দীপ্তি কলিতার জন্ম ১৯৭৯ সালে বাবার কর্মস্থল নাগাল্যান্ডে। আদিবাড়ি আসামের যোরহাট জেলায় এবং বৈবাহিকসূত্রে বর্তমানে এই জেলাতেই বসবাস করছেন। সমাজের বৈষম্য ও নারী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাঁর লেখা সাদিন, প্রতিদিন, আমার আসাম, দৈনিক জনমভূমি, অগ্রদূত, খবর, আসাম আদিত্য এর মতো জনপ্রিয় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর একটি গল্প অনুবাদ করেছেন সত্যজিৎ চৌধুরী
মধ্য
দুপুর। সময়কাঁটা ঠিক দু'টো বাজার জানান দিচ্ছে। এদিকে
উৎকট গরম। সাথে ছাতাটাও নেই। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এক ঢোক জল খেয়ে নিলাম।
যোরহাটের চিনামরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি বরুয়া চারিআলির দিকে যাওয়া ম্যাজিক
ভ্যানগুলোর অপেক্ষায়। দু'টি ম্যাজিক ইতিমধ্যে চলে গেল। বসার
কোন খালি জায়গা ছিল না। এমন সময় উদাত্ত কণ্ঠের গান 'জিনা
য়ঁহা মরনা য়ঁহা, ইসকে সিবা জানা কঁহা ...'। 'মেরা নাম জোকার' ছায়াছবির
মুকেশের কন্ঠের সেই কালজয়ী গানটি কারও সুকণ্ঠে যেন প্রাণ পেয়েছে। এদিক ওদিক
তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার দিকে এগিয়ে আসা রিকশাটিতে বসে থাকা চালকজন প্রাণ ঢেলে
গানটি গাইছে। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, বোধহয় এই
ব্যক্তিটিই পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। যান্ত্রিক জীবনে কিছুমাত্র কৃত্রিমতা না থাকা
মানুষদের দেখলে আমারও আজকাল পেটে পেটে কেমন হিংসে হয়। কথাগুলো ভেবে থাকতে থাকতে
পঁয়ত্রিশ/সাঁইত্রিশ বছর বয়সি একজন রিকশাচালক আমার ঠিক সামনে এসে ডাক দিতে আমার
সম্বিৎ ফিরে এল। "দিদিভাই, যাবেন নাকি?" আমি যাব বলে রিকশাটিতে উঠে বসলাম। ওকে বললাম, "আমি
বরুয়া চারিআলি পর্যন্ত যাব, ভাই। "সে আমার দিকে এক নজর
দেখে বলল, "ভাড়া কিন্তু সত্তর টাকা নিব দিদিভাই। আগের
থেকেই বলে রাখলাম।"
- ঠিক আছে, চলো তো। কিছু পেলে আগেই নেমে যাব। নয়তো শেষ
পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে আসবে। এই বলে আমি রিকশার গায়ে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম।
- ভাই, তুমি আমার প্রিয় গানটি এত সুন্দর সুর ধরে
গাইছিলে......
সে
একটু লজ্জা পেয়ে আত্মসন্তুষ্টির হাসি ঠোঁটের কোণে এনে মাথাটি নাড়িয়ে বলল -
- এভাবেই জীবনের দুঃখগুলো ভুলে সুখী হয়ে থাকি দিদিভাই। জানেন, আমার ছেলেটি আরও ভালো গান করে। যেমন পড়াশোনায় ভালো, নাচে গানেও সমান পারদর্শী। ছবি আঁকার হাতও খুব সুন্দর। গত সপ্তাহে বিতর্ক
প্রতিযোগিতায় সে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে।
সে
অনর্গল একই উৎসাহে উৎফুল্লিত হয়ে আমাকে পুত্রের কৃতিত্বের কথা বলে গেল। আমি শুধু
হু-হা করে মনোযোগ দিয়ে একান্ত বাধ্য সহযাত্রীর মতো শুনে গেলাম। এই মুহূর্তে আমি
অনুভব করছিলাম, সে যেন তার সুখের সংসারের কথা শোনাতে একজন
ভালো শ্রোতা খুঁজে পেয়েছে। তাই আমি হিসাবের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তার কথা শুনে
যাচ্ছিলাম। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, "দিদিভাই, আপনি কি বরুয়াদের বাড়ির পিছনের দিকের অংশে থাকেন নাকি? বড্ড চেনা চেনা লাগছে।"
আমি
কোন বরুয়া উপাধিধারীর ঘরে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকি না বলে জিজ্ঞেস করলাম -
"তুমি কোথায় থাকো?" সে তখন বলল,
"বরুয়াদের বাড়িতেই। পশ্চিম দিকের এক চালার ঘরগুলিতে। দুই
