বুট কালাই আর সাদা সাদা আঁকাবাঁকা ঝুরি ধামার ভেতর পাহাড়ের চূঁড়া হয়ে আছে। দুপুর রোদের ঝিলিকে যেন আরো ফর্সা হয়ে উঠেছে ঝুরি। আরেক পাশে গোল মতো লাল বাতাসা আর চিনির হাতি চিনির ঘোড়ার আস্তাবল। কতদিন খাই না চিনির ঘোড়া! আমার ছেলেদের সাঁজের হাতি ঘোড়ার দিকে কোন উৎসুক্য নেই। অথচ আমাদেন ছেলেবেলা ছিল এমনই যে মেলা থেকে গুড় বা চিনির হাতি ঘোড়া কিনে চাটতে চাটতে বাড়ি যাওয়া—এক্কেবারে কামড় যেন না পড়ে পাছে শেষ হয়ে যায়!
চরণতলার মেলা—এই উত্তর জনপদের প্রাচীন ও বৃহৎ মেলা। সাকিন বিষ্ণুপুর। গুণে গুণে কাগজ কলমে মেলার বয়স একশত সাত। কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলেন। বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রথম মঙ্গলবারে মেলায় যাই রে চরণতলার মেলায় যাই রব ওঠে।
এ তল্লাট এক সময় ছিল আদিবাসী পাড়া। কৃষি প্রধান। মূলত ধানের জমির বিস্তার মাইলের পর মাইল। অন্য ফসল যে হয় না তা কিন্তু নয়। গারো উপশৈলের পায়ের পাতা হবার কারণে উত্তরের যে কোন জায়গা থেকে খাড়ামুড়া-বিষ্ণুপুর একটু উঁচু। সোমেশ্বরী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে রানীশিমূল ইউনিয়ন। জমির উর্বরতার কারণে এখানে দুই ফসল কোথাও তিন ফসল উৎপাদনে কৃষক পরিবারে নিয়ে এসেছে সমৃদ্ধিরর বাতাবরণ।
দেশভাগ জনিত প্রভাব বলয়ে সিংহভাগ আদিবাসী কাঁটাতাঁরের ওপারে চলে গেছে নানা সময়ে। বিষ্ণুপুর পেরুলে যে খাড়ামুড়া গ্রাম তার পাশে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে সীমান্ত সড়ক। পায়ে হাঁটা পথ। কাজে কাজেই সীমান্ত পাড় হওয়া গেছে সহজেই।
এখন এখানে আদিবাসী হিন্দু মুসলিম সবাই আছে—সবে মিলে এক সাথে থাকি আর এক সাথে ঘরের মতো ঠেসাঠেসি যাপন। একবাড়ির ঘরের চিপা দিয়ে অন্য বাড়ির উঠানে পৌঁছানো যায় সহজেই।
লাগালাগি ঘরের মতো দেখাদেখি চাষের জমিন। আটাশ ধান পেকে নুয়ে আছে। হলদে সবুজে মাখামাখি বেশ বাড়াবাড়ি হলেও কুরুয়া কুড়িকাহনিয়া গ্রামের জমির দশা হয়নি। কাল রাতে শীলা বৃষ্টির দাপটে ফলবতী ধান মাটির সাথে মিশে গেছে। ফলন আর কৃষকের ঘরে উঠবে না।
উত্তর ময়মনসিংহে শুধু চরণতলা মেলা নয় আরো আরো মেলা চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে মধ্য জৈষ্ঠ্য পর্যন্ত কোন না কোন স্থানে মেলা আয়োজিত হয়। যদিও তার প্রভাব ও প্রতাপ কমে গেছে। সুপারমল যেমন টানে তেমন করে মেলা টানে না আজকের প্রজন্মকে।
ততোদিনে বোরো ধান কাটা-মারাই সারা। ফকফকা উঠানে মোটা পরত নিয়ে নয়া ধান রোদ মাখে গায়। ধান গোলায় উঠার আগেই উদলা আবাদী জমিনে সামিয়ানা টাঙানো সারা। মাঠে তখনো কর্তিত মোথার কোমর শক্ত। সেখানেই অনেক খানি জায়গা জুড়ে মেলা তাঁর ডানা মেলে বসে।
