তৈমুর খানের কবিতা ।। গোধূলি সংবাদ ও অন্যান্য



জীবনের গল্প থেকে

 

একটা সময় পেরিয়ে গেলেই আর একটা সময় কাদম্বিনী দৌড়ে নামে জলে

জলের কাছে প্রাণ রেখে সে মৃত্যু আনে তুলে তীরে তখন চিতাকাঠের মেলা

সাজিয়ে বসে থাকি আমরা ক'জন

 

প্রমাণ চাওয়া সমাজ শুধু অন্ধকারে 

         আলোর স্বরভক্তি খুঁজে ফেরে

বিপ্রতীপে শুধুই মেঘলা আকাশ 

সূর্যবিহীন দিনের সংকোচনে রাত্রি আনে 

 

বলো কাদম্বিনী, কেমন করে বাঁচবে তুমি স্বামীর ঘরে এবং বাপের ঘরে?

 

  

শববিহঙ্গ

 

যেদিকেই চেয়ে দেখি,

ঘুমের বিছানা ছেড়ে উড়ছে কাতর শব

লজ্জাবস্ত্র নেই কারও—

 

সত্য লুকানো নেই কোথাও

দুইকষ বেয়ে রক্ত নামছে খ্যাঁতলানো 

                                     মৃত্যুর স্বাক্ষরে

 

এখন কোন সময় সভ্যতার?

দুপুর—সকাল—সন্ধ্যা কিছুই জানি না 

              শবেরা বিহঙ্গ হয়ে উড়ে যাচ্ছে শুধু

 

আমরা শুধু ফসলের খেত আগলাই 

  আমরা শুধু বীণাতন্ত্রে আগমনী গাই

       আমরা শুধু হাহা-দিন হাহা-রাত

               কলার মান্দাসে ভেসে যাই

                                   একাই বেহুলা

 

বেলা যায়—

যেদিকেই চেয়ে দেখি—বেলা যায় 

            ঘুমের বিছানা ছেড়ে শব ওড়ে…

 

 

   

নাগরিক সমাজ

 

শেষরাতে কুয়াশামাখা চাঁদ

     পসরা সাজিয়ে বসে আছে 

        তার কাছে শুনি রোজ গ্রহণের ডাক

 

আমিও নষ্ট হই, চরিত্র হারাই

 

চরিত্র কাকে বলে জানত না কোনও কার্লমার্কস্ 

মাথা থেকে বেরিয়ে আসে এক-একটি নির্জন সাপ

 নিষিদ্ধ আলোয় চেটে খায় পাপ

 

আমরা দেখি রাজপথ 

পথের পাশে নাগরিক সমাজ

 

চেতনার ভূখণ্ড জুড়ে মায়াবী প্রহর 

 বলো দৈত্য, কোথায় লুকিয়ে রাখব দুষ্টু ভ্রমর?      

 কুয়াশার অঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসছে কাম, সমস্ত দুর্মর আলো

        পোশাকের ভেতরে আজ উলঙ্গ হলাম

 

 

   

ক্যালেন্ডার

 

বালক-বালিকা বিকেলের ধুলো মেখে 

 নরম সহজ বাক্য উচ্চারণ করে যায়

     গাছপালার ভেতর নদীর কলধ্বনি 

 উঠোন আগলায় পাখি, উড়ে উড়ে নামে

 

সময় সমীচীন হলে দুয়ারে মেঘদূতের বিশ্রাম

       যক্ষিণীর ভাষা বোঝে ব্যাকুল পরান 

 স্নেহের পরাগ মেখে জলে নামে হাঁস 

         জলধোঁয়া ভানায় তার লেগে থাকে রঙ্

 

বিপ্লব কোথায় আসে? ঘরদোরউঠোনকবর

     সারারাত একই পরিবার মানুষমকর 

 সত্যের ফুল দিতে এসেছে বৈরাগী 

       কে ছিল ঝাঁসির রানি, কে তাঁতিয়া টোপী?

