আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ছুটি হলো মেমোরিয়াল ডে, যা প্রতি বছর মে মাসের শেষ সোমবার পালিত হয়। এই দিনে আমেরিকান সিভিল ওয়ারসহ বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। আমরা যারা করপোরেট চাকরিজীবী, তাদের জন্য এটি একটি দুর্লভ টানা তিন দিনের ছুটি—তাই এবারের ছুটিকে বিশেষভাবে উপভোগ করতে চেয়েছিলাম।
আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই প্রকৃতিপ্রেমী। বিশেষ করে পাহাড়ি ঝর্ণা আর নদীর ধারে নিরিবিলি সময় কাটানো আমাদের খুব প্রিয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ব্লু রিজ পার্কওয়ে (Blue Ridge Parkway)আর স্মোমি মাউনটেন (Smoky Mountains) অঞ্চলে কোনো এক পাহাড়ি শহরে কটেজে সময় কাটাবো। আমরা থাকি নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লট শহরে। শার্লট থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ এই বিখ্যাত ব্লু রিজ পার্কওয়ে, যা পেনসেলভেনিয়া থেকে শুরু হয়ে ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও টেনেসি পেরিয়ে জর্জিয়াপর্যন্ত বিস্তৃত। প্রকৃতির এই অমোঘ টানেই আমরা রওনা দিলাম আমাদের দুই দিনের যাত্রায়। সঙ্গে আমার স্ত্রী মৌমিতা এবং আমাদের চার বছর বয়সী ছেলে রুসাইদ মাসিব আয়াত।
শনিবার সকাল ৯:৩০ মিনিটে আমরা রওনা দিলাম কটেজের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে আমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম পিসগা জাতীয় উদ্যান (Pisgah National Forest) এবং নানটাহালা জাতীয় উদ্যান (Nantahala National Forest) ঘুরে কিছু ঝর্ণা দেখবো। মাঝপথে এক রেস্তোরাঁয় থেমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম এবং গাড়ির ট্যাঙ্ক ফুল করলাম, যাতে নির্ভার ঘোরা যায়।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিলো পিসগা জাতীয় উদ্যানের দর্শনার্থী কেন্দ্র (visitor center)। সেখান থেকে কিছু গাইডবুক নিয়ে আমরা গেলাম লুকিং গ্লাস ঝর্ণা (Looking Glass Falls) দেখতে। ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম দেখাতেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো “আলহামদুলিল্লাহ”—যেন কোনো রূপকথার রহস্যময় রাজকন্যা পাহাড়ি ঝিরি দিয়ে জলরাশি ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর তার সাথে প্রকৃতিতে বিলাচ্ছে অবারিত সৌন্দর্য।
পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসে সে,
স্নিগ্ধ জলে গা ভেজায় বাতাসের প্রেম।
ফেনায়িত ধারায় বাজে তার সুর,
প্রকৃতির মুখে জেগে উঠে গীতিময় নূর।
এরপর আমরা গেলাম ড্যানিয়েল রিজ ঝর্ণা (Daniel Ridge Falls) দেখতে, যেটি দেখতে কিছুটা হাইকিং করতে হয়েছে। আমাদের চার বছরের ছেলে আয়াত-ই যেন সবচেয়ে উৎসাহিত ছিল—আমাদের ছাড়িয়ে একাই ঝিরিপথ ধরে দৌড়ে চলেছে। এই ঝর্ণার বিশেষত্ব হলো এটির পানির পবাহ অনেক উঁচু থেকে পরে। আমরা পাথর বেয়ে উপরে উঠে ঝর্ণার প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম এবং এরপর কিছুক্ষণ কাটালাম পাহাড়ি নদীর পাড়ে বসে।
