সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই নেট দুনিয়ায় তুমুল হইচই হচ্ছে। নেটিজেনদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বেশও কয়েক বছর থেকেই কবিতায় সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের নাম শোনা যাচ্ছিল। এবছরও কবিতার সাথে বঙ্গবন্ধু গবেষণা শাখায় তাঁর নাম বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছিল। তবে পুরস্কার ঘোষণার পর তাঁর ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীরা বেশ হোঁচট খেয়েছেন। সে বিষয়েই প্রতিক্রিয়া জানতে শুক্লপক্ষ মুখিমুখি হয়েছিল কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের।
শুক্লপক্ষঃ এবার ২০২২ সালের জন্য যাঁরা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে দুই অগ্রজ ফোকলোরবিদ বাদে বাকীর প্রায় সবাই আমার বন্ধু এবং অনুজপ্রতিম। ১১টি শাখায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৫ জন লেখক। সবাই স্বনাম ধন্য। সবাইকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।
শুক্লপক্ষঃ প্রতি বারের মতো এবারও আপনার নাম শোনা যাচ্ছিলো যে, আপনি কবি হিসেবে অথবা বঙ্গবন্ধু গবেষক হিসেবে পুরস্কার পাচ্ছেন। কিন্তু…
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ আমিও শুনেছি, শুনছি।
শুল্কপক্ষঃ না পাবার প্রতিক্রিয়া?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ হা হা হা। যারা পেয়েছেন, তাদের প্রতিক্রিয়া নিন। না পাওয়ার প্রতিক্রিয়া! আশ্চার্য!
শুক্লপক্ষঃ আমরা উল্টো করে দেখতে চাই, উল্টো করে দেখাতে ওচাই।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ তাহলে তো আরো পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
শুক্লপক্ষঃ যেমন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ যেমন ধরুন, জসীম উদদীনকে ডিঙ্গিয়ে বা বাদ দিয়ে বিতর্কিত ফররুখ আহমদ, বেনজীর আহমদেরকে এক সময় পুরস্কৃত করা হয়েছে। অথচ জাতীয় কবি নজরুল ঐ পুরস্কার পাননি এবং পল্লীকবি নেননি। আমি তো সামান্য এক লেখক।
তবে এবারও মজা পেয়েছি- পুরস্কার ঘোষণা আগ থেকে অতি উৎসাহীরা হাস্যকর ভাবে অগ্রিম Congratulations জানাতে শুরু করে। এবং পরেও অসচেতন দু’এক জন (ফরিদ আহমদ দুলালের প্রাপ্ত) অভিনন্দন আমাকে জানিয়েছেন।
শুল্কপক্ষঃ আপনার পাঠক-ভক্তদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলেন।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ পুরস্কার ঘোষণার পর বন্ধু, সুহৃদ, লেখক, প্রিয় পাঠক, প্রিয় মানুষ (এবং অপ্রিয়, অপছন্দের, শত্রুপক্ষের লেখকও) আমাকে টেলিফোনে, হোয়াটসআপে, ইনবক্সে, মেসেজে আমি পুরস্কার না পাওয়ায় বেদনা এবং সমবেদনার কথা জানিয়েছেন।
কেউ বলেছেন, কবিতাতেই আপনাকে দেয়া উচিৎ ছিল, কেউ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ওপর অনন্য ও অসাধারণ গবেষণার ক্ষেত্রে আপনি অতুলনীয় অথবা অন্তত মুক্তিযুদ্ধের গবেষণায় আপনাকে পুরস্কার দেয়া অবশ্যই উচিৎ ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, এই পুরস্কার আপনি বহু বছর আগেই পেতে পারতেন! এসব শুনতে শুনতে এখন আমি বিব্রত, বিরক্ত।
