ফিরোজ শাহের কবিতা: নতুন এক স্বর ।। অলোক বিশ্বাস



ছোট কবিতার শব্দ সংস্থাপন পরিসর যেহেতু সীমিতঅধিকাংশ ক্ষেত্রে চটজলদি একটি মুখ্য বার্তা সন্নিবদ্ধ করার প্রবণতা থাকে। কবিতা সর্বক্ষেত্রে কবিতাই। একথা মেনেও কবিতার বিভিন্ন প্রবণতাবৈচিত্র্যময় গঠনকবিতার আদলে অদ্ভুতরকম নিরীক্ষাকবিতাকে অবশ্যই আবহমান সত্তা থেকে পরবর্তী সম্ভাবনায় পৌঁছে দিয়েছে অসংখ্যবার। বহুকাল ধরে কবিরা যে আখ্যানধর্মী কবিতা লিখে এসেছেনসেই আবহমান ধারা তো চলতেই পারতো—বিংশ শতকে এবং এই একবিংশে। কিন্তু বিস্ময় আর যাপন মুহূর্তগুলোর সমানুপাতিক হয়ে এবং একই সঙ্গে প্রতিশিল্পের সন্ধানে বেরিয়ে চৈতন্য মানস জগতের কবিমানুষ আবিষ্কার করে নিয়েছে ঐচ্ছিক অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন রূপ

ইচ্ছার বহুস্তরীয় ব্যঞ্জনাকে প্রয়োগ করে কবি ফিরোজ শাহ কবিতাকে মুক্তাঞ্চলে ছেড়ে দিয়েছেন কবিতায় প্রদর্শিত কাব্যিক অতিরঞ্জন আর অলঙ্কারের ঔদ্ধত্য থেকে কবিতার অন্তরাবয়বকে বিচ্ছিন্ন করে। যেকোনো প্রকার পরিমাপের ও সংশ্লিষ্ট কাব্য ভাষারীতির সচেতন অসচেতন পুনরাবৃত্তি চলতে চলতে কোনো জাতির কাব্যে একমাত্রিক অর্থব্যাপ্তি আপনা থেকেই গড়ে ওঠে। যেমনভাবে কিছু ব্যতিক্রম রেখেও গড়ে ওঠে চিত্রকল্পের পৌনঃপুনিক সাদৃশ্য। একই চিত্রকল্পকে সামান্য অদল বদল করে এবং মাত্র পোশাক বদল করে অধিকাংশ কবি প্রচল কবিতার সঙ্গে অন্যতর কবিতার চিহ্নবিভাজিত পরিসরগুলোকে ক্রমশঃ গুলিয়ে ফেলেন। মুক্ত কবিতায় বার্তাটি থাকবে পরোক্ষে। কিন্তু শিল্প সূক্ষ্মতায় তাকেও তীব্র ইঙ্গিতময় রাখা যায়। যেমনটি করেছেন কবি ফিরোজ শাহ তাঁর 'মানুষ নিজেই একটি বিয়োগচিহ্নগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায়। তরঙ্গায়িত জলের প্রাকৃতিক সারল্যের একমাত্রিক অভিমুখকে কবি ফিরোজ শাহতাঁর নির্মিত অভিসারে প্রথামুখ থেকে টেনে চিত্রকল্পের অনভিপ্রেত লক্ষণগুলোর সঙ্গে সম্পর্কায়িত করেছেন কবিতায়। পাঠকের অভিপ্রেতে ধাক্কা লাগছে। ওঁর কবিতা পাঠের সময় পর্বে স্থান ও অবস্থানের শিফ্টউত্তর আধুনিক মুক্তচিন্তার অন্যতম নিয়ামক। অবস্থানগত শিফ্টকে বা পেরিফেরাল শিফ্টকে কবিতার নির্মাণ চেতনায় ব্যবহার করেছেন কবি

 

