সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে কবিখ্যাতি পান হেলাল হাফিজ। যখন সময়ই অনেকটা হাত ধরে কবিতারঅঙ্গনে কবিদের প্রতিষ্ঠা করেছে। তারপর তাঁকে আর হোঁচট খেতে হয়নি–পাঠকের কাছ থেকে দূরে থাকতেহয়নি। বরং পাঠকই তাঁর দোরগোড়ায় গেছে–বার বার কড়া নেড়েছে তাঁর চৌকাঠে। তিনিই বরং অবরুদ্ধথেকেছেন নিজের গড়া গোপন কুঠুরিতে। পালিয়ে বেড়িয়েছেন জীবন থেকে–কবিতার কাছ থেকে–পাঠকদের কাছ থেকে। তবু পাঠক তাঁকে পালাতে দেয়নি–হারিয়ে যেতে দেয়নি। উষ্ণতাদায়ী ওলেরসোয়েটারের মতো আগলে রেখেছে। আবার সময় তাঁকে নিয়ে খেলেছেও খেলারামের মতো। আর সেইখেলায় তিনি হেরেছেন না জিতেছেন তা তর্কের বিষয়। কিংবা তিনি স্বইচ্ছায় হেরে নিজেকে মহিমান্বিতকরতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায়ও সে ইঙ্গিত পাওয়া যায়,
হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয় তো গিয়েছি হেরে
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।
হেলাল হাফিজকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই অবধারিত ভাবে “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” চলে আসে। চর্চিতচর্বন মনে হয়। উপায়ও নেই। “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” পাশ কাটিয়ে যাবার মতো লেখা তাঁর আছে কি নাসেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। আরও একটা ব্যাপার হলো তিনি স্বল্পপ্রজ–অন্য অনেকের মতো প্রচুরলিখেননি অথবা লিখতে চাননি। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন “যে জলে আগুন জ্বলে” কাব্যগ্রন্থেরআকাশচুম্বী গ্রহণযোগ্যতার পর তিনি আর সাহস করে ওঠতে পারেননি লিখতে। কারণটা ছিল “যে জলেআগুন জ্বলে”কে উৎরাতে না পারার ভয়। অনেকটা হয়তো পাঠকদের অত্যধিক প্রত্যাশার চাপে নিজেরআত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। বর্তমানে তিনি পচাত্তর বছরের জীবন অতিবাহিত করছেন। তবুও সেইপ্রত্যশার চাপ উতরে ওঠতে পারেননি বলেই মনে হয়। অন্তত তাঁর প্রকাশিত “কবিতা একাত্তর” (মৌলিকনয়, প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে পনেরটি নতুন কবিতা যোগ করা হয়েছে) ও “বেদনাকে বলেছি কেঁদো না” সেকথাই বলে।
হেলাল হাফিজকে দ্রোহ ও বেদনার কবি বলে থাকেন তাঁর ভক্তরা। নিশ্চিত ভাবেই তিনি বেদনার কবি-এনিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তাঁর জীবনটাই একটা বেদনা। তাইতো লিখেছেন-দুঃখের আরেক নাম হেলালহাফিজ। কিন্তু কথা হচ্ছে তিনি কি আসলেই দ্রোহের কবি? যতটা না দ্রোহ আছে “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়”তেতার চেয়েও প্রকট ভাবে আছে আকুতি, অনুরোধ, আহ্বান। এখানে দ্রোহের চেয়ে আকুতি যে প্রকট সেটাহেলালের জীবন থেকেও পাওয়া যায়। তিনি ব্যক্তি জীবনে অতটা সাহসী ছিলেন না যে বিদ্রোহ করতেপারেন। কারণ ইকবাল হলের ছাত্র হেলাল হাফিজ পঁচিশে মার্চের রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুর কাছেথেকে যাবার জন্যই ইকবাল হলের নৃশংস পাকিস্তানি হত্যযজ্ঞ থেকে বেঁচে যান। এবং সেখান থেকে বেঁচেনির্মলেন্দু গুণের সাথে জীবন বাঁচাতে বুড়িগঙ্গা পার হন। কার্যত তিনি একটা অতিরিক্ত জীবনপেয়েছিলেন সেদিন। পেয়েছিলেন বলেই তিনি বিদ্রোহ করে সরাসরি সম্মুখ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতেপারতেন। কিন্তু সেই বিদ্রোহের সাহস তিনি দেখানতে পারেননি। না পারাটা যে অন্যায় তেমন নয়। কোটিকোটি মানুষ সেদিন সম্মুখ যুদ্ধে যোগ দেননি। নিরাপদ থেকেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। সেটাস্বাভাবিকও। তাঁর এই নিরাপদ জীবন বেছে নেবার মতোই “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” আমার কাছে নিরাপদআহ্ববান-আকুতিই মনে হয়। তবে সন্দেহাতীত ভাবে এটি একটি রাজনৈতিক কবিতা।
