বেশ ক'দিন হলো ইঁদুরদের মধ্যে সভা চলছে কিন্তু সভা থেকে কোনো সিন্ধান্তই উঠে আসছে না! গোত্রের সকলই ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছে ওদের এই বিশৃংখল পরিস্থিতি কিভাবে মিটমাট সম্ভর! কেউ কারো কথা শুনছে না, যে যেভাবে পারছে মানুষের বাসা বাড়িতে হামলে পড়ছে। যে কারণে নতুনদের খাবার সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া আজ সকলের সম্মতিতে গোত্রপতিও মনোনয়ন করা হবে তাই কেউ কেউ সকাল সকাল এরই মধ্যে সভায় হাজিরও হয়ে গেছে।
কত কত ইঁদুর এসেছে দূর-দূরান্ত থেকে। ধাড়ি, নেংটি, গেছো, মেটে আরও কত ইঁদুর। একেকজন দেখতে আবার একেকরকম। কোনটার ইয়া বড়ো কালো রোমশ শরীর, কোনটার আবার কুতকুতে চোখ, কোনটা ধূসর রঙের, কোনটার আবার একরত্তি শরীর নিয়ে এদিক-ওদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
যে যার মতো করে একে একে সভায় জড়ো হয়েছে। বুড়োরাও এসেছে জোয়ানদের কাঁধে ভর করে। সকলেই নেতাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এবার অন্তত নতুন কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় কিনা!
কিন্তু সভা থেকে কোন সিদ্ধান্তই উঠে এলো না। শেষমেশ অমিমাংসিতভাবে শেষ হলো সভা। সপ্তাহের এই একদিনই একসাথে জড়ো হয় সবাই।
ধাড়ি গেছোকে আক্ষেপ করে বলল, "আজই তো সভার অর্ধেক কাজ সেরে ফেলতে পারতো,কালকের জন্য ঝুলিয়ে রাখার কি দরকার ছিলো! বুঝি না বাপু, কী এদের মতিগতি! সব কাজ বাদ দিয়ে আবার আরো একটি দিন আসতে হবে এখন! এই গেছো তোর আবার কি হলো? কিছু বলছিস না যে। তুই কাল আসবি?" "আসতে তো হবেই। নেতাদের কথার তোয়াক্কা না করার সেই আস্পর্ধা কী আর আমাদের আছে, বল! কে কত দূর থেকে আসলো, কে সব কাজ ফেলে সভায় উপস্থিত হলো এতে কার কী এসে গেছে এ পযর্ন্ত।" গজরাতে গজরাতে কথা ক'টি বলে গেলো গেছো।
এই দিক দিয়ে নেংটিরা বেশ ভালোই আছে। লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সুযোগ পেলেই নেতাদের আশেপাশে গিয়ে এর ওর বিরুদ্ধে কান ভাঙানি দিচ্ছে। সময়ে সময়ে তৈল মর্দন করছে। এসব ঘটনা আবার দূর থেকে মেটে আর লেজ খাটো দেখছে আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, "এই নেংটিগুলো হলো যাচ্ছেতাই। বাসাবাড়িতে থাকে তো, তাই কূট বুদ্ধি সবসময় মাথায় গিজগিজ করতে থাকে। দেখ না ঐ বড় কালো মেটে ইঁদুরটার কানে কী সব কুমন্ত্রণা দিচ্ছে ওরা ক'জন মিলে!" "দেখে যা শুধু মেটে। সভাটা শেষ হতে দেয় শুধু, তারপর এমন ঠ্যাঙানি দিবো না, ওদের নাম ভুলিয়ে দিবো।" রাগে ফুঁসতে থাকে লেজ খাটো।
এরপর মঞ্চে বসে থাকা ক'জন নিজেদের মধ্যে কি যেন কথা বলে নিলো, আর বাকিরা মাথা নেড়ে সায় দিলো। বসে থাকা ক'জনের মধ্যে থেকে মাথা মোটা ধাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলো, "আপনারা যারা এখনও বসে আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনারা যে যার মতো করে চলে যান। সভা আজকের মতো মূলতবী করা হয়েছে তা তো শুনেছেনই। কাল আবার সকালে দেখা হবে। ধন্যবাদ।"
নানান আক্ষেপ আর একরাশ হতাশা নিয়ে যে যার মতো করে হাঁটা ধরলো বাকীরা। দেখতে দেখতে পুরো জায়গাটি ফাঁকা হয়ে গেলো। থেকে গেলো শুধু কিছু নেংটি, মাথা মোটা ধাড়ি আর গেছো। "লেজ খাটো আর মেটে'র হাবভাব ভালো ঠেকছে না ভাই! কাল হয়তো গন্ডগোল পাকাতে পারে।" বাকিদের হুঁশিয়ার করে দিলো নেংটিদের একজন।
"আরে ধুর, রাখো তো, কী যে মুরোদ আছে ওদের, তা বেশ জানা আছে, বুঝলে হে নেংটি!" এই বলে পাত্তাই দিলো না ধাড়ি, নেংটিকে। "চলো, চলো এখন উঠে পড়া যাক। অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজগুলো সব তাড়তাড়ি সারতে হবে তো। কাল আবার কাক ভোরে উঠতে হবে না?" এই বলে তাড়া দিলো গেছো।
তারপর দিন সকাল সকাল সরগরম হয়ে ওঠেছে সভা। শুরুতেই মোটা ধাড়ির বক্তব্য দিয়ে শুরু হলো সভার কাজকর্ম, " উপস্থিত ভাই ও বোনেরা, এমনিতেই আমাদের হাত থেকে দুই দিন চলে গেছে। যারা যারা বক্তব্য রাখবেন, ছোট আকারে বলার চেষ্টা করবেন। দুপুরের আগেই নির্বাচনের কাজ শুরু করবো আমরা। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে। তাদেরও বাড়ী যেতে হবে। কাজেই সভার কাজকর্ম আমরা যত দ্রুত সম্ভব আজকের মধ্যে শেষ করে ফেলবো। কাজেই সকলেই আগামী দিনের কথা মাথায় রেখে স্বচ্ছ ও দক্ষ কর্মীদের নিয়ে যাতে নতুন সভাসদ গঠন করা হয় এই প্রস্তাব রেখে যে যার মতো করে বক্তব্য শেষ করবেন।" একে একে অনেকেই মঞ্চে এসে তাদের নিজ নিজ মতামত ও অভিযোগ জানালেন।
এখন সভাসদবৃন্দ বাছাইয়ের পালা। এদিকে বাছাইপর্ব শেষে যাতে, কেউ কোনরকম বিশৃঙ্খলা না করতে পারে সেজন্য রাক্ষুসে ইঁদুরদের ওপর পড়েছে টহলের দায়িত্ব।
দেখতে দেখতে শেষ হলো কাঙ্খিত সেই বাছাইপর্ব। যখনই নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলো তখনই শুরু হয়ে গেল তুমুল হট্টগোল। গেছো, মেটে আর ছোট ইঁদুরের দল কমিটির বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল, "এই নতুন কমিটি আমরা মানি না। তেলবাজ আর অযোগ্যদের কমিটি হয়েছে এটি। আমাদের কারো কথা ভাবা হয়নি। এই এক চোখা কমিটি আমরা কোনভাবেই মানবো না।" এদিকে রাক্ষুসে ইঁদুরের দল ওদের ধারে কাছে এসে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে আর যখনই ক্ষীপ্র ভঙ্গিতে গেছোদের ঘাড় ধরতে যাবে অমনি বড় ধাড়ির ইশারায় হাত গুটিয়ে নিলো রাক্ষুসেরা।
-আমরা সবাই বন্ধু। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে কোন লাভ আছে? আপনাদের ক্ষোভটা কোথায় খুলে বলুন। বলল বড় ধাড়ি।
-নেঙটিরা ভীষণ স্বার্থপর নিজেদের স্বার্থ ছাড়া ওরা কিছুই বোঝে না! সেদিন গেছোদের একজন আনাজের ঝুড়ি থেকে শুধুমাত্র একটা আলু নিয়ে দৌঁড়ে পালাচ্ছিলো অমনি হাওলাদার বাড়ীর পুচকে ছেলেটা আলমিরার উপর-নীচ যেভাবে লম্বা লাঠি দিয়ে গুঁতোগুতি করছিলো, কপালের জোড়ে বেঁচে গিয়েছিল বেচারা। না হলে কী যে হতো ভাবতেই ভয়ে রোম খাড়া উঠছে আমাদের। অথচ ওখানে নেঙটিদের দুইজনও ছিলো। ওরা চাইলে সাবধান করতে পারতো, কিন্তু তা না করে সেখান থেকে তার আগেই পালিয়ে গিয়েছিল ওরা। এই বলে ক্ষোভ ঝাড়লো গেছোদের একজন।
-"হুম, বুঝলাম এখন। নেঙটিদের এই কাজ করা ঠিক হয়নি। এ ব্যাপারে নেঙটিদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।" এই বলে ধাড়ি ইশারায় নেঙটিদের ক্ষমা চাইতে বললো। নেঙটিদের একজন বেশ বিনয়ের সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করলো সকলের কাছে।