শৈশবের দুরন্তপনা ও দুষ্টুমির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। কবি তাঁর কবিতায় প্রয়োগ করেছেন সেই দুরন্তপনাযে দুরন্তপনাসংস্কারমথিত পেট্রিয়ারকাল সমাজের চোখ রাঙানি মানে না। কবি ব্যবহার করেছেন গর্ভবতী নারীর উল্টোপাল্টা স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে। কবি ব্যবহার করেছেন কাব্যিক সমাজের শৃঙ্খলার বিপরীতে থাকা তরুণ মনের আয়রনিকে। ব্যবহার করেছেন দৌড় প্রতিযোগিতার শুরুতে হুইসেলের অপেক্ষায় থাকা প্রতিটি প্রতিযোগীর হৃদয়ের ধুকপুক। বাংলাদেশের প্রান্তিক হাট বাজারে যাঁরা নিয়মিত যানতাঁরা একটা জিনিস কখনো লক্ষ্য করে থাকবেন। কিছু বিক্রেতা যেসব জিনিস বিক্রিতে ব্যস্তসেই জিনিসগুলোর নিজস্ব বস্তুনামের পরিবর্তে অন্য কোনো আইডেন্টিফিকেশন ব্যবহার করছেন সেইসব বিক্রেতা। যেমন ধরুনসদ্য জমি থেকে তুলে আনা ডবকা মূলোর নামের পরিবর্তে তাঁরা চিৎকার করছেনরসকদম বা নলেন গুড়ের রসগোল্লা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে বস্তুটি একই থাকলেও ক্রেতা বা বিক্রেতার কাছে বস্তুর আইডেন্টিফিকেশন বদলে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিক্রয়যোগ্য বস্তুর মধ্যে থাকা অর্থ ও স্বাদকে নতুন সময়ের কৃষক আনন্দজনিত ইচ্ছায় নতুন পরিচিতি দিতে চাইছেন

 

বস্তুজগতের মধ্যে কবিসত্তা মিশে যাচ্ছে। হ্যাঁবস্তুপ্রকৃতির কবির নিবিড় সান্নিধ্য দেখছিআবার সেই সান্নিধ্য থেকে তাঁর বেরিয়ে আসাটাও দেখছি ফিরোজের কবিতায়। বস্তুপ্রকৃতির সান্নিধ্য বিচ্যুত হবার সময় বস্তুপ্রকৃতির কিছু কিছু উপাদান মুহূর্তকে তিনি সঙ্গে নিয়েই বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। এরপর সেসবের মধ্যে নিজস্ব ভাবনাভঙ্গিমাফ্যালাসিপার্সোনাল বা ব্যক্তিগত মেটাফরবস্তুর প্রাণীকরণ বা পারসোনিফিকেশনএ্যান্টিথেসিসপান (pun) ইত্যাদির মিশ্রণে বস্তু প্রকৃতির ক্ষণমুহূর্তের স্বভাব রিমেকিং ঘটাচ্ছেন। বস্তুপ্রকৃতির সাইকোলজিকাল ট্রান্সফরমেশন ঘটছে ফিরোজ শাহের কবিতায়। বস্তুপ্রকৃতিকেই আবার কবি অধিকার দিচ্ছেন কবিসত্তাকে নিয়ে খেলার। পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের মধ্যে। চলতে চলতে সর্বদা সাইকোলজিকাল ট্রান্সফরমেশন ঘটতে থাকাযা ফিরোজ শাহর কবিতাকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে। আমরা 'বিলকবিতাটির পাঠ নিই এবার—

শরীর একটা বিল

আষাঢ় এলে থইথই জল

 

মেঘের শাড়ি খুলে বেরিয়ে আসে একঝাঁক বক

ঠোঁটে পুঁটি মাছের

অভিশাপে চলে আসে পৌষমাস

 

