একাত্ম ।। শাপলা বড়ুয়া


গুগলে সার্চ দিয়ে ঠিকঠাক বিষয়ভিত্তিক ছবি পাওয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়েছে আজকাল। দু'দিন বাদেই ডামিতে বসবে লেখা ও ছবিগুলো। এদিকে এখনো কাজগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে ওঠতে পারে নি পরমা। অনেক ঘাটাঘাটির পর যুতসই ছবিটি পাওয়া গেলো শেষ পযর্ন্ত। হঠাৎই মাথা ঘুরে ওঠল যেন পরমার। কম্পিউটারের স্ক্রীনজুড়ে মুহুর্তেই সাদা রঙ লেপটে দিল বুঝি কেউ। না আর তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে গা গুলিয়ে বমি চলে আসবে। কয়দিন ধরে শরীরটাও বেশ বিগড়ে আছে।

 সাপ্তাহিক এক ম্যাগাজিনে কাজ করে সে। অফিস-বাসাবাসা-অফিস করতে করতে এখন আর পেরে ওঠে না পরমা। কদিন হল রাহেলাও কাজে আসছে না। মাঝেমধ্যে কি যে হয় মেয়েটার! এমনতিই বেশ কাজের। কিন্তু ইদানিং কাজেকর্মেও যেন মন নেই ওর। আট মাসের পোয়াতি। অথচ গায়ে বাড়তি মাংস লাগেনি এখনও। চোখের নীচের কালো দাগটাও যেন আরও বড় হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে  পড়েছে। চোখ দুটো কেউ যেন জোর করে কোটরে ঢুকিয়ে দিয়েছে! আগের মতো তেমন পরিশ্রম ও করতে পারে না। আগে পাঁচটা বাড়িতে ছুটা কাজ করতো। শরীরে পেরে ওঠে না বলে পরমার এখানেই এখন কাজ করছে। রাহেলার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে মাঝখানে ছুটি দেয়ার কথাও ভেবেছিল পরমা। কিন্তু নানান কাজের ভিড়ে আর তাকে সেই কথা বলে ওঠা সম্ভব হয়নি।

সকাল সাতটা। এরই মধ্যে রোদটাও বেশ তেতে ওঠেছে। রেলরাইনের ধারে লাগোয়া বস্তি। এখানেই কোন এক বাড়ীতে হয়তো রাহেলা থাকে।  অনেকদিন আগে কোন এক দরকারে আসতে হয়েছিল ওকে। এখন শুধু ক্ষীণ সেই স্মৃতিটাই ভরসা। ঢেঙা মতোন মধ্যবয়সী এক লোক বাঁশের বেঞ্চে বসে বিড়ি ফুঁকছিলো। আশেপাশে তেমন কাউকে আর দেখতে পেলো না পরমা।

–আচ্ছা এখানে রাহেলার বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারেন?

–কোন রাহেলাহ এইহানে একজন রাহেলা থাহে। হেরে তো এহন হাসপাতালে ভর্তি করানো হইছে।

–বাসাবাড়িতে কাজ করে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ মতো হবে। ঔৎসুক্যের ভঙ্গিতে জানতে চাইলো পরমা!

–পিছন বাড়িত গিয়া একবার খবর দ্যাখতে পারেন। আমি যারে চিনি হে কিনা দেহেন।

বেশ কয়েকটি বাড়ি পেরুতেই খুঁজে পাওয়া গেলো সেই বাড়িটি। আধ ভেজা দরজা। উদোম গায়ে এক বাচ্চা ছেলে টিনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস শব্দ। ভয়াতুড় কিছু চাউনি। পাশ কেটে গেলো ক'জন নারী-পুরুষ। এর মধ্যে  দু'য়েক একজন আবার কৌতুহলী হয়ে পরমাকেই যেন দেখার চেষ্টা করছে। 

জানা গেলোপাঁচ দিন হল রাহেলা হাসপাতালে। মাতাল স্বামীর উপুর্যপরি পেটে লাথি আর মারধরে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে তাকে। সে এখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। 

যাই হোক মৃত্যুর সঙ্গে এই লড়াইয়ে ওকে শেষ পযর্ন্ত বাঁচিয়েই দিয়ে গেল ওর ভাগ্যবিধাতা। তবে প্রচুর রক্তক্ষরণে পৃথিবীর আলো দেখারও সুযোগ ঘটে নি অনাহুত ভ্রুণটির। 