নালিতাবাড়ি'র অষ্টমী স্নানকে কেন্দ্রে রেখে মেলার যে ঘনঘটা গত শতকের আটের দশক পর্যন্ত দেখেছি এখন আর নেই। শুধু স্নানটুকুই রয়ে গেছে সলতের বুক পুড়ে মিটিমিটি আলো দেবার মতো। আনুষ্ঠানিকতা আছে উদ্দীপনা নেই—অথচ কালীবাড়ি গুদারা ঘাটের প্রশস্ত সাদা মোটা বালিতে পূর্ণার্থীরা জড়ো হবার আগেই তারাগঞ্জ বাজারে পসরা সাজিয়ে বসে গেছে নানা ব্যবসায়িরা।
বক্মীগঞ্জে বৈশাখী মেলার বিস্তার অন্য যে কোন জায়গায় থেকে বেশিই। সংখ্যা ও বৈচিত্রের দিক দিয়েও। অষ্টমী স্নানের ভোর থেকে শুরু হয়ে পুরো বৈশাখ জুড়ে মেলার মৌসুম। বোরো মৌসুমের ফসল ঘরে উঠলে কাঁচা পয়সা পকেটে আসে। উদ্দাম আর প্রয়োজন একসাথে চলে তখন।
বক্মীগঞ্জের উত্তর পশ্চিমে দশানী নদীর জলে পূর্ণার্থীরা স্নাত হতে না হতেই মেলা বসে যেত সারমারা বাজার জুড়ে। অপ্রশস্ত দশানী নদী যমুনার একটি শাখা নদী। ছোট্ট ক্ষীণধারা। বাজারে গভীর রাত অব্দি হ্যাজাক আর ভোগাবাতির আলোয় চলত মেলায় বেচাকেনা। গমগম করত করতে মেলার বুকে পিঠে ডাক উঠে যেতো। চারিদিকে লোকারণ্য। ইলেকট্রেসিটির আলোর প্রকোপ বাড়তে বাড়তে মেলার নিজস্ক আলো কমতে কমতে সে এখন দশানী নদীর মতোই ক্ষীনধারা।
আবার দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ব্রহ্মপুত্রের উগড়ে দেয়া বালির বিস্তারে গড়ে উঠেছে টুপকারচরসহ এই তল্লাটের বসতভূমি। ব্রহ্মপুত্রের সোঁতা থেকে একটা ক্ষীন শাখা টুপকার চর পেরিয়ে মেরুরচর হয়ে কল্কিহারা হয়ে দশানীতেই পড়েছে সে জলধারা। গতি নেই। খালের মতো নদী। লাফ দিয়ে ড্রেন পারাবারের মতো। কোথাও আবার পলি আর দোঁআশে জমা চরে বেড়ে উঠেছে নানা আবাদ।
এখানেও অষ্টমী স্নানের ঘাট। বেশ পুরানো। বছর বছর শুধু ঘাট সরে যায়। নাব্যতা হারিয়ে এমনই অগভীর হয়ে গেছে যে জলে দাঁড়িয়ে আঁজল ভরে জল তুলে তুলে মস্তক ভেজাতে হয়। গা ডুবে না।হাঁটু ডুবে। এমন জলেই প্রাত্যহিকতা এমন জলেই ধর্মিককৃত্য।
ক্ষীনধারা হলে কী হবে বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রের জলের দাপটে সব একাকার। কুল নাই কিনার নাই অবস্থা তখন। দূরের দেয়ানগঞ্জেরর ঘাট হয়ে যায় টুপকার চরেরর ঘাট। কোথাও আর চরের ভাঁজ পাওয়া যায় না। সব চিহ্ন একাকার। চৈত্রের মেলা এখানে আর বসে না। বাজারে বসলেও মুদি দোকানের পাশে শোভা পায় অল্প কিছু হাতি ঘোড়ার সাঁজের ঝাঁকা।
বৈশাখের তের দিন পাড় হবার পর প্রথম রবিবার বা বৃহস্পতিবারের ভেতর যে দিনই আসুক কেন সেই দিন বসে জামাই মেলা। যদি রবিবার আসে সেদিনসহ বৃহস্পতিবার বা উল্টোটা—দুই দিনই বসে জমজমাট জামাই মেলা; বক্মীগঞ্জের পূর্ব দক্ষিণে চরকাউরিয়া ভাটি পাড়ায়।
ততোদিনে বোরো ধান কাটা-মারাই সারা। ফকফকা উঠানে মোটা পরত নিয়ে নয়া ধান রোদ মাখে গায়। ধান গোলায় উঠার আগেই উদলা আবাদী জমিনে সামিয়ানা টাঙানো সারা। মাঠে তখনো কর্তিত মোথার কোমর শক্ত। সেখানেই অনেক খানি জায়গা জুড়ে মেলা তাঁর ডানা মেলে বসে।
