আজ এক কন্যা শিশুর গল্প বলবো। নাম তার অথৈ। নয় বছর বয়স ওর। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। অন্য পাঁচটা শিশুর মতো বেড়ে ওঠা হয় নি ওর। যে বয়সে খেলাধুলা করে দৌড়ে বেড়ানোর সময় সেই বয়সেই বাসায় একরকম বন্দী হয়ে গিয়েছিল ও! শিশু বয়স থেকেই ওকে চাল ফুটিয়ে কিভাবে ভাত রান্না করতে হয়, গরম তেলে পেঁয়াজ সামান্য লাল হয়ে উঠলে ফুটানো ডাল ছেড়ে দিয়ে কিভাবে ডাল রাঁধতে হয়, তা একরকম বাধ্য হয়েই শিখে নিতে হয়েছিল ওকে। কারণ মা'য়ের যে পেটে অসুখ করেছে! এরই মধ্যে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে, না হলে পরে বড় ধরনের কোনো জটিলতা সৃষ্টি দেখা দিবে। আর তাই মা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে পইপই করে এই রান্নাগুলো শিখিয়ে দিয়েছিল ওকে। কারণ হাসপাতালে কত দিন থাকতে হয় তার তো ঠিক নেই। বাসার অন্য সদস্যরা খাবে কী!
যাই হোক, মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর বেশ বুঝে গিয়েছিলো, 'মেয়ে আমার কিছু রান্না শিখে গেছে এখন থেকে ও আমার একরকম সহকারী হয়ে ওঠলো।' এদিকে গত ক'দিন ধরে বাসায় বেশ শোরগোল পড়ে গেছে! স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র। কাজেই এখন কোথাও ঘুরতে গেলে মন্দ হয় না। তাই সবাই মিলে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যাবার কথা চলছিলো বাসায়, বেশ ক'দিন ধরেই! মেজো পিসি টাঙ্গাইল থাকেন। পিসিও অনেক দিন ধরে তার ওখানে এসে ঘুরে যাওয়ার কথা বলছিল মাকে। আর এই নিয়ে অথৈদের পরিবারে চলছে খুশির আমেজ। অনেক দিন পর সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হবে। কিন্তু ভাবনার একটা রেশ থেকেই গেল! বাসায় বাবা থাকবে। বাবা অফিস থেকে ফিরলে, তাকে রান্না করে কে খাওয়াবে! কাজেই সবার টাঙ্গাইল যাওয়া হবে না। সিন্ধান্ত হলো অথৈকেই বাসায় থাকতে হবে। মাত্র তো তিন দিন। দেখতে দেখতে সময়টা কেটে যাবে। মা খুব করে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালো ওকে! পরিবারের একরকম বাধ্য মেয়ের মতোই বাসায় থেকে যেতে হলো অথৈকে। ভাই-বোনেরা সবাই মা'র সাথে হৈ হৈ করে চলে গেলো টাঙ্গাইল।
এদিকে অথৈ-এর সময় যেনো কাটতেই চায় না। পাড়া- মহল্লায় ছেলে-মেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করে খেলাধুলা করে, আর অথৈ তা মনমরা হয়ে দেখতে থাকে। কখনওবা ঝুল বারান্দার গ্রীল ধরে এ-পাশ ও-পাশ দেখে যায়। সারাদিন বারান্দাতেই দিন কাটে ওর। এর মধ্যে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেই দৌড়ে গিয়ে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কেউ আবার আসলো কিনা! না, বাবা তো আর এত তাড়াতাড়ি আসবে না, হয়তো কোনো ভিখিরি কড়া নেড়ে চলে গেছে!
শুনশান রুম দু'টো যেনো রাজ্যের শূণ্যতা নিয়ে পড়ে আছে। এদিকে কিছুতেই সময় কাটতে চায় না ছোট্ট অথৈ-এর। দেখতে দেখতে দিনের আলো ক্ষীণ হতে হতে এক সময় সন্ধ্যা নেমে আসে।
সান্ধ্য আলো সরে গিয়ে হয়ে যখন গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে তখনই ওর গা ছমছম করে উঠতে থাকে! অধীর আগ্রহে দরজার দিকে বির্বণ ও শুষ্ক মুখ নিয়ে বসে থাকে অথৈ। 'এমন সময়ই তো বাবা বাসায় চলে আসে। তাহলে আজ এত দেরী করছে কেনো।' ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ে ও। এদিকে ধীরে ধীরে রাত আরো গভীর হতে থাকে, কিন্তু দরজায় আর কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায় না। কাঠের চেয়ারে বসেই ঝিমুতে থাকে অথৈ'এর ছোট্ট শরীর। যখনই টুক করে কোথাও কোন শব্দ করে ওঠে তখনই নড়েচড়ে বসে ও। বাবার জন্য ওর অপেক্ষার যেন আর শেষ হতেই চায় না। একসময় ভয়ে গুটিসুটি হয়ে বিছানার এক কোণে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে ও! না, বাবা সেই দিন আর বাসায় ফেরে নি। পর পর দুটো রাত এক বিভীষিকাময় সময় হয়ে নেমে আসে যেনো অথৈ'এর ওপর।
তিনদিন পর সবাই যখন হৈ হৈ করে বাসায় ফিরলো, তখন ঝড়ো কাকের মতো আতংকিত অথৈকে দেখেই আঁতকে ওঠলো মা, 'এই তুই এমন ভীতু ভীতু হয়ে তাকিয়ে আছিস কেন রে, কি হয়েছে তোর?'অমনি তীব্র বেগে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে ছোট্ট অথৈ! এই ক'দিনের ব্যবধানে বড় মানুষের যত গাম্ভীর্যতা যেন ভর করেছে ওর একরত্তি শরীরে!
এই লেখকের আরও লেখা...
0 Comments