মাহমুদ দারবিশের কবিতা ।। অনুবাদ ।। আবির আবরাজ


 

তুমি যখন তাকাও মনে হয় আমার অন্তরে কাঁটা বিঁধছে

এমন ব্যথা লাগেতবুও সেই কাঁটা এবং ব্যথাটাকেই ভালোবেসে ফেলি

আর তাকে আড়াল করে রাখি হাওয়ার কাছ থেকে

আমি তাকে লুকায়ে রাখি আমার রক্ত মাংসের ভেতর

লুকায়ে রাখিরাত এবং সমস্ত অন্তর্বেদনা থেকে।

আর এর ক্ষতটাই আমার জন্য আলো নিয়ে আসে সমস্ত অন্ধকারে

এই ক্ষতের আগামীটাই জন্ম দেয় আমার বর্তমানকে

এই ক্ষত আর ব্যথা আমার কাছে আমার আত্মার থেকেও প্রিয়


ব্যথা যতোই হোকতা খুব দ্রুতই তা আমি ভুলে যাই

যখনই আমার চোখ গিয়ে ওই চোখগুলির সাথে 

মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়,

ওই সময়টার মতোনদরজাগুলির আড়ালে

যখন আমরা একে অপরের মুখোমুখি হতাম।

তোমার কথাগুলি আমার গান ছিলো

যা আমি গাইতেও চেয়েছি

কিন্তু যন্ত্রণা আমার ঠোঁট আর জবান ঘিরে রেখেছে

আর যেনো গিলে নিয়েছি এমনভাবে 

তোমার শব্দগুলি আমার ভেতরেই থেকে গেছে।

আমাদের ঘরের দরজাগুলি আর আমাদের শরৎকালটাও চলে গেছে

তোমার চলে যাবার রাস্তা ধরে

যেখানে আমাদের আয়নাটা ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছে

তখন দুঃখগুলিও সহস্রতার হিসাব ধরে বেড়েছে

ফলে আমরা শব্দ জমিয়েছি,

জমিয়েছি আমাদের মাতৃভূমির জন্য গাওয়া শোকগাথা থেকে।


একসাথে এই সুরবাহার আমরা আমাদের হৃদয়ে রুয়ে দেবো

আর ওই ছাদগুলিতে যেখানে আমাদের শোকের কাছে এসে তারা গান হয়ে যাবে

যার ফলে চাঁদ ও পাথরের সহজ নৈশব্দগুলি ছিন্নভিন্ন হবে

কিন্তু আমি এখন ভুলে গেছি

এইসব আয়োজন কীভাবে মিথ্যা হলো?

এটা কি তোমার চলে যাওয়ার কারণে নাকি আমার নিরবতাই ছিলো কারণ

গতকাল তোমাকে বন্দরে দেখলাম

এক বিদিক নাবিকের মতো

একটা এতিমের মতো আমি তোমার কাছে ছুটে গেলাম

আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে চাইলাম:

কীভাবে একটা চির-সবুজ কমলা বাগানকে টেনে নিয়ে 

জেলে ঢুকিয়ে দেয়া যায়নির্বাসনে পাঠানো যায়একটা বন্দরে

এবং সে এতো এতো ভ্রমণের পরেও,

শরীর ভরা সামুদ্রিক লবণের সুবাস এবং তৃষ্ণার পরেও

কীভাবে সে চির-সবুজ থেকে যায়?

আমি আমার ডাইরিতে লিখলাম:

আমি কমলা ভালোবাসি আর ঘৃণা করি বন্দর

আরও লিখলাম:

আমি ডকের উপর দাঁড়ায়ে ছিলাম

আর খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলাম

আমাদের বলা যায় এমন শুধুমাত্র কমলার খোসাই আছে

বাকি সবই মরুভূমি হয়ে গেছে।


ঘন বনে আবৃত পাহাড়ে আমি তোমাকে দেখেছিলাম

এক মেষহীন রাখাল বালিকা

এগিয়ে যাচ্ছো ধ্বংসের দিকে

তুমি আমার বাগান ছিলাআর আমি ছিলাম আগুন্তক

কড়া নেড়ে গেছি দরজায়

হৃদয়আমার হৃদয়টা দাঁড়ায়ে ছিলো সে দরজার বাইরে

তোমার জানালাতোমার দরজাসিমেন্ট আর পাথরের সামনে।

আমি তোমাকে দেখেছি পানির ব্যারেলগুলির পাশে

ভাঙা শষ্যের গোলায়,

আমি তোমাকে এক দাসীরূপে দেখেছি নাইট ক্লাবে,

আমি তোমাকে দেখেছি চোখের পানির রিফ্লেক্সনে এবং নানারকম ব্যথায়

তুমি আমার বুকের ভেতরে ফুসফুসের মতো;

আমার ঠোঁটে শব্দের মতোন;

তুমি পানিতুমিই আগুন।

আমি তোমাকে দেখেছিলাম গুহার মুখেগুহার ভেতরে

তোমার এতিমখানার ন্যাকরাগুলি রোদে শুকাতে দিচ্ছো

আমি তোমাকে দেখেছিলাম দাউ দাউ করতে থাকা আগুনের পাশে,

দেখেছি রাস্তায় আমি তোমাকে


দেখেছি পুড়তে পুড়তে গভীর হওয়া ক্ষতস্থানে আর সূর্যের রক্তে

এতিমদের গানের মধ্যে আমি তোমাকে দেখেছি আর দেখেছি লাচারদের সাথে।

তোমাকে দেখেছি সমুদ্রে আর সৈকতে।

এই জগতের সৌন্দর্য বলতে তুমিই ছিলা

শিশুদের সরলতার মধ্যেও ছিলা 

আর ছিলা এরাবিয়ান জেসমিনের মাধুরি হয়ে।

আর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি

নতজানু হয়ে আমার চোখের পাপড়ি আর রুমালের মতোন,

তোমার চোখের ভাষা যেখানে খোদাই করা ছিলো,

আর ছিলো একটা নাম,

যে নাম জপে জপে একটা হৃদয় বহুকাল আগে বিঘাল গিয়েছিলো

আমি তোমার জন্য একটা বন তৈরি করে রাখবো

আমাকে এই কথা মধু এবং চুম্বনের চাইতেও স্পষ্ট করে লিখে রাখতে হবে:

