চারিদিক খ্যাপাটে অন্ধকার। তিমির কাঁপিয়ে ফুটে উঠছে এক ব্যথানিরোধক চাঁদ। মৃদু হাওয়ায় ভাসছে শিরীষফুলের গন্ধ। দূরের পীতবর্ণের নক্ষত্র থেকে নেমে আসছে শ্রুতিহীন আলোর সংলাপ। চারিদিক বকের পাখনাধোয়া জ্যোৎস্না, হয়তো এমনই কোনো জ্যোৎস্নামুখর রাতে গৌতমী পুত্র গৌতম মহাজীবনের ডাকে ঘর ছেড়েছিলেন, রাজবধূ গোপার হৃৎপিণ্ড পুড়ে গিয়েছিল, তিনি হারিয়েছিলেন তার বুকের নির্জনে লুকিয়ে থাকা আপন পৃথিবী। তারপর কতকাল কেটে গিয়েছে, কত বৃক্ষ স্থবির মুগ্ধতায় ফুটিয়ে চলেছে বিচিত্র পুষ্পরাগ, কত নদী স্রোতভাঙা অলিখিত চুক্তি নিয়ে বয়ে চলছে, ঘটে গেছে বহু নক্ষত্রের ক্ষয় … তবুও পৃথিবীর অনির্বচনীয় প্রেমিকারা সব ভালবেসে ভাঙা হৃদয়ে জাপটে ধরেছে বিষণ্ণ–কুয়াশার গান।
তুমিও চলে গেছ বহুদূর। আমার বুকের শূন্যতা বিন্দুর চেয়ে বড় হতে হতে আজ অসীম আকাশ। তাও ধুলিসম্রাজ্ঞীর মতো আপন রাজ্যেই অধিষ্ঠিত, ভালবাসায় বুঁদ হয়ে আছি। কেননা আমার ভিতরেও আছে নির্জন এক মর্মলোক। যেখানে আছে ছোট্ট এক হর্ষভরা দ্বীপ, দ্বীপের তিনদিকে নিভৃতির সরোবর।
সরোবরের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য সব কিশোর গাছ। যখন সেই সব গাছের পাতায় বিকেলের মৃদুলস্বর্ণছায়া এসে পড়ে মনে হয় তুমি কোথাও কাছাকাছি আছো, তোমাকে স্পর্শ করতে গেলেই খুব কাছে নুয়ে পড়ে এলোমেলো মেঘ, তখন আমার মর্মলোকের দ্বীপ যেন ঝাপসা। তোমাকে হারানোর যন্ত্রণায় আমি হয়ে পড়ি কোনো মীনরাশির জাতক। সরোবরের বিশাল আয়নায় ভেসে ওঠে তোমার মুখ। তখন আমার এই সামান্য শরীরে যেন দোতারার স্পর্শ জাগে। ভুলে যাই বিষণ্ণ মুহূর্তের গল্প, ভুলে যাই তোমার আমার মধ্যেকার পাড় ভাঙার শব্দ, শরবন থেকে ভেসে আসা আহত হরিণীর আর্তনাদ, ভুলে যাই লাঞ্ছিত নক্ষত্রের কান্না। মেঘলা নির্জন এই হৃদয় ঘিরে তখন তোমার সুবাস। আমার চারপাশ অনুভুত হচ্ছে প্রণয়ব্রতের কম্পনে, অথচ তখনও তুমি বোবাধরা এক বিশাল পাথর! মহাস্তব্ধতার ভিতর স্তব্ধ হয়ে আছো। অনন্তে বিস্তৃত হচ্ছে সুগভীর বিষাদের ছায়া, নদী থমকে বিচ্ছেদের অকপট ইতিহাস নিয়ে। শুকনো পাতার মর্মরে ঝরে পড়ছে বিষণ্ণতা। একি! আমার গহনকোণে যেটুকু সুর ছিল পিঁপড়ের নীরবতায় হেঁটে হেঁটে কোথায় চলেছে!
সেসব সারেগামা পেরিয়ে আমার গানের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে চলে যাই সুদূরের লুম্বিনী উদ্যানে! এও কি সম্ভব! লুম্বিনী উদ্যানের সমস্ত বৃক্ষ কী এক ধীর সত্যে নিশ্চুপ! উদ্যান জুড়ে পড়ে আছে অজস্র শুকনো পাতা, তাতে লেগে আছে হাজার হাজার বছরের স্মৃতি–বিস্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। চারপাশে ঘন হয়ে নির্বিকার শূন্যতা। উদ্যানের এক কোণে পীতময় পৃথিবীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে একটি পিত্তল নারীমূর্তি। দু’চোখে নীলব্যথা, কেশবিন্যাসে জড়িয়ে পালি ভাষার হরফ, নখে বিঁধে বিষণ্ণ সব সঙ্কেতচূর্ণ, একটি শ্বেতপাখি সেই নখ থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে নিচ্ছে বিষণ্ণতার ছায়া আর সেই নারীমূর্তি ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছে আনন্দলহরীর তান। চতুর্দিক আলোর রোশনাই। এমন দৃশ্যে আমার শরীর ঝিমঝিম করে ওঠে, এক তীব্র স্ফুলিঙ্গের টানে চেতনা হারাতে হারাতে বলি–
কে তুমি নারী!
কে এই শ্বেত পাখি!
চোখ বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেখতে পাই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ তুমি, হাতে একটি শ্বেত গোলাপ,কী এক সুগন্ধি মায়ায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর, আর সেই শ্বেত পাখিটি কণ্ঠে ‘বুদ্ধ… বুদ্ধ’ ডাক ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে দূরের নির্বিকার শূন্যতার দিকে …
এই লেখকের আরও লেখা...
রাখি সরদারের ধারাবাহিক গদ্য ।। হে আমার রিক্তসুন্দর মাছরাঙা ।। পর্ব-০১
0 Comments