পরিবারগুলো তখন উৎসবের তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ অবস্থা। জামাই মেলা শত বছরের পুরাতন মেলা। রেওয়াজ এখনো আগেরই মতো।হোক সে নয়া জামাই বা পুরাতন-জামাই জামাই-ই। অন্য সময় আসলে আসুক বা না আসুক—এই মেলা উপলক্ষে জামাই নিমন্ত্রিত হয়। এই সময় জামাই বিশেষভাবে বরণীয়।
এই বরণ পারিবারিক বন্ধনের গিঁটগুলো মজবুদ করে। মেলা সেই বন্ধণের ব্রীজ-শুধু পারিবারিক নয় সামাজিক সাংস্কৃতিকও বটে। আর অর্থনৈতিক যোগসুত্রতা তো আছেই। মেলার দিন আর বক্মীগঞ্জে হাটবার দিন একই দিন হবার কারণে জামাই মেলার অপেক্ষা সকলের কাছে একদা দারুণ প্রতীক্ষার প্রহর গোনার মতো ছিল। এখন সেই মেলার প্রভাব অনেকটা কমে গেলে জামাই বরণের রেওয়াজ রয়ে গেছে ষোল আনা।
আখড়া বাড়ির মেলা নামেই মেলা। কিংবা বলা যেতে পারে প্রাচীনতার সৌরভ নিয়ে মানুষের স্মৃতিতে আজো আছে। শুধু নাম পাল্টে গেছে—এখন জিন্না বাজার বলেই মানুষজন চেনে জানে। এই বাট্টাজুড়ের আখড়া কবে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা এতোদিন বাদে আর জানার উপায় নাই। তেমনি খনচে পাড়ার মেলা কাকিলা কুড়ার মেলা।
শিব বাঙালির ঘরের দেবতা। কাছের মানুষ। শিবের কাছেই দাবী দাওয়ার নানা মানত। শিব স্বাভাবিক বিশুদ্ধতার প্রতীক। উৎপাদনমুখীতা সাথে তার গাঁটছড়া বাঁধা। কৃষিতে বাড় বাড়ন্ত এই প্রান্তিকে শিবের থান থাকবে না—শিবের মেলা হবে না—তাই কি হয়?
শিব গৌরির সাধনা বাঙলির যোগলের সাধনা। অর্ধনারীশ্বরের সাধনা। পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে এই সময়ে শিব-গৌরি আসে ঢাক ঢোল কাঁসর পিটিয়ে। গায়ে কালি ঝুরি মেখে শালু কাপড় পেচিয়ে ত্রিশুল নিয়ে ঢুকে পড়ে জটাধারী শিব। গৌরিও পিঠে চুল ছড়িয়ে মাথায় চূঁড়া নিয়ে গেরস্থের উঠানে ডমরু বাজিয়ে ত্রিশুল উঁচিয়ে পায়ের পরে পায় দিয়ে বৃত্ত এঁকে ঘুরে ঘুরে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের নৃত্য করে। গৌরির সাজ সাজে পাড়ারই কোন যুবক। টানাটানা কাজল দিয়ে আর শনের গোছায় কালো রঙ মাখিয়ে।
বৈশাখে প্রথম সপ্তাহেই বসে শিবের মেলা। লোকে বলে শিবি মেলা বা শিব ডাঙির মেলা। বক্মীগঞ্জের পশ্চিম ঘোষপাড়া ঢুকবার সময় যে উঠানের মতো প্রশস্ত জায়গা সেখানেই মেলা মেলা কিছু নিয়ে বসে। শত বছর ছাড়িয়ে গেছে বটে—তবে সেই জৌলুস নেই। মেলার শরীরে এখন কলঙ্কের দাগ। মেলায় চেয়ে জুয়ার আসরই জমজমাট। এক কাঁটা চরকি ঘুরানো খেলা কিংবা নির্দিষ্ট সামগ্রির উপর রিঙ ছুঁড়ে দিয়ে ডাবল টাকা অর্জন ইত্যাদি জুয়া মেলার গৌরবকে পদদলিত করে তুলেছে।
এমনটা ছিল না একদা। নানা কারনে সরে গেছে স্থানিক মানুষ। যারা এই বারোয়াড়ি শিরেব মেলা আয়োজন করতো তারা স্থানচ্যুত। স্থানিকের চিহ্ন কালের দাপটে ক্ষয়ে গেছে। একরূপতার বয়ানে স্থানের যে সৌন্দর্যরূপ হারিয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের জলে । ঘোষপাড়ায় অতীত ফটোগ্রাফ শব্দে তুলে এসেছেন গত শতকের কবি সুহৃদ জাহাঙ্গীর।
