অস্ট্রিক ঋষি'র ‘নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে’ শিরোনামটাই আমার কাছে চমক লেগেছে। কবিতা আমার মতে, মন ও মস্তিস্ককে একসাথে নিংড়ে তোলে, এমনটাই বুঝি। টি. এস. ইলিয়ট যেটাকে বলেছেন 'blending of emotion and intellect. আমরা ঋষির কবিতায় একাধারে wit, intellect, pathos, bathos, emotion, anarchy, paradox এই সবকিছুর অনুপম রসায়ন ঘটতে দেখি।
প্রথম কবিতা ‘অর্থময়তা’ আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
চিঠিতে আমি কিছু লিখিনি। সাদা একটা পাতা, খামে ভরতে দেখে তোমরা হো হো ক'রে হেসেছিলে। অথচ আমি জানি—মা যখন চিঠিটা পাবে তখন অঝোরে কাঁদবে, কাগজে আমার স্পর্শ আছে ভেবে।
তুমি যা কিছু পাগলামি ভাবছো, ভাবছো—হাস্যকর, এর কোন মানেই হয় না। কারো কারো কাছে তা-ই পরম পাওয়া, সবচেয়ে বেশি অর্থবহ।
এই যে অর্থহীনতায় অর্থ খোঁজা, এটা একটা পোস্ট মডার্ন উপাদান। তাছাড়া জীবনের অর্থ তো একধরনের আপেক্ষিকতার বিষয়। আমাদের চারপাশে এতো কিছু থাকার মধ্যেই তো একধরনের নৈরাজ্য, শূন্যতা তৈরি করেছে। রবীন্দ্রনাথ যেটা ‘সৌন্দর্যের প্রবন্ধ’-এ বলেছেন, জগতকে জ্ঞান দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জানা যায় না, অনুভবে জানতে হয়। সৌন্দর্য শুধু আপাত দেখতে সুন্দর যা তা নয়,অনুভবের গভীর থেকে উপলব্ধি করতে জানলে কারো কাছে যা “অমাবস্যা, কী গভীর অন্ধকার!”আরেকজনের কাছে তা-ই “পঞ্চদশী চাঁদ” মনে হয়, সুন্দর লাগে। ঋষির সন্দর্ভ চিত্তে এই কবিতায় এইরূপ আপাত মিনিংলেস, অন্ধকারের মাঝেও মিনিং এবং আলোর পরাগায়ন দেখতে পাই।
এ প্রসঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীর বারোক যুগের থিয়েটার ইল্যুশনের কথা টানা যেতে পারে যেখানে জীবন ও জগতকে মঞ্চের সাথে তুলনা করতো এবং দেখানো হতো জীবনটা একটা মিনিংলেস, মায়া, বিভ্রান্তিতে ভরপুর, তবুও কতো মোহময়। এবং এগুলো শিল্পের খোরাক।
যদি শেক্সপিয়ার যখন 'ম্যাকবেথ'-এ বলেন, ‘life is a tale told by an idiot- signifying nothing’. এই ক্যাওয়স, মিনিংলেসনেসকে এবসার্ড থিয়েটার খুব গুরুত্বের সাথে দেখেছে। পোস্ট মডার্ন এইজের মানুষের চিন্তা চেতনা অসংখ্য স্বপ্ন, আশা, নিরাশার অনুভূতিগুলোকে মাইক্রোস্কোপিক দৃষ্টিতে এবসার্ড থিয়েটারের সাহিত্যিক শিল্পে তুলে ধরেছেন। সর্বসাধারণের কাছে অতি তুচ্ছ জিনিসকে শিল্পে মহিমান্বিত করা হয়েছে। অর্থ খোঁজা হচ্ছে অর্থহীনতার মাঝে, নৈরাজ্যের মাঝে। “Waiting