মানুষ মুগ্ধ হতে ভালোবাসে-হোক সেটা প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য , নয়তো নর-নারীর বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্য। কিছুটা মুগ্ধতা নিয়ে আমাদেরও ফেরা হলো ঘরে।
ওয়ায়োমিংয়ের ছোট্ট শহর লেরামি। তবে জনসংখ্যার তথ্যানুযায়ী ল্যারামি ভ্যালির ভিতর শহরটির আয়তন দিনদিন বেড়েই চলছে। পাহাড়ের ভ্যালির ভিতর হওয়ায় ঠিক পাহাড়ের মতো না হয়ে অনেকটাই সমতল ভূমির মতো। এই শহরের অন্যতম আকর্ষণ হলো স্নোয়িরেঞ্জ পর্বতমালা। যেন চীনের মহাপ্রাচীরের মতো অটল দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে নিরাপত্তা বলয় হয়ে। অবস্থান অ্যালবানি আর কার্বন কাউন্টির মধ্যবর্তী। স্নোয়িরেঞ্জকে দক্ষিণ ওয়াইয়োমিংয়ের রত্ন বলা হয়। এখানে দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো যা আছে সেগুলো হল, ক্রিস্টাল ব্লু অ্যালপাইন লেক, জাজেড চূড়া, বিভিন্ন রকম বুনো ফুল। এছাড়াও পিনকিন করা ও রাতে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকার জন্য ক্যাম্পগ্রাউন্ড। আছে হাইকিং ট্রেইল। তুষারপাত হলে স্নোই স্কি করার জায়গা আছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েছে এল্ক, মোজ, হরিণ। ল্যারামি থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে মেডিসিনবো জাতীয় উদ্যানের মধ্য পড়েছে স্নোয়িরেঞ্জ পর্বতমালা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে যার উচ্চতা প্রায় দশ হাজার ফুট। কোন এক হেমন্তের মিঠে কড়া রোদে আমরা বের হলাম স্নোয়িরেঞ্জের উদ্দেশ্যে। আমরা বলতে সঙ্গী বর। হেমন্তের এই সকালে জীবনানন্দ দাসকে মনে পড়লো-
হেমন্ত বৈকালে
উড়ো পাখপাখালীর পালে
উঠানের পেতে থাকে কান
শোনে ঝরা শিশিরের গান
তবে হেমন্তে এখানে শিশির পড়ে না। পড়ে তুষার। এই তুষারপাত চলবে পাঁচ-ছয় মাস ধরে, এপ্রিল-মে পর্যন্ত। তুষারপাত পুরোপুরি শুরু হলে স্নোয়িরেঞ্জ যাবার এই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
খটখটে মাঠের বুক চিড়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। আঁকা-বাঁকা সাপের মতো নয়। খুব বেশি উচু-নিচুও নয়। ছন্দহীন। সাঁইসাঁই করে গাড়ি ছুটে চলছে। যাদের তাড়া আছে তারা অভারটেক করে যাচ্ছে। কোন হর্ণ নেই-নিয়ম মেনে লেন ধরে চলছে যে যার ছন্দে। দূরে পাহাড়ের সারি দাঁড়িয়ে নির্বাক। যেন পাহারা দেওয়াই তার কাজ। বাংলাদেশের পাহাড়গুলো সবুজে ঘেরা। যেটা এখানে অনুপস্থিত, কিন্তু এখানের যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করেছে, সেটা হচ্ছে এখানকার প্রশস্ত রাস্তা, কোথাও কাঁদা-মাটি, ধুলো-বালির ছিটে ফোঁটা নেই। মাঝে মাঝে গরু নির্ভার ভাবে ঘাস খাচ্ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ গরুর খামার আছে। হঠাৎ একপাল হরিণ দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। শহরে হরিণ দেখেছি তবে এত বড়ো পাল নয়। গৃষ্মে নতুন বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাসহ হরিণগুলো চড়ে বেড়াচ্ছে আর কুটকুট করে ঘাস খাচ্ছে। আবারও জীবনানন্দ মনে পড়ে গেল-
কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস— তেম্নি সুঘ্রাণ—
হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।
আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে-গেলাসে পান করি
আমি কি ঘাসের প্রেমে পড়ে গেলাম? না কী হরিণের? কে জানে! কবিতা, গল্প, উপন্যাসের জীবন্ত প্রকৃতিকে এমন ভাবে উপস্থাপিত হতে দেখে প্রেমে না পড়ে উপায় কী?
