।। বিছন ধানের কথকতা ।।
চৈত্রের নোনতা বাতাস থেমে গেলে
ধানের গোলা কাটে মেটে ইঁদুর।
দুশমন হলেও বিড়াল তখন ছানাদের নিয়ে
সংসার যাপনে মনোযোগী হয়।
বাড়ির ত্রিসীমানায় শিয়াল দেখলেই
যে কুকুর চিৎকার করে উঠত,
সেও আজ উরুতে মুখ গুঁজে ঘুমায়।
এসব দেখে জীবনের মানে খুঁজতে চাওয়া অর্থহীন!
এই পৃথিবী শুধু মুমিনের জায়নামাজে নয়
পণ্যস্ত্রীর অদৃশ্য গীর্ঘশ্বাসেও গড়া।
চার্জ ফুরিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা অটোরিক্সার কাছে
জীবনের মানে খুঁজতে চেয়ে হরিনাথ আজ বিকারগ্রস্থ
কনডমের নাম না-জানা পুরুষ অপরিকল্পিত জীবনে
সকাল-বিকাল বিছন ধান সেদ্ধ করে অপক্ক কৃষানীর মতো।
পরিকল্পনায় দক্ষ পুরুষ জানে কতটা পাকলে ধান বিছন হয়,
কতটা ছ্যাপছ্যাপা পানিতে রোয়া ধান কুশি গজায়।
যে সন্তান বাবার পরিচয় জানে না—
তার কাছে বিছন আর ভোজন ধানের কোন তফাৎ নেই।
।। হাওয়া ঘর ।।
এখানে এই পলেস্তারা খসা—দক্ষিণ দুয়ারি খিড়কি আঁটা ঘরে
গত জন্মের অবরোধ মুক্ত হয়ে—হাওয়াদের নির্বিঘ্ন মোয়ামেলা।
ভাট ফুলের রূপ নিয়ে—জানজাবিল হাতে জেগে থাকে নসরীয় রাত
পুরোনো প্রেমের স্মৃতি উড়ে আসে নতুন প্রেমের উঠোনে।
এমন প্রেমময় রাতে আমাদের ভাই-বোনদের স্রষ্টা মরহুম আব্বা-আম্মাকে
পৃথিবীর নিপুণ শিল্পী মনে হয়, যার কিছুটা আমিও পেয়েছি।
এখানে এই নির্জন হাওয়া ঘরে আমি জাতিস্মর নই,
পূর্বজন্মের স্মৃতি হাওয়ার পিঠে লিখে রাখেনি আমার আব্বাও।
তবুও শিল্পিত প্রেমের নাড়ি-নক্ষত্র হরবর করে বলে দিতে
কাঁপে না স্মৃতিরা। এমনই কিছু স্মৃতি আমার প্রস্টেটে আর
গিন্নির স্তনগ্রন্থিতে আলগোছে জমা হয় প্রতিনিয়ত,
যার খবর আমরা পরস্পরের কেউ পাই না কোনোদিন।
তবুও চোখে চোখ রেখে—পরস্পরকে পড়তে পারার মিথ্যে গৌরবে
খিড়কি আঁটা দক্ষিণ-দুয়ারি ঘরে পাশাপাশি ঘুমাই প্রতিদিন।
।। লাল ব্লাউজ ।।
পতনোন্মুখ জীবন আমার—
একদিন গতরের লাল ব্লাউজের নিশান উড়িয়ে
পতন ঠেকিয়েছিলে বলেই আজ আমি কবি।
রুহানি ইস্কুল থেকে ভালোবাসাই শিখছি শুধু। তবু
অমর করার মতো এখনো ভালোবাসতে পারিনি।
হাওয়াই মিঠাই অনুভূতি—হাওয়ার ছোঁয়ায় ঝিম মেরে যায়
ঘোর কেটে যাওয়ার আগে যেমন ঝিম ধরে মাথা।
তখন পৃথিবীর সমস্ত আব্রুকে লাল ব্লাউজ মনে হয়।
মনে হয়—চাপা পড়া ঘাসের মতো ইতিউতি মাথা তোলে
আলো খুঁজছে খাঁজকাঁটা গোলাপের কলি।
।। সময় ।।
দক্ষিণ দুয়ার খুলে বেরিয়ে গেছে নবাবী সময়—
তারই পথ চেয়ে সোনাগাছির আলতারানি ওরফে স্বপ্না খানম।
আয়নাও ইদানীং পক্ষপাতিত্ব জানে বেশুমার,
সিঁথির সিঁদুর আর প্রসাধনের পুরো স্তর ছাপিয়ে
বলিরেখাই দেখায়। উদয়াচলে যে মাঝির গানের ভাষা ছিল
শীৎকার—অস্তাচলে সে গায় হরি বোল হরি বোল...