যদিও “নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কবিতার ভাব বা আকুতি কিংবা রাজনৈতিক পরিপক্বতা তাঁর “যে জলেআগুন জ্বলে” কাব্যগ্রন্থের সর্বময় বয়ে নিতে পারেননি। তবুও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কবিতাবইটিতে পাই। সেগুলোতেই বরং কিছুটা বেশি দ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে। এই যেমন “অন্যরকম সংসার” কবিতায় বলেছেন–
এইতো আবার যুদ্ধে যাবার সময় এলো
আবার আমার যুদ্ধে খেলার সময় হলো
এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাবো
এবার যুদ্ধে জয়ী হলে গোলাপ বাগান তৈরী হবে।
আরও ঝাঁঝালো দ্রোহ নিয়ে “অস্ত্র সমর্পণ” কবিতায় বলেন,
যদি কোনদিন আসে আবার দুর্দিন
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙ্গে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।
যেহেতু রাজনীতি হেলাল হাফিজের কবিতার অবিছেদ্য অনুষঙ্গ তাই তাঁর কবিতার পাঠ নিতে সময়বিবেচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত তার কবিতায় ছোট পরিসরে তিনটি কাল বিভাগ পাই। স্বাধীনতাপূর্ববর্তী যেখানে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ ও ‘দুঃসময়ে আমার যৌবন’। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে চুয়াত্তরপর্যন্ত এবং আশি থেকে পরবর্তী। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে কবি ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে ‘নিষিদ্ধসম্পাদকীয়’র মতো জ্বালাময়ী কবিতা দিয়ে কবিখ্যাতি পেলেন–তিনি ঊনসত্তরের অভ্যুথ্যান, সত্তরেরনির্বাচনের অগ্নিঝরা দিন আর স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্বে মাত্র দুটি কবিতা লিখলেন? কিংবা পঁচাত্তরেররাজনৈতিক পট পরিবর্তন থেকে ঊনআশি পর্যন্ত নীরব থাকলেন! ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় যতটাজেনেছি প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত একশত পঞ্চাশটি কবিতা থেকে ছাপান্নটি কবিতা নিয়ে ‘যে জলেআগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থ সাজিয়েছিলেন। ছাপান্নটি কবিতা নির্বাচনের পিছনে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজারবর্গমাইল আয়তনের ধারণাটা মাথায় রেখেছিলেন বলেই কবি জানিয়েছেন। কে জানে হয়তো বাদ পড়াকবিতার মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধ পর্বের কবিতাসহ পঁচাত্তর পরবর্তী কবিতা থেকে থাকবে–যা কবিনিজেই আলোর মুখ দেখাতে চাননি। ‘বেদনা কে বলেছি কেঁদনা’ প্রকাশের আগে ও পরে একাধিকসাক্ষাৎকারে কবি নিজেই বলেছেন অনেক কবিতা আছে যা কোনদিন তিনি আলোর মুখ দেখাতে চাননা। এটা সবার বেলাতেই সত্য। সব কবিতাই আত্মবিশ্লেষণে শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠে না। তাই আরপাঠকের হাতে পৌঁছায় না। তবে সংখ্যার বিচারে নয় বরং গুণের বিচারে যারা বিশ্বাসী তারা বলতে বাধ্যহবেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এবং ‘দুঃসময়ে আমার যৌবন’ কবিতা দুটিই উত্তাল সময় ধরে রাখার জন্যযথেষ্ট। মাত্র পাঁচ লাইনের ‘দুঃসময়ে আমার যৌবন’ কবিতায় দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন,
মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই।
স্বাধীনতা পরবর্তী অধ্যায়ে তাঁর কবিতায় হতাশা দেখি। যে বাংলাদেশ তিনি চেয়েছিলেন, এদেশের মানুষচেয়েছিল–সে বাংলাদেশ তারা পায়নি। সেসময়ের শাসনতান্ত্রিক দেশ পরিচায়নায় কোন কোন সিদ্ধান্তহয়তো তাঁকে বিব্রত কিংবা ক্ষুব্ধ করেছিল। তাই হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়েও তিনি ‘যুদ্ধে যাবারসময় এলো’ উচ্চারণ করেছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতার সময় জমা দেওয়া অস্ত্র প্রয়োজনেঅস্ত্র গুদাম ভেঙ্গে আবার মানুষ হাতে তুলে নিতে পারে। সে যুদ্ধে তাঁকে আত্মাহুতিও দিতে হতে পারে–সেবিষয়ে সচেতন ছিলেন। তবুও তাঁর বা তাঁদের জীবনের বিনিময়ে গোলাপ বাগান তৈরি হবে এটাইচাওয়া ছিল। এবং এই চিরন্তন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত কোন জগত নয় বরং মৃত্যুর পরজৈবসার হয়ে দেশের মাটিতেই গাছ বাড়ানোর চিন্তা করেছিলেন। স্বাধীন দেশে যারা নাগরিক অধিকারপায়নি কিংবা সুস্থ রাজনীতির জন্য যারা মিছিল করেছে তাদের কণ্ঠস্বর তিনি তুলে এনেছেন ‘নিখুঁতস্ট্যাটেজী’ কবিতায়।
অথচ পালটে গেলো কতো কিছু, রাজনীতি,
সিংহাসন, সড়কের নাম, কবিতার কারুকাজ,
কিশোরী হেলেন।
কেবল মানুষ কিছু এখনো মিছিলে, যেন পথে–পায়ে
নিবিড় বন্ধনে তারা ফুরাবে জীবন।
…পতন দিয়েই আজ ফেরাবে পতন।
এক অজানা কারণে পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনা এবং তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তার কলমথেমে ছিল–কিংবা সেই সময়ের কবিতা আলোর মুখ দেখেনি। বছর কয়েক আগে কবির ব্যাধিগ্রস্থ চোখেরচিকিৎসায় স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তহবিল থেকে চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছিলেন। সেসময়তার বিরোধী কিংবা অনিষ্ঠপ্রত্যাশীরা জেনারেল জিয়ার প্রশংসা করে লেখা একটি কবিতা কবির নামেসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন। তবে হেলাল হাফিজ সেটা নিজের কবিতা নয় বলে স্বাক্ষ্যদিয়েছেন। হয়তো তৎকালীন শাসককের স্তুতিগেয়ে লিখিত কবিতাটি তাঁর নয়। কিন্তু এমনও হতে পারেতিনি তৎকালীন শাসকের গুণমুগ্ধ ছিলেন। হতেই পারেন –সেটা দোষের কিছু নয়। অনেকেই ছিলেন।আমি শুধু মেলাতে চেষ্টা করছি সে সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতিগুলো সেকারণেই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে কি না? অথবা তিনি সচেতন কিংবা অবচেতন ভাবে সেসব প্রকাশকরেননি? তবে আশির শেষের দিকে থেকে পরবর্তী শাসকের সময়ে কবিকে সরব হতে দেখা যায়।
পঁচাত্তর পরবর্তী শাসন ব্যবস্থায় তিনি বোধ হয় স্বস্তিতেই ছিলেন অথবা হতাশ হয়ে গিয়ে সব কিছুর ওপরথেকে নিজের অধিকার স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছিলেন। তাইতো ‘ইদানিং জীবন যাপন’ কবিতায় বলেছেন,
আজকাল আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই থাকেন
অঙ্কুরোদগম প্রিয় এলোমেলো যুবকের
অতৃপ্ত মানুষের শুশ্রূষা করেন। বিরোধী দলের ভুল
মিছিলের শোভা দেখে হাসেন তুমুল
… প্রিয় দেশবাসী; আপনারা কেমন আছেন?
