গরমের ছুটি। কোথায় যাওয়া যায় ভাবতেই উঠে এলো মেক্সিকো নয়তো কানাডা। শেষ পর্যন্ত মেক্সিকো যাওয়ারই সিদ্ধান্ত হলো। হালকা কেনা কাটা, মেক্সিকো সিটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ আর যাতায়াতের টিকিট। ডিসকাউন্টে ভালো দামে টিকিট পাওয়া গেল। বাকি থাকলো হোটেল বুকিং। সেখানেও পাওয়া গেল ডিসকাউন্ট। অনলাইন থেকে নিয়ে নেওয়া হলো মেক্সিকো ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র। আমেরিকান ভিসা থাকায় খুব সহজেই মেক্সিকো ভ্রমণের অনুমতি মিলে গেল।
কলরাডো বিমান বন্দর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে সকাল সাতটায়। বিমান বন্দর আমাদের শহর থেকে তিন ঘণ্টা গাড়ির দূরত্ব। রাত আড়াইটায় আমরা বেরিয়ে গেলাম। আমরা বলতে সঙ্গে পতি মহাশয়। রাতের শুনশান নীরবতা, গৃষ্মের মৃদুমন্দ বাতাস। শীতের শেষে সবে গাছে কচি পাতা এসেছে। গাছগুলো যেন নতুন বউয়ের মতো ঘুমটা দিয়ে শাড়ি পরে আছে। আকাশে মধ্য বৈশাখের পূর্ণ চাঁদ হেলে গেছে পশ্চিমে। খণ্ড খণ্ড মেঘ চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। একবার চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। পরক্ষণেই নির্মল শিশুর মতো আড়াল থেকে বেরিয়ে খিলখিল করে হাসছে।
পাহাড়ি এলাকা। মাঝে মাঝেই ডানে বামে ছোট-বড় পাহাড়কে পিছনে ফেলে রাতের নীরবতাকে ছিন্ন করে যান্ত্রিক ভূভূ শব্দে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। মাঝে মাঝে উৎসুক হরিণ আশ্চার্য হয়ে ঘাড় তুলে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আবার পক্ষণেই বিপদ হতে পারে ভেবে দৌঁড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছে। কলোরাডোতে ঢুকতেই বিপত্তি বাঁধল। গাড়ির গতি না কমিয়ে উপায় নেই। সামারের এ সময়েও দুই পাহাড়ের মাঝে কুয়াশা ভরে আছে। হিম শীতল কুয়াশার প্রবাহ দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাচ্ছে। অগত্য ইমারজেন্সি লাইট দিয়ে সত্তর মাইল বেগের রাস্তা ত্রিশ মাইলে পার হতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি অতিক্রম করছে। যাদের একান্ত প্রয়োজন তারাই হয়তো এত রাতে রাস্তায় ছুটছে–গন্তব্যে। এবার চিন্তা হতে শুরু হলো। সময় হিসেব করে বের হয়েছি। রাস্তায় কম গতিতে চলার জন্য না আবার প্লেন মিস হয়ে যায়! তবে চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মিনিট বিশেক পর কুয়াশা কেটে গেল। এবার ছুটছি আবার। ভোর হবার আগেই আমাদের বিমান বন্দরে পৌঁছাতে হবে। সময় মতই পৌঁছা গেল। গাড়ি পার্ক করে এয়ারপোর্ট সাঁটলে চেপে বসলাম। চেকইন করে নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে আমরা অপেক্ষায় প্লেন ছাড়ার। দেখতে দেখতে সময় চলে গেল। চেপে বসলাম বিমানে। আমেরিকার পর এটা আমার দ্বিতীয় কোন দেশ ভ্রমণ। আমার বর অবশ্য এর আগে চীন আর কাতার ঘুরেছে।
চার ঘণ্টা পর আমাদের বিমান মেক্সিকো সিটি বিমান বন্দরে অবতরণ করল। নেমেই নিরাপত্তা চেক করে বাইরে যাবার লাইনে। ঢাকা বিমান বন্দরের সাথে বেশ মিল আছে। খুব বেশি উন্নত নয়। পুরনো আমলের বিল্ডিং। আবার নতুন গ্লাসে ঘেরা ভবনও আছে। নিরাপত্তা চেক করার পর কোন ঝামেলা ছাড়াই বের হলাম। শুরুতে সমস্যা হয়েছিল। নিরাপত্তা কর্মীরা খুব একটা ইংরেজি জানে না। আমরা আবার স্প্যানিশ জানি না। গুলগ ট্রান্সেটরে সাহায্য নিয়ে কাজ সারতে হয়েছে। বের হয়েই মেক্সিকান পেসো আর সিমকার্ড কিনে টেক্সি ডাকলাম। ঢাকার মতই ট্যাক্সি ওয়ালাদের হাঁক ডাক। দরদাম ছাড়াই ট্যাক্সিতে উঠে বসে হোটেলার ঠিকানা দেখালাম। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম যে ট্যাক্সি ওয়ালা আমাদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিয়েছে। হোটেলে পৌঁছাতে বিশ মিনিটের মতো লাগল। অনলাইন বুকিং দেওয়া ছিল–তথ্য যাচাই করে চাবি নিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম। ঘুম কম হওয়ায় ক্লান্তি লাগছিল। রুমে ঢুকে হাতে মুখে পানি দিয়ে কিছুটা ক্লান্তি দূর করলাম। এবার খাবার পালা। খিদে লেগেছে খুব। খাবারের খোঁজে তাই বের হতে হলো।
