আমেরিকার উইস্কনসিনে ঈদ ।। রেজা করিম

ঈদের নামাজে অন্যদের সাথে লেখক 

শুক্রবারে ঈদ হবার সম্ভাবনা আছে জেনে আমি ও আমার স্ত্রী জয়া দুজনেই অফিস থেকে আগেই ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম। কারণ আমেরিকাতে তো আর ঈদ উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটির ব্যবস্থা নেই। মেয়ের স্কুলেও জানিয়ে রাখতে হয়েছিল। ঈদ উদযাপন করতে আনুভা স্কুলে যাবে না বলেই স্থির করেছিল। 

আমরা থাকি উইস্কনসিন অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ম্যাডিসন শহরে। রাজধানী হলেও ম্যাডিসন শহর আকারে খুব একটা বড় নয়। এখানে ঈদের সবচাইতে বড় জামাত হয় এলিয়েন্ট এনার্জি সেন্টার নামক একটি মাল্টি-কমপ্লেক্স ভবনে। বাসা থেকে পনেরো মিনিটের মতো গাড়ির দূরত্ব। প্রথম জামাত সকাল সাড়ে আটটায়। আগের রাতে অনীক বলে রেখেছিল, “আপনাদের গাড়ি নেবার দরকার নেই, সবাই মিলে আমার গাড়িতে করে একসাথে নামাজ পড়তে যাবো।”  

দেখতে দেখতে রোজা শেষ হয়ে গেল। সৌদিআরবে ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে ঈদের দিন। সৌদিআরবের সাথে আমেরিকাতে একসাথে ঈদ পালিত হয়। শুক্রবারেই ঈদ হচ্ছে। খুব সকালে ঘুম থেকে আমরা ঈদের নতুন জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিলাম। আমি মেয়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি- দেশের মতো ভিন দেশে ঈদের খুব বেশি আবহ না থাকলেও তার উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। আমার ছোট বেলার ঈদে চোখ থেকে ঘুম চলে যেত। সূর্য ওঠার আগেই হয়তো উঠে যেতাম-কি উচ্ছ্বাস ছিল! মেয়ের মধ্যেও তেমন কিছু লক্ষ্য করলাম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঈদের আনন্দ এভাবেই হয়তো বয়ে যায়-তা সে মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই হোক আর দেশের বাইরে ভিনদেশি সংস্কৃতিতেই হোক। কিছুক্ষণ পর অনীক ও ঝুমুর এলো আমাদেরকে তাদের গাড়িতে তুলে নিতে। তার আগে রোমেল ও শাপলাকেও তুলে নিয়েছে। এক গাড়িতে সাতজন চেপে এলিয়েন্ট এনার্জি সেন্টারের দিকে ছুটলাম।  

পরিবারের সাথে লেখক

দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক না কেন, আমার কাছে ঈদের সবচাইতে আনন্দময় পর্বটি হলো সকালে সবার সাথে ঈদের নামাজ পড়া। তবে, আমেরিকাতে ঈদের নামাজ পড়ার এই আনন্দটা একটা ভিন্ন মাত্রা পায়। এখানে ঈদের জামাতের সময় মনে হয় যেন সমগ্র পৃথিবীর সব মুসলমানরা একসাথে এসে জড়ো হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যআফ্রিকাএশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সবাই এসে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাক পরে আসে–আফ্রিকার লোকেরা আসে চকচকে ঢিলেঢালা পোশাকেআরবের লোকজন আসে গায়ে জোব্বা আর মাথায় কাফিয়া-আগাল পরে, আর ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন আসে তাদের নিজস্ব পোশাক পরে।

তবেএত এত ভিন্নতা আর বৈচিত্র্যের মাঝেও একটা জিনিসের সাধারণত কখনও পরিবর্তন হয় না। সেটা হলো —ঈদের নামাজের সময় আমার দ্বিধান্বিত মন। প্রত্যেক ঈদের নামাজের পুরোটা সময় আমি দ্বিধায় থাকি এই তাকবিরে কি হাত বাঁধবোনাকি ছেড়ে দিবপরের তাকবিরে কি রুকুতে যাবনাকি দাঁড়িয়েই থাকব?

 

নামাজ চলাকালীন পুরোটা সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে ছোট ছোট বাচ্চাদের গগন-বিদারী চিৎকারের শব্দ। আমেরিকার ঈদের জামাতে পরিবারের পুরুষ-মহিলা-শিশু সবাই চলে আসে। বিশাল বড় কক্ষের সামনের দিকে নামাজ পড়ে পুরুষেরা, আর পেছনে মহিলা ও শিশুরা। নামাজ শুরু হলে মায়েরা যেহেতু বাচ্চাদের দিকে নজর দিতে পারে না, ছোট ছোট বাচ্চাগুলো তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে আনন্দ করে।

 

প্রতি তাকবিরের দ্বিধা আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাচ্চাদের উচ্চস্বরে চিৎকারের মাঝেই এক সময় নামাজ পড়া শেষ হলো। খুতবা শেষ হতেই শুরু হলো কোলাকুলি আর ছবি তোলার হিড়িক। কমপ্লেক্সের বাইরের পার্কিং লটে দেখি স্থানীয় এক নিউজ চ্যানেল সবাইকে ধরে ধরে ঈদ সম্পর্কে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। আমাদেরকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো– তোমরা কি কিছু বলতে চাও? আমরা দলবেঁধে ক্যামেরার সামনে চেঁচিয়ে বললাম –ঈদ মুবারক!


ঈদের দিনের বাকি সময়টা কেটেছে ম্যাডিসনে বাংলাদেশি কমিউনিটির সবার সাথে আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় আর খাওয়া-দাওয়া করে। দেশ থেকে বহু দূরেপ্রশান্তের এ পাড়ে। তবুও আপনজনের ছোঁয়া-আবেগ প্রশান্তের ঢেউয়ের মতো এসে মনে আঘাত করে। বিষণ্ণও হয় মন। আনমনে আমার ফেলে আসা শৈশব-দেশ-পরিজনদের কথা বাজে মনের কোণে। স্মৃতিকারত হই। আমার মেয়ে আনুভা হয়তো এসব কিছুই জানে না। করণ তার দেশই তো আমেরিকা। 



Post a Comment

1 Comments

  1. সুন্দর উপস্থাপন ।

    ReplyDelete