২৬ শে ডিসেম্বর। ডেক্স ক্যালেন্ডারে চোখ পড়তেই ঐ তারিখটাতে গিয়েই চোখ আটকে গেলো অরণীর! ক্রুর হাসি খেলে গেলো ওর চোখে-মুখে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুর ফোটাগুলো অভিমান হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো যেনো। বড্ড অবহেলায় অশ্রুর ছটাটি কড়ে আঙ্গুলে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো ও। কেবল এই একটি দিনই ওর অনেককিছুই এলোমেলো হয়ে যায়! এক সদ্য নবজাতকের আর্তচিৎকার চারপাশটা গ্রাস করতে থাকে তখন।
রাস্তার ওদিক থেকে হাঁক ছাড়তে ছাড়তে চলে গেলো এক ফেরিওয়ালা। হঠাৎই সম্বিত ফিরে এলো অরণীর। বেলা অনেক গড়িয়েছে। বিছানা ছাড়া দরকার। কিন্তু শরীররটা কেমন যেনো ম্যারম্যারে হয়ে আছে। চাইলেও বিছানা ছেড়ে ওঠতে পারছে না। অফিসেও যেতে মন চাইছে না আজ। কিন্তু মজুরদের অফিস কামাইয়ের সুযোগ আছে! নাহ্, যেভাবেই হোক আধবেলা অফিস করেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে ভেবে নেয় অরণী।
২৫ শে ডিসেম্বর। সকাল সাড়ে নয়টা। মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো অন্তসত্ত্বা একজন নারীকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগির অভিভাবক কে জানতে চাইলে, ছুটে এলো আধময়লা ও আটপৌড়ে শাড়ি পরিহিতা ত্রিশোর্ধ এক নারী। "আমি রোগির গার্জেন। উনি আমার আফা হউন। আমি উনার বাসায় কাজ করি। কাল থিক্যাই পেটের ব্যাথায় কোঁকাইতাছে বেচারি,দয়া করে উনারে ভর্তি করায়ে নেন, স্যার।' এই বলে আঁচলে গুঁজে রাখা টাকার দলাটি টেবিলে রাখলো টুনির মা। সরকারি হাসপাতাল। বেড পাওয়া খুব মুশকিল। তবে টাকার জোর আর ক্ষমতার দাপট থাকলে বেড পাওয়াও নাকি তেমন ব্যাপার না। ভর্তি করিয়ে নেয়া হলো অন্তসত্ত্বা সেই নারীকে। মেঝের ওপর কাত হয়ে কখনো বা' হাত, কখনো বা ডান হাতটি পেটের ওপর চেপে ধরে যন্ত্রনায় ছটফট করছিলো সেই নারীটি। এরই মধ্যে নার্স এক লহমায় এসে রোগিকে দেখে নিয়েই টুনির মাকে জানালো, 'এই রোগির সাথে আসছে কে?"
'আমি উনার বাড়ির লোক।", জানালো টুনির মা। 'বুঝলাম, তুমি ছাড়া আর কেউ নেই উনার। থাকলে খবর দাও। আর বেশি সময় নেয়া যাবে না। উনাকে ডেলিভারি রুমে নিতে হবে', এই বলেই বেরিয়ে গেলো সিস্টার।
হাতে গোঁজা দলা পাকানো কাগজের টুকরোটি অভ্যর্থনা কক্ষের এক ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে টুনির মা বললো,'স্যার এই নাম্বারে একটা ফোন দিতে পারেন? এইহানে আমি এক রোগি নিয়া আইছি তো উনার এক আত্মীয়রে জানান দ্যায়া লাগবো।'
"ভাবী এখন কোথায়? আমাকে আগে জানাও নাই ক্যান! কখন নিয়ে আসছো হাসপাতালে?" এই বলে তড়িঘড়ি করে টুনির মা'র সাথে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটা ধরলো এক ভদ্রলোক।
"সিস্টার, আমি রুনু হাওলাদার। রোগি আমার বন্ধুর স্ত্রী। ওর অফিসে কাজের চাপ থাকায়, ও আসতে পারে নি। রোগির অবস্থা এখন কেমন?'
'উনাকে ডেলিভারী রুমে নিতে হবে। আর বেশী দেরী করা যাবে না। রোগির অভিভাবক কোথায়?' জানতে চাইলো সিস্টার।
"আমিই রোগির অভিভাবক। উনাকে ডেলিভারী রুমে নিতে পারেন।"বলেই সিস্টারের সাথে তড়িঘড়ি করে ১নং ওয়ার্ডের মহিলা কেবিনে ঢুকলো রুনু হাওলাদার।
অফিস থেকে ফেরার পথে বেকারি থেকে একটি কেক ও সাথে কিছু ফুল নিলো অরণী। এই একটি দিন, যে সময়টি সে নিজের মতো করে কাটাতে চায়।
অন্ধকার ঘর। রাস্তার বাতির ক্ষীণ আলোকচ্ছটায় রহস্যময় হয়ে ওঠে ওর ছোট ঘরটি। শতরঞ্জির ওপর পেতে রাখা কেক ও ফুলের গোছাটিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে কখন যে মুখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রুর এক একটি ফোঁটা কেকটির সাথে এক হয়ে মিশে যাচ্ছিলো খেয়ালই হয় না ওর। হঠাৎই মোবাইলটি তীব্র কর্কশ শব্দ করে ওঠে। ওই প্রান্ত থেকে ভেসে আসে এক নারী কণ্ঠ। ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ও কিছু কুশল বিনিময় করেই ফোনটি রেখে দেয় ভদ্রমহিলা। সব যন্ত্রণা একে একে বিরক্তিতে রূপ নিয়ে পাশে থাকা সেই মোবাইলে গিয়ে পরে। " ধ্যাৎ, মোবাইলটা বন্ধ করতেই ভুলে গেছি। কেন যে লোকজন এই ছাইপাশ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়, বুঝি না।"
মোবাইলের সুইচড অফ করতে গিয়েই কষ্ট-যন্ত্রণাগুলো চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ওকে!
" খুব দরকার ছিলো এমন অযত্ন আর অবহেলায় এই চরাচরে একটি প্রাণের আগমন ঘটানো! আমার মতো অবহেলিত একটি ভ্রুণ না আসলে কার কি এমন ক্ষতি হতো! " কষ্টে- অভিমানে এ যেনো নিজের সাথে নিজের কথা বলা, "এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে আমার কেউ নেই। আমার ওপর কারো দায় নেই, ছিলোও না কোন সময়! আমারও দায় নেই কারো ওপর! প্রয়োজনও নেই।" বুক ঠেলে পাহাড়সম অভিমান গলে গলে ওর চোখ বেয়ে পরতে থাকে যেনো। ঠিক তখনি মিডফোর্ডের মেঝের ওপর যন্ত্রণায় কাতর অন্তসত্ত্বা সেই নারীর মুখাবয়ব ভীষণ মনে পরে যায় অরণীর। মূহুর্তেই সদ্যজাত সেই নবজাতকের আর্তচিৎকার বিদীর্ণ করে দিয়ে যায় ওর অন্ধকার ঘরটিকে।
এই লেখকের আরও লেখা...
তুতুর স্পেশাল ।। শাপলা বড়ুয়া
0 Comments