অসহায় আকুতি নিয়ে বলেন,
কথা ছিল একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চলিসে বসে বলবেন,–‘পেয়েছি, পেয়েছি।
…ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবেন তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে -বোশেখে ।
তখন সবিতা মিস্ট্রেস কিংবা মনুমিয়ারা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ছাপিয়ে হয়ে ওঠে দেশের প্রতিনিধি। কবিরনিজের আফসোস হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক। আবার তাঁকে বেশ ক্ষিপ্ত হতে দেখা যায়। যখন তিনি উচ্চারণকরেন,
ভোলায়া ভালায়া আর কথা দিয়া কতোদিন ঠগাইবেন মানুষ
ভাবছেন অহনও তাদের ওয় নাই হুঁশ
…রাইত অইলে অমুক ভবনে বেশ আনাগোনা, খুব কানাকানি
আমিও গ্রামের পোলা চুতমারানি গাইল দিতে জানি।
অথবা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে আক্ষেপের সুরে বলেন–
স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না
যেমনটা বলেছিলাম, ক্ষমতার পালাবদলে তিনি আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন,
আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁঠ নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোন সে রকম পোষা পাখি নাকি?
‘লাবণ্যের লতা’ কবিতায় বলেন,
দুরভিসন্ধির খেলা শেষ হয়ে কোনোদিন
দিন যদি আসে, এই দেশে ভালোবেসে বলবে মানুষ,
অনন্বিত অসন্তোষ অরাজকতার কালে এসে
লাবণ্যের লকলকে লতা এক খুব কায়ক্লেশে
একদিন তুলেছিল বিনয়াবনত মাথা
এতোটুকু ছিল না দীনতা।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দেখে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন,
তুমি কে হে?
সোনালী ছনের বাড়ি তছনছ করে রাতে
নির্বিচারে ঢুকে গেলে অন্দরমহলে
বেগানা পুরুষ, লাজ-শরমের মাথা খেয়ে
তুমি কে হে?
হেলাল হাফিজ বোধহয় চেয়েছিলেন প্রেমের কবিতা লিখতেই। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন এবং স্বীকারকরেছেন শেষ পর্যন্ত প্রেমের কবিতাই টিকে থাকবে। হেলাল হাফিজের প্রেমের কবিতা মূলত বেদনারকবিতা। মানুষের সাথে পোশাক যেমন অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকে–হেলালের প্রেমের কবিতার সাথে বেদনারসম্পর্কও তেমন অঙ্গাঙ্গিক। স্নানঘরে পোশাক খোলে একপাশে রাখলে যেমন আদিম অকৃত্রিম মানুষকেপাওয়া যায়, তেমনি হেলাল হাফিজের কবিতার প্রেমের আবরণের ভিতর বেদনার অকৃত্রিম দেহ পাওয়াযায়। বেশির ভাগ জুড়েই সে দেহ হেলেন আর বাকিটা তাঁর একাকীত্ব। ফলে তাঁর বেদনাগুলো ব্যক্তিকেছাপিয়ে কতটা নৈর্ব্যক্তিক হতে পেরেছে তা প্রশ্ন রাখে। তিনি একটা সংঘাতময় সময়ের স্বাক্ষী হয়েছেন–মানুষের কান্না, অভাব, মৃত্যু, ক্ষুধা, দারিদ্রতা, জরা চারিদিকে জাল বিস্তার করেছিল। সেই অর্থে সেই বৃহৎজনগোষ্ঠীর বেদনা তাঁর কবিতায় ওঠে আসেনি। ফলে আর্তের-পীড়িতের বেদনার কণ্ঠস্বর না হয়ে হেলালহাফিজের বেদনাগুলো ক্লিসে হয়ে ব্যক্তিক বেদনা হয়েই কচ্ছপের মতো মাথা তুলে থাকে। আবার ডুব দেয়নিজের গহীন ভিতরে।