'প্যালেস্টাইনসে ছিলো এবং এখনো আছে'

এক বজ্র-বিদ্যুতের রাতেআমি আমার দরজা আর জানলাগুলি খুলে দিলাম

আমাদের পরিচিত রাতগুলির সেই অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া স্পষ্ট চাঁদটা দেখার জন্য

আমি রাতটাকে বলেছিলাম: শেষ হয়ে যাও

ওই অন্ধকারের পেছনেওই দেয়ালগুলির আড়ালে গিয়ে লুকাও;

আমার কিছু প্রতিজ্ঞা আছে যা রাখতে হবে 

আর তার জন্য আমার শব্দ এবং আলোকময়তার দরকার

তুমি আমার কুমারী বাগান

যতদিন পর্যন্ত আমাদের গানগুলি তলোয়ার হয়ে যাবে 

যখন আমরা তাদের গাইবো

আর তুমি আমাদের শষ্যগুলির মতোই বিশ্বস্ত

আমাদের গানগুলির মতো দীর্ঘ

এই উর্বর জমিনটাকে বাঁচায়ে রাখো 

আমাদের ফসলরূপনকালীন সময়টার জন্য


তুমি মনের মধ্যে একটা পাম গাছের মতোন:

কোনো তুফান কিংবা কাঠুরের কুড়াল 

কোনোদিন যার খোঁজ পাবে না

এখনো যার ত্বকে জঙ্গল ও মরুভূমির 

কোনো জানোয়ারের নখের দাগ বসেনি 

এমন একটা পাম গাছ তুমি।

কিন্তু আমি তো সেই নির্বাসিত দেয়াল ও দরজাগুলির ওপারে এখনো

আমাকে আশ্রয় দাও তোমার দৃষ্টিতে।

আমাকে নাওতুমি যেখানেই আছো,

আমাকে নাওতুমি যেভাবেই আছো

আমি তোমার চেহারা আর শরীরের আরামে থাকতে চাই

তোমার অন্তর আর চোখের আলোতে চলে যেতে চাই,

রুটির লবণ আর গানে,

পৃথিবী ও মাতৃভূমিতে থাকার অভিজ্ঞতা যেমন হয় সেখানে

আমাকে নিয়ে যাও


আমাকে আশ্রিত করো তোমার চোখে,

আমাকে নাওবাদাম কাঠে তৈরি কোনো ঘরে,

দুঃখের কটেজে,

আমাকে নাওআমার ট্র‍্যাজিক বইয়ের একটা ভার্সের মতো,

আমাকে নাও কোনো খেলনার মতো কিংবা ঘরের একটা পাথরের মতো,

যাতে করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম 

কোনোভাবেই আমাদের ঘরে ফেরার পথ ভুলে না যায়

তার চোখ এবং তার হাতের ট্যাটু ফিলিস্তিনি

তার নামফিলিস্তিনি

তার স্বপ্নতার দুঃখফিলিস্তিনি

তার রুমালতার পা ও শরীরফিলিস্তিনি,

তার শব্দ ও তার নিরবতাফিলিস্তিনি

তার গলার আওয়াজফিলিস্তিনি

তার জন্ম এবং তার মৃত্যুফিলিস্তিনি

আমি তোমাকে নিজের সাথে বহণ করেছি আমার পুরাতন নোটবুকে

যেহেতু আমার লেখা আয়াতগুলির আগুনই

আমার সমস্ত ভ্রমণকালীন খাদ্য


তোমার নামে আমার ডাক আজও উপত্যকায় ভাসে:

আমি বাইজেন্টিয়ামের ঘোড়াগুলি দেখেছি

এমনকি যুদ্ধটা ভিন্ন হলেও

হুশিয়ার হওহুশিয়ার

আমার গান থেকে তৈরি হওয়া 

আর গ্রানাইটের উপর আঘাত করা বজ্রপাতের থেকে।

আমি যৌবনের ফুল আবার যোদ্ধাদের যোদ্ধা!

আমি আদর্শকে খুন করে আসা খুনি

আমিই ল্যাভেন্টাইন সীমান্ত ঠিক করে এসেছি আমার কবিতা দিয়ে

যা ঈগলদের অবমুক্ত করে ফেলে।

আর তোমার নামে আমি ডেকেছি আমার শত্রুদের:

হে কীটেরাআমার রক্ত মাংস খেয়ে নিয়ো যদি কখনও ঘুমাতে যাই,

পিপড়ার ডিম থেকে কখনও ঈগল পয়দা হয় না,

ডিমের খোসা কখনওই একটা সাপকে আটকাতে পারে না!

আমি বাইজেন্টিয়ামের ঘোড়াগুলি দেখেছি,

আর তারও আগেসবকিছুর আগেমনে রেখো

আমি জানিআমি যৌবনের ফুল এবং যোদ্ধাদের যোদ্ধা!

 


Post a Comment

1 Comments