শুক্লপক্ষঃ আপনি তো স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকসহ অন্যান্য পদক নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ স্বাধীনতা বিরোধী শরসিনা পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহের স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) বাতিলের দাবি জানিয়ে ভোরের কাগজে লিখেছি, প্রধানমন্ত্রিকেও চিঠি দিয়েছি। একই ভাবে অকবি রইস উদ্দিনের (২০২০) পদক প্রত্যাহারের দাবিতে বাংলা একাডেমির বইমেলায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছি। এক বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালে আবারো একই ঘটনা ঘটে! আরেক অকবি আমির হামজার জন্য ঘোষণা করা স্বাধীনতা পদক বাদিতে প্রতিবাদ করেছি। এই দুটো পুরস্কারই প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বাংলা একাডেমির নীতিমালা ডিঙ্গিয়ে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিরোধী নিয়াজ জামানকে ২০১৭ সালে বা/এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আমি সাথে সাথেই তথ্য-প্রমাণসহ ফেইসবুকে প্রতিবাদ করেছি। সেজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রির হাত থেকে পুরস্কার নিতে পারেননি।
শুক্লপক্ষঃ আপনি তো ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার বার বার প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেনো?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ ২০১১ সাল থেকে শামসুজ্জান খান ব্যক্তিগত উদ্যোগে লন্ডনে বসে প্রবর্তন করেন ২০১৪ সালে তার নামকরণ করা হয়- ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার’।
জামান খান প্রথমে প্রবাসী সাহিত্য পুরস্কার এবং পরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার দেয়ার জন্য আমাকে ফোন করেন। তারপর পর হাবিবুল্লাহ সিরাজী একই কান্ড করেন।
আমার অবস্থান বা বর্তমান বাসস্থান কানাডায় হলেও আমি নিজেকে কখনোই প্রবাসী-লেখক মনে করিনা। সেই মূল্যায়ণ আমার জন্য অবমূল্যায়ন।
শুক্লপক্ষঃ আপনি এবারও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার না পাওয়ায় ফেইসবুকে খুব লেখালেখি হচ্ছে এবং লেখকদেরমধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে! কেউ বলেছেন, কবিতাতেই আপনাকে দেয়া উচিৎ ছিল, কেউ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ওপর অনন্য ও অসাধারণ গবেষণার ক্ষেত্রে আপনি অতুলনীয় অথবা অন্তত মুক্তিযুদ্ধের গবেষণায় আপনাকে পুরস্কার দেয়া অবশ্যই উচিৎ ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, এই পুরস্কার আপনি বহু বছর আগেই পেতে পারতেন!
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ পুরস্কার ঘোষণার পর বন্ধু, সুহৃদ, লেখক, প্রিয় পাঠক, প্রিয় মানুষ (এবং অপ্রিয়, অপছন্দের, শত্রুপক্ষের লেখকও) আমাকে টেলিফোনে, হোয়াটসআপে, ইনবক্সে, মেসেজে আমি পুরস্কার না পাওয়ায় বেদনা এবং সমবেদনার কথা জানিয়েছেন।
নানান প্রতিক্রিয়ায়, আপনাদের আবেগে আমি গর্ববোধ করছি, পরম সৌভাগ্যবান মনে করছি। আপনাদের অসীম ভালোবাসায় আমি গর্বিত। পাশাপাশি বিব্রতবোধ করছি, বিরক্ত হয়েছে।
শুক্লপক্ষঃ কেনো, কারণ?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ কারণ দু’একজন এ নিয়ে পোষ্ট দিয়ে আমাকে বিব্রত এবং বিতর্কিত করছেন। বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। আমি তো পুরস্কারের জন্য তা করিনি অথবা বাণিজ্যের জন্যও নয়।
শুক্লপক্ষঃ আপনি দু:সময়-দু:শাসন-দুর্দিন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহুমাত্রিক এবং একাধিক বই লিখেছেন। শিল্প-সাহিত্য ছাডাও ইনডেমনিটি বিল, খুনি নূর চৌধুরী, বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতার উপর গবেষণা করেছেন।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা নিয়ে লেখাটা ২০০৫ সালের ১৫ আগষ্ট দৈনিক জনকন্ঠের বিশেষ সংখ্যায় যত্ন করে ছাপেন কবি নাসির আহমেদ। সেই লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা সুধাসদনে ডেকে নিয়ে প্রশংসা করেছেন এবং তিনি স্বতস্ফুর্ত ভাবে বইটির ভূমিকা লিখেন। এটা কি কম পুরস্কার?
