ইন্টারভিউ ।। ঋতব্রত গুহ



বইমেলা শেষ হতে আর মাত্র দুদিন বাকি। গরমটা বাড়ছে ধীরে ধীরে। তবে এবার বইমেলাটা সপ্তকের কাছে খুব স্পেশাল। সপ্তক সাংবাদিক হতে চেয়েছিল। লেখালিখির সাথে যুক্ত থাকতে চেয়েছিল। মানুষের জীবনে তো কত স্বপ্ন থাকে। পেশা আর প্যাশনের সমাপতন সবসময় সম্ভব হয় না। তবে নিজের প্যাশনের সাথে অ্যাডজাস্ট করবার ছেলে সপ্তক নয়। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে একদিন হঠাৎ আই টি সেক্টরের চাকরিটা ছেড়ে দিল সপ্তক। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। চাকরিটা ছেড়ে সে নিজেই একটা ওয়েব পোর্টাল খুলেছে। এর সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা চ্যানেল খুলেছে যেখানে সে নিজেই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে নানা কথা বলে। সেলিব্রিটি রাইটার, গায়ক, পরিচালকদের সে তার চ্যানেলে ইন্টারভিউ করে। অল্প সময়ের মধ্যেই সপ্তকের চ্যানেলটি বেশ পরিচিত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো ভিউ আর আয় সমানুপাতিক। সপ্তককেও নিজের পোর্টালে এবং চ্যানেলে ভিউ আনতে নানারকম কৌশল অবলম্বন করতে হয়। 

আজ বইমেলাতেই সপ্তকের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে এই সময়ের অন্যতম প্রখ্যাত লেখক অনির্বাণ লাহিড়ীর সাথে। অনেক কষ্ট করে স্লটটা পাওয়া গিয়েছে। তার দুটি বই খুব ঘটা করে এবার প্রকাশ করেছে শান্তি প্রকাশনী। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তার প্রবল উপস্থিতি। ফলোয়ারের সংখ্যা চার লাখ ছুই ছুই। সপ্তক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে শান্তি প্রকাশনীর স্টলের দূরত্ব তেমন বেশি নয়। অথচ এখান থেকে স্টলের ভেতরে কি চলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অনির্বাণের ফ্যানরা সব দাড়িয়ে আছে। তাদের এক হাতে বই। অন্য হাতে মোবাইল। অর্থাৎ বইয়ে তো সই করাবেই। তার সাথে একটি সেলফিও মাস্ট। 

-দাদা আজ মনে হচ্ছে না আর ইন্টারভিউ টা হবে। ভিড় দেখেছ?

চা এর কাপে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে প্রশ্নটা করল পাবলো। পাবলো সপ্তকের পাড়াতেই থাকে। সেও কিঞ্চিৎ লেখালিখি করে। সপ্তকের মত চাকরি ছাড়ার সাহস না দেখালেও সপ্তককে নানারকম ভাবে সাহায্য করে পাবলো। এই যে সপ্তক ইন্টারভিউ গুলো নেয় সেখানে ক্যামেরা ধরার দায়িত্ব পাবলোরই থাকে। 

-ইন্টারভিউ না দিলে হবে? কালকেই তো ওর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছি। এটা একটা প্রফেশনাল ডিল।

অলকানন্দাদির ম্যানেজারকে পটাতে পারলে? অলকানন্দাদির যদি একবার ইন্টারভিউ নিতে পারো তবে কিন্তু আর কোন চিন্তা নেই। ওর যা ফ্যান ফলোয়িং! বাপ রে বাপ! কাল বইমেলা এসেছিল। ওকে নিয়ে ওর ফ্যানদের উদ্দীপনা দেখেছিলে! যেভাবেই হোক অলকানন্দা মিত্রের একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার ব্যবস্থা কর।  

-না ওনার ইন্টারভিউ নেওয়া সম্ভব নয়। যা টাকা চাইছে দশ মিনিটের ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য তা আমার বাজেটের বাইরে। এদের যে কিসের এত দেমাক! লেখাও তো তেমন আহামরি নয়। 

-সপ্তক দা তাতে কি আসে যায়? এই যুগটা হচ্ছে বিজ্ঞাপনের যুগ। যত বেশি তুমি খবরে থাকবে তত বেশি তোমার বই বিক্রি হবে। সবার ক্ষেত্রেই তাই হয়। অতএব কাউকে একা দোষ দিয়ে লাভ নেই। উৎকর্ষের দিকে সবাই দৌড়ায় না। সবাই চায় জনপ্রিয় হতে।

সপ্তক পাবলোর যুক্তির বিরুদ্ধে একটা যুতসই উত্তর দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ ওর চোখ গেল বারো নম্বর স্টলের দিলে। সেই স্টলের গেটের ঠিক বা পাশে একজন ভদ্রলোক প্লাস্টিকের একটি চেয়ারে বসে বইয়ে সই করছেন। তাকে ঘিরে জনা পাচেক লোক। ভদ্রলোকের নাম তন্ময় বসু। বাংলা সাহিত্যের জগতে একসময় বেশ পরিচিত নাম ছিলেন। সব বিখ্যাত ম্যাগাজিনেই তিনি লিখেছেন। 

সপ্তক মোবাইল বের করে টাইমটা দেখল। এখনও আধঘণ্টা সময় হাতে আছে। তাছাড়াও শান্তি প্রকাশনীর বাইরে যা লাইন তাতে অনির্বাণ এত তাড়াতাড়ি ফ্রি হবে না। এই সময়টাকে ব্যবহার করাই যায়। সপ্তক এগিয়ে গেল বারো নম্বর স্টলের দিকে। পাবলোও সপ্তক কে ফলো করল।

তন্ময় বসুকে রাজি করাতে খুব একটা সময় লাগল না  সপ্তকের। তন্ময় বাবু নিপাট ভদ্রলোক। নিজেই চেয়ার এগিয়ে দিলেন সপ্তকের দিকে। পাবলো ট্রাইপডে ক্যামেরাটা অ্যাডজাস্ট করল। শুরু হল ইন্টারভিউ।


-আপনি এখন এত কম লিখছেন কেন তন্ময় বাবু?

-তন্ময় একটা স্মিত হাসি হাসলেন। 

-কি করব? প্রকাশকরা তো তেমন আর ডাকেন না। আমি তাদের চিঠি পাঠাই। লেখা পাঠাই।  কোন উত্তর পাই না। আগের যে বইগুলো বেরিয়েছিল সেখান থেকেও তো রয়ালিটি তেমন কিছু পেলাম না। কি জানো ত! লিখতে খুব ভালবাসি। কিন্তু সংসারটাও তো দেখতে হবে। আজকের দিনে একজন প্রফিটেবল রাইটার হওয়াটা খুব সহজ কাজ নয়।

সপ্তকের ইন্টারভিউ নিতে নিতে একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। এক দুটো প্রশ্ন করলেই ও বুঝে যায় ইন্টারভিউ টা কেমন হবে। তন্ময় বাবু বেশ খোলামেলা কথা বলছেন। ইন্টারভিউ যত বিতর্কিত হবে তার প্রচার তত বেশি হবে। এই ইন্টারভিউয়ে তেমন একটা সম্ভাবনা রয়েছে। 

-কিন্তু এই যে এই প্রজন্মের কিছু লেখক কে নিয়ে এত  উন্মাদনা, এত হইচই, কি বলবেন? আপনি কোথায় পিছিয়ে পড়লেন?

-বলতে পারব না। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি। কেন পিছিয়ে পড়লাম? হয়ত তেমন ভাবে মার্কেটিং করতে পারলাম না। মার্কেটিং ছাড়া এখন কিছু হয় না। এই বইমেলাতেই দে‍খ। কত লেখকের কত অসাধারণ লেখা টেবিলের এক কোণে অনাদরে পড়ে আছে। তাও তো আমার একটা পরিচিতি রয়েছে। তাদের তো তাও নেই। তাদের অনেকেরই লেখার মান ভিড়ের মাঝখানে মধ্যমণি হয়ে আছেন যারা তাদের লেখার থেকে অনেক ভালো। কিন্তু তাদের মার্কেটিং নেই। তাদর কথা কেউ জানে না। পাঠক পাঠিকারা বঞ্চিত হচ্ছেন ভালো লেখা থেকে।

