রাখি সরদারের ধারাবাহিক গদ্য ।। ভালো তো গো বাসিলাম ।। পর্ব-০৩


অনেক দূরের কেউ হয়ে গেছো। অনেকঅনেক দুরের তাও প্রতিনিয়ত জেগে থাকো মরণপুষ্পের ঘ্রাণে। কে যেন বলেছিল মানুষ দূরে সরে গেলেও তার মহৎ চিহ্নসকল লেগে থাকে পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে। তুমি ফিরে গেছতোমাকে হারানোর ব্যথা দুঃখপরাগ হয়ে আজও ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু হলুদ ঘাসফুলে। দিন যায়মাস যায় সে ফুল কিছুতেই শুকিয়ে ওঠে নাআমার সমস্ত বিষণ্ণতা ছেনে ছেনে মাটির কানের কাছে আরও হাহাকার করে ওঠে। কতদিন বলো আর এভাবে পুড়িআমার যা কিছু অবসাদ দূরে সাদাপাথরের কবরে আজ রেখে এসেছি। কত বছর পর গূঢ় আয়নায় দেখছি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে এক নিবিড় আলাপময় বিকেলপাতায় পাতায় উদাসী ধুলোর মর্মর ভেঙে যাওয়ার শব্দ। আমার পরনের শাদা শাড়ি হয়ে উঠেছে গাঢ় ময়ূর রঙের। বিকেলের সূর্য ছায়া ফেলে ফেলে ডুবে যাচ্ছে নির্জন অশ্বত্থের কোলে  

আষাঢ়ে সূর্যাস্তে যে এত কারুকাজ থাকে জানা ছিল না। প্রথমে গাঢ় কমলা রঙে ঢেকে গেল আকাশের প্রান্ততারপর টকটকে লাল বেনারসি রঙের বিবাহসাজে সজ্জিত হয়ে উঠল গোটা আকাশদেখে মনে হচ্ছে নববধূ রক্তাভ কৌমার্যে আতুর হয়ে পড়ছে। পরক্ষণেই চিনচিনে ব্যথার মত এক চিলতে নীলরঙ রক্তাভ আকাশে ছড়িয়ে পড়তেই দেখি এক বিরাট পানকৌড়ি পাখি তার কালো ডানায় মুড়ে নিল সমস্ত আকাশ। মুহূর্তে হাঁসেদের ঘরে ফেরার চৈ চৈ সুরে নেমে এল বরষার সন্ধে। জানালার পাশে বাদামগাছের লালচে পাতাগুলো দুলতে থাকেবাগানের সুপুরিগাছের সারি ঝোড়ো হাওয়ায় মৃত্যুনাচে উদ্দামএকদল সাদাবক তড়িঘড়ি উড়ে গেল নিজ ঠিকানায় গাছেদের সিঁড়ি বেয়ে ঝম ঝম শব্দে বৃষ্টি এসে গেল। সে বৃষ্টির কত রকম শব্দ! পাশের বাড়ির রানি পিসি এমন বাদর সন্ধেয় গান গাইছেন 

                             ভালো তো গো বাসিলাম ভালবাসা পাইলাম

                              এখনো তো ভালোবাসি – তবুও কী নাই ।।

                              কিছুই তো হল না ।

                              সেই সব – সেই সব – সেই হাহারব,

                               সেই অশ্রুবারিধারাহৃদয়বেদনা 

হাওয়ায় হাওয়ায় কী আকুলি বিকুলি! কী নিবিড় বেদনা ঝরে পড়ছে বৃষ্টি রূপে। সত্যিই তো ভালোবাসিলামকিন্তু কিছুই হল নাবৃষ্টি পায়ে পায়ে ও কার পদচিহ্ন শুনি! জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে কেবল উঠে আসে দীর্ঘশ্বাসসেই দীর্ঘশ্বাস শুনে নির্জন এক জন্তু আবারও আমার পুরানো স্মৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করছেব্যাঙ্গের স্বরে বলছে 

         কইবুক চিরে দেখাতার বিরহে  

                    কতটা মেঘ জমেছে? 

আমি তখন অসম্ভব ব্যথার মধ্যে বসেযন্ত্রণার শিলাখণ্ডে গড়িয়ে পড়ছে রক্তঅসহ্য ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে কে যেন টেনে নিল স্মৃতির অন্ধকারে। যে অন্ধকারে বসে কে যেন অনন্তকাল মন্দিরা বাজিয়ে চলেছে … আমি উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে উঠি – কে! কে গো তুমি! 

আমি তোমার শ্রাবণ – স্মৃতি

আমার শ্রাবণ – স্মৃতি?

আসবেআসবে এখানে?

কথাগুলো বলতে বলতে সে আমাকে এক ঝটকায় টেনে নেয় এক মেঘমদির দেশে। অসংখ্য সাদা শালুক ফোটা এক পুকুরের ঘাটে আমি বসেপাশে নীল পাঞ্জাবী পরে বসে আছে এক যুবক। মুখ ফেরাতেই তাকে চিনতে পারি। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। দুটি শালিক অদূরেই একজন আর একজনের ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে। মেঘ ডাকছে জোরে জোরেবাতাসে আমলকী ফুলের গন্ধ। আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠছে বজ্রপাত। আমি ভয় পেয়ে সেই যুবকের আঙুল চেপে ধরে বলিচলোঘরে ফিরিভয় করছে। সেই যুবক আনন্দে বলে ওঠে 

ভয় কেনদেখো পাখিরা কেমন ডানা ঝাপটাচ্ছে। মাছেরা পুকুরে খেলা করছে। মেঘ মানেই তো মায়া, ভালোবাসা। মেঘ তুমি কেমন করে ভালোবাসার কাছে ডানা মেলে ধরোচিরধরা হৃদয়ে কেমন করে প্রেম ঝরাও! জানি, হে মেঘ তুমি তাপিতজনের শরণ। তুমি তো প্রেমের দরিয়ায় হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী  সে যুবকের মেঘে মেঘে ছেয়ে যায় পৃথিবীএত মেঘ আগে কখনো দেখিনি! পুকুরে শালুক ফুলের বনে একটি হংস তার হংসিনীকে আদরে আদরে ডুবিয়ে ধরেছে। তাদের ধলা শরীর ভেজা মৈথুন দৃশ্যের ভিতর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। 

যুবকটির ভিজে পুরুষ নাভি থেকে একপ্রকার বন্যঘ্রাণে সিক্ত হয়ে উঠছিল আমার শরীর। তার বৃষ্টিভেজা পাঞ্জাবীর আড়ালে স্পষ্ট হয়ে উঠছে পুরুষ স্তন। আমি তা স্পর্শ করতেই আমার শরীর জুড়ে অনুরণিত হতে থাকলো মা মা ধ্বনি! এ কি হল! হঠাৎ কে আমার চৈতন্যমণ্ডলে এত জোর ধাক্কা দিল যে মুহূর্তে জ্ঞান হারাই। চেতনা ফিরলে দেখি আমি একা ভিজে বারান্দার চেয়ারে বসেকী সুতীব্র অভিমানে নীল অপরাজিতার মতো রাত্রিকালবৃষ্টি শেষে গোলগাল চাঁদ উঠেছে। চরাচরের যাবতীয় বিষণ্ণতা ধুয়ে মুছে চিকচিক করছে জ্যোৎস্না।  দূর থেকে ভেসে আসছে বিসমিল্লা খানের একলা সানাইয়ের সুর –‘ভালবেসে সখীনিভৃত যতনে ’ বসে থাকিবসেই থাকি অন্তহীন প্রেম- অপ্রেমের মধ্যিখানে  

 

এই লেখকের আরও লেখা... 


রাখি সরদারের ধারাবাহিক গদ্য ।। হে আমার রিক্তসুন্দর মাছরাঙা ।। পর্ব-০১

 

Post a Comment

0 Comments