শুক্লপক্ষঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানককে নিয়ে আপনার গ্রন্থগুলো কি কি? বইগুলোর নাম যদি পাঠকদের জন্য বলতেন।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ আটটি মৌলিক এবং ৪/৫টি সম্পাদনা। ‘সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব’ বের হয় ১৯৯১ সালে। সেই ধারাবাহিকতায় গত বছর ১৫ আগস্ট বের হলো সর্বশেষ বই- 'বঙ্গবন্ধু প্রাইমারি স্কুল, বেথনাল গ্রিণ লন্ডন'।
পুরো বইয়ের তথ্য-তালিকা বেশ লম্বা। তবুও পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো–
সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব, ১৯৯১ অনিন্দ প্রকাশ। (গবেষণামূলক প্রবন্ধ)
শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব, ১৯৯৬ এবং ১৯৯৬, শিখা প্রকাশনী।(গবেষণা)
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ : মুজিব হত্যা মামলা, শিখা প্রকাশনী ২০০০, শিখা প্রকাশনী এবং আহমদ পাবলিশিং হাউস ২০২০। (রাজনৈতিক)
বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন, ২০০২ এবং ২০২২ পাঠশালা। (জীবনী গ্রন্থ)
কানাডার কাশিমপুরে খুনি নূর চৌধুরী, ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, চন্দ্রদ্বীপ প্রকাশনী এবং ২০১৮ অনিন্দ্য প্রকাশন। (অনুসন্ধানী ও তথ্যমূলক)
জাদুকর, ফেব্রুয়ারি ২০০১, আদিত্য অনিক প্রকাশনী। (নাটক)
এক যে ছিলো শেখ মুজিব, ২০২০ পাঠাশালা। (ছড়া)
আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ, ২০২০ অন্যপ্রকাশ। (কবিতা)
রেসকোর্সের অশ্বারোহী ২০২০, অনন্যা। (ছোটগল্প)।
মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর সমগ্র, ২০২২, অন্বেষা প্রকাশনী।
বঙ্গবন্ধুসমগ্রঃ স্বরব্যঞ্জন, ২০২০। শিশু কিশোর সমগ্র, ২০২০।
সম্পাদনাঃ
বঙ্গবন্ধুঃ ১০০ কবির ১০০ কবিরা, স্বরব্যঞ্জন ২০১৯।
বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০০ ছড়া, পাঠশালা ২০২০।
বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত নির্বাচিত গল্প, স্বরব্যঞ্জন ২০২০।
কানাডায় মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ, ২০২২, ঐতিহ্য।
ভারতীয় বাঙালি কবিদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু (প্রকাশিতব্য, ২০২৩)
বিদেশে বঙ্গবন্ধু চর্চা (প্রকাশিতব্য, ২০২৩)।
এছাড়া বিটিভিতে ‘জাদুকর’ নাটক হিসেবে প্রচার হয়েছে- ১৭ আগষ্ট ২০১৩ সালে।
শুক্লপক্ষঃ বই লেখা ছাড়াও ‘আগামসি লেনে কোন ১৫ আগস্ট দুপুরে ঝাঁড়ু-থুতু দিয়েছেন, দাউন্দকান্দি দশপাড়ায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের কবরে পা থেকে জুতো খুলে নিক্ষেপ করে এসেছেন, ১৫ আগস্ট টরন্টোস্থ খুনি নূর চৌধুরীর বাসায় জুতো-সেন্ডেল ঝুলিয়ে দিয়ে ফেইসবুকে লাইফ করেছেন দুই-দুই বার। চাকরিচ্যুত হয়েছেন, দেশান্তরী হয়েছেন। এসব কাজ মূলত: বঙ্গবন্ধুর প্রতি সন্মান এবং মূল্যায়ন। কিