চেয়ার
চেয়ার। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। ওই চেয়ারটায় বসার আগে আমি ভালোই ছিলাম। আমিও আপনাদের মতো সব দেখতে পেতাম। উঁচু নিচু, শোষক, শোষিত–সব। কে বা কারা ঠিক সাপের মতো ফিসফিস করে কানে বলল, “এটা আপনার। বহু কাঙ্ক্ষিত এক স্বর্গীয় ফল।” আমিও আদমের গন্ধম খাওয়ার মতো গিয়ে বসে গেলাম। চেয়ারে বসার পর আমার মধ্যে বিবর্তন ঘটতে লাগলো। আমি যাদের জন্য প্রমিথিউসের মতো স্বর্গ থেকে আগুন এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, প্রথমে তাদেরকেই ভুলে গেলাম। আমার চারপাশে চাটুকাররা অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ফেলল। আমার ভেতর একটা মটর নিওরনের যন্ত্র বসানো হলো। আমি যা করছি এমনকি যা ভাবছি তা-ও আমার নয়। আমি শুধুমাত্র পিপীলিকার মতো ফেরোমোনেসের সংকেতে চলতে লাগলাম। কিংবা একটা মেট্রিক্স ওয়ার্ল্ডের মতো একটা অপটিক্যাল ইল্যুশনের জগতটা সত্য ভেবে চলতে লাগলাম। আমি ভাবছি–যা করছি তা ঠিক, ন্যায়, যুক্তিযুক্ত। অথচ আমি সেই পোকার মতো যাকে প্যারাসাইট ভাইরাস আক্রমণ করেছে। এখন সে আমার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করছে। ভাইরাসটার নাম চেয়ার। আমি চোখে সব দেখছি আবার কিছুই দেখছি না। যেন একটা বুনো ষাড়ের কানের ভেতর পোকা ঢুকে গিয়েছে। এখন পোকাটাকে মারার জন্য সারা জঙ্গল তছনছ করে দিচ্ছি। সমস্যা হলো এটা আমি বুঝছি পারছি না। কারণ, প্যারাসাইট ভাইরাস আমার উপর সম্পূর্ণ দখল করে নিয়েছে।
অথচ আমি এই চেয়ারে বসেছিলাম প্রোলোতেরিয়ান দিনমজুর সমাজের প্রতিনিধি হয়ে। এখন নিজেকে কিং চার্লস মনে হচ্ছে যে সামান্য মুরগী চুরির জন্য প্রজাদের মাথা কেটে ফেলত। চেয়ারে বসার আগে আমার অবস্থা ছিল ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণের আগের পৃথিবীর ছোট ছোট শোষিত প্রাণিদের মতো যারা নিষ্পেষিত হয়েছিল ডাইনোসরদের দ্বারা। ভেবেছিলাম চেয়ারে বসার পর পৃথিবীর সব প্রাণীর মাঝে একটা ইকোলজিকাল ব্যালান্স তৈরি হবে। অথচ আমি নিজেই এখন হয়ে উঠলাম প্রথম শ্রেণির খাদক। চেয়ারে বসার আগে আমিও অনেককিছুই করার স্বপ্ন দেখতাম।
বোধ
লোহার হাতল ধরে বসে আছে একজন বয়স্ক প্রাণী। বয়স কতো হবে? ৮০ এর বেশি। শুকনো মৌসুমের ইরি ক্ষেতের খাঁদের মতো মুখের বলিরেখা। মনে হচ্ছে উদ্দাম যৌবনের স্মৃতি ভাঁজ করা ওই তামাটে ত্বকের ভাঁজে। আমিষহীন চোখ দুটি শিশুর মতো তাকিয়ে আছে। অসহায় দৃষ্টি। ঠিক কয়েকহাত দূরে টেবিলের উপর পানির গ্লাস। বৃদ্ধ নড়তে পারছে না। চারপায়ের এই চেয়ারটায় যেন আটকে গেছে তার পৃথিবী। টেবিলটা যেন সৌরজগতের বাইরে–আলোকবর্ষ দূরে। এমনই মনে হচ্ছে তার কাছে। ধীরে ধীরে সবার কাছে অভিকর্ষহীন হয়ে উঠছে।
আশেপাশে সবই গতিশীল। অথচ বৃদ্ধের পৃথিবী এই গতিশীলতা থেকে যোজন যোজন দূরে। ইশারা দিয়েও কাউকে বলবে এমন শক্তিও পাচ্ছে না। তার কাছে মনে হলো চেয়ারটাই তার জগত।
চারিদিকে এত শোরগোল কোন কিছুই তার কানে আসছে না। বরং শব্দ তার জগতের নীরবতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই নীরবতা ভয়ংকর। বৃদ্ধের কাছে মনে হলো একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসে আছে। এই ত্রিমাত্রিক জগতে তার কোন মাত্রা নেই, নেই কোন ব্যাস বা পরিধি, শুধু একটা বিন্দুর মাঝে বসে আছে। চোখে শিশুর মতো চাহনি। তবে কৌতূহল শূন্য।
-আপনার কি কিছু লাগবে? আশেপাশের মানুষের প্রশ্ন।
আসলেই কি কিছু বৃদ্ধের দরকার? হ্যাঁ। একটা ঘুম–চিরকালের জন্য। সে হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। একটা গভীর খাদ ত্বকের মাঝে লুকিয়ে আছে–বিশাল শূন্যতা নিয়ে।
-আপনাকে কমলা দিই? জুস?
বৃদ্ধের কি এসব আসলেই দরকার? না মৃত্যুই এখন সবচেয়ে মোহময়?