বংশী পাড়ার বুড়ো বটগাছটার কথা আজো মনে পড়ে
আমূল উৎপাটিত সেই বটোচ্ছায়া আজো
আবাল্য স্মৃতির আস্তিনের মতোন জড়িয়ে
রাখে সমগ্র বোধের শরীর।
এখনো দেখি
দাসপাড়া-গোয়ালপাড়ার মধ্যবর্তী
উঠোনের সমান ফসলের মাঠ শরতের ভুঁই,
অম্বিকাচরণের শনক্ষেত। নীলকান্তেন বিল
কায়স্থদের শ্মাশান,গেন্দুদাসের ভিটা
সমন্বিত বিরানভূমি যেন।
পৌষ পার্বনের সারা নেই
মুড়ি মুড়কির বাতাসা নেই
নাড়কেল নাড়ু মোয়া বিলানোর ধুম নেই
দই চিড়ার নেমন্তন্য নেই
সাঁঝ সকালে তুলসী তলায় উলুধ্বনি শঙ্খবাজা নেই
রাত বিরাতে কালীঘরে সমস্বরে কীর্তন গীত
বউ ঝিদের আরতি নেইঃ আজ এখানে
স্বজনহীন এই বাস্তুভিটায়
মঙ্গল মৃদঙ্গ আর বাজে না মন্দিরা
(জলের আগুনঃ মঙ্গল মৃদঙ্গ আর বাজে না)
তিল, তিসি, শর্ষে, ধনে আর কাউনের চাল এই চরাঞ্চলের ফসল। হাটবার ছাড়াও মেলা এই সমস্ত পন্য বিক্রির যথার্থ চাতাল। সারা বছরের হলুদ মরিচ যে কোন গেরস্থের দরকার। মেলা তাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ বয়ে আনে। দমে সস্তা। মানে ভালো। বছর পনেরোর আগে আমি এমনই এক মেলা থেকে হলুদ আর মরিচ কিনেছিলাম এক পাল্লা করে। সারা বছরের খোরাক। হলুদের রঙ টকটকে। ঝোলে বা ভর্তায় মরিচের ঝাঁঝ মস্তকে ধরে। বক্সিগঞ্জে এই নানা ধরনের সংখ্যাধিক্য মেলা হবার কারণ বোধ হয় এটিও একটি।
গড় জরিপার কালীদহ সাগর এই তল্লাটে বিখ্যাত জলাশয়। নানা উপকথা জড়িয়ে আছে এই কালীদহ আর চাঁদ সওদাগরের নিয়ে। যতটুকু না ঐতিহাসিকতা তার চেয়ে অধীক জনবিশ্বাস। মানুষের যাপনের সাথে জড়িয়ে ছড়িয়ে থাকে জনবিশ্বাস। পরম্পরায় গড়ায় সেই স্মৃতি ও শ্রুতি।
কালীদহ সাগর কোন সাগর নয়—মস্তবড় দীঘির নাম। কালীদহ সাগর মানুষের মুখে মুখে স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। জনপদে মস্ত দীঘিই ছিল পানীয় জলের উৎস। উদাম জলে বিশ্বাস রেখেই মানুষ যেমন স্নাত হতো তেমনি গেরস্থ কর্মের নানা কর্মাদি সম্পন্ন করতো তেমনি তেষ্টাও মেঠাতো।
এমন জলের উপর মানুষের আর বিশ্বাস নেই। কী করে যেন হঠাৎ পুকুর নদী কুয়োর জলের উপর সকল বিশ্বাস ভেঙে গেল হুড়মুড় করে। নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেল। জলাশয় পুকুর হয়ে পড়ল হেজেমজে যাওয়া ডোবা আর কুয়ো বা ইন্দিরা পরিত্যাক্ত হয়ে গেলো নিমিষেই। জলের জন্য নতুন বিশ্বাস রাখলাম মিনারেল ওয়াটারের উপর। আমি আপনি এখন পানি কিনে খাই। লিটারে হিসাব কষে। ব্র্যাণ্ডভেল্যু দেখে।
কালীদহের ব্যাপ্তি আর নেই। মজে গেছে। কাছাড় থেকে একটু দূরে লতাগুল্মের উঁচু মাটির ঢিপি। এখানেই এসে নাকি চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা আটকে গেছিল। বড় নৌকার মতো ব্যাপ্তি নিয়ে উঁচু ঢিপি। উঁচিয়ে থাকা নৌকার লগুয়ের মতো একটা ভাঙা কাঠও নাকি কেউ কেউ দেখেছে। জনবিশ্বাস তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। জল যতই বাড়ুক—সেই মাটির উঁচু ঢিপি কখনো ডুবে না। এমন বিশ্বাসের সাথে মানুষের গাঁটছড়া।
