শীতের জিঞ্জির মুক্ত হয়ে বসন্তের ট্রেনে চড়ে বসেছে আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যগুলো। তুষারের চাদর থেকে মুখ বের করে উষ্ণতাপ্রিয় বালিকার মতো রোদের আঁচ নিচ্ছে। শীতের তেজহীন সূর্যই গ্রীষ্মে তেজী ঘোড়ার মতো দৌঁড়াচ্ছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। তার ছোঁয়ায় গাছে গাছে রঙ লেগেছে সদ্য বয়ঃসন্ধির বালিকার মতো। কুঁড়ি থেকে বের হচ্ছে সবুজ পাতা। এমন গ্রীষ্মই এখানেই বেঁচে থাকার আনন্দ। সেই আনন্দে মন গ্যাস বেলুনে উড়ে বেড়ায়।
গাছে গাছে সবুজ পাতা, বাহারি ফুল, ফিরে আসা পরিযায়ী পাখি, ফসলের সবুজ মাঠ। ফসল বলতে সয়াবিন আর ভুট্টা। হলুদ গাঁদা থেকে লাল ডালিয়া, সূর্যমুখী, সালভিয়া, জারবেরা, ডেইজি, ক্যালেন্ডুলা, বাহারি গোলাপ, টিউলিপ, আরও কত কি! বাহারি তাদের রঙ। মন খারাপ করার জো কোথায়? আয়েশি বর্ণচ্ছটা নিয়ে দাড়িয়ে আছে বাগানে। কোথাও বা বেলকনির কার্ণিসে,সড়ক দ্বীপে কিংবা বাড়ির লনে। রোদের হিরককুচি লেগে আছে পাপড়িতে। সকালের সোনালি রোদের ঝিলিক লাগা সেই বর্ণিল পাপড়ি ছাপ ফেলে খসখসে মনেও। সুবাসিত করে চারপাশ। তারই গন্ধ নাকে মেখে সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে এক কাপ ধোয়া ওঠা কফি নিয়ে বসে বাড়ির মালিক।
সৌন্দর্য, কোমলতা আর পবিত্রতার প্রতীক এক একটি ফুল। উৎসবে আচারে, রঙে-ঢঙে, প্রেমে ও ভক্তিতে ফুল হয়ে ওঠে অপিহার্য। পার্কের কোনায়, রেস্তোরায় কিংবা ঘরে প্রেয়সীর প্রতিক্ষা । কখন তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ফুল হাতে দিবে দেখা। প্রিয়তমা সে ফুল খোপায় গুজে দেবে প্রতিদান। ভক্ত সে তো কাক ভোরেই ফুলের ডালা সাজিয়ে নতজানু দেবতার চরণে। উদ্দেশ্য দেবতার কৃপা দৃষ্টি। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
আমাদেরি কুটির-কাননে
ফোটে পুষ্প, কেহ দেয় দেবতাচরণে
কেহ রাখে প্রিয়জন তরে…
ফুল এখন আর শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধির বৃত্তে বন্দি নেই। রীতিমত হয়ে উঠেছে হাটের পণ্য। বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি টাকার সওদা হচ্ছে তাকে নিয়ে। বসছে টিউপিপ মেলা। ফুল যে শুধু মনব-মানবীকেই আকৃষ্ট করে তা নয়। হাজারো পাখি, পতঙ্গ চুম্বন করছে কোমল বর্ণীল পাপড়িতে। ফুলও তা পরম আবেগে গ্রহণ করে—প্রতিদানে দিচ্ছে মধু।
এতসব সৌন্দর্য আর মুগ্ধতার পরশ ছাপিয়ে এক সময় বেজে উঠবে বিষণ্ণতার তার সুর। রোদের আঁচ আর শীতের থাবায় শুকাতে থাকে ফুল। বিবর্ণতা আর মলিনতার ঢেউ জেকে বসে তাকে। শ্রীহীন এক একটি ফুল তখন ঝরে পড়ার মিছিলে যোগ দেয়। এ যেন মানব জীবনের এক চিরন্তন প্রয়ান গাথা। জীবনের উদ্দাম দ্যুতি শেষে প্রস্থানের ট্রেনে চেপে বসা। যে ট্রেনের গন্তব্য অজানা গহিন কোন অরণ্য। কিন্তু এই চিরাচরিত প্রয়ান জেনেও বাঁচতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে, দেখাতে হবে। স্বপ্নের ডানায় ভর করে খোঁজতে হবে স্বপ্নাতীত আগামী। ফুলের মতই যত দিন বাঁচি রূপ-রস আর গন্ধে আমোদিত করতে হবে পৃথিবী। তাইতো ফুলের সমান্তরালে চোখ রেখে মন অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই...
এই লেখকের আরও লেখা...
0 Comments