সময় বড় নিষ্ঠুর, শেষরাতে জলসা ফুরিয়ে গেলে—সব ভুলে
ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে হাত দেয় সতিনের শ্রোণি-সন্ধিতে।
।। ধানখেত ।।
কৃষাণীর লাল শাড়ি আর কৃষকের সচ্ছল পুরুষ হবার স্বপ্ন নিয়ে
মাঠজুড়ে কচি সবুজ মাথা দুলিয়ে বেড়ে ওঠে ধানখেত
অনাবৃষ্টি আর ইঁদুরের মুখ থেকে বেঁচে ফসলে মাঠ ভরে উঠলে
ভরা মাঠ শূন্য করে মহাসমারোহে প্রস্থানের আয়োজন চলে
প্রস্থানের এই নিয়মে আগামীর অংকুর পাকা ধানে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে
পূর্ণ হলেই চলে যেতে হয়, ছেড়ে দিতে হয় স্থাবর-অস্থাবর অধিকার!
।। পলাতক মন ।।
নিশ্চুপ ঝরে পরা বরফ শুয়ে আছে ঘাসের বিছানায়
অলস ঘুমকাতুরে বালিকার মতো, তাড়া নেই।
বিড়াল পায়ে নেমে আসা ভোর থেমে থাকেনি পথের ধারে
ঘড়িতে দুপুরের ছাপ ফেলে ভরা নদী পায়ে হেঁটে চলে গেছে।
কান্ট্রি রোডের বাঁকে সতর্ক দৃষ্টিতে বসে আছে পলাতক মন
সুযোগ পেলেই ছুটবে অজানা গন্তব্যের পথে।
উলঙ্গ গাছেদের মন খারাপ, সাদা বরফকে পিতৃঘাতক ভেবে—
রুক্ষ মেজাজে প্রতিশোধের মন্ত্র জপে বসন্তের পথ চেয়ে,
অত্যাচারের খড়গ নেমে এলে ভুলে যায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ
‘ইয়া শাফি ইয়া শাফি’ জিকিরে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণ করে।
অসহায়ের আর্তনাদের শক্তি ফুরিয়ে গেলে একদিন ঘুম ভেঙে দেখে
সত্যের পাথর ঠোঁটে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে আসমানি আবাবিল।
জমার খাতা চিরস্থায়ী নয়—জমা খরচের হিসাব মেলাতে—
একদল হিসাবরক্ষক ছুটির দিনেও বিরামহীন কাজ করে চলে।
।। বুনন বিদ্যা ।।
আমি তাঁতির মতো নিবদ্ধ মনে—
তোমার শরীরে বুনি প্রণয়ের লাল শাড়ী।
জমিনের বিশালতায় শিল্পী হয়ে ওঠে মন
সেখানে পাড় টেনে কোন সীমানা থাকে না।
দক্ষ তাঁতে শিল্পীত শব্দে ভরে ওঠে শাড়ীর শরীর
জমিন জুড়ে খেয়ালি হাত আঁকে রঙের আলপনা।
যতটা পাকা রঙ হলে এক ফালি কাপড় হয় শাড়ী
ততটা রঙ জমিনে রেখে বাকীটা শুষে নেই ঠোঁটে।
বালিকা সুফিয়া তুমি জড়তা ভেঙে যুবতী হয়ে ওঠো—
বুনন বিদ্যায় পাকাও তোমার গোলাপি হাত।
ওলের প্রিয় সোয়েটারের মতো তোমার দক্ষ হাতে
নিপুণ আদরে বুন আমার বারোয়ারি শরীর।
।। পুরানা পল্টন এভিনিউ ।।
নিযুত বিকেল একা থাকার পয়গাম নিয়ে আমরা উঠে গেলাম অসমাপ্ত আলাপ সমাপ্ত করে। অথচ অমন পয়গাম আসার কথা ছিল না আমাদের ডাকবাক্সে। আমরা জানি ভেঙে যাওয়া অব্দি আমাদের ঠোঁটের অনন্ত প্রতীক্ষায় থাকবে কফির কাপ-তৃষ্ণিত চোখে সহস্র মানুষের ভিড়ে আমাদের পায়ের ছাপ খুঁজবে বিকেলের স্মিত আলো। হুড তোলা রিক্সা হারাবে এক জোড়া নিবিড় যাত্রী।