তুতুর স্পেশাল ।। শাপলা বড়ুয়া


গোল গোল চাকতির মতো দেখতে। আর সেই ছাই রঙা এই চাকতির গায়ে আবার ফুটকির মতো কী যেনতুতু এর নাম দিয়েছে 'স্পেশাল'। স্পেশাল নয়তো কী! কেবল দুপুরের খাবারের পরই প্রতিদিন একটি করে বরাদ্দ থাকে ওর জন্য। সেজন্য কত প্রতীক্ষা! কখন দুপুরে ভাত খাওয়ার পর্ব শেষ হবে আর মাকে টানতে টানতে নিয়ে যাবে ঐ ওয়ারড্রোবের কাছে। আর মা ঐ কাপড়গুলোর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কোনো এক খুপচি থেকে বের করে নিয়ে আসবে সেই ছোট শিশিযেখানে নামি-দামি সম্পদগুলো ওৎ পেতে বসে থাকে শুধুমাত্র তুতুর জন্য। যখনই মা ছোট শিশিটির ছিপি খুলে চাকতিগুলো বের করে নিয়ে আসে অমনি ওর ঠোঁটের কোণ বেয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়তে চায় যেন। 'প্রতিদিন তো একটিই দাও,আজ দুটো দাও না! দুটো দিলে আমি আর দুষ্টুমি করবো না। ভাত খেয়েই লক্ষ্ণী বাবু হয়ে শুয়ে পড়বো। দাও নাদুটো দাও।অনুনয় করতে থাকে তুতু।


আর এমনই পীড়াপীড়ি চলে প্রতিদিনই।


'নাএকটিই নে। দুটো খেলে পেট খারাপ করবে। এমন করলে কাল থেকে আর একটিও পাবি না', এই বলে মা কাপড়গুলোর কোন এক ফাঁকে আবার ঢুকিয়ে রাখে শিশিটি। এদিকে তুতুরও যেন কৌতুহলের শেষ নেই। গলা'কে বেশ খানিকটা লম্বা করে, উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে নেয়ার চেষ্টা করে কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেলো ওর মূল্যবান সম্পদগুলোযেখান থেকে প্রতিদিন রহস্যভেদ করে ওর হাতের তেলোয় টুপ টুপ করে পড়তে থাকে ছাই রঙা এক একটি চাকতি।
 


সেই চাকতি খাওয়ারও আছে নানান কায়দা-কানুন। প্রথমে জিহ্বা দিয়ে চেটে কিছুক্ষণ সুখানন্দটা নিয়েইমুখে পুরে দেয় চাকতিটিকে। তাই বলে সাথে সাথে কিন্তু গিলে ফেলে না। রসিয়ে রসিয়ে খেতে থাকে অনেকক্ষণ। একটু ঝাল,একটু নোনা স্বাদের চাকতিটিকে জিহ্বার মাঝবরাবর নিয়ে টাক টাক শব্দ করে চুষতে থাকে। চুষতে চুষতে রুম তিনটিতে কয়েক পাক ঘুরে আসতে না আসতেই পাতলা হতে থাকে জিহ্বার টাকরাতে আটকে থাকা চাকতিটি। এক সময় জিহ্বার সাথে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত বিস্ফোরণ। ইস্শেষ হয়ে গেলো। পুরো শিশিটা থাকলে কত মজাই না হতো! শুধু স্পেশাল খেয়েই কাটানো যেত এক একটি দিন। কখন যে ঐ পুরো শিশিটা ওর হাতে আসবে আর ওর হয়ে যাবে! ভাবতেই গেলেই পুলকিত হয়ে ওঠছিল ও।


আর এই ঝাঁঝালো নোনা স্বাদের চাকতিকে সবাই 'হজমীবললেও তুতু কিন্তু এর নাম দিয়েছে 'স্পেশাল'
 কত সাধ্য সাধনা করে মার কাছ থেকে আদায় করতে হয় এই সম্পদটিকে। অত সহজে মা কি তা দিতে চায়! এর জন্য কত বাহানাই না ধরতে হয় ওকে। মানতে হয় কত কত শর্ত! এরপরেই একটু একটু করে ধরা দিতে থাকে সেই কাঙ্ক্ষিত স্পেশাল। এই তো সেদিনখেলতে খেলতে মার স্বাদের ঐ ডাল ঘুটনিটা বারান্দার বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছিলো বলেকী ভীষণরকম কানমলাটাই না দিয়েছিলো মা। স্পেশালটাও চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি বেশ ক'দিন। এরপরই লক্ষ্ণী বাবু হয়ে ওঠার নানান চেষ্টা করতে হয়েছে ওকে। ঝামেলা না করেই সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খানাটিও সারতে হয়েছে নিয়ম মেনে। সময় মতো তৈরি করতে হয়েছে স্কুলের পড়াগুলোও । সুবোধ বাবু হওয়ার নানা চেষ্টা করতে হয়েছে ওকে! এরপরেই তো মিললো সেই স্পেশাল! 