শুকনো বিলে 

ঘাসের খোঁজে ছুটছে গরুর পাল।

সাত পংক্তির কবিতা। মাঝে তিনটি স্পেস। স্পেস চিহ্ন আমি দিয়েছি বোঝানোর কারণে। এক্ষেত্রে কবির সত্তা 'বিলহতে পারার অধিকার নিয়েছে অথবা প্রকৃতিকে সেই অধিকার দিয়েছে তাঁর সত্তাকে জলপূর্ণ বিলে পরিণত করার। কবি প্রথম স্তবকে বলছেন, 'শরীর একটা বিল'। দ্বিতীয় স্তবকে আষাঢ়ের প্রাকৃতিক মাত্রার যথার্থ ছবিথইথই জল খুবই স্বাভাবিক। এটাও স্বাভাবিক যে মেঘের ভেতর থেকে একঝাঁক বকের থইথই জলভরা বিলের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া। মেঘের সঙ্গে 'শাড়িশব্দটাকে ব্যবহার করে কবি মেঘকে পারসোনিফায়েড করলেন। একটা চিত্রকল্পও তৈরি হলো। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তবকে'অভিশাপও 'শুকনোশব্দদুটো এ্যান্টিথেটিকাল ভিউ তৈরি করছে। একঝাঁক বকের ঠোঁটে পুঁটিমাছ। কিন্তু পুঁটিমাছগুলোর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুজনিত অভিশাপে চলে আসছে পৌষমাস।

 

'পৌষমাসশব্দের সঙ্গে সর্বনাশ প্রসঙ্গটি প্রবাদপ্রতিম। অনেকেই জানিপৌষমাস কারো কারো সর্বনাশের কারণ। এরপর ট্রানজিশন অর্থাৎ থইথই বিল পরিণত হচ্ছে শুকনো বিলে। বিল শুকিয়ে ওঠার সময় ঘাস জন্মাতে থাকে সেখানে। বিলের শুকিয়ে যাবার ঘটনাটি কবির কাছে অনভিপ্রেত হলেও প্রাকৃতিকতার স্বভাবকে কবি গ্রহণ করে নিচ্ছেন। আর ক্ষুধার্ত গরুর পাল শুকনো বিলে জন্মানো ঘাসের খোঁজে ছুটছে। একটা বড়ো সময় পর্বের কালানুক্রমিক প্রক্রিয়াটি ঘটছে কবিসত্তার মধ্যে এবং অবশ্যই মাত্র তিনটি স্পেসসহ ৬ লাইনের কবিতায়। বস্তুপ্রকৃতির এই ট্রান্সফরমেশন কবি এ্যালাও করছেন বা ঘটতে দেখছেন মানবসত্তার জগতে। 

 

এবার দেখে নিই কবি নিজে কী বলছেন 'মানুষ নিজেই একটি বিয়োগচিহ্ন'-র কবিতাগুলো সম্পর্কে। কবি লিখছেন, ''আমার জীবন অভিজ্ঞতাভেতরের চোখ দিয়ে এঁকেছি 'মানুষ নিজেই একটি বিয়োগচিহ্নকবিতার বইয়ে। পুড়ে যাওয়া খণ্ড সময়ের স্মারক যা আমার নিজেরই অংশ। পয়সার ভেতরে আনন্দবৃক্ষ। হাত বদলে ছড়িয়ে পড়ে সাদা ঘ্রাণ। বাবার প্লেটে আলুভর্তার পাশে আস্ত একটা চাঁদজোছনা খেতে খেতে বাবার জোনাকি হয়ে যাওয়া। পোড়া মরিচের অন্ধকারে দৌড়ে মায়ের আয়ুরেখা অতিক্রম। আমার যাপিত জীবনের স্বচ্ছ আয়না। রেললাইন থেকে নিয়ে আসা পাথরট্রেনের শব্দ পেয়ে আবার রেললাইনে ফিরে যায়। বন্দি জীবনের মায়া কি আমি কখনো ত্যাগ করতে পেরেছিকলাপাতার ওপরে বসে থাকা ক্লান্ত শালিক নিজের ডানা খুলে ফেলে। আর কলাগাছ সেই ডানা লাগিয়ে উড়ে যায় আকাশে। সবাই মুক্তি চাই। নিজের শাড়ি খুলতে খুলতে পেঁয়াজ মুছে যায় দ্রাঘিমারেখার। বাটিতে করে সমুদ্র ঘরে আনি। লাফ দেয় ইলিশ মাছ যেন পরম সৌভাগ্য। কিন্তু সেই সৌভাগ্য অধরাই থেকে যায়। আর সেই কষ্ট বুকে নিয়ে মানুষ বিয়োগচিহ্ন হয়ে যায়। ট্রেনের বগির মতো জোড়া লেগে পালিয়ে যায় স্টেশন থেকে। আমার আত্মদর্শনের সাংকেতিক দলিল হলো 'মানুষ নিজেই একটি বিয়োগচিহ্ন'"