অকারণে তুমুল গল্পের কথককে খুঁজবে বিষন্ন বাতাস। তবু কোন কিছুই থমকাবে না—শুধু একজোড়া চড়ুই বিষন্ন মনে কিছু সময় কাটাবে কার্নিশে বসে। অতঃপর, সব ভুলে নতুন খুনসুটিতে মাতবে ভোরের আলোয়। আমাদের যৌথ প্রকল্পের ফাইল অনুন্মোচিত থেকে যাবে কোটি বছর—আমরা কেউই তার খোঁজ রাখবো না। এমন কি আমাদের ব্যস্ততা এবং ইগোতে ডুবে থাকবো আমরা। হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ হবে—মনে পড়বে খুউব—আনমনা হবো, কষ্টও হয়তো পাবো, কিন্তু পরক্ষণেই আমরা এটা ওটা দিয়ে মন ভুলিয়ে রাখবো—কেউ কারও খোঁজ নিবো না। নির্ঘুম উত্তরের বাতাসে বিষাদ উড়ে এসে জমা হবে মনের বেলকনিতে। ভরা পূর্ণিমায় মনখারাপের বাউণ্ডুলে জোছনায় নির্বাক আকাশের দিকে চেয়ে রবো-তিন তারার গতিপথে দৃষ্টি বিছিয়ে আনমনে হবো। পুরনো স্মৃতিগুলো খুব গোপনে চেপে রাখতে রাখতে হঠাৎ করেই কাউকে কাউকে এক-আধটু বলে দিবো, নাত-নাতনীর কাছে গর্ব ভরে গল্প করবো। তারা উৎকর্ণ হয়ে শুনবে। এই পুরানা পল্টন এভিনিউ আমাদের মতই বদলে যাবে—অবলীলায় মুছে দিবে আমাদের জোড়া পায়ের চিহ্ন। আমরা হেরে যাওয়াকে একদিন শিল্পে পরিণত করবো।
।। কাঁটাতার ।।
একবার দুবার তিনবার—কতবার পুড়েছে প্রেম
কিশোর প্রেম, নাবালক প্রেম–সাবালক প্রেম
জীবনের মতো প্রেমেরও একটা মেয়াদকাল থাকে
জীবন যেমন ফুরায় প্রেমও ফুরায়—নতুন বান আসে
তবুও কোথাও একটা টান লাগে—
পড়ি মরি করে হঠাৎ হঠাৎ বেঁজে ওঠে জীবনের ঘণ্টি।
বাস্তুহীন মানুষের পীড়ন কেবল বুঝে প্রেম হারা মানুষ
যেমন বোঝে শীতের প্রকোপে ঘরছাড়া পরিযায়ী পাখি
পাখি তবু ফিরে যায়—সহস্র মাইল দূরে, নিজভূমে
ভেঙে যাওয়া মনে অভেদ্য দেয়াল তোলে কাঁটাতার।
কত কত পুরনো ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে দূর দেশে
সীমান্ত পেরিয়ে—কত কত স্মৃতি জমে পূর্বপুরুষের নামে
অদৃশ্য দুরুহ প্রাচীরে বাঁধা পেয়ে ফিরে আসে হাটুরে মন
দুঃস্বপ্নে হানা দেয় বুকে তাক করা প্রহরীর রাইফেল।
।। নারকেল তেল ।।
কসমেটিকের দোকানে গেলে আমি নারকেল তেলের বোতলের দিকে চেয়ে থাকি
এই অসুন্দর চিটচিটে তেল-ই নারীর কোমল হাতে পড়ে কেমন সুন্দরী হয়ে ওঠে!
তেলের আত্মজীবনী লিখতে গেলে নারকেল আর কারিগর ছাপিয়ে
ঘুরে ফিরে আমার কেবল নারীর সুন্দর হাতের কথা মনে পড়ে!
বিষ্ময় নিয়ে চিন্ময় আমারে জিগায়, নারকেল তেল কেমনে সুন্দর হয় আকাশ?
সুন্দরতো নারী—নারীর চুল, ঠোঁট, গাল, বুক, জঙ্ঘা, চিবুক...
আমি কই, আমি তো অন্ধ—ভালোবাসার চেরাগ জ্বেলে নারীর প্রেমে অন্ধ
নারকেল তেল আর নারী আমার কাছে সমার্থক।
নারীকে ভালোবেসে আমিও নারকেল তেল হয়ে যাই, ভাবি—
কঠিনের আবরণ খুলে কতটা গলে গেলে নারকেল তেল হওয়া যায়।
আকাশ মামুন। জন্ম ১৪ জুলাই, ১৯৮৪, কেন্দুয়া, ধনবাড়ি, টাঙ্গাইল। রসায়নে স্নাতকোত্তর। উচ্চ শিক্ষা ঢাকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কর্মজীবনে তিনি একজন গবেষক। প্রকাশিত কবিতার বই–মেয়াদোত্তীর্ণ রাজমহল (২০১৯), শিল্পিত মিথ্যার প্রেসনোট (২০২১)।
3 Comments
সুন্দর। ভালো লাগলো সবগুলো।
ReplyDeleteআমি তাঁতির মতো নিবদ্ধ মনে—
ReplyDeleteতোমার শরীরে বুনি প্রণয়ের লাল শাড়ী।
ভালো লাগা রেখে গেলাম।
ReplyDelete