বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন লোকালয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহুল আলোচিত এক জনগোষ্ঠীর নাম মণিপুরি জনজাতি। এ জনজাতির সল্পালোচিত একটি অংশের আচরিত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। মণিপুরি মুসলমান, খা-ই-বাঙাল বা পাঙাল নামে পরিচিত এ জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস মণিপুর হলেও এদের লহুধারা কিন্তু হবিগঞ্জের তরফ অঞ্চলের নরম মৃত্তিকায় গ্রথিত। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থেকে পাঙালদের জীবন চরিত খুব সহজেই আলাদা করা যায়। ফলে স্বীয় বৈশিষ্ট নিয়ে পাঙালরা আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে বাংলাদেশে।
মণিপুরি মুসলমান সমাজে নবজাতকের আগমনকে কল্যানকর হিসেবে বিবেচনা করে এবং এ আগমন বার্তা পারিবারিক পরিমন্ডলে এক অনিন্দ্য আনন্দের ফুয়ারা সৃষ্টি করে। সন্তান ধারণের খবরটি নিশ্চিত হওয়ার পর দোয়া দরুদ ও মেহমানদারি চলতে থাকে। সুখবরটি চাউর হওয়ার পর সন্তান প্রসবের দিন ঘনিয়ে এলে বর ও কনে পক্ষের আত্মীয় স্বজনরা হাঁস, মুরগী, মাছ, মাংসসহ সাধ্যমত বিভিন্ন প্রকার পিঠা, সন্দেশ, মিষ্টি ও ফলমূল সমেত সুবিধা মতো দিনে পোয়াতির বাড়িতে গমন করেন। তারা সেখানে পোয়াতির স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেন, অধিকন্তু সাথে করে নিয়ে আসা খাদ্যদ্রব্য স্বযত্নে নিজেদের হাতে রান্না করে পোয়াতিসহ বাড়ির সবাইকে আপ্যায়ন করান। এতে সন্তান সম্ভাবা মায়েদের শরীরে আমিষের অভাব অনেকাংশে দূরীভূত হয় এবং আত্মীয়তার পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় করে। এভাবে আত্মীয়স্বজনের আনাগোনায় পোয়াতির বাড়িতে এক আনন্দঘন উৎসবের সৃষ্টি হয়।
সন্তান জন্ম নেওয়ার পরও ধর্মীয় বিধান মোতাবেক নির্দিষ্ট দিনে চুল কাঁটা ও আকিকা দেওয়ার রেওয়াজতো রয়েছেই, অধিকন্তু সন্তানের বয়স চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হলে গুড়ের মুড়কি ও মিষ্টি নিয়ে নানা বাড়িতে যাওয়ার এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের ডেকে এনে তা বিতরণ করার রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। নানা বাড়ি থেকে ফিরার সময় পুনরায় মুড়কি, মিষ্টি ইত্যাদি ফেরত দেওয়ার প্রচলনও রয়েছে।
সন্তানের বিবাহের সময় উপনীত হলে সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাত্র পাত্রী বাছাই সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে উভই পক্ষের সম্মতিক্রমে প্রচলিত বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের পর বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানের সাথে থাকে প্রীতিভোজ, ওয়ালিমা বা ভৌভাতের নামে ভূড়িভোজনের সরব উপস্থিতি। মণিপুরি মুসলমানদের যে কোন আপ্যায়ন বা মেহমানদারির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো আমন্ত্রিত অতিথিদের সবাইকে মাটিতে বিছানো মাদুর বা চাদরে একসাথে বসিয়ে খাওয়া পরিবেশন করা।
মেজবান খাওয়ার আয়োজন করলেও ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ দায়িত্বে থাকেন গ্রাম পঞ্চায়েত। খাওয়া দাওয়ার পুরো ব্যবস্থাপনাটি তদারকি করে পঞ্চায়েতের মুরব্বিরা। রান্না বান্না, খাবার পরিবেশন ইত্যাদি কাজের দায়িত্বে থাকেন গ্রামের যুবকরা । সাধারণত তিনটি ধাপে খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে। প্রথমত পুরুষ, দ্বিতীয়ত মহিলা এবং সর্বপরি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরা। উল্লেখ্য যে, উপস্থিত সবাইকে কোন প্রকার বৈষম্য ব্যতিরেকে সমভাবে মাংস বা তরকারী বিতরণ করার সুনাম এ জনজাতির রয়েছে। যত বড় অনুষ্ঠানই হোক সবাইকে ভাত মাংস, তরকারী পরিবেশন সম্পন্ন করার পরই ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে খাবার শুরু করার সংকেত সরূপ জোরে বিসমিল্লাহ বলার পর সবাই এক সাথে খাওয়া শুরু করে।