ডাউনটাউন বেশ ঘিঞ্চি এলাকা। একটা সাথে আরেকটা বিল্ডিং লাগানো। ঢাকার মতো। উঁচু উঁচু বিল্ডিং। বেশ পুরনো এলাকা–বড় বড় গাছ আর বিল্ডিংয়ের নির্মাণ দেখেই বোঝা যায়। তবে আধুনিক বিল্ডিঙও আছে। খাবার খেতে গিয়ে বিপত্তি হলো আর একবার। খাবারের দোকানগুলোতে ইংরেজি জানা কেউ নেই। এক রেস্টুরেন্টে জিজ্ঞেস করতেই অন্য আর একজনকে ডেকে নিয়ে এলো। অ্যাপ হাতে নিয়ে সে বেশ ভালোভাবেই সামলে নিলো আমাদের। তবে জানালো আমরা হালাল বলে যা চাচ্ছি তা তাদের কাছে নেই। অগত্য ভেজিটেরিয়ান খাবার খেতে হবে। অর্ডার যখন আসলো ততক্ষণে বুঝতে পারলাম আমরা আসলে তৃণভোজী হতে যাচ্ছি। এক বাটি লেটুস কিছু মেয়নিজ দিয়ে আমাদের সামনে রাখা হলো। আর ছিল পেঁয়াজের রিং ভাজি। সেটা খেয়েই কোন রকম বিল পরিশোধ করে বের হলাম রাতের খাবারের জন্য ভয়টা মাথায় নিয়ে। কারণ যা খেলাম তা আর দ্বিতীয় বার খাওয়া যাবে না। ফেরার সময় ব্রেড, জেলি পানি নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। হোটেলে ফিরেই শরীর ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু ক্লান্তিকে পাত্তা না দিয়ে আমারা বেরিয়ে পরলাম আবার।
এবার গন্তব্য মেক্সিকোর স্বাধীনতার প্রতীক এঞ্জেল অব ইন্ডিপেন্ডেট মনুমেন্টে–হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্বে। খুবই মনোরম দেখতে। সুউচ্চ মনুমেন্টের চূড়া। যার উচ্চতা ১১৮ ফুট, যা প্রায় চৌদ্দ তলা ভবনের সমান। এটি দেখতে অনেকটা জুলাই কলাম, কিংবা বার্লিন কলাম, কিংবা নিউইয়র্কের কলম্বাস মনুমেন্টের মতো। মনুমেন্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো একটা শিশু একটি সিংহকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিশুটি আসলে মেক্সিকোর জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করছে। এটি ১৯১০ সালে মেক্সিকোর স্বাধীনতার একশত বছর পূর্তীতে উদ্ভোধন করা হয়। মেক্সিকো ১৮১০ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্প্যানিশদের কাছও থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। মনুমেন্টটি চারদিকে চারটি কলামের ওপর দাঁডিয়ে আছে। যার তাৎপর্য হলো যুদ্ধ, আইন, বিচার এবং শান্তি। মনুমেন্টটি ঘিরে যুদ্ধাদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। বেসমেন্টে একটি জাদুঘর আছে। তবে করোনা পরবর্তী সেটা আর খোলা হয়নি। মনুমেন্টটি পর্যটকদের আকর্ষনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য প্রতিবাদ ও আনন্দ উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
হাঁটতে হাঁটেই রাত নেমে এলো। রাতের মেক্সিকো সিটি খুবই মনোরম। রেস্টুরেন্টগুলোর সামনে ছোট ছোট ব্যান্ডদল গান পরিবেশন করতে থাকে আর ভিতরে হইহুল্লোড করে চলে খাওয়ার পর্ব। ইতোমধ্যে আমরা বাংলাদেশি খাবারের দোকান খুঁজে নিয়েছি–কাবাব রেস্টুরেন্ট। বাংলাদেশি ও ভারতীয় খাবার পাওয়া যায়। ডিডিতে দেড়শ পেসো দূরত্বে। আগে থেকেই ফেসবুকে তাদের জানিয়ে রাখলাম যে আমরা আসছি। কিন্তু যখন পৌঁছালাম তখন দেখলাম ভাত বা বিরিয়ানি কিছু নেই। কারণ আমরা যেতে যেতে দেরি করে ফেলেছিলাম। ততক্ষণে রাতের খাবারের প্রায় শেষ সময়। নান আর মুরগীর মাংস দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলাম। শাকাহারীদের খাবারের চেয়ে তা ঢের ভালো।
এই লেখকের আরও লেখা...
0 Comments