এই কবিতার বইয়ের প্রথম কবিতা 'আনন্দবৃক্ষ'— 

পয়সার

ভেতরে একটি আনন্দবৃক্ষ

প্রতিবার

হাত বদলে

একটি করে ফুল ফোটে

ছড়িয়ে পড়ে শাদা ঘ্রাণ।

 

  কবিতার উৎস আনন্দ। 'আনন্দশব্দ যোগে বৃক্ষকে পারসোনিফায়েড করা হয়েছে। সেই আনন্দকে আবার যুক্ত করা হয়েছে পয়সায়যা জীবনের অনিবার্যতার প্রতীক। জীবনে আনন্দ কখনো একাকার হয়ে যায় পরানুভূতির সঙ্গে। আনন্দ বহুমাত্রিক। কবির আনন্দ জরায়ু থেকে নভিকুন্ড থেকে। নরক থেকে বিবাহের মঙ্গলসূত্র থেকেসমুদ্রের আছড়ে পড়া থেকে সৃষ্ট। সেই মানবিক আনন্দ সঞ্চালিত হচ্ছে বৃক্ষে। এবং আনন্দবৃক্ষটি মানুষের হাতে। তার অবয়বে ফুল ফোটেছড়িয়ে পড়ে শাদা ঘ্রাণ। অনেক সময় কবিতাকে ডিকোড করতে হয়। এখানে এই কবিতায় কোনো কিছু ডিকোড না করেই আনন্দের বিনির্মিত স্তরে পাঠকের ভ্রমণ করতে অসুবিধা হয় না। 

 

ফিরোজের বেশ কিছু কবিতা পড়ার পর মনে হয়ওঁর চেতনায় হঠাৎ হঠাৎ বিস্ময়বোধ প্রবল হয়ে উঠছে আর এভাবেই নিয়মরীতি তোয়াক্কা না করেই নির্মিত হচ্ছে মহাচেতনার জগৎ। ফিরোজের পরিণত কবিতা বাংলা কবিতার নতুন এক স্বর। নতুন এক হাইপার রিয়েলিটিঅথচ খুব সংহতসংযত। নতুন চিন্তাবাস্তবের কাজ। এই স্বভূমি প্রথাগত নয়। যদিও বাংলা কবিতার প্রবাহমান রূপবৈচিত্র্য এখানে অস্বীকৃত হয়নি। ভাষাগত নিজস্ব আবেগ কবিরা নির্মাণ করে নেন স্বাতন্ত্র্যের প্রবণতায়। ফিরোজ শাহ এইসব ছোটো কবিতায় নিজস্ব আবেগের মায়াবিহারী রূপবৈচিত্র্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন। পেয়েও যাচ্ছেনসাধনার বৈয়াকরণিক অবস্থান সম্পর্কে অবগত হয়েই। সেই অবস্থানের শিফ্ট যখন কবিকে অস্থির করেভাঙেহৃদয়কে ওলোটপালোট করতে থাকে অবিরতকবি ফিরোজের পক্ষে চড়াই-উৎরাই পথচলার সচেতনতা প্রকাশ সম্ভব হয়। অসম্ভবের সম্ভাবনা ছুঁতে চান সেই কবি যাঁর জাগরণে প্রবেশ করেছে বিকেন্দ্রিকরণ প্রক্রিয়া। 

 

