমন হলো? নিজের অজান্তেই বলে গেলো কথা ক'টি। এরপর সাবান দিয়ে ইচ্ছেমতো ঘষতে থাকলো ওর পুরো শরীর। খানিক পর নীচু মুখ কিছুটা উঁচু করে অপরদিকের দেয়ালে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কঠিন হয়ে ওঠলো ওর চোখমুখ। যেনো চোখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরিয়ে এসে সবকিছু অঙ্গার করে দেবে মুহূর্তের মধ্যে। দরজায় বাইরের কড়া নাড়ার শব্দ কান অব্দি পৌঁছালো না ওর; হয়তো ইচ্ছে করেই শোনার চেষ্টা করলো না ও! ছরছর করে পানি পড়ে যাচ্ছে অথচ ঝর্না বন্ধ করার তাগিদ অনুভব করলো না নীলা।
এই লেখকের আরও লেখা
0 Comments