 

আলগোছে মরকতমণি সূর্যপ্রভায় 

  শিশির ঝরার মতো চুপচাপ পতন

  লক্ষ‍ যুগ দাঁড়িয়ে আছে যুগের পঞ্জিকা

         আমরা দেয়ালে দেখি ঝোলে ক্যালেন্ডার…

 

 

পৃথ্বীরাজ

 

ঝড়ে হড়কম্প কুঁড়েঘর 

 সংযুক্তা লন্ঠন জ্বেলে দিচ্ছে পৃথ্বীরাজকে

  কাচ ভাঙা লন্ঠন বলে ঝড়ে ও আগুনে ঠেলাঠেলি 

উঠোনে নুয়ে পড়ছে বেগুন গাছ 

          গাছের কোটরে লুকিয়ে যাচ্ছে কাঠবেড়ালি

 

ইতিহাস উঠে দাঁড়াচ্ছে আজ আমাদের পাড়ায় নেহাৎ দুর্গম ঝোপঝাড়ে আটকে যাচ্ছে আলো 

            আদিম জোনাকির ভাষায় রাতের গুহালিপি

                     পাঠ করছে ঐতিহাসিক শবর

 

ছেলেপুলে কী করে বাঁচবে পৃথ্বীরাজ? 

ঝড় তো মামুদ বাহিনী!

 ঝটিকায় উড়িয়ে দেয় চাল— 

এই বাংলা মাটিতে মিশে যায় তোমার রক্ত ঘাম

           ঘর বেঁধে আবার আলো জ্বালো,পৃথ্বীরাজ চৌহান!

 

 

  

গোধূলি সংবাদ

 

কোনও আকস্মিক যুদ্ধ থেকে 

              নীল সূর্যাস্ত স্তব দেখি

 ভূমণ্ডল ছেয়ে আছে অরিন্দম হাওয়া 

  গর্জনে দুর্জয় কাল, কালের প্রত্যক্ষরা

 

কোনও দিকেই নিয়তি নেই 

   কেবল প্রলম্বিত দো-টানা আলোক 

      শহর ছাপিয়ে আজ এসেছে বরণডালা

                মেঘদূতের নতুন কার্যকলাপ

 

কোথাও মধ্যগগনের ছায়ায় সমুদ্র বিস্তার

         নাবিক নক্ষত্রগুলি ডুবে যায়

মেঘে মেঘে শারদীয়া ছেঁড়া যুদ্ধের রুমাল

       অথবা পঞ্চাঙ্ক প্রাদুর্ভাব, অসুর নাশিনী

 

কখনও প্রবল শ্রদ্ধা, নমস্য নিশ্চেতনার

         উন্মাদ বিলোল চক্র খণ্ড সর্বনাম

কখনও প্রত্যয় মৃদু উদ্বুদ্ধ সাধন 

         বিস্ময় ছাপিয়ে যায় নৈশ সূর্যস্নান


তৈমুর খান। জন্ম ২৮ জানুয়ারি১৯৬৭বীরভূম পশ্চিম বঙ্গ। পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেপেশায় একজন শিক্ষক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২২টি। পেয়েছেন কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কারদৌড় সাহিত্য পুরস্কারসহ এওং নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার। 

 

এই লেখকের আরও লেখা:

 

নিঃশব্দের তর্জনী ও অন্যান্য


 

 

 

 

Post a Comment

1 Comments

  1. একটা সময় পেরিয়ে গেলেই আর একটা সময় কাদম্বিনী দৌড়ে নামে জলে
    জলের কাছে প্রাণ রেখে সে মৃত্যু আনে তুলে
    তীরে তখন চিতাকাঠের মেলা
    সাজিয়ে বসে থাকি আমরা ক'জন

    প্রমাণ চাওয়া সমাজ শুধু অন্ধকারে
    আলোর স্বরভক্তি খুঁজে ফেরে
    বিপ্রতীপে শুধুই মেঘলা আকাশ
    সূর্যবিহীন দিনের সংকোচনে রাত্রি আনে

    বলো কাদম্বিনী, কেমন করে বাঁচবে তুমি স্বামীর ঘরে এবং বাপের ঘরে?


    ReplyDelete