আমাদের গাড়ি গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। আমি এ শহরে শুধু নই, আগন্তুক এ দেশেও। তাইতো কৌতুহল নিয়ে আশপাশটা তাকিয়ে দেখছি। শহর পেরিয়ে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু বিস্তৃত খোলা ভূমি, কোন আবাসস্থল চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে দু' একটি খামার, হরিণের পালদেখা পাওয়া যায় যা সত্যিই উপভোগ্য। দৃষ্টিগোচর হয় দূরের ঐ পাহাড় আর নীল দিগন্ত। মনে হচ্ছে হাত ছানি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। আবার এটা বললেও ভুল হবে না নীল রঙের আকাশকে, পাহাড় তার সুউচ্চ শরীর দিয়ে ছোঁয়ার বৃথা চেষ্টা করে চলছে।
সেন্টিনিয়ল পার হলেই আমাদের গাড়ি পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে গেল। চারদিকে এখন কিছু গাছ দেখা যাচ্ছে। তবে বেশিরভাগই পাইন গাছ। মাঝে মাঝে এস্পেন পাতা নাড়িয়ে দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাচ্ছে। সেন্টিনিয়ল খুবই ছোট পাড়ার মতো। মাত্র ১৫০ জন মানুষের আবাস। আর একটু সামনে এগুতেই রাস্তার বামে ওয়াচ টাওয়ার দেখতে পাওয়া গেল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরের পাহাড়ের সারি দেখা যায়। একসময় টেলিস্কোপ ছিল। যদিও এখন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। টেলিস্কোপে পাশের অন্য তিনটি প্রদেশ দেখা যেতো।
ওয়াচ টাওয়ার পার হলেই স্নোয়িরেঞ্জ পর্বতের চূড়া ঠিকঠাক দেখা যায়। যতই কাছে যেতে থাকলাম-একটা অনির্বচনীয় ভালো লাগা ভিতরে কাজ করতে থাকলো। সৃষ্টির কী অনন্য সৌন্দর্য! কী দৃঢ়তায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কত কত ইতিহাস নিয়ে -কালের পরিক্রমার স্বাক্ষী হয়ে আছে কে জানে? কত দিনই বা থাকবে তাই বা কে জানে?আশ্চর্য লাগে, কিয়ামতের দিন এই পাহাড়ই তুলোর মতো উড়বে! স্নোয়িরেঞ্জের কোন পাহাড়ের চূড়ায় যেন মধ্য ষাটের দশকে একটা বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ছেষট্টি জন যাত্রীর সবাই মারা গিয়েছিল। কী মর্মান্তিক!
ভাবতে ভাবতে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের পাদদেশের খুব কাছাকাছি চলে এলো। পাদদেশ থেকে টলটলে নীল জলরাশি নিয়ে শুয়ে আছে লেক। নাম মিরর লেক। তারই অদূরে আরেকটা লেক-লেক মেরি। দুজন সহোদরা কি না কে জানে? আকাশের নীল হ্রদের জলের সাথে মিলে একাকার হয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছে। এরকম ছোট বড় অনেক লেক ছড়িয়ে আছে স্নোয়িরেঞ্জের চারপাশে।
গাড়ি পার্কিং করে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। পায়ে পায়ে ঘাস ফুল ছোঁয়ে যাচ্ছে। লতিয়ে যাচ্ছে বুনো লতা। একদিকটায় ঠিক প্রশস্ত ট্রেইল নেই। রাস্তা করে হাঁটতে হচ্ছে। সাবধানে হাটতে হয় না হলে পা পিছলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড়ের ওপর থেকে ঝিরিঝির পানির গড়াছে লেকে। তাই মাঝে মাঝে স্যাঁতস্যাঁতে। দেখে দেখে সামনে এগুতে হয়। অনেকে আবার বেশ ঘটা করে মাছ শিকারের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন, কিছুক্ষন মুগ্ধ হয়ে সেসব উপভোগ করলাম। এরপর পাহাড়ের প্রশস্ত ট্রেইল ধরে হাটা আরম্ভ করলাম। অসংখ্য পাইন গাছ পাহাড়ের বুক জুড়ে।
ফাঁকে ফাঁকে দেখা মেলে রঙিন অ্যাস্পেন গাছের। রঙিন বলতে হেমন্তের ঠাণ্ডা বাতাসে পাতা হলুদাভ মেরুন হয়েছে। এখানে এটাকে ফল কালার বলে। রঙধনু যেমন আকাশের সৌন্দর্য আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় ঠিক তেমনই-গাছের ফল কালার পাহাড়ের সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। পরক্ষণেই মনে হলো-আহারে! আমি তো শুধু সৌন্দর্যের কথাই ভাবছি। কিন্তু পাতা ঝরা এই গাছগুলোর কতই না কষ্ট হচ্ছে-হবে। সামনের শীতের দীর্ঘ সময় তার খাদ্য প্রস্তুত করতে পারবে না। জমানো খাবার দিয়ে কোন রকম প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে! ছোট একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে গেল কি?
লেকের পানি ভাটিতে গড়াচ্ছে। কানে পানি গড়ানোর একটানা শব্দ। এই কলকল ধ্বনি সত্যিই মনোমুগ্ধকর-প্রশান্তি দেয়। অনেকে আবার রাএিযাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছে পরিবার,বন্ধু নিয়ে। আরভি বা রিক্রিয়েশন ভিহিক্যাল নিয়ে, কেউ বা আবার খোলা আকাশের নীচে তাঁবু টানিয়ে উপভোগ করেন রাতের তারা ভরা আকাশ আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। এই চাঁদ, তারার খেলা, রাতের নির্জনতাকে আরও একটু ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। আশপাশটা ঘুরে বেশ ক্লান্ত। এখন আমাদের ফেরার পালা।
ফেরার পথে দেখা মিলল মোজ (মহিশ সদৃশ প্রাণী)। মানুষ গাড়ি থামিয়ে দেখছে। রাস্তায় কিছুটা জ্যাম পড়ে গিয়েছে। আমরাও খানিকটা থেমে দেখে নিলাম। মানুষ মুগ্ধ হতে ভালোবাসে-হোক সেটা প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য, নয়তো নর-নারীর বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্য। কিছুটা মুগ্ধতা নিয়ে আমাদেরও ফেরা হলো ঘরে।
0 Comments