ইন্টারভিউ এগিয়ে চলল । সপ্তক যে রসদ চাইছিল সেটাও পেয়ে গেল । তন্ময় বাবু স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বহু বিতর্কিত কথা বলে ফেললেন । হাতে আর সময় নেই । এবার শেষ প্রশ্নটা করল সপ্তক । 

-তন্ময় বাবু আপনি যখন সবই বুঝছেন তবে মার্কেটিং এর দিকে যাচ্ছেন না কেন? সেলফ পাবলিশিং করুন। সোশাল মিডিয়ায় মার্কেটিং করুন। যুগের সাথে মানিয়ে নিন। কেউ তো আর বাধা দিচ্ছে না আপনাদের।

-তন্ময় বাবু উত্তর দেওয়ার আগে একটু সময় নিলেন। আসলে অভ্যস্ত হতে পারছি না। সেলফ পাবলিশিং বা মার্কেটিং তো আসলে একটা ইনভেস্টমেণ্ট। তার ওপর সোশ্যাল মিডিয়ায় গিমিক করবার জন্য প্রমোশন। ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য প্রমোশন। তারপর কিছু দিন বাদে হিসেব কষতে হবে কতখানি রিটার্ন পেলাম। অর্থাৎ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেণ্ট। এভাবে সাহিত্যকে কখনো ভাবিনি জানেন। যারা এভাবে ভাবছেন তাদের প্রতি আমার শুভ কামনা রইল। কিন্তু আমি পারব না।

তন্ময় বাবুকে আরও এক দুটো প্রশ্ন করবার ইচ্ছে ছিল সপ্তকের। কিন্তু কোনভাবেই আর সময় নষ্ট করা যাবে না। অনির্বাণ কে যে করেই হোক ধরতে হবে। সেলিব্রিটি রাইটার বলে কথা! 

 

.

অনেক চেষ্টা করেও কোন লাভ হল না। অনির্বাণের আজকের বইমেলায় দারুণ চাহিদা। অনির্বাণ সপ্তকের সাথে ইন্টারভিউটা ক্যান্সেল করে দিয়েছে। অনির্বাণের ম্যানেজার সপ্তককে টাকাটা সাথে সাথেই রিটার্ন করে দিল। অনির্বাণের জন্য আজকে অনেক নাম করা পত্রিকার সময় নেওয়া রয়েছে। এদের সবাইকে ছেড়ে অনির্বাণ নিশ্চয় সপ্তকের  চ্যানেলকে ইন্টারভিউ দেবেন না। সপ্তকের নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে এই রিজেকশনের পর। 

এদের এত দাম্ভিকতা! বেশি দিন টিকবে না দেখিস। হাওয়ায় ভাসছে। একদিন ঠিক পড়ে যাবে। পাবলো সপ্তকের কাধে হাত রাখল । 

-ধুর ছাড়ো ত। এ তো আমাদের প্রফেশনের কমন হ্যাজারড। সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। এদের এত জনপ্রিয়তা! এরা আমাদের চিনবেই বা কেন? তবে ওর ম্যানেজার সেটা কাল বললেই পারত। এতক্ষণ গরমে সেদ্ধ হতে হত না। তবে এই সুযোগে তন্ময় বাবুর ইন্টারভিউ  টা পাওয়া গেল। যদিও জনপ্রিয়তায় উনি অনির্বাণের ধারে কাছেও যান না। তবে একেবারে ফেলে দেওয়ার মতও নন তিনি।

সপ্তক কোন উত্তর দিল না। ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে রওনা দিল গেটের দিকে । 

সপ্তক বইমেলা থেকে প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল। হঠাৎ পাবলোর ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

-একটু এদিকে আসবে? 

সপ্তক এগিয়ে গেল পাবলোর দিকে।

-ওই লোকটিকে চেন?

সপ্তক লোকটির দিকে তাকাল। গেটের থেকে একটু দূরে মাটিতে চট পেতে বই বিক্রি করছে। দশ বারোটা বই আছে ভদ্রলোকের ঝুলিতে। 

-হ্যাঁ। সেই নদীয়ার লোকটা না। কি যেন নাম? 