ঘুরে ঘুরে বেশ ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম দরকার। তাই কটেজে ফিরার পালা। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী কটেজের দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা, পাহাড়ি রাস্তায় আমরা ছুটে চললাম—একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে ঝরনা আর ঝিরিপথ। পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা মেঘে পথ কিছুটা কঠিন হয়ে গেলেও, সেই কুয়াশার আবেশেই যেন ছিলো এক রূপকথা। পথিমধ্যে ব্লু রিজ পার্কওয়েসহ অসংখ্য পাহাড়ি চূড়া পেরিয়ে অবশেষে সন্ধ্যা ৬ টা ৪৫ মিনিটে আমরা পৌঁছালাম ব্রেইসন শহরে (Bryson City) আমাদের বুক করা কটেজে। তখনো সূর্য পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিলো। ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি এই কটেজটির সামনে বিশাল সবুজ পাহাড়, আর পেছনে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। ঠিক যেনো কোনো পাহাড়ি রাজ্য, যেখানে সময় থেমে থাকে।
কফির কাপ হাতে নিয়ে আমরা চলে এলাম কটেজের পেছনে—কফিতে চুমিক দিতেই সারা দিনের ক্লান্তি যেন ক্লিশে হয়ে এলো। চনমনে মন আর শরীর নিয়ে কটেজের পেছনের চেয়ারে বসলাম। খরস্রোতা নদী, নিজের মুখচ্ছবি মৃদু হাসছে পানির ভিতর থেকে। মনটা ভালো হয়ে গেলো। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলালাম পানি। কিছুটা মুখেও লাগালাম। আমার স্ত্রীকেই বেশি উৎফুল্ল দেখালো। সেও পানি দিয়ে খেলছে। খানিকের জন্য আমরা চুপ হয়ে গেলাম। হয়তো নিজের ভিতরে নিজেকেই খুঁজছি, উপভোগ করছি। আয়াতের আশ্চর্য চিৎকারে ঘোর কাটলো–বাবা হাঁস! অদূরে পাহাড়ি রাজহাঁস তাদের ছানাদের নিয়ে হাঁটছে, আর আমাদের ছেলে আয়াত ছানাদের ধরার জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি—চারপাশের প্রকৃতি, ঝিরিপথ, নদীর কলধ্বনি।
কখন সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে খেয়ালই নেই কারো! তবে চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। নদীর স্বচ্ছ পানি আর চাঁদের আলো মিলে এক জাদুকরী পরিবেশ। রাতের খাবার খেয়ে জানালার পাশ থেকে আমরা বহুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম সেই নদীর দিকে—মনে হচ্ছিলো সময়কে থামিয়ে এখানেই থেকে যাই। শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম প্রকৃতির এই বিশালতায় ডুবে।
সকালে চেকআউট করে ব্রাইসন শহরের ডাউনটাউনে গিয়ে নাস্তা করলাম। এরপর রওনা দিলাম স্মোকি মাউন্টেন জাতীয় উদ্যানের ভিতর দিয়ে গ্যাটলিনবার্গ শহরের দিকে। এই পথে অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্ণা, বন, পাখির ডাক, মেঘে ঢাকা চূড়া—এক কথায় যেনো স্বর্গীয় দৃশ্য। আমাদের প্রতি মুহূর্ত ছিলো মনোমুগ্ধকর। গ্যাটলিনবার্গে আমাদের মূল গন্তব্য ছিলো অ্যানাকেস্টা (Anakeesta)—একটি প্রাইভেট ট্যুরিজম রিসোর্ট যেখানে রয়েছে রোপওয়ে, পাহাড়ি ট্রেইল, ঝুলন্ত ব্রিজ এবং মাউন্টেন ভিউ স্পট। কৃত্রিম হলেও বেশ সাজানো গোছানো আর প্রাকৃতিক আবহে খারাপ লাগছিল না। আয়াতের বেশ পছন্দ হয়েছে মনে হলো। ছেলে উপভোগ করছে দেখে ভালো লাগলো।
বিকাল নাগাত আমরা রওনা দিলাম শার্লটের পথে, কিন্তু স্মৃতির ঝুলিতে ভরে নিলাম তিন দিনের অজস্র মুহূর্ত। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শেষ হলো আমাদের মেমোরিয়াল ডে উইকেন্ডের ভ্রমণ—হৃদয়ে একগুচ্ছ সুখস্মৃতি আর ক্যামেরায় কিছু চিরস্মরণীয় মুহূর্ত ধরে রেখে আমরা ফিরলাম বাস্তব জগতে।
লেখকঃ ড. রোমান আল সৈকত, ঊর্ধতন বৈজ্ঞানিক, সিলড এয়ার কর্পোরেশন
romanabdullah03@gmail.com
0 Comments