মাহবুবুল ইসলামের অনুগল্প ।। আঙুল

 


অন্ধকারের একটা বড় প্রতিভা হলোসে কোন কিছুকে পরিস্কারভাবে দেখতে দেয় না। ফলে পৃথিবীর সমস্ত দৈন্য চোখের আড়ালে চলে যায়। তবে অন্ধকারের গুণ হলো সে একটা জিনিসকে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলে। অন্ধকারে হারিকেনের হলুদ আলোয় হরিপদ পন্ডিত মশাইয়ের আঙুলগুলো এরকমই দেখাতো। উঁনি যখন পড়াতেনপাড়ার সবই উঠোনজুড়ে বসে পড়ত। ঠিক ancient mariner এর মতো সবাইকে সম্মোহিত করতে পারতেন। তবে রঞ্জু উঁনার  আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। আঙুলের নিজস্ব একটা ব্যক্তিত্ব আছে৷ রঁদা যদি এই আঙুলগুলো দেখতোহয়ত সুনিপুণ আঁচড়ে ভাস্কর্যে তুলে রাখতেন। 

রঞ্জুর কাছে মনে হয় আঙুলগুলো একটা টেক্সট। এই আঙুল অন্ধকারে কালো অক্ষরের গহীন থেকে তুলে আনত এক আলোর দীপ্তি। আঙুলের ব্যবহার শুধু যে বল্লমতীরবর্শা নিক্ষেপের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়ের জন্য শুধু আবিষ্কার হয়নি৷ এর এক নন্দনত্ত্বিক দিক রয়েছে৷ কোনরকম ক্যালকুলেটর ছাড়াই হরিপদ পন্ডিত মশাই বড় বড় যোগ বিয়োগ করতে পারতেন। পাঁচটা আঙুল নদীর স্রোতের মতো কাগজের ভূগোলে বয়ে যেতো। আর রঞ্জুর চোখ পথহারা নাবিকের মতো যেন এক সিন্দাবাদের নেতৃত্বে খুঁজে পেত দূর এক দারুচিনি দ্বীপের দেশ। 

সহস্র পিঁপড়া যেমন ফেরোমোনেসের হরমোনের প্রভাবে একসাথে চলতে থাকে সামনের দিকে। তেমনি তারাও উঁনার আঙুলের ইশারায় সামনের দিকে অগ্রসর হতো বিমুগ্ধচিত্তে। কী ব্যাকরণকী ভূগোলসবই যেন একটা চিত্রকল্প আর গল্পের মতো হাজির করতেন। হরিপদ পন্ডিত মশাই বলতেনপ্রত্যেকটা অক্ষরশব্দ এক একটা অজানা নগরী৷ তোমাকে অপার বিস্ময়ে এগোতে হবে। বিরাট এক ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে এর ভেতর। 

প্রায়ই বলতেনবুঝলি রঞ্জুমানুষ ইক্ষু গাছ  খায়আম গাছ নয়। কারণ রস ছাড়া আনন্দ ছাড়া কোন কিছু হৃদয়ঙ্গম হয় না।  এখন চারিদিকে এতো আলো! উন্নত পরিবেশ! শিক্ষার জন্য এতো ব্যবস্থা! সবই আছে। শিক্ষাটাই নাই। তবুও সেই হরিপদ পন্ডিত মশাইয়ের আঙুল খোঁজে পাওয়া যায় না যে আঙুল অন্ধকারে হারিকেনের হলুদ আলোর সামনে বসে যেন এক সক্রেটিস সন্ধান দিত রঞ্জুকে এক জ্ঞানের ঐশ্বর্যের জগত।

হরিপদ পন্ডিত মশাইয়ের একটা কথা এখনও রঞ্জুর মনে পড়ে-

পথ নেই বলে দুঃখ করিস না

যখন পা আছেশিক্ষা আছেপথ তৈরি হয়ে যাবে।

পকেটে টাকা নেই বলে নিঃস্ব ভাবিস না।

টাকা নয়শিক্ষা দিয়ে হৃদয়ের পরিধি মাপা হয়। 

Post a Comment

1 Comments