কোথায়? কোথায় আমার
জল-অভিভূত মাছ ! স্রোতের
মোহ ডিঙিয়ে কি কোনো ঘূর্নির
তলে লুকিয়েছো ? নাকি দারুণ
প্রেমে ভেসে গেছো সারসের কামে!
এই সরীসৃপ দেশে কে! কে এমন পাখিস্বরে কথা বলে! তবে কি নিসর্গ আজ লঙ্ঘন করলো যাবতীয় নিয়ম! জলাভূমি ছেড়ে উড়ে আসে মেঘলা আকাশ, কোথাও ঘন্টা বাজছে অনুচ্চস্বরে, বুনো চালতা ফুলের ঘ্রাণ শূন্যতায় ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাস-শরীরে। আমি পাথুরে গর্ত ছেড়ে কোনোরকমে বের হই, তখনও আমার ধূম জ্বর, একদিন হলো খোলস পাল্টে ধূর্ত সমাজে জায়গা পেয়েছি। এর মধ্যেই পাখিধ্বনি! দেখি চেনা নদীর নাভি উপচে থই থই ফেনা, নদী তখন অনর্গল কথাবলা প্রেমিকার মতো উচ্ছ্বসিত। তার বক্ষ ছুঁয়ে থাকা জারুলের ডালে বসে এক নীলকণ্ঠী মাছরাঙা। সেই মাছরাঙাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো দূর অশ্বক্ষুরহ্লদের বাসিন্দা। নদীর জল ছুঁয়ে থাকা জারুল শাখার পাশেই মহাআবর্তের ঘোরে চলে গেছে পাতালের সিঁড়ি, যে পথে ডুবলেই পাওয়া যায় মীনগ্রাম, তপ্তকাঞ্চনবর্ণ প্রবাল সাম্রাজ্য। সেখানেই কি হারিয়েছে মাছরাঙার প্রিয়তমা...
কেন এসেছ হে পাখি এ ফোঁসধ্বনি দেশে! দেখো, থম মেরে গেছে কেমন জলের নির্জন ...
ধ্যানী মাছরাঙা মীনশোকে এতটাই কাতর যে খেয়াল করেনি পিছনে তার রূপোপাড় শাড়ি পরা জোড়াসাপ। আকাশ আজ মিথ্যের সংলাপ! সব গান, সব প্রেম অনন্ত ক্ষুধার মুখে পড়লো বলে, আমার দৃষ্টির ভিতর ভেঙে পড়ছে নিয়তি দেবীর স্নানঘর, খুলে যায় চেতনার পান্থশালা, সেই পান্থশালা লক্ষ্য করে উড়ে যায় সব হারানো মাছরাঙা, পিছে পিছে গান ফুরানো অন্ধকার। এসব দৃশ্য দেখা ছাড়া আমার কোনো জিজ্ঞাসা নেই। কারণ আমি তখন ত্রুটিপূর্ণ এক লালসা-সম্রাজ্ঞী, একমনে নিজস্ব প্রাসাদে এঁকে চলেছি ভোগের ভৈরবীচক্র আর আমার রং, তুলির আধিপত্যের ভিতর ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে যুবক ঈশ্বরের নগ্ন শরীর। রাতভোর বৃষ্টির খবরে নদীর তাবিজ ফেটে বেরিয়ে আসছে ঝড়, মীনকন্যারা এক সুরে পড়ে চলেছে শৃঙ্গারশতকগাথা। রঙের অধিকারে ঈশ্বর তখন উন্মাদ, পরিত্যক্ত কামনায় দেহকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছেন ... আমি সব ভুলে হয়ে গেছি গায়ে গতরে কামোন্মাদ দেবী ...
কে বলে আমি পাপী! পাপের বেসাতি নিয়ে লেখা যা কিছু কবিতা সেসব অপার্থিব আগুন, দহনের ভার গ্রহণ করা অতি কঠিন বলেই এই ব্রহ্মাণ্ড আমার কাছে এক আশ্চর্য দরবেশ ছাড়া আর কিছু নয়। যা কিছু পাপ ও পুণ্য সবকিছু সে দরবেশের মহাঝুলির মধ্যে আনন্দধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে। সে কারণেই মাছ ও মাছরাঙার মধ্যে গড়ে উঠেছে অসবর্ণ প্রেম।
হে পান্থশালার মাছরাঙা, দেখো! দেখো! তোমার সুন্দরতম মাছ আজ কী উজ্জ্বলতায় পাখনার প্রমিতি নিয়ে ফিরে এসেছে! এখনও কী ভয় পাও? দেখো, জোড়াসাপ দুটি আজ তিমিরকুণ্ডের কলসে বন্দী হয়ে ভেসে যাচ্ছে মহাপ্রলয়ের দিকে। বনের উড়ন্ত ব্যাধের তূণীর দেখো গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপে ভরা। এসো, ফিরে এসো হে মৎসপ্রেমী মাছরাঙা...
কোন আঘাতে কে যে ব্যথার ভিতর চূর্ণ হতে হতে হয়ে পড়ে মহারিক্ত তা কেউ জানে না। বিরহী মাছরাঙা সমস্ত অসূয়া ও অভিমান ভুলে কী এক ব্যথিত নিশ্বাসে ছটফট করতে করতে উড়ে যায় বহুদূর চন্দ্রনদীর দিকে, যেখানে কেউ আজ ও অপেক্ষা করে আছে তার বাদামি ওষ্ঠ ভালোবেসে ...
0 Comments