বাংলা নাটকে হুমায়ূন আহমেদ এক নতুন যুগ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আশির দশকে শুরুতে। নাটক বিনোদনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। নাটকের উদ্দেশ্য বিনোদন হলেও কেউকেউ বিনোদনের বাইরে গিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়ে থাকেন। তবে বার্তা দেওয়াটা নির্মাতার নিজস্ব ইচ্ছা বা অভিরুচির ওপর নির্ভর করে। বার্তা দিতেই হবে এমন নয়। কোন কোন সমালোচক আবার প্রচ্ছন্ন বার্তায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ বার্তাটা এমন হবে যে দর্শক সেটাকে খুঁজে নিবেন। সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে নাটকের গল্প কোন কিছুকে বলে দিবে না। তবে নাটক যে নির্মল আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে থাকবে সে ব্যাপারে কোন সমালোচকেরই দ্বিমত নেই। নাটক মানুষের যাপিত জীবের ঘটনাপুঞ্জ একীভূত করে সেলুলয়েডের মাধ্যমে শোবার ঘরের দোয়ার পেরিয়ে মনের গহিনে গিয়ে দাগ কেটে বসে যাবে। গল্প কিংবা হাস্যরসাত্মক উপাদান নিয়ে মানুষের নির্মল বিনোদনের মাধ্যম হয়ে যাপিত জীবনের ভার কিছুটা হলেও লাগঘ করবে—এমনই প্রত্যাশা নাটকের কাছে।
সেই বিচারে হুমায়ূন আহমেদের নাটক উত্তীর্ণ হতে হতে মানুষের আরও কাছে চলে যেতে থাকে। তিনি মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলে নতুন স্বর হয়ে ওঠেন। তাঁর নাটকে দেখা যায় মুসলিম আচরিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রথাগত ইসলাম বিদ্বেষী কোন চরিত্র তার নাটকে দেখা যায়নি। সাধারণ টুপি-দাঁড়ি পরিয়ে সামাজিক কুসংস্কার আর অনৈতিক কাজ দেখানোর যে প্রবণতা আমাদের নাটক-সিনেমায় দেখা যায় সে পথে তিনি হাঁটেননি। তাঁর চরিত্রের মুখ দিয়ে হরহামেশাই আল্লাহ, নবী-রাসূল, ইনশা আল্লাহ, সুবহান আল্লাহ, বিসমিল্লাহ বলতে, কোরআন তেলাওয়াত করতে, নামাজ পড়তে দেখা যায় এবং তা ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথেই। আবার সেই চরিত্ররাই আবহমান কালের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত হন নির্দ্বিধায়। ফলে এই অঞ্চলের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি তাঁর নাটকে ফোটে ওঠে। এমনকি দাঁড়ি-টুপি পরিহিত মানুষকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়। এতে করে দিন দিন মানুষের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের ওপর। আর সেই প্রত্যাশার চাপেই নাকি আত্মখোরাকে কিংবা ব্যবসায়িক চাপে একের পর এক নাটক তৈরি করতে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ।
মানুষের অবচেতন মনের ইচ্ছা আর খেয়ালি জীবন-যাপনের যে বাসনা সুপ্ত থাকে হুমায়ূন আহমেদ তা সূক্ষ্ম ভাবে ধরতে পেরেছিলেন। তাইতো তার নাটকের চরিত্ররা বিচিত্র ভাবে গাছের সাথে কিংবা নিজের সাথে কথা বলতো। বাঙালির আবহমান কালের ঐতিহ্য স্বরূপ যৌথ পরিবার তার নাটকের অন্যতম অনুষঙ্গ। সাথে যুক্ত হতো পারিবারিক টানাপোড়েন। ফলে মানুষের মনকে সহজের ছোঁয়ে যায়। মাছ ধরা, চাঁদনী রাতে জ্যোৎস্না দেখা কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা সবই তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর নাটকে। এতে করে গ্রাম প্রেমিক শহুরে মানুষগুলোকেও তাঁর নাটক আকর্ষণ করতে পেরেছিল।
গান হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বড় একটা জায়গা নিয়ে আছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহ্য-লোক গানগুলোকে তার নাটকের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন সারাদেশে। গ্রামীণ আড়ম্বরহীন গায়কদের দ্বারা দেশিয় ঢোল-বাঁশি আর দোতরা বাজিয়ে আলাদা গাম্ভীর্যের মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেছেন দর্শকের সামনে। ফলে অধুনিক গানের স্রোতে হারাতে যাওয়া গ্রামীণ গানগুলো দর্শকের ভিতর নাড়া দেয় আলমারিতে যত্নে তুলে রাখা পুরনো স্মৃতির মতই।
এইসব শক্তিশালী আর হৃদয় ছোঁয়া চিত্রনাট্য আর প্রদর্শনীর মধ্যেও যে দিকটা মানুষের মধ্যে একঘেয়েমির উদ্রেগ করে তা হলো ঘুরেফিরে একই অভিনেতাদের দিয়ে তিনি অভিনয় করিয়েছেন। তারচেয়ে বড় বিষয় হলো একই জায়গায় চিত্রয়ন করেছেন এবং ঘুরেফিরে একই ধরণের দৃশ্য একাধিক নাটকে দেখিয়েছ—ক্ষেত্র বিশেষে পাত্র-পাত্রির সংলাপও একই ব্যবহার করেছেন। মেয়েদের চরিত্রকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষের আজ্ঞাবহ আর সংকীর্ণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন। পুরুষ কর্তৃক নানাভাবে খাটো করেছেন মেয়েদের। এই জায়গায় তিনি প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেনি। একই গানকে বারবার উপস্থাপন করেছেন। ফলে যে দিকগুলো হুমায়ূন আহমেদের নাটকের শক্তিশালী দিক হয়ে ওঠতে পারতো সেগুলোই তাঁর নাটককে দীর্ঘমেয়াদে দূর্বল করে দিয়েছে। দিন যতই যাবে—হুমায়ূনের কাজ নিয়ে আরও গবেষণা হয়তো হবে এবং সমালোচকদের হয়তো এই বিষয়গুলো বিব্রত করবে।
লেখাঃ আকাশ মামুন সরকার
0 Comments