-শুধু ক্ষমা চাইলেই সবকিছুর সুরাহা হবে না! মানুষরা ভীষণ চালাক প্রাণী। ওরা আমাদের ধরার জন্য নানান ফাঁদ তৈরি করেছে। ঘরের বিভিন্ন কোণে খাবারের সাথে বিষ মাখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের এক হয়ে নানানভাবে আক্রমণ করতে হবে ওদের। আমরা যারা বাসাবাড়িতে থাকি এখন, তাদের বিপদ পায়ে পায়ে হাঁটছে। বিশেষ করে যে বাড়ীগুলোতে খাবারের ছড়াছড়ি এই যেমন রহমান বাড়ী, দারোগা বাড়ী, মীর রাড়ী ঐ বাড়ীগুলোতে যে দু'দন্ড নিশ্চিন্ত মনে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে খাবো তার কোন উপায় নেই। যেখানে সেখানে মরণফাঁদ রেখে দিয়েছে। এ নিয়ে আমাদের কত বন্ধু এই ফাঁদে আটকে পড়ে মারা গেলো আমরা ক'জন এর খবর রেখেছি।'চোখ বড় বড় করে জানালো ছোট ইঁদুর।
-আরে ছোট, তুই এই কথা বলছিস, আমরা যারা মাঠে গর্ত করে থাকি তাদের অবস্থা তো আরও কষ্টকর! এখন ধানি জমির ওপর মানুষেরা ইটের ভাটা করছে, এতে নাকি দ্বিগুণ লাভ! শস্য রোপন বাদ দিয়ে এখন ওরা নিজেদের জন্য বসতবাড়ি উঠাচ্ছে। ধান, ভুট্টা আর গম খেয়ে যে নিজেদের জীবন চালাবো এখন সেই আশাও দেখছি না! পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে কৃষকেরা এখন কৃষিজমিতে যত্রতত্র বিষ ছড়াচ্ছে! কি যে দূর্গতি চলছে আমাদের! আর কিছু দিন পরই শুরু হবে ধান কাটা মৌসুম। তখন ন্যারাগুলোয় ধরানো হবে আগুন, আগুনের ধোঁয়ায় গর্তে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়বে। এই ধোঁয়ায় আমাদের কত বন্ধু দমবন্ধ হয়ে মারা গেল তার হিসেব দিলেও শেষ হবে না!, আক্ষেপের সুরে জানালো মেটে ইঁদুর।
-যাই হোক প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে আমরা এক হচ্ছি ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ আমাদের কিছুই হচ্ছে না। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবা দরকার আর একটা সমাধানেও আসা দরকার। তাছাড়া বড় ধাড়িকে আমরা এই নতুন গোত্রপতি হিসেবে মানি না, যার নিজেরই চরিত্র বলতে কিছু নেই সে কি করে সকলের দুঃখ-কষ্টের নেতা হতে পারে। ক্ষোভ ঝাড়লো ছোট ইঁদুর।
-গোত্রপতিকে নিয়ে আবার আপত্তিটা কিসের! আপনাদের দেখি আপত্তির শেষ নাই। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করলো বড় ইঁদুর। এদিকে রাক্ষুসে ইঁদুরের দলও যে যার মতো করে মারমুখী অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। যেন নেতাদের কোন ইশারা পেলেই তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে বিদ্রোহীদের ওপর।
-এই তো সেদিন আমার সদ্য বিয়ে করা বউটার দিকে কিভাবে নজর দিচ্ছিলো নেঙটি গেছোটা। তখনই সন্দেহ হয়েছিল আমার। পরে রাত্তির বেলায় বউ আমার মীর বাড়ীতে খাবার আনতে গিয়েছিলো অমনি অন্ধকার ঘুপচি থেকে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নেঙটি গেছো। বাসায় এসে বউ-এর সে কী কান্না। সেদিন নানান ঝামেলায় ছিলাম বলে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে ও। না হলে, সেদিনই কয়েকটি উত্তম মাধ্যম পড়তো ওর পিঠের ওপর!
"ছোট তুই এই কথা বলছিস, দুই দিন আগেও নাকি মেটে ইঁদুরের বাড়ি গিয়ে ওর ছোট বোনের ওপর যাচ্ছেতাই আচরণ করেছে। বাজে প্রস্তাবও দিয়েছে ও। শুধু তাই নয়, ওর ইন্ধনেই নেঙটিরা রহমান বাড়ী আর দারোগা বাড়ীর ভালো ভালো কাপড় চোপড় দাঁত দিয়ে কেটে কুচি কুচি করেছে।" এই বলে ঝাল ঝাড়লো লেজ ছোট ইঁদুর।
এই অভিযোগ শুনেই ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠলো নেঙটিরা।
-প্রমাণ না দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দিতে পারো না তোমরা। তাছাড়া দাঁত ছোট রাখার জন্য কিছু না কিছু কাটাকুটি আমাদের ইঁদুর সম্প্রদায়কে করতেই হয়। এমন ভদ্রতা দেখাচ্ছো যেন তোমরা কাটাকুটি করো না।
-আমরাও কাটাকুটি করি। কিন্তু তোমারা যেটা করো সেটা স্রেফ দুষ্ট বুদ্ধি থেকেই করো। রহমান রাড়ীতে কী কাপড়ের অভাব ছিলো? বেছে বেছে তোমরা ভালো কাপড়গুলো কাটতে গেলে কেন? তোমাদের শয়তানি বুদ্ধির কারণে এখন আমাদের ঐসব বাড়ীতে যাওয়াটাই বন্ধ করতে হয়েছে। খাবার সংকটে পড়তে হয়েছে আমাদের। রাগত স্বরে বলল ছোট ইঁদুর।
সবাই সমস্বরে জানান দিলো, মানি না এই গোত্রপতিকে। আবার নতুন করে গোত্রপতি বাছাই করা হোক। দক্ষ ও যোগ্যদের নিয়ে আসা হোক কমিটিতে। অমনি সভাজুড়ে হুলোস্থুল বেঁধে গেল! হাতাহাতি,কামড়াকামড়ি সে কী এক অবস্থা! রাক্ষুসে ইঁদুরের দল ঝাঁপিয়ে পড়লো মেটে, লেজ খাটো আর ছোট ইঁদুরদের ওপর। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে! সুবিধাবাদীরা যে যেখানে পারছে পালিয়ে অন্যত্র সটকে পডছে। এদিকে রাক্ষুসেদের কবলে পড়ে বেশ ক'জন ছোট ইঁদুর ঘটনার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করলো। মারাত্মক জখম হলো মেটে আর লেজ খাটোর দল। নেঙটি গেছোদের তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা!
মারামারি আর কামড়াকামড়ি মধ্য দিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো ইঁদুর সম্প্রদায়। এখন আর কেউ কারো পথ মাড়াতেও চায় না। সহ্য করতে পারে না একে অন্যকে। অন্যদিকে কেউ কেউ আবার এই ভাগাভাগি মেনে নিতে পারে না বলে মনোকষ্টে দিন যায়!
মনের সেই কষ্ট মনের মধ্যেই চেপে রাখতে হয়। কালেভদ্রে দেখা হলে, সুখ-দুঃখের কথা বলে যায় ওরা। সময় ফুরিয়ে এলে আবার চোখের জলে একে অপরকে বিদায় জানিয়ে যে যার মতো চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে। অন্যদিকে সুবিধাবাদীদের হয়েছে পোয়াবারো! সবদিক বজায় রেখে ভালোই দিন কেটে যায় ওদের।
0 Comments