ইদানিং দাদু'র সঙ্গে বেশ ভাবও হয়েছে তুতু'র। দাদু বাইরে বেরুতে যাবে তো অমনি শুরু হয় নানান বায়না! এত সব বায়নাক্কার মধ্যে ইনিয়ে বিনিয়ে স্পেশাল নিয়ে আসার আব্দার থাকেই। 'আমার জন্য দুই প্যাকেট চিপস আর চকলেট নিয়ে আসবে। আর সাথে মনে করে স্পেশাল নিয়ে আসবেবুঝলে।এই বলে এটা-ওটা বাড়িয়ে দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে দাদুকে। ঘরের দোর বরাবর এসে আরও একবার মনে করিয়ে দেয়, ‘এক শিশি স্পেশাল আমার চাই ভুলো না কিন্তু।'
 


দাদু বাইরে থেকে ফিরে যখন তার বুক পকেট থেকে গোটা দু'য়েক ছাই রঙা হজমি ওর হাতে তুলে দেয় অমনি পাংশুর মতো হয়ে যায় তুতু'র মুখখানা। 'মোটে এই দু'টো! আরো চারটা দাও। তুমি না এক শিশি স্পেশাল নিয়ে আসার কথা বললে সেদিন।'
 
'দোকানে তো এতো হজমি একসাথে বিক্রি হয় না দাদুএই ক'টাই পাওয়া গেছে কেবলতাছাড়া এত হজমি খেলে তো পেট খারাপ করবে। প্রতিদিন একটি করেই খেতে হয় এই হজমি।


বাধ্য হয়েই মিথ্যে বলতে হয় দাদুকে। এদিকে নাছোড়বান্দা তুতু আড়াল থেকে ঠিকই দেখে নেয় সিন্দুকের কোন কোটরে জায়গা পাচ্ছে হজমিগুলো। এরপর কোন এক দুপুরে দাদুর
  ভাতঘুমের সময়টুকুতে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো সেই শার্ট বরাবর কাঠের চেয়ারটিকে এনে আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে সেই গুপ্তধনগুলোকে! 


এরই মধ্যে দু'টি-তিনটি করে সরিয়েও নেয় সময়ে-অসময়ে। এরপর থেকেই দাদুর জামার পকেটে থাকা হজমিগুলো একে একে জায়গা নিতে থাকে কাগজের ছোট বাক্সমতোন কোন এক কৌটোয়। রং পেন্সিলশুকনো ফুল-পাতাভাঙ্গা চুড়ি ও মাকড়ির সঙ্গে মিশে এরাও যেন নতুন করে শোভা বাড়ানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।
 


মধ্য দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুরে সবাই যখন নিজেদের মতো করে জিরিয়ে নেয়তখনই শুরু হয় চৌকোণো বাক্সের মধ্যে থাকা নিষ্প্রাণ সঙ্গীদের সঙ্গে তুতু'র রাজ্যপাট। কাগজের ঐ কৌটো থেকে ক'য়েকটি হজমি মুখে পুরে নিয়ে উলটে পালটে দেখে নেয় বাকিগুলোকে। কখনো একটির সঙ্গে অপরটিকে গায়ে গায়ে লাগিয়ে দিয়ে কখনোবা একটার কাঁধে আরেকটাকে চড়িয়ে সযতনে সাজিয়ে রাখে হজমিগুলোকেযেভাবে সবার খাওয়া শেষে মা বাসনগুলোকে গুছিয়ে রাখে ঠিক সেভাবে।


কোন এক ভর সন্ধ্যায় আধোঘুমের মধ্যে হঠাৎই যেন শুনতে পায় বাবার রাগত কন্ঠস্বর। বাবামার ওপরই যেন ভীষণরকম চোটপাট করছিল, 'কতবার বলেছি ওকে এইসব ছাইপাঁশ দিও না। এরপরও এই অখাদ্যগুলো পায় কি করে ও! এইসব খেয়েই তো এখন পেটে অসুখ করেছে।গজরাতে গজরাতে কে যেন তুতু'র সেই চৌকোণা বাক্সের সাম্রাজ্য লণ্ডভণ্ড করে দিতে থাকে। বাবাই বুঝি বলছিল,'এই তোহজমি। এতোগুলো হজমি একসাথে পেলো কোথা থেকে! আজই এগুলো বাইরে ফেলে দিবো আমি।কাগজের কৌটোটি নিয়ে বাবা বারান্দার বাইরের ফেলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে তুতু সর্বশক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করে, 'স্পেশালগুলো ফেলে দিও না বাবা
। আমি এখন থেকে শুধু একটিই খাবো। এর বেশি খাবো না। তুমি যা বলবে তা-ই শুনবো। এখন থেকে আমি আর দুষ্টুমি করবো না। প্লিজবাবা স্পেশালগুলো ফেলে দিও না।তুতু'র এই আর্তি আসবাবপত্রগুলো শুনতে পেলেও পৌঁছালো না কেবল বাবার কান অব্দি! 

Post a Comment

0 Comments