সেই কারীদহে চৈত্র মাসে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে স্নাত হতে আসে পূর্নার্থীরা ।পুরোহিতের উচ্চারিত সংস্কৃত শ্লোকের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে জলে অবগাহন করে। লোকে বলে বারুনী স্নান। দেড় শত বছরের পুরাতন স্নানঘাট ও মেলা। যদিও পূর্ণার্থীর সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে মেলার বিস্তার। কাছার জমি দখল।দীঘির অগভীরতা তলানিতে। ধর্মিক বিশ্বাসের অবনমন নাগরিক ব্যস্ততা ইত্যকার নানা কারনে বারুণী স্নান ও মেলা ভাটির দিকে।
স্নানে শুধু গা ভেজানো নয়। উদ্দেশ্য পাপ মোচন। পূর্ব পুরুষের প্রতি গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজাচার করে তাদের আত্মার শান্তির জন্য দু'হাতের আাঁজলা ভরে জল নিয়ে তর্পন। এ ছাড়াও ব্যক্তি মনের কুটিলতা সংকীর্ণতা দূর করবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
২
ব্যক্কি বিচ্ছিন্ন যুগে সকলে মিলে সকলের সাথে একই জলে স্নাত হওয়া সামাজিক যৌথতার চিহ্ন। একদিকে যেমন সামাজিকতা তেমনি প্রাকৃতিকতাও বটে। বহবান জলের সাথে জীবনের বহমানতার গাঁটছড়া বন্ধন। ব্যক্তি ও তার জীবনাচার একাকী জীবনের তলানিতে এসে ঠেকেছে। যেন অপরের সাথে তার কোন বন্ধন নেই। একাকী জীবন খুপড়িতে যাপন। নদীও তার নাব্যতা হারিয়ে নিজের জলে আটকে রেখেছে নিজেকে। নদী ও জীবন দুই-ই বহমান। দুই বহমানই জীবন ও যাপনকে সুন্দর করে।
আধুনিক মানুষ শুধু নদী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। প্রকৃতি থেকেও। প্রকৃতিকে ভেবেছে অপর সত্তা হিসেবে। যাকে ভোগ করা যায়। ধংস করা যায়। চারদিকে নদী বন পাহাড় ধ্বংসলীলা সে মূলত নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকৃতিকে বোঝার কারনে।
মানুষ যে নিজেই প্রকৃতি সেই সংযুক্ততা সে হারিয়ে ফেলেছে ব্যক্তিবোধের স্বাতন্ত্রতার দাপটে। পল্লবিত জীবনের চেয়ে তার লক্ষ্য টাকায় টাকা আনে সেই লক্ষের দিকে।
অষ্টমী স্নানঘাট সেই বহমানতার চিহ্ন। খ্রিষ্টীয় "পাপ" ধারনা দিয়ে সসনাতনীরা অষ্টমী স্নানকে বুঝেছে 'পাপ মোচন' স্নান বলে। বহমান জলে যৌথ স্নানে সামাজিক গুরুত্ব আছে। তার সাথে পাপ মোচনের ধারনা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূর পারলৌলিক ধারনার আধখেচরা মিল মাত্র।
পণ্য বিনিময় যুগে তো বটেই মূদ্রা ব্যবস্থার প্রাথমিক যুগে নদীকূলবর্তী তীরই ছিল পণ্য বিনিময়ের চাতাল। যে চাতাল ছিল প্রয়োজনীয় পন্যের আদান প্রদানের একমাত্র পরিসর। "পাপ" মানে পালকের পালিতা। উৎপন্ন পণ্য বা উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ ভাবে বিনিময় করতে না পারলে সেই পণ্য পালকের কাছে বোঝা হয়ে যায়। বহমানতা স্তব্ধ হয়ে যায়। স্নান ঘাটে সেই পণ্যে বেচাকেনার মধ্য দিয়েই যে মূদ্রা অর্জিত হয় তাই তার পূন্য। পণ্য বিক্রির পূণ্যফল। সেই মূদ্রাই পণ্যের মালিকের জীবন যাত্রাকে বহমান করে।
