ঈদ–সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এক মহাআনন্দের দিন। কিন্তু এ আনন্দ ম্লান হয়ে যেতে পারে যদি আপনজনদের থেকে দূরে–পরিচিত গণ্ডির বাইরে ঈদ উদযাপন করতে হয়। অমুসলিম দেশে হলে তো ম্লান হবার সম্ভাবনা আরও বেশি। কিন্তু এ সত্যকে মেনে নিয়েই হাজারও প্রবাসীদের বছরের পর বছর ঈদ পালন করতে হয় ভিন দেশের ভিন পরিবেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে। সারা বছরের ক্লান্তি শেষে ঈদে হয়তো কেউ কেউ ছুটিও পায় না–কাজ করতে হয় ঈদের দিনও।
যারা ঈদ উদযাপন করতে পারেন তাদেরও হয়তো সাকালে রান্নাঘরে ঢুকে কিংবা ঈদের নামাজে গিয়ে চোখ ভিজে আসে মা-বাবার মুখ মনে করে। কিংবা মা-বাবার বাষ্প মিশ্রিত কণ্ঠ বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। তবু বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতে–তাদের কষ্ট না বাড়াতেই হয়তো নিজের কষ্ট বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে। জীবন থেমে থাকে না। ছুটে চলে দ্রুতগামী ট্রেনের মতো। কখনও কখনও শ্লথ হলেও সিগন্যালের সবুজ বাতি জ্বললে আবার ছুটে চলে। কারণ গন্তব্য যে বহুদূর। কান্না উদ্বায়ী হয়–সামনে এগিয়ে যেতে হয়। প্রযুক্তির যুগ এখন একটু সহজ করেছে। আপনজনদের সাথে এখন ভিডিও কলে কথা বলা যায়। অপ্রাপ্তির মধ্যে এতটুকুই হয়তো প্রাপ্তি।
দেশ থেকে দূরে ঈদ করলেও দেশের বাইরে বড় শহরগুলোতে মুসলিম কমিউনিটি থাকে। একই ভাবে ঈদ জামাত হয়। বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের সাথে একই কাতারে ঈদের নামজ আদায় অন্য রকম অনুভূতি। যদিও দেশের মতো খোলা প্রান্তরে নামাজ আদায়ের সুযোগ কম থাকে। কোন কোন শহরে যেখানে মুসলিম কমিউনিটি বড় সেখানে খোলা জায়গায় ঈদ জামাত হয়। এবারের ঈদ শুক্রবারে হওয়ায় শনি-রবি মিলেয়ে বেশ লম্বা ছুটিই। দেশের ঈদের তিন দিনের ছুটির মতো একটা উৎসব উৎসব আমেজ। আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের টুসন শহরে সে লম্বা ছুটিকে কাজে লাগিয়ে ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন (বিএসএ) শনিবার সন্ধ্যায় আয়োজন করল ঈদপূনর্মিলনী অনুষ্ঠানের।
ইউনিভার্সিটির পুরনো ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিংয় বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকেই মুখরিত হতে থাকে বাংলাদেশিদের আনাগোনায়। এম্পিফায়ারে বেজে ওঠে ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গান। তখনও কেউ কেউ আসেনি। ঈদের আনন্দকে রাঙাতে আয়নার সামনে নিজেকে শেষ বারের মতো আরও একটু সাজাতেই হয়তো কারও কারও দেরি। যারা এসছে তারা নিজেদের মধ্যে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছে। একে অপরের খোঁজ নিচ্ছে। কেউ কেউ দল বেঁধে ছবি তুলছে বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয়, কেউ আবার স্মৃতি টুকু ধরে রাখতে ঠোঁট পাউট করে নিজেই দাঁড়িয়ে গেছে নিজের মোবাইল ক্যামেরার সামনে।
সময় গড়াতে থাকে আর ভিড় বাড়তে থাকে। ছোট ছোট জটলায় আড্ডা গড়াতে থাকে, হাসির রোলও গড়াতে থাকে। সাথে চলছে হালকা খাবার, চা, কোমল পানীয়। কয়েকটি গ্রুপ আবার বসে যায় কার্ড নিয়ে। এমপ্লিফায়ার মৃদু ছন্দে একের পর এক বাংলা গান বাজিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে–নিয়ন আলো জ্বলে উঠে। অনেকেই হয়তো খেয়ালই করে না–আড্ডায় কোন ছেদও পড়ে না। এর মধ্যেই চলতে থাকে খাওয়ার প্রস্তুতি। বিএসএ পরবর্তী বছরের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে ভোট গ্রহণও চালিয়ে যায়।
ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা ছুঁইছুঁই। শুরু হয় খাওয়ার পর্ব। খাওয়া শেষে ঘোষণা করা হয় নব নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির নাম। নির্বাচিতরা হলেন, সভাপতি-সোপান সরকার, সহ-সভাপতি-এহসানুল হক জোহা, সাধারণ সম্পাদক-এ এস এম কায়েত সোহান, হিসাব রক্ষক-আরিফ আহমেদ, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক-সুবহানা সালাম, জনসংযোগ সম্পাদক-নিঘাত আফরোজ চৌধুরী, সচিব-তাহসিন আফরোজ হক।
ঘড়ির কাঁটা রাত এগারটা পেরিয়ে গেছে। এবার ফেরার পালা। একে একে বিদায় নিয়ে সবাই বাড়ির পথে পা বাড়ায়। বাইরে রাতের অন্ধকারকে তাড়িয়ে জ্বলজ্বল করে নিয়ন আলো। তেমনি সাড়ে আট হাজার মাইল পেরিয়ে আসা আপনজনদের থেকে দূরে ঈদ পালন করার দুঃখটুকু লুকিয়ে আনন্দটুকু মুখে ফুটিয়ে গাড়ি চেপে ছুটে যায় যে যার গন্তব্যে।
লেখা: আকাশ এম সরকার, রিসার্স প্রফেশনাল, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা
0 Comments