কেউ কেউ থানায় ঘটনাটি জানাতে চাইলেও বাদ সাধে রাহেলা। এত অত্যাচারের পরেও সবকিছু একরকম মেনে নিয়েই স্বামী দেবতাটিকে আগলে রাখতে চায় ও। এই সমাজ যে ওদের নিভার্র আশ্রয় দেয় নি কখনও। এই খুঁটিকে ধরেই এখন বাঁচার স্বপ্ন দেখে সে। স্বল্পশিক্ষিত এই তরুনীটিও বুঝি জীবেনের এই কঠিন সত্যটিকে বুঝে নিয়েছে নিজের মতো করে। 

রাহেলার সঙ্গে নিজের কোথায় যেন এক সুক্ষ্ণ মিল খুঁজে পায় পরমা ! কত দিন হয়ে গেল শোভনপরমার খবরটুকু নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করে নি। বিয়ের পর পরই জেনে গিয়েছিল এক নারীতে তৃপ্ত নয় শোভন। বৈচিত্র্যের স্বাদ খুঁজে বেরিয়েছে প্রতিনিয়ত। এতো কাল ধরে ক্ষ্ণীণ সুতোর ওপরই যেন দাঁড়িয়ে ছিলো এই সম্পর্কটি। এটিও বুঝি সময়ের ফেরে ছিঁড়ে পড়বার যোগার হয়েছে এখন! খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে যখন-তখন গোল বাঁধাতেও ছাড়ে না শোভন। পরমার ত্রুটিগুলোকে সামনে নিয়ে এসে হেনস্থা করার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকে যেন সে। এই তো সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরেই মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছিলো। চোখ মেলে তাকাতে পারছিলো না ও। বেশ দূর্বল লাগছিলো। এরপরও শরীরটাকে এক রকম টানতে টানতে রান্নাঘর অব্দি নিয়ে যেতে পেরেছিলো। কোনভাবে চুলায় চালটা চড়িয়ে দিয়ে আর কোন কাজ করার মতো অবস্থায় ছিলো না শরীর। সন্ধ্যায় বেশ কাঁপুনি দিয়ে আসলো জ্বর। কিন্তু এ ব্যাপারে  শোভনের যেন কোন মাথা ব্যাথাই নেই।

–আজ কোন রান্না করো নিকোন ভর্তা-টর্তা করলেই তো পারতে। সারাদিন করোটা কি! রান্না করতেও এতো সমস্যা তোমার!

–শরীরটা ভালো লাগছে না। আজকে কোনভাব নিজের মতো করে খেয়ে নাও না!

–এত ঘন ঘন শরীর খারাপ হওয়া তো একটা সমস্যা। সামান্য ঠাণ্ডা লেগেছে এতেও ওঠে দাঁড়াতে পারছো না। আমার মতো এমন চাকরি করলে তোমাকে তো খুঁজেই পাওয়া যেতো না। ভৎর্সনা সুরে কথা ক'টি বলে যায় শোভন!

মাথাটাও ভীষণ ঝিমঝিম করছিলো। এরপর আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিলো না পরমা'র। আর কিছু বাক্য বিনিময় হলে হয়তো আরো কঠিন কোন কথা শুনতে হবে ওকে। আর এ যেন এই পরিবারের প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। 

সব তো মেনেই নিতে চেয়েছিলো পরমা এরপরও তর সইছিল না যেন শোভনের। দিনের পর দিন নানান কথার ফেরে রক্তাত্ত করেছে ওকে। শ্রেফ অযৌত্তিক সব কারণ দেখিযে এই সম্পর্কটিকে চুকিয়ে দিতে চেয়েছে সে। 

কিন্তু সমাজ নামের অদ্ভুত ব্যবস্থার কাছে  বাধা পড়ে গেছে পরমাও। মিল-অমিলের দোলাচলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ঐ নারী মূর্তিটিকে বড়ই আপন মনে হয় পরমার। নানান শব্দের মিশ্রণে ওদের মধ্যে চলে নিঃশব্দ কথোপকথন।

 

Post a Comment

0 Comments