হাজার টাকার এক কামরার ঘরে থাকা তাও অনেক বছর হয়ে গেছে। এবার কিন্তু পাল্টাতে হবে।
ওরও অসুবিধা হচ্ছে। তার উপর ছেলের নাচগান, খেলাধুলার সরঞ্জাম
রাখার জায়গার সংকুলন হচ্ছে না রুম দু'টি ছোট হওয়ার জন্য।
সে ও আমি দু'জনে কথাবার্তা এমনভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলাম যেন যোরহাট শহরে আমাদের ছাড়া আর কেউ নেই। কেন যেন তার সাথে কথা বলে তার সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখে আমার ধীরে ধীরে তার পরিবারের বিষয়ে জানার আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছিল। তবুও কৌতুহল চেপে তার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে শুধু সমর্থন করে যাচ্ছিলাম। একবার আমি বললাম, "ভাই, তুমি একজন দায়িত্ববান পিতা। ছেলেটিকে সব দিকে এগিয়ে দিয়েছ।' সে তখন হেসে বলল, "দিদিভাই, আমার মূল বাড়ি তেজপুরে। আমার জীবনের কাহিনি শুনলে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন। আমি চার বছর ধরে একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। আমার থেকে সে পাঁচ বছরের ছোট ছিল। তাকে অন্য ঘরে বিয়ে দিয়ে দেবে জানতে পেরে আমি তেইশ বছর বয়সে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাবা সেই সময়েই বের করে দিয়েছিল ঘর থেকে। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে ওর আর কলেজে পড়া হয়ে ওঠেনি। দু'জনে প্রথমে চারশ টাকার ঘরে সংসার আরম্ভ করলাম।
প্রথমে জীবিকার তাগিদে শাকসবজির ব্যবসা শুরু হল। সেই উপার্জনের টাকায় সংসার চালানোর পরও ওকে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে কলেজে ভর্তি করে দিলাম। সে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চতর মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। তারপর আমি তাকে স্নাতকস্তরে নাম লেখাতে বললাম। আমার কষ্ট দেখে সে আর পড়বে না ভেবেছিল, যদিও আমি ওর চোখে স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিলাম। তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যতই কষ্ট হোক আমি ওকে পড়াব। তারপর ও ডিগ্রী ভালোভাবে পাশ করল। আমি শাকসবজি বিক্রি করা ছেড়ে দিয়ে ভাড়ায় রিকশা চালাতে শুরু করলাম। চুক্তি ছিল মালিককে রোজ একশো টাকা করে দেওয়ার পর যা হাতে থাকবে তা আমার হবে। এরই মধ্যে আমাদের পরিবারে একটি পুত্র সন্তান এল। আমি ওকে সর্বদাই বলতাম, তোমার পড়াশুনায় সন্তান বড় করা কোনো বাধা হবে না। এভাবে ওকে আমি শারীরিক ও মানসিক দু'ভাবেই উৎসাহ দিতে লাগলাম। আমি কিন্তু আমার নিজের দেশের বাড়িতে একবারও যাইনি দিদিভাই। মাঝে মায়ের শরীর খারাপ শুনে পাশের জ্যাঠামশাইয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দূর থেকে খবর নিয়ে এসেছি। খুব ইচ্ছে ছিল, মায়ের মুখখানা একবার প্রাণ ভরে দেখে আসি। কিন্তু রক্তচক্ষু বাবাকে বারান্দায় ঘুরঘুর করতে দেখে দরজা খুলে শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত ঘরটিতে ঢুকতে সাহস হল না। বাবার সঙ্গে দেখা না করে, না জানিয়ে দূর থেকে প্রণাম করে ওই স্থান ত্যাগ করলাম।
অবশেষে
ও রাজনীতি বিজ্ঞানে এম এ করল। হাজার দুঃখ কষ্টের মাঝেও আমি ওকে প্রেরণা দিতে
লাগলাম। ইতিমধ্যে আমি অন্যের রিকশা ভাড়ায় চালানো বাদ দিয়ে লোনে দু'টি রিকশা কিনে একটি নিজে চালানো শুরু করলাম। অন্যটি ভাড়ায় দিলাম। তারপর
আমরা আমাদের থাকার ঘরটি বদল করলাম। ও মাঝখানে একটি জুনিয়র কলেজে পার্টটাইম কাজে
যোগ দিয়েছিল। রোজগার থেকে কষ্ট বেশি দেখে চাকরি ছেড়ে ঘরেই টিউশনি করতে শুরু করল।