পাখি উড়ে গেলে যেমন ছায়াটা মনের ভেতর গেঁধে থাকে তেমনই সেই সামাজিকতার শর্ত সরে যাবার কারণে অষ্টমী স্নান খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে গেছে পাপমোচনের স্নান। সামাজিক কর্ম যজ্ঞই সকল ভাব ভাবনার উৎস স্থল। আঁতুর ঘর। সেই সামাজিকতার দিকটি ভুলে গেলে সে আচার আচরণ জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেটি জমা হয়।পারলৌলিক জনবিশ্বাসে। সামাজিক কর্মযজ্ঞের কারণেই সমাজের উপরি কাঠামো গড়ে ওঠে। গড়ে উঠে রীতি নীতি। অষ্টমী স্নান সেই আচার আচরনের ক্ষয়িষ্ণু ধারা।
চরণ চরণে যা চলে তাই তো আচার আর আচরণ। উৎপাদন ব্যবস্থপনা ছাড়া কোন আচারকেই বোঝা যাবে না। প্রত্যেকটা আচরণের যেমন উদ্ভব শর্ত থাকে তেমনি থাকে তাঁর বিকাশমান অবস্থা একই সাথে তার বিলয় হবার শর্তও থাকে।
যে চরণতলার মেলায় আজকে এসেছি তাকে কেন্দ্রে রেখে আছে নানা লৌকিক অলৌকিক কথাবার্তা। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা দ্বারা আমাদের আজকের নাগরিক জীবন পরিচালিতা; অর্থব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত জীবন।
বাঙালি যে উৎসব পার্বণ তা স্থানিক পঞ্জিকা দ্বারা জীবন ও জীবনাচার পালিত হয়। সেখানে গ্রহ নক্ষত্রে সাথে নানা তিথি কালবেলা মাহেন্দ্রক্ষণের মেলামেলির জীবন। মেলাগুলোও সেই তিথি মেনে চলে। জীবন যেহেতু মহাজীবন ব্রহ্মাণ্ডের সাথে যুক্ত সেহেতু নানা পার্বণ তাকে লক্ষ রেখেই ঠিক হয়। এই যেমন চরণ তলা মেলা। শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের তিথিতে আয়োজিত হয়ে আসছে।
ভিড় ঠেলে ঠেলে এক মাথা রোদ নিয়ে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বড় চাতাল ঘুরে ঘুরে দেখলাম মেলার সৌরভ। মেলার গৌরব। মেলার শরীরে নানা রঙ নানা বিভাব। ঢাকিদল ঢাকের তালে যৌখ কোরাস তুলছে মেলা ঘুরে ঘরে ঢাক কাঁধে করে।
মেলার চারদিকে মেলা কিছু। ডুগডুগি, মুখোশ, কুশন মাটির গয়না মাটির ট্যাপা পুতুল ছৈ তোলা নৌকা শিশুকোলে দাঁড়িয়ে থাকা মেটে রঙের পুতুল, কোনটা লালচে খয়েরি বা সাদা লালে ডোরা কাটা পুতুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানী।
আবার স্থানিক কারিগরের হাতে লাল রঙের রসে ডোবা গোল্লা খাজা গজা নিমকিগোল লাল বাতাস চিনির হাতি ঘোড়া খুড়মা সুজির হালুয়ার সামিয়ানা টাঙিয়ে এক দিন একরাতের দোকান। কী নেই মেলাতে! কাঁচা বাঁশের বেত চিরে চিরে বানানো ডালা চালুন কুলা—সন্তান কাঁখে করে রাখা একজন নারী কুলা দেখছে আর গুনছে গুনা বাঁধা তার—রাম লক্ষন সীতা—রাম লক্ষন সীতা আর রেখে দিয়ে আরেকটা গুনছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো কুলার 'বাইন' ভালো না।
কেন?
যতবারই গুনছি সীতায় গিয়ে ঠেকছে।
তাতে কী?