-রমাপদ গায়েন, পাবলো বলল।

দুজনে এগিয়ে গেল রমাপদ বাবুর সেই মাটিতে পাতানো দোকানের দিকে। পাবলো আর সপ্তক রমাপদ বাবুর দুদিকে বসলেন। ভদ্রলোকের মুখে একটা চওড়া হাসি। 

-বই কিনবেন? রমাপদ বাবু প্রশ্ন করলেন। 

-সে তো কিনবই। নিজের লেখা বই বিক্রি করছেন যে! কেউ আপনার বই বিক্রি করছে না? ভদ্রলোক সপ্তকের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের চোখ দুটো চিকচিক করছে। 

-আমাকে কেউ এত গুরুত্ব দেয় না। এখানে যে বসতে পেরেছি এই অনেক! আপনারা যে আসছেন সেটাই তো আমার সৌভাগ্য। জানেন খুব কষ্ট করে লিখি। আমার একটা ছোট দোকান আছে। বাড়িতে দুই মেয়ে। কোনমতে সংসার চলে। আসলে লিখতে খুব ভালোবাসি। আমাদের গ্রামের কথা! মানুষের কথা! কত কি যে লিখতে ইচ্ছে করে! লেখাপড়া করবার অনেক ইচ্ছে ছিল। টাকার অভাবে হল না। তবে মেয়েরা  কলেজে পড়ছে। আমি এখনও গ্রামের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে নিয়মিত পড়ি।  

-বই বের করলেন কেমন করে? বই প্রকাশে তো খরচ হয়!

-সবটাই আমার স্ত্রী এর জন্য সম্ভব হয়েছে। একবার তো নিজের গয়নাও বন্দক রেখেছিল আমার এসব পাগলামির জন্য। ও না থাকলে লেখার ইচ্ছেটা কবে মরে যেত।

সপ্তক অনুভব করল ওর চোখটাও ভিজে যাচ্ছে। 

-একটা ইন্টারভিউ দেবেন?

-ইয়ে মানে আমার ইন্টারভিউ? আপনি নেবেন? রমাপদ বাবু যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। 

-এই বইমেলায় ইন্টারভিউ নেবার জন্য আপনার থেকে যোগ্য লোক আর কেউ আছেন নাকি! সপ্তক হেসে উত্তর দিল। ইন্টারভিউ শুরু হল। 

 

.

আজকের মতো বইমেলা শেষ। বাইপাস দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে ক্যাব। 

-অনির্বাণ তাহলে আমাদের খুব অপকার করেনি বল! ইনফ্যাক্ট ও ইন্টারভিউ দিল না বলেই রমাপদ বাবুর ইন্টারভিউটা পেলে, পাবলো বলল। 

-সপ্তক শরীরটা এলিয়ে দিল গাড়ির সিটে। তা যা বলেছিস। আমি সবরকম চেষ্টা করব যাতে এই ইন্টারভিউটা সবার কাছে পৌছায়। আমাকে সেদিন একজন প্রশ্ন করছিল যে বইমেলা নিয়ে যে এত হাইপ! এত আলোচনা! এর সার্থকতাটা কোথায়? উত্তর দিতে পারিনি। রমাপদ বাবুর মধ্যে আজ আমি সেই সার্থকতাটাই খুজে পেলাম।


এই লেখকের অন্য লেখা...

মুহূর্ত ।। ঋতব্রত গুহ

 

 

 

ঋতব্রত গুহ  জন্ম ১৯৮৮ সালে ভারতের শিলিগুড়ি শহরে ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক। চাকরি জীবনের শুরু সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।  সাহিত্য জগতে প্রবেশ নির্জনে বসে নামক লিটল ম্যাগাজিনের সহসম্পাদক হিসেবে। তার লেখা গল্প দেশ পত্রিকা সহ অন্যান্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কর্পোরেট জীবনের সমান্তরালে চলছে লেখকের সাহিত্যচর্চা। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা প্রথম উপন্যাস আফিয়া। অতি সম্প্রতি সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা গল্প সংকলন অন্যান্য ও কমরেড

 

 

 

 

 

Post a Comment

0 Comments