কবি ফিরোজ প্রথাগতর কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ছেন অন্য মেরুতে। তিনি নতুন এক ভাষা উৎসবে মেতে উঠেছেন। মনের গভীরে যখন বাউলজন্ম অনুভূত হয়তখনই বোধ হয় এমন মুক্তকবিতা সম্ভব। কবিতা নামক যে আতুতুতু ব্যাপারসেটা সটান ভাঙতে পারেন তিনি। ওঁর কবিতায় বেশ ভালো লাগছে অপর চিন্তাচিহ্নের ব্যবহার। পৃথক উত্তাপ পাওয়া যায় ওঁর ছোটো ছোটো কবিতাগুলো থেকে। কেউ বলবেন অণু কবিতাকেউ বলবেন মাহূর্তিক কবিতা। আদপে এমন লেখায় কবিতাই আছে সামগ্রিকভাবেবাউল চেতনায়। বাংলা ছোটো কবিতার ইতিহাসে লেখা থাকবে কবিতার নিজস্ব নির্মাণ শৈলির এই প্রাকৃতিকতা। নির্মাণ শৈলির মুক্ত পৃথিবী রচিত হয়েছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কবিতায় একবিংশের দুই দশকে। কবি ফিরোজ শাহ তাঁদের অন্যতম। ভাষার অন্দরমহলের অন্যতর যাপনের খেলাটিকে বহির্জাগতিক অবস্থার সঙ্গে যাদুবাস্তবতায় অভূতপূর্বভাবে সমন্বয় করে দিচ্ছেন তিনি। 

 

শব্দ-ভাবনার বিন্যাসগুলোকে চমকপ্রদভাবে ব্যবহারে কবিতার নির্ধারিত মিথকে ধাক্কা দিচ্ছেন। ছোটো কবিতার লিনিয়ার প্রক্রিয়াতে নতুন ভাবনার সংযোজন ঘটছে। ছোটো কবিতার ট্র্যাডিশনকে তিনি ছুটি দিচ্ছেন। আমাদের নিরূপিত ছন্দের পাঠপছন্দকে ধাক্কা দিচ্ছেন। কবিতার ভাষাবিন্যাসে যোগ করছেন সুন্দরের ভেতরে অন্য সুন্দরকেযাকে কেবল পরাবাস্তবতায় সঙ্গায়িত গণ্ডিতে ব্যাখ্যা করা চলে না। আবহমান বাংলা কবিতার পাঠ যদি কোথাও এসে থমকে যায়তার পরের অবস্থা কী হতে পারে,একজন পাঠক সেটা যতোক্ষণ না উপলব্ধি করবেনফিরোজের কবিতা পাঠের উপভোগ্যতা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে। প্রথাবিরোধী মনন অর্জনের ইচ্ছায় ফিরোজের কবিতার অন্তরপ্রবাহকে চিহ্নিত করা সম্ভব বলে আমার মনে হয়

 

ফিরোজ শাহের কবিতা গ্রন্থ 'মানুষ নিজেই একটি বিয়োগচিহ্নপাঠে আমি এই গ্রন্থের লেখাগুলোর যে সব বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন লক্ষ্য করেছিসেগুলো এরকম—

১. স্বভাবগত পুনরাস্থাপন সঞ্চালন বা সাফ্লিং (কলাগাছ শালিকের ডানা লাগিয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে: মুক্তি)। 

২. ভাষার সৌন্দর্যায়ন ( চশমা জিরোচ্ছে টেবিলে/ ফ্রেম থেকে বের হয়ে/ গ্লাস দুটো উড়ে যাচ্ছে বিড়ালের চোখে/ জ্বলে ওঠা অন্ধকারে মনের আনন্দে/ বিড়াল হেঁটে যাচ্ছে দোজখের দিকে: চশমা)। 

৩. এ্যালিয়েনেশন। 

৪. কল্পনাগত উল্লম্ফন (মাছদের ঘুম পাড়িয়ে উড়ে যায় জামগাছ: জামগাছ)। পরিচয়গত চিহ্নগুলোর (identification) রূপান্তর

