পাকদণ্ডী পথে একদিন ।। শাপলা বড়ুয়া


ভোর ছয়টা। চারপাশটা কেমন ম্যাড়ম্যড়ে হয়ে আছে এখনও। সূর্যও যেনো বড্ড অভিমানে মুখ লুকিয়েছে। রহস্যের ঘেরাটোপ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসা কুয়াশা তার ধূসর চাঁদর বিছিয়ে থম মেরে আছে সেই কখন থেকে। পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথ বেয়ে দ্রুত গতিতে উঠে পড়ছে বাস। ধুসরতা গ্রাস করেছে যেন সবদিকে। হঠাৎ হঠাৎ অপরপ্রান্ত থেকে রহস্যের জাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে এক একটি যান। বোঝা গেলোপাহাড়ি রাস্তা টপকানো চালকদের জন্য চারটিখানি কথা নয়! সরু রাস্তা বেয়ে কিভাবে যে এক বাস আরেক বাসকে ছাড় দিচ্ছে ভাবতেই চক্ষু চড়ক গাছ অবস্থা আমার। সরু রাস্তা নয় তো কী! দুটো বাস এদিক ওদিক যাওয়া আসা করছেতাও ধীর গতিতে কখনো কাত হয়ে অন্যকে জায়গা করে দিচ্ছে। আবার কখনো একজন ছাড় দিলেও অন্যজন গোঁয়ার মোষের মতো ছুটে চলেছে। এদিকে আমার মতো আগুন্তুকদের বুকের ধুকপুকানি পাল্লা দিয়ে ওঠানামা করছে। এ নিয়ে চালক বেটার কোন ভ্রক্ষেপই নেই। দেদার আনন্দের বাসের সাথে সাথে নিজেও কাত হচ্ছে আবার কখনো শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে নিয়ে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সমানতালে চলছে হিন্দি গানও। এক ফাঁকে অন্যান্য যাত্রীদের ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নিলাম। অন্যরা বেশ স্বাভাবিক। অনেকে নিবিড় ঘুমে। শুধু আমার মতো কয়েকজন জেগে আছে আর কেউ কেউ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে। 

যাই হোক অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েশহরে ঢুকলো বাস। খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ড। হৈ হোট্টগোল তেমন নেই।‌ বন্ধের দিন বলেই হয়তো মানুষের আনাগোনা কম। সকাল সাড়ে নয়টা। এদিকে খিদেয় পেটে ছুঁচো খুঁড়ছে। একটু পর পর ঠাণ্ডা হাওয়া শরীরে জোর হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে যেনো। নাআর দ্যারই চলবে না, কোন এক খাবারের দোকানে ঢুকে পড়া উচিৎ। না হলে আর রক্ষে নেই। হোটেলে ঢুকতেই চোখ পড়লো পাচক ডুবো তেল থেকে ঝাঁঝরিতে ছেঁকে ছেঁকে রেকাবির মতো বড় বড় পরোটা তুলে রাখছেন থালে। কি আর করা এই সব ছাইপাশ দিয়েই পেটপুজো করতে হবে। তবে চা পেলে বেশ‌ জমে যেতো!

চা খাচ্ছি। ঠিক আমার মুখ বরাবর রাস্তার অপরপ্রান্তেএকচালা টিনের ঘরের নীচে পাতা বেঞ্চিতেছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে এক প্রৌঢ়! মাটিতে জবুথবু হয়ে বসে আছে আরো ক'জন! চটের বস্তার মতো কিছু একটা গায়ে জড়ানো। ওদের দলে তিনজন শিশুও আছে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে আর একে অন্যের গায়ে গা ঠেকিয়ে ওম নিচ্ছে। আহ! এই শীত কারো কাছে উপভোগের আর কারো কাছে তীব্র কষ্টেরও বটে!

সবকিছু মিলে সকালটা কেমন তেতো হয়ে আছে আজ! সারাদিন সূর্যেরও আর দেখা পাওয়া গেলো না। মনমরা হয়ে আছে চারদিক। থাকার ব্যবস্থা হলো এক বন্ধুর বাসায়। কয়েকদিনের জন্যই তো ঘুরতে আসাহোটেলেই ওঠার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু বন্ধুটির ওজর আপত্তিতে আমার ইচ্ছে আর খাটলো না। ওর জোরাজুরিতেই থেকে যেতে হলো ওদের বাসায়। 

কখন যে চারদিক অন্ধকার ছড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো বুঝতেই পারলাম না। পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে চলেছি। কী এক অদ্ভুত স্তব্ধতা নিয়ে গোঁজ হয়ে আছে প্রকৃতিযেন সাধনায় নিমগ্ন। মিটিমিটি আলো নিয়ে কয়েকটি জোনাক পোকা উড়ে গেলো এদিক ওদিক। পাহাড়ের গা ঘেঁষে একচালা চায়ের দোকান। কয়েকজন পাহাড়ি নারী-পুরুষ হাত-পা ছড়িয়ে এখানে ওখানে বসে আছে। এর মধ্যে চার-পাঁচজন হুক্কায় টান দিয়ে গা গরম করে নিচ্ছে। বোঝা গেলো দোকানিও পাহাড়ি। নিজেদের মধ্যে মৃদু স্বরে কি নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে ওরা। চা খাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কেনো যেনো জমছে না। কেমন অস্বস্তি ছেয়ে আছে দোকানটিকে ঘিরে। থমথমে হয়ে আছে আশপাশ। আমার পাহাড়ি বন্ধুটি জানালো,বিকেলের দিকে বাজারে একটা সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটি ও মারামারি হয়েছে। একদল আরেকদলকে রীতিমতো শাসিয়ে দিয়ে গেছে। দশ-বারো দিন আগেও এরকম কোন্দল থেকে কয়েকটি দোকানে আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর রেশ এখনো কাটেনি। আর এ নিয়ে এত উদ্বিগ্নতা! মনে মনে ভাবছিলাম কী শহরকী দূর মফস্বলগাঁও- গ্রাম সবখানেই শান্তি নামের এই শব্দটিই হারিয়ে যেতে বসেছে যেনো।

বাসায় ফিরে কথা বলতে বলতে কখন যে রাত বাড়লো বুঝতেই পারলাম না। খেতে খেতেও বেশ দেরী হয়ে গেলো। এখন প্রায় সাড়ে বারোটা।‌ আড়কাঠে হেলান দিয়ে বসে আছি। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। নিস্তব্ধ চারদিক। কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলেছে এক পাহাড়ি যুবক। পাকদণ্ডী পথ বেয়ে শীস দিতে দিতে সাবলীল ভঙ্গিতে বিস্তৃত কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেলো চোখের নিমেষে। 

 


Post a Comment

0 Comments