for godot” এর একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সাহিত্যে ইতোমধ্যে যা ছিল গ্রান্ড ন্যারেটিভ, তার জায়গায় এসেছে ফ্রাগমেন্টেশন, কোলাজ। শব্দেরও মিথ ভেঙ্গে গেছে। দেরিদা’র ডিকনস্ট্রাকশন সব ধরনের logos (শব্দব্রহ্ম) কে বাতিল করে দেয়। বিকেন্দ্রীকরণ করে। শিল্প সাহিত্যে চিন্তা চেতনা, শব্দ আর চিত্রকল্পে নতুন জোয়ার আসে।
সার্ত্রে’র ‘বিং এন্ড নাথিংনেস’-এ অস্তিত্বহীন অবস্থা অনুভব থেকে যেমন শুরু হয় অস্তিত্বের সন্ধান তেমনি ঋষিও সগৌরবে প্রচার করেন—
তুমি যদি ভেবে থাকো কিছুই তো হয় নি, এসবও কি অর্থময়? তবে শোন, হোক বা না হোক, অনেকের হয় না বলে'ই কারো কারো হয়।
এই মহাবিশ্বে সেটাই মিনিংফুল যেটা আপনি কমিনিউকেট করতে পারছেন। এর কোন শাশ্বত রূপ নেই।
তার ‘সম্প্রীতি' কবিতায় সমাজের অসংগতিগুলো, বিপরীত স্বভাবের দুইয়ের সহাবস্থান, যেটাকে সাহিত্যে Juxtaposition বলে, চমৎকারভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। অথচ আমাদের চোখে প্রায়ই ধরা পড়ে না। অডেনের কবিতায় এমনটা পেতাম, চমৎকার উইট এ্যান্ড হিউমার পাওয়া যায় ঋষির কবিতায়।
বেশ আইরনিক্যালি বিষয়টি তুলে ধরেছেন ‘সম্প্রীতি’ কবিতায়। একইসাথে গ্রেইটনেইস আর ট্রিভিয়ালিটি, বারুদ আর ফুল কিংবা বই -এইসব juxtaposition আমাদের ভাবিয়ে তোলে Swift এর
‘freak of nature’ এর কথা।
একটু পাঠ করা যাক—
গুলিস্তান গিয়ে দেখি—
জাতীয় মসজিদের পাশেই
জাতীয় স্টেডিয়াম
রাস্তার উল্টেপাশে
সারি সারি বন্দুকের দোকান
বন্দুকের দোকানের গাঁ ঘেঁষেই গ্রন্থ -ভবন
এবং
গ্রন্থ-ভবন ও সচিবালয়ের মাঝখানেরাস্তা যেইখানে
দুইপা ফাঁক ক'রে
আলাদা হয়ে গেছে,
সেইখানে...
উদ্দীপিত শিশ্নের মতো খাড়া হ'য়ে আছেগোলাপ শাহ'র মাজার।
এরকম হাইসিরিয়াসনেস আর কমিক উপাদানের কাউন্টার পয়েন্ট পাঠকের মন ও মগজকে আন্দোলিত করে। উল্লেখ্য ফ্রয়েডীয় লিবিডো অবচেতন মনে যে তাড়িত করে তা গম্বুজ, টাওয়ার এরকম স্থাপনায় যে ছাপ ফেলে তাও দেখতে পাই।
বিশ্ব সাহিত্যের দিকে তাকালে, বোদলেয়ারই প্রথম জিহাদ ঘোষণা করেন ভিক্টর হুগোদের রোমান্টিক ভাবালুতার বিরূদ্ধে। প্রকৃতি শুধু wordsworthian nurture, guide, something benevolent শুধু যে নয়, তা বোদলেয়ার -পরবর্তীতে ইলিয়ট প্রমুখদের লেখায় পাই।
বোদলেয়ারের spleen কবিতা থেকে একটা উদ্ধৃতি নিলে- “when rain falls straight from unrelenting clouds, forging the bars of some enormous jail”.