সীতাতে বাইন থামলে সংসার চিতায় যায়।
সীতাতে থামে যে বাইন সেই কুলা ভাল না। অমঙ্গল হয়। যেই বাইন গুনতে গুণতে রাম বা লক্ষণে পড়ল তখনই সদ্য সংসার শুরু করা মহিলাটি দাম দিয়ে কিনে নিলেন কুলা।
সংসার বুঝি এমন নিয়মে বাঁধা? কে জানে? ভাবতে ভাবতে ভিড় ঠেলে যেতে যেতে কত মানুষের সাথে চোখাচোখি হলো। ক্যামেরা তাক করার সাথে সাথে আঁচলে মুখ ঢেকে মিশে যায় মানুষের ভিড়ে। ভিড়ের ভেতর হাজং, গারো, হদি, রাজবংশী, বৈষ্ণব, শাক্ত, বাউল, কৈবর্ত, বর্মন, কাপালিক আর দলিত—কেউ বাসফুর সম্প্রদায় কেউ হরিজন সম্প্রদায়েরসহ আরো যাদের সাথে মোলাকাত হলো তারা হলো মুসলিম, পীরের মুরিদ, নারী, হিজাব পরা নারী, ফকির তান্ত্রিক কবিরাজ ভবঘুরেসহ বারো রকমের মানুষের মেলা এই চরণতলার মেলায়।
জামই নতুন কী পুরাতন সেটি নয়। জামাই জামাই-ই সামষ্টিকতার অংশই হয়েই মেলা উপলক্ষে জামাই নিয়ে পরিবারে আনন্দে আমোদিত হওয়া।
হিজরাও কম নয়। দলবেঁধে ঢলেঢলে পড়ছে আর মেলায় ঘুরছে। উঁচু নিতম্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে বুকের চূঁড়া আর চুলের খোপা। কথাই তো বলে খোপা যেমন চোপাও তেমন। দুই হাতে টাস টাস শব্দ তালিতে মুখ বাকিয়ে চোপা খুলে আদায় করছে নজরানা। দিবি না ক্যান দিবিই; নইলে দেখবো খেইল বলেই দশ হাত পরনের শাড়ি হাটু অব্দি তুলে ফেলছে নিমিষেই। দোকানিও নজরানা দিয়ে গাহেকের দিকে নজর দিচ্ছে উদোম শরীরে ঘাম মুছতে মুছতে।
স্থানিকের আনন্দ মেলার আনন্দ। মেলাতে মেলা কিছুর প্রাপ্তি যোগের আনন্দ। সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে যে আনন্দ সে আনন্দ মেলাতেই পাওয়া যায়। মেলায় আসা মানুষের বিনোদন নয় আনন্দের দিকেই ঝোক। বিনোদন শুদু ইন্দ্রীয়বৃত্তের বশ করা। আনন্দ রসে বশে থাকে। শরীরে সবশতা যেমন থাকে তেমনি মনের সরসতাও থাকে।
ব্যক্তি পরিবারসহ আনন্দ। একা একা ভোগে নয় পরিবারের সকলকে নিয়ে ভোগ উপভোগ। সকলের আনন্দের সাথে নিজের আনন্দকে একাকার করে তোলা। নকশি'র কোচদের বাস্তু ও কালী পুজা উপলক্ষ্যে আয়োজিত মেলা যেমন যতক্ষণ মেলা ততক্ষণ কোচ নারী পুরুষ বালক সাবালক সকলেই মেলা ঘিরে সারা দিনমাণ কাটে। যৌথ রসে ডুবে থাকে কোচ পরিবার। নৃত্যে যৌথতা গানে যৌথতা একই পঙক্তিতে বসে যৌথ ভোজসভা।
যদিও বছরের শুরুতে বিহু উৎসব ও তার উদযাপনের যে ঘনঘটা ছিল বোরো ধান গোলায় তোলাকে কেন্দ্র করে সংখ্যার চাপে সেই বিহু উৎসব এখন কাগজ কলমে।
জমিই নেই কিসের আবার বিহু উদযাপন। আবার ভাটিয়াপাড়ার জামাই মেলাও তেমনি। সকলকে নিয়ে মেলা পারিবারিক মেলা। সমুহের মেলা। জামই নতুন কী পুরাতন সেটি নয়। জামাই জামাই-ই সামষ্টিকতার অংশই হয়েই মেলা উপলক্ষে জামাই নিয়ে পরিবারে আনন্দে আমোদিত হওয়া।