খাবার সামনে আসার পরেও খাওয়া শুরু না করে অন্যের জন্য অপেক্ষার বিষয়টি সবাই মেনে নিয়ে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শান্ত সুস্থির ভাবে খাওয়া সম্পন্ন করে। নিকট অতীতেও বিবাহের দিন বর ও কনের বাড়িতে রাতভর বিভিন্ন লোকসংগীত, দেশাত্মবোধক গান, গজল ও কাওয়ালী ইত্যাদি গাওয়া হতো, কিন্তু কালের বিবর্তনে আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে সেগুলো নির্বাসনে পাঠিয়ে ড্রাম এবং অপ ও বিজাতীয় সংস্কৃতিতে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
মণিপুরি মুসলমান পঞ্চায়েতের কোন সদস্য মারা গেলে তার দাফন কাফনের দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর বর্তায়। শুধু কাফনের কাপড় এবং আনুসাঙ্গিক খরচের টাকা পরিবার থেকে প্রদান করা হয়। মৃতের সংবাদ প্রচার থেকে শুরু করে মৃতের গোসল ও কাফন পড়ানো, কবরের জন্য বাঁশ কাটা, কবর খনন, দূর দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয় স্বজনদের মেহমানদারিসহ সকল আনুসাঙ্গিক কাজ গ্রাম পঞ্চায়েতের লোকেরাই করে থাকে। মৃতের সংবাদ শুনে দূরদূরান্ত থেকে আসা মেহমানদের মেহমানদারির জন্য পঞ্চায়েতের সদস্যদেরকে নির্দিষ্ট পরিমান চাউল এবং আনুসাঙ্গিক খরচ মিটানোর জন্য নগদ টাকা প্রদানের রেওয়াজও প্রচলিন রয়েছে। মৃত্যুর দিন বা পরের দিন পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে মৃতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কোরান তেলাওয়াত ও দোয়ার ব্যবস্থাও করে থাকে।
জীবন এমন একটি অবস্থা, যা একটি জীবকে জড় পদার্থ ও মৃত অবস্থা থেকে পৃথক করে। খাদ্য গ্রহণ, বিপাক, বংশবৃদ্ধি, পরিচলন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড জীবনের উপস্থিতি নির্দেশ করে। এক কথায় বলতে গেলে বেঁচে থাকাটাই জীবন। বেঁচে আছি বলেই আমাদেরকে ঘর সংসার, বংশবৃদ্ধি, বাসস্থান, খাদ্য ও বস্তু উৎপাদন, শিক্ষা গ্রহণ ও ঔষধ ইত্যাদির আঞ্জাম করতে হয়। মণিপুরি মুসলমান সমাজেও এর ব্যতিক্রম নেই। বেঁচে থাকার তাগিদেই জীবনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা সুরক্ষিত করতে হয় বিধায় তাদেরকেও জীবিকার একটি পন্থা বেছে নিতে হয়।
মণিপুরি মুসলমান সমাজের লোকেরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে খুবই পরিশ্রমী। এরা মুলতঃ একটি কৃষিজীবী সম্প্রদায়। পুরুষরা মাঠে আর মহিলারা ঘরকন্না আর তাঁত বোনায় ব্যাস্ত থাকে। প্রতিটি ঘরে নিজেদের পরিধেয় কাপড় এবং চাদর বোনার জন্য কোমর তাঁত এবং শাড়ি বোনার জন্য সাধারণ তাঁত রয়েছে। এদের তৈরী মণিপুরি শাড়ি আজ সুবিদিত।
তবে শিক্ষার প্রসার এবং জীবন ধারণের তাগিদে আজ তাদের অনেকেই বিভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত হচ্ছে। চাকুরিজীবীর সংখ্যাও নিরেট কম নয়। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী অফিসে আজ অনেকেই চাকুরিরত। এ বিষয়ে মহিলারাও পুরুষের সমানতালে এগিয়ে আসছে। পুলিশ, বর্ডার গার্ড, সেনা, নৌ, ও বিমান বাহিনীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক চাকুরি করছে। অনেকেই আজ বিভিন্ন ব্যাংক ও ক্যাডার সার্ভিসে চাকুরিরত। শিক্ষক, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। ব্যবসা ও ওকালতি পেশায়ও আজ অনেকেই সম্পৃক্ত।
মণিপুরি মুসলমান সমাজ বিশ্বাস করে সমাজ ও জাতির উন্নতি বিধানের জন্য আচার-আচরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। তারা বিশ্বাস করে আচার-আচরণ মানবতার অংশ এবং সততা ও সত্যবাদিতার মধ্যেই সুখ ও শান্তি নিহিত। মণিপুরি মুসলিম সমাজে বয়জ্যেষ্ঠ ও বর্ষীয়ান মুরব্বিদেরকে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়। পিতা, মাতা যতই বয়স্ক, দূর্বল ও অক্ষম হোক কখনও অবহেলা করে না। অদ্যাবধি কারো পিতা, মাতা বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়ার নজির এ সমাজে নেই। এ সমাজের লোকদের পারস্পরিক সামাজিক বন্ধন খুবই দৃঢ়।
মণিপুরি মুসলমান সমাজ বিশ্বাস করে আনুষ্ঠানিক বা আদালতি বিচার ব্যবস্থার চেয়ে অনানুষ্ঠানিক বা সামাজিক বিচার ব্যবস্থা অনেক বেশি কার্যকারী ও প্রাসঙ্গিক। তাই তারা নিজেদের সামাজিক পরিমন্ডলেই সকল বিবাদ-বিসম্বাদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। আনুষ্ঠানিক আদালতে আইনের কূটকৌশলে সবলরাই সুবিধা পায়। আইনকে তারা ক্রয় করতে পারে। কিন্তু সামাজিক বিচার ব্যবস্থায় আইনকে ক্রয় করা সহজ নয়। যদিও বর্তমানে সামাজিক বিচার ব্যবস্থাকে অনেকটাই কলুষিত দেখি, তবুও এটা পরিত্যাগ করার মতো অবস্থায় এখনো পৌঁছেনি বলে মনে করে। মণিপুরি মুসলমান সমাজের সামাজিক বিচার ব্যবস্থা কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করা হয়। প্রথমতঃ গোষ্ঠীর মধ্যেই সকল বিবাদ-বিসম্বাদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। গোষ্ঠীর বয়জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে গোষ্ঠীপতি হিসেবে গন্য করা হয়। গোষ্ঠীপতির নেতৃত্বেই সালিশ বৈঠক পরিচালিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত। যদি গোষ্ঠী বিবাদ মিটাতে ব্যার্থ হয় তখন গ্রাম পঞ্চায়েত বিষয়টি পর্যালোচনা করে মিটিয়ে দেন। গ্রাম পঞ্চায়েতের সালিশে কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে আঞ্চলিক পঞ্চায়েতে যেতে পারে। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে আঞ্চলিক পঞ্চায়েত গঠিত হয়। শালিশের চুড়ান্ত ধাপ হচ্ছে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতগুলোর সিদ্ধান্ত অবজ্ঞা করলে বিভিন্ন সামাজিক শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে, যেমন ভরা মজলিশে সালাম প্রদান, আর্থিক দন্ড, মানা বা সামাজিক বয়কট ইত্যাদি।
মণিপুরি মুসলমান সমাজে আপোষ ও অহিংস রাজনৈতিক সমাধানকেই রাজনীতি মনে করে। এ সমাজের লোকদের রাজনৈতিক চিন্তার পরিধি নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ, অধিকন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ, বড়জোর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা পর্যন্তই সীমিত। স্থানীয় সরকারের আওতাধীন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিবার কমলগঞ্জ উপজালার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে সদস্য পদে একাধিক ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসছে। আদমপুর আর ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান পদে এবং কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে একাধিকবার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে এ সমাজের লোকেরা।
মানুষ সামাজিক জীব। মণিপুরি মুসলমানরাও সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে পছন্দ করে। তারা যেখানেই বসবাস করে সেখানেই একটি সমাজচক্র গড়ে তুলে। তারা তাদের সমাজকে গ্রাম আর গোষ্ঠীতে বিভাজন করে রেখেছে। প্রতিটি গ্রাম নিয়ন্ত্রন করে এক একটি গ্রাম পঞ্চায়েত। আবার কয়েকটি গ্রাম নিয়ে আঞ্চলিক পঞ্চায়েট এবং সকল আঞ্চলিক পঞ্চায়েত নিয়ে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত গঠিত হয়।অর্থনীতির বিবেচনায় মণিপুরি মুসলমানদের আর্থিক মানদন্ড মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পর্যায়ের। তবে এ সমাজে কোন ভিক্ষুক নেয়। ভিক্ষাবৃত্তিকে এরা ঘৃনা করে। এদের মধ্যে কোন পুঁজিপতি, শিল্পপতি অর্থাৎ উচ্চবিত্তের লোক নেই। তার পরেও তারা সম্পদ নয়, সততা ও সত্যবাদিতার মধ্যেই সুখ ও শান্তি খুঁজে।
0 Comments