সম্প্রতি তিনি স্বীকার করেছেন তিনিটি ঘটনা তাকে স্থায়ী ভাবে সংসার বিমুখ করেছে এবং এই সংসারবিমুখতাই তিনি উপভোগ করেন। কিন্তু তিনি কি টের পান তাঁকে নিয়ে তার পরিজনের উদ্বেগ–বেদনা,তাঁর ভক্তকুলের উৎকণ্ঠার তাপ? তাঁর কবিতায় যেমন আপন দুঃখযাপন প্রকট হয়ে উঠেছে তেমনি তাঁরব্যক্তিজীবনের দুঃখগুলোও তুষের আগুনের মতো একাই পোহাচ্ছেন। অথচ একজন সৃষ্টিশীল মানুষদুঃখকে জয় করে নতুনের স্বপ্ন দেখবেন–দেখাবেন। কিন্তু তিনি নিজেই দুঃখের জাহাজ ভাসিয়ে বেদনারগহীন সাগরে নিরুদ্দেশ হয়েছেন–প্রতারণা করেছেন জীবনের সাথে। ঠিক একই ভাবে প্রতারণা করেছেনপাঠকদের সাথেও। তাসের খেলায় তিনটি জোকার নষ্ট হবার কষ্টে যখন তিনি নীল হয়ে বুঁদ হয়ে বিচ্ছিন্নহয়ে পড়েন জগৎ সংসার থেকে, তখন কবিতা তাকে ডাকলেও সে ডাকে সাড়া দেবার স্থিরতা তাঁর ছিলনা। ফলে বঞ্চিত হয়েছে পাঠক–প্রতারিত হয়েছে বাংলা কবিতা। এবং তিনি তা স্বীকারও করেছেননির্দ্বিধায়। বলেছেন, কত দিন কবিতা তাকে টেবিলে ডেকেছে কিন্তু তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসেননি,কবিতা লিখেননি।
ঠিক একই ভাবে তিনি সাড়া দেননি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ডাকে। হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে তিনি কোন টুঁ-শব্দটি করেননি। যে কবি দুঃসময় এলে অস্ত্রাগার লুট করে অন্যায়কে প্রতিহতের স্বপ্ন দেখতেন সে কিনা এমন স্বৈরাচার আর দুঃশাসনে উট পাখির মতো মাথা গুঁজে থাকলেন! শোভাকাঙ্খীরা বলেন, প্রতিবাদ করার মতো শারীরিক কিংবা মানসিক শক্তি হেলালের নেই। কিংবা স্বৈরাচারের দাক্ষিণ্যে চোখের চিকিৎসা হয়েছিল বলে এক প্রকার মৌনতার কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থেকেছেন।
তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে কিছু শব্দ বারবার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যেমন ধ্রুপদী, নষ্ট, কষ্ট, তুমুল। ফলেতাঁর দুঃখনগরীর সৃষ্ট কবিতাগুলোকে একটি থেকে অন্যটি আলাদা করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। পাঠকের মনেহয় যে দুঃখ যাপনের মধ্যে ছিলেন তা এখনও চলমান–নতুন কোন সুর তাদের সামনে আসে না।‘নিরশ্রয় পাঁচটি আঙুল’ পড়লে ‘সোনালি কাবিন’র ছায় পাওয়া যায় কিংবা “পরানের পাখি” মনেকরিয়ে দেয় “পরানের গহীন ভিতর”র ভাব।
যাকে ভালোবাসা যায় তাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়। কবিতা আর পাঠকদের যত অবহেলাই হেলাল হাফিজকরুন না কেন, পাঠক তবু হেলাল হাফিজকেই ভালোবাসেন–জলের আগুনে পুড়েন। যতদিন বাংলাসাহিত্য থাকবে উচ্চারিত হবে কবিতার এ রাজপুত্রের নাম ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র নাম।
লেখাঃ আকাশ মামুন
এই লেখকের আরও লেখা
পিতৃগণ: বাঙালির উৎসমূলের আঁতুড়ঘর
0 Comments