স্ত্রী, কন্যা, পুত্র–সবাই কাছে। তাদের শব্দগুলো কানে পৌঁছলেও হৃদয় অনুবাদ করতে পারছে না। বৃদ্ধের মনে হলো সে কারোরই নয় এখন। একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এটা H2O নয়। এটা কি হতে পারে? মায়া? ভয়? সবকিছু হারিয়ে ফেলার? আসলেই কি কিছু বৃদ্ধের ছিল? না আছে? এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে ৮০টা বছর অর্থহীন একটা জীবন কাটিয়েছে। তার এই অসহায়ত্ব আর চারিদিকে অসংখ্য চোখ উলটো কৃষ্ণগহব্বরের মতো গিলে খাচ্ছে। তার কাছ থেকে ছিনিয়ে জীবনী–শক্তি। এটাই কি তাহলে এন্ট্রোপি–সবকিছু ক্ষয় হয়, হওয়া দরকার বিবর্তনের জন্য? এবং স্রষ্টার বিধান?
আহা প্রকৃতি! ও মানুষ, তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসো! কে বলেছিল প্রথম কথাটা? কেন ভালোবাসে? ঘাসের উপর শিশিরের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মতই তো জীবন। তবুও মানুষ মায়ার বন্ধনে জড়ায়, কাঁদে, কাঁদায়। বৃদ্ধের চারপাশে মানুষ। ঠিক মানুষ নয়, মানুষের নৈঃশব্দ্য, আর ভরহীন পদার্থের মতো বৃদ্ধ জড়িয়ে চেয়ারে যেন মহাবিশ্বের মহাশূন্যে কোথাও।
সুইসাইড
রঞ্জুর মাথায় কয়েকদিন ধরে একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে। মৃত্যু আর আত্মহত্যা। আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে। কিন্তু সে করতে পারছে না।
বরং সে উপযুক্ত কারণ বা সময় খুঁজে পাচ্ছে না। তাছাড়া সিদ্ধান্তটা একান্তই নিজস্ব নাকি হরমোন কিংবা সাময়িক হতাশা থেকে এই প্রবণতা জাগছে সেটা সে বুঝতে চাইছে। ঠিক হ্যামলেটের মতো প্রোক্রাস্টিনেশনে ভুগছে। তবে একটা জিনিস ঠিক, তার জেনেটিক কোন কারণ নেই। যতটুকু জানা যায়, মানুষ অন্যকে অনুকরণ করে। বিষণ্নতা কিংবা হতাশায় মস্তিস্কের মিরর নিওরণের প্রভাবে কি রঞ্জু এই পথ বেচে নিচ্ছে? হতেও পারে। আজকাল তো তা-ই হচ্ছে। তাছাড়া মানুষ কেনো তিমি ডলফিনও সমুদ্রের বালুচরে দেখাদেখি আত্মাহুতি দেয়। বুদ্ধিমান জীব বিষণ্ণ হয়, আত্মহত্যাপ্রবণও হয়। তবে রঞ্জুর কারণটা কী? শিল্প সাহিত্যে আত্মহত্যাকে একধরণের বিলাসিতাই ভাবা হয়। এর বহু নজির রয়েছে। প্রতিটা মুহুর্তে তারা এডভেঞ্চার চায়। তবে জীবন একগুঁয়েমি আর এ্যাবসার্ড। যাই হোক ওই ধরনের কিছু রঞ্জুর ভেতর কাজ করছে না। তবে একবার তীব্র ইচ্ছে হয়েছিল। সেটাও বহু আগে। তবে কি মনের অবচেতনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সেই প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে? যেন খড়ের গাদার ভেতর থেকে শুকনো পাতা পুরোনো গ্রামোফোনের মতো বেজে উঠেছে আবার। তবে তার কাছে মনে হচ্ছে জগত বলতে কিছু নেই। হয়তো জগতের কাছেও সে কিছু নয়। সে হাঁটছে যেন মানুষ নয় একটা কঙ্কাল। বরং সে মরেই গিয়েছে। তার আত্মা দূর কোথাও থেকে তাকে দেখছে। বৃষ্টি, রোদ, সুখ কিংবা দুঃখে তার মাঝে কোন সংবেদনশীলতা তৈরি করছে না। সে হাঁটছে। অথচ কেমন যেন অভিকর্ষহীন লাগছে৷ ভালোবাসা, ঘৃণা কিংবা হিংসা কোন কিছুই মনের ভেতর জেগে উঠছে না। মনের বিরাট জায়গা জুড়ে কোন কিছু না থাকার একটা আবহ।
আচ্ছা মানুষ চলে গেলে জগতের কাছে মানুষটার অস্তিত্ব থাকে না, কিন্তু রঞ্জু অনুভব করছে সে সময়ের এমন একটা কাটা অংশে আছে যেখানে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে আলাদা কিছু নেই। জগত কেমন যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করছে শূন্যে। যেন সে ওয়ার্মহোলের মধ্য দিয়ে অন্য কোন জগতে প্রবেশ করছে। সে মানুষের সাথে কমিউনিকেট করতে পারছে না। মানুষও না। তার কাছে মনে জগতের সবচেয়ে ভয়াবহ মুহুর্ত তখন আসে যখন মানুষের কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা অন্যকে বুঝিয়ে বলতে পারে না। আচ্ছা রঞ্জু কি স্বপ্নে এসব ভাবছে? সে কি জীবিত নাকি মৃত? সময়ের এক অদ্ভুত দ্বারপ্রান্তে রঞ্জু –থাকা আর না থাকার মাঝে।
এ লেখকের আরও লেখা:
0 Comments