সরকারি স্কুলের চাকরির জন্য টেটে পরীক্ষা দিয়েছে। ভাগ্যে কী আছে কে জানে। কিন্তু
আমি যে ওকে পড়াশোনা করাতে পেরেছি, এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।
বর্তমান অবস্থায় আমাদের ঘরটি খুবই ছোট। টিউশন করার জন্য পৃথক একটি ঘরের প্রয়োজন
ও আমাকে প্রায়ই বলে। তাই ভাবছি, আগামী মাসে ওর সুবিধা মতো
নতুন একটি ঘর দেখব।
বর্তমানে
আগের থেকে আমার উপার্জন ভালো। এখন আমার পাঁচটি রিকশা। আমি একটি নিজে চালাই।
বাকিগুলি ভাড়াতে খাটে। ও আমাকে মাঝে মাঝে 'আপনাকে রিকশা
চালাতে হবে না' বলে কপট অভিমান করে। যদিও আমি শরীর-স্বাস্থ্য
ভালো থাকা পর্যন্ত রিকশা চালানো ছাড়তে পারবো না বলে বলে দিয়েছি। দিদিভাই, এই রিকশাই আমার জীবনের রথ। জীবনরথের চক্র।
যতই তার কথা শুনছি ততই আমার ভিতরে ওর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছিল। এই সমাজেই বড় হয়ে দেখেছি - একটি মেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় সবদিকে এগিয়ে গেলেও কিছুসংখ্যক পুরুষ বিয়ে করে ঘরে আনার পরও নারীটিকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে করে সেই নারীর সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, যাবতীয় প্রতিভা বাবা-মায়ের ঘরে বিসর্জন দিয়ে স্বামীর চৌহিদ্দিতে ধন-দৌলতের মাঝে আবদ্ধ করে রাখে। আমার 'পত্নী' যখন তখন আমার মতো সবকিছু হতে হবে বলে দাম্ভিকতা দেখায়। এমন শিক্ষিত একদল স্বামীরূপী দাম্ভিক পুরুষকে আমার একদম সহ্য হয় না। আজকের তারিখে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে একজন নারীর জীবন বিবাহের বন্ধনে দুর্বিসহ করা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষদের জন্য এই 'নাথ' উপাধিধারী রিকশাচালক অনুপ্রেরণা হোন।
গন্তব্য
স্থানে পৌঁছতেই আমি ওকে ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। ওকে বললাম,
"ভাই, তোমার প্রতি আমি আসলে কী ধারণা
পোষণ করছি তা জানানোর মতো ভাষা আমার কাছে নেই। তোমার কাহিনি সমাজের জন্য একটি
প্রেরণামূলক বার্তা। আমি তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব? এই যে
তোমার সাথে আমার আলাপ হল, এই সময়টুকু আমার জন্য অতি সুখের
সময়। একটি কারণে ভালো লাগল যে, যান্ত্রিকতার যুগেও আজকের
দিনটি অন্তত অকৃত্রিম একজন মানুষের জীবন পরিক্রমার বর্ণনা শুনে আমি ধন্য হয়ে গেছি
। তোমার পরিবারে আরও ভালো হোক। তুমি কিন্তু তোমার রথে চড়ে সেই অর্থপূর্ণ গানটি
সর্বদা গাইবে। একদিন বাবা-মা'র কাছে যাবে। ওনাদের পুরোনো সেই
স্বাভিমান ও অভিমান এখন নিশ্চয় কমেছে। ওনাদেরও বয়স বাড়ছে। তোমাকে দরকার
ওনাদের।"
ওর
চোখ দু'টি অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠল। দুই হাত জড়ো করে বলল, 'নিশ্চয়
যাব দিদিভাই, আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি। রিকশাচালক হয়ে এত বছর
কাটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু এত আন্তরিকভাবে আমার সাথে আলাপ করা
বোধহয় আপনিই একমাত্র ব্যক্তি। তাই, আমি আজকে মন খুলে আপনাকে
সব কথা কেন বলে ফেললাম, তা আমি নিজেই জানি না। আজ আমার বুকটা
খুব হালকা লাগছে। আপনিও সর্বদা কুশলে থাকবেন। আমি কিন্তু আপনাকে মনে রেখে দিলাম,
কোথাও দেখা পেলে ডাক দিব দিদিভাই।"
একটু হেসে তার থেকে যদিও বিদায় নিলাম, ওর কথাগুলো কিন্তু দুইদিন পর্যন্ত আমার মনের ভেতর বারংবার ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল।
এই লেখকের আরও লেখা...
0 Comments