দেখা যায়, বৃষ্টির আগমন কবিকে জেলখানার শিকলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
ঋষির কবিতায়ও এরকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাই। তিনি জগত ও জীবনের ভয়াবহ দিকটার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেননি। তিনি escapist নন। বরং beauty is truth, truth is beauty এই বাস্তবতাটাকে নিংড়ে তুলেছেন শিল্পে। আধুনিক শিল্প, সাহিত্যে আগলিনেস এন্ড বিউটির যে মিথস্ক্রিয়ার কথা টি. এইচ. হিউম বলেন সেটা বাঙময় হয়ে ওঠে ঋষির কবিতায়।
‘যে জীবন অস্ত্রাঘাতে শুরু’ কবিতা থেকে পাঠ করা যাক-
জন্মের পর কার সাথে পরিচয় হয়েছিল তোমার?
ধাত্রী? নাকি ধাত্রীর হাতে থাকা ছুরি—
কে তোমাকে অভিবাদন জানিয়েছিল প্রথম?
যদি ছুরি হয়, সে তো অস্ত্রই
যদি ধাত্রী হয়, হাতে তো অস্ত্রই ছিল
মানুষ—
চিরকাল তোমাকে অস্ত্রের সাথেই পরিচয় করাবে
শেষের লাইনে এসে আঘাতটা তীব্র হয়। জীবনের ভয়ংকর সত্যটা মেনে নেয়ার প্রয়াস পায়। জীবন যে কুসুমশয্যা নয়, পরতে পরতে বিছানো আছে কাঁটা—এরকম এগ্রেসিভ রিয়েলিটি দেখতে পাই আমরা।
ঋষির লেখা মাইক্রো পোয়েম, ম্যাক্সিম কিংবা কাপলেটগুলোও একদিকে যেমন উইটী আবার এরকম জীবনের অন্ধকার দিকটা ফুটে ওঠে চমৎকারভাবে।
স্বাধীনতার প্রতীক যে পতাকা সেও থাকে রশির কাছে বন্দী
যে ফুলটা তুলে দিচ্ছ প্রেমিকার হাতে, মনে রেখো— বোঁটার সাথে রয়েছে তার বিচ্ছেদের সম্পর্ক।
এরকম অসংখ্য কাপলেট, ম্যাক্সিম আছে যা আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে নতুন ভাবে জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে।
‘বিভিন্ন আকাশ’ কবিতাটি পড়লে আধুনিক নগর জীবনের অন্তঃসারশূন্যতার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। এ কবিতা আমাদের ইলিয়টের waste land এর কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যায় আধুনিক যুগে এসে; সম্পর্ক, ভালোবাসা, বন্ধন। ‘Things fall apart.’ এই থিমটা অনুরণিত হয় ঋষির কবিতায়।
ঋষি লেখেন “ছিঁড়ে যাওয়াই আধুনিকতা”
আমাদের সম্পর্কগুলো বিহঙ্গের মতো উড়ে গেল যার যার যার ব্যক্তিগত বিভিন্ন আকাশে।তবে কবি এ মেনে নিয়েছেন দুঃখবোধ থাকা সত্ত্বেও। একধরণের stoicism লক্ষ্য করা যায় কবিতাতে যখন কবিকে বলতে শুনি-
ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্ককে রিফু করানোর জন্য গিয়েছিলাম দর্জির কাছে। সে জানালো—আজকাল জোড়া লাগাতে কেউ আসে না; আসে ছিঁড়িয়ে নিতে।
আরেক জায়গায় কবি বলেন–
“পাতায় পাতায় ছিঁড়ে যাওয়া নাড়ি থেকে মানবজন্মের আধুনিকতা”। এরকম পেনিট্রেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে অভিভূত করে।
ঋষির চিত্রকল্প, উপমাও বহুল প্রচলিত নয়। সেখানে প্রচলিত সব চিত্রকল্পকে ভাঙতে দেখি আমরা।
মাথার উপর একটা চাঁদ
খুব হর্নি
আলোর অর্গাজম ঘটিয়ে যাচ্ছে;
নিজেকে মনে হচ্ছে—পৃথিবীর জিভ
মানুষ এক পর্যটক কিংবা ভিতরে অশ্বের মতো ছোটে যার হাওয়ার হিল্লোল কিংবা আকাশে কাফনের মতো মেঘ অথবা সিজারিয়ান মহিলার পেটের সেলাইয়ের মতো একটা রেললাইন চলে গেছে বস্তির উদর চিরে।
এরকম অনেক উপমা, চিত্রকল্প ঋষির ভাষা, বাক্যপ্রকরণে মুন্সিয়ানা প্রকাশ করে।
‘মা বিষয়ক বিষণ্ণতা’ কবিতায় সহজ সাবলীল কিন্তু ভাবের গভীরতায় যেন মা’কে সংসারের এক সম্প্রদান কারকের মতো হাজির করেছেন।
মা সেই সুতো—সংসার নামক সুইয়ের ছিদ্রে আটকা পড়েও যিনি হয়ে ওঠেন উলেন সোয়েটার, সমস্ত শীত যিনি আমাদের পেচিয়ে রাখেব আরামপ্রদ ওমে, আর বসন্ত এলেই যাঁকে আমরা ছুঁড়ে ফেলি অন্ধকার কাঠের বাক্সে।
সবচেয়ে যে কবিতাটি আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হলো সেটা হলো–
‘নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে’। একটু পাঠ করা যাক কিছু লাইন:
কখনো শীৎকারের শব্দ শোনেনি যে বধির, তার
তৃপ্ত সঙ্গিনীর
একান্ত উচ্চারণের
বেদনার মতো করুণ কিন্তু
উজ্জ্বল একটা আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে
যেন বিশেষ মুহূর্তের কম্পনরতা তলপেট
কোনো রমনীর—
আজ
এই মুক ও বিষণ্ণ গভীর মেঘনায়বৈঠার অবুঝ আঘাতে
ছিন্নভিন্ন চাঁদের মতোই একা ও অস্থির আমি
ফুটে উঠেও ফেটে পড়ছি জলে।
তবু মেঘ কত কথা বলে।
মিথ্যা অনেক রকম।
আকাশে ফানুশ ওড়ে।
কমলা-হলুদ কিছু তারা।
........
এবং সাগরের পরিবর্তেধরা যাক নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে।
শেষের দিকের লাইনগুলো পুরো কবিতার ওয়াচওয়ার্ড বলা যায়।
বার্থে’র কথা মেনে নিলে আর বিনির্মান তত্ত্বের দোহাই দিয়ে বলা কবিতায় মিনিং খুঁজতে কবি কি বলেছেন তারচেয়ে আপনি কীভাবে কমিউনিকেট করেছেন সেটাই মূখ্য। পুরো কবিতা জুড়ে ছিন্নভিন্ন চাঁদের মতো একা ও অস্থির এক ‘আমি’ শেষে সাগরের পরিবর্তে এন্ড্রয়েড ফোনে মিশে যাচ্ছে সব কিংবা মিশে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের ভার্চুয়াল জগতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। real আর reel লাইফ এ আমাদের যে একই সাথে বসবাস এবং বারোক যুগের থিয়েটারের মতোই ভার্চুয়াল জগতের মায়ায়, মোহে শুধু ডুবেই যাচ্ছি না, একটা অল্টার রিয়েলিটি বানিয়ে প্রশান্তি খুঁজে ফিরছি-এই বিষয়টা বাঙময় হয়ে ওঠে চমৎকারভাবে।
তবে পুরো কবিতার শরীর জুড়ে একধরনের misanthropy পাওয়া যায় মানব জীবন সম্পর্কে।
পাঠক বাকিটুকু পাঠ করে মূল্যায়ণ করবে আশা করি।
এ লেখকের আরও লেখা:
0 Comments