৫. একজনের বস্তুগত উপাদান অন্যের দ্বারা স্বায়ত্তিকরণ। 

৬. ম্যাজিক রিয়ালিজমের উপুর্যপরি ব্যবহার (ওয়েট মেশিনের ওপর দাঁড়িয়ে আছি/ আমার ওজন শূন্য দেখাচ্ছে। ব্যাটারিমেশিন সবই ঠিকঠাক/ মাটি থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছি: দুঃখ)। 

৭. পারসোনিফিকেশন বা বস্তুর ওপর ব্যক্তিত্বের আরোপ। 

৮. অতিপ্রাকৃত উপাদানের ব্যবহার। 

৯. তান্ত্রিকতার নিয়োজন। 

১০. ট্রাজেডি। 

১১. এ্যামবিভ্যালেন্স বা বিপরীতধর্মী অবস্থার যুগপৎ ক্রিয়াশিলতা। 

১২. সাইকোলজিকাল ট্রান্সফরমেশন (মানুষ নিজেই একটি বিয়োগচিহ্ন/ ট্রেনের বগির মতো/ জোড়া লেগে পালিয়ে যাচ্ছে স্টেশন থেকে...: মানুষ)।

১৩. কাব্যভাষার আচরণগত উল্লাস। 

১৪. মাহূর্তিক শর্তগুলো নিয়ে খেলা। 

১৫. চমকে দেওয়ার মতো চিত্রকল্পের ব্যবহার। 

১৬. নিজের অস্তিত্বের খেলা। 

১৭. পার্সোনাল মেটাফর (সবুজ মার্বেল বন হচ্ছে/ সাদা মার্বেল আকাশ হচ্ছে: মার্বেল। কান্নার পাহাড়ে: উৎসমুখ। বৃক্ষের নির্মিত সবুজ রাত্রি : বৃষ্টি। মৃত সন্ধ্যা : স্প্রে। মুখে মাস্ক পরে বসে থাকে সূর্য: এপিডেমিক ট্রি)। 

১৮. অনেক সময় কবিতার নামকরণ শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় কবিতার অন্তিমে (আট্টারফুলস্নানঘরমহাশূন্যফুলস্টপগমখেতলাইটারঘাটক্যালেন্ডারবাসরঘর ইত্যাদি)। 

১৯. বিষয়কে বিষয়ের মৌলিক বাস্তবে সীমায়িত না রাখা। বিষয়ের মধ্যেই রাখা থাকে বিষয়ান্তর প্রকাশ। 


বিষয় কখনো এর মৌলিক রূপকে নিগেট করে সরে গেছে অন্যত্র। এই ঘটনাটি অত্যন্ত সচেতনভাবে ঘটেছে বিভিন্ন কবিতায়। যেমন 'কঙ্কালকবিতায় দরজার ছায়া খেয়ে গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে ঘর। এরকম আরও: মানুষ নিজে একটা বিয়োগচিহ্নে পরিণত হচ্ছে। জামার ঘ্রাণে ধোঁয়ারা লাফিয়ে পড়ছে চারদিকে। বৃক্ষের নির্মিত সবুজ রাত্রি মটমট করে ভেঙে ঢুকে যাচ্ছে লোকালয়ে বিধ্বস্ত বাড়ি-ঘরে। অর্থাৎ বাক্যের মিনিং বা অর্থ অনেক সময় কোনো ডেকোরাম না মেনে অদ্ভুত বিস্ময়কর সব চিত্রকল্প নির্মাণ করছে



Post a Comment

4 Comments

  1. চমৎকার আলোচনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ফিরোজ শাহSeptember 18, 2022 at 11:12 PM

      ধন্যবাদ

      Delete
  2. ছোট কবিতা থেকে বেরুতে হবে। যে ধাক্কা দিয়ে কবিতাটা শুরু করেন সেটাকে তাড়িয়ে নিতে হবে। আমার মনে হয় একটা জায়গায় আটকে গেছেন। সেটা অতিক্রম করে যেতে হবে। দেখা যাক কতটা পারেন।

    ReplyDelete
  3. দাদা, ফিরোজ শাহের কবিতা নিয়ে আপনার লেখা পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। যথার্থ ও দারুণ মূল্যায়ন। আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন।

    ReplyDelete