মেলা উপলক্ষে আয়োজিত কী রামলীলা রাসলীলা যাত্রা কবি গান বা পালাগানের আসর খোলা মঞ্চের আসর। প্রোসিনিয়াম মঞ্চ নয়। নাটুয়ার সাথে দর্শকের সম্পর্ক সরাসরি। যদিও উঠে গেছে সবই। আজকের বাংলা ম্যাাইক্রোক্রেডিট বাংলা আজকের বাংলা ওয়াজিবাংলা। এক কেন্দ্রীয় বাংলা। পুঁজির দাপটে সবই এক রঙের বাগান। বৈচিত্র্য নেই।
মেলার অঙ্গ এক রঙে আঁকা নয়। মেলা মেলার নিজস্বতায় বহু রঙের আধার। বহুকেন্দ্রিক। বহু পরিচয়ে পরিচিত। সে পরিচয়বাদী নয়। সে মেলা কিছু। মেলা বর্ণাঢ্য শলাকার বিস্তার। সনাতন লোকাচার পূজা পার্বন কেন্দ্রে রেখে মেলার বিস্তার ঘটলেই মেলা শুধু সনাতনের থাকেনি। সকলের মেলবন্ধনের চাতাল হয়ে ওঠেছে। আর্থ সামাজিকতার ব্রীজ হয়ে ওঠেছে। সেই পারাবারে সকলের অধিকার। সমূহের মৈত্র স্থাপন।
রথ দেখাও হলো কলা বেঁচাও হলো। একজন হয়তো রথের রথিরে স্রদ্ধাভরে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছে অন্যে শুধু গেছে কলা বেঁচতে। অথবা কেউ হয়তো রথও কলাও বেঁচেছে। আবার কেউ হয়তো বারো রকমের মানুষের তামাশা দেখেছে। মেলা এক রৈখিক নয় বহুরৈখিক বহুমাত্রিক। আজকাল মেলা নিয়ে যারা সংকীর্ণ প্রশ্ন তুলছে তারা হয়তো মেলার বৈচিত্রের দিকটি নজর দেননি। মেলার সৌন্দর্যের দিকে নজর দেননি।
কানেকটিভিটিই প্রোডাকটিভিটি যেমন আজকাল গ্লোবাল যুগের বীজমন্ত্র তেমন আজকের এই ব্যবসা বানিজ্যের গোলকায়ন হবার আগেই এই স্থানিকের মেলাই ছিল সংযক্ততার প্রধান সূত্র। শারীরিক যোগাযোগের চাতাল ছিল মেলা। ছিল স্থানিক ছোট ছোট কারিগর বা উদ্যোক্তা নানা বুদ্ধি খাটিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের কৃৎকৌশল। সচ্ছলতার পথ। হোক টেপা পুতুল কিংবা ঘন বুননের শীতল পাটি অথবা লাল বাতাসা। অথবা কোকা কোলা বিস্তারের আগে নানা ধরনের সরবত তৈরি ও বিক্রি।
একেক জায়গা একেক মানুষের একেক ধরনের সরবত তৈরি করার পরম্পরায় জ্ঞান। কোথাও লেবু পাতা দিয়ে কোথাও গরমের দাবদহে প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রাণের তেষ্ঠা নিবারণের জন্য তেঁতুল দিয়ে বা তোকমা দিয়ে বানানো সরবত।
স্থানিক অর্থনীতির বুনিয়াদ গঠন করে মেলা। মেলাতে মেলা কিছুর সমাবেশ। একরূপতার সংস্কৃতি গ্রামীন অর্থনীতির এই চাতালকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। পুঁজি দাপটে বাচ্চা পুঁজি মৃত। একথা ঠিক পূঁজির প্রকোপে সুপার মল ঝলঝলে জ্বলে উঠছে অন্যদিকে মেলার ঔজ্জ্বল্য মিটিমিটি হ্যারিক্যান বাতি। সকলের বুক পুড়ছে জ্বালানিও তলানিতে। মেলার সংখ্যা ও পরিসর ভাটির দিকে। হারাচ্ছে স্থানিকতার চিহ্ন।
3 Comments
ভালো
ReplyDeleteথরে থরে সাজানো তথ্যে সমৃদ্ধ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দীর্ঘ লেখা। অনেক কিছুই জানতাম না।
ReplyDeleteলেখাটা বেশ দীর্ঘ দেখছি, সময় নিয়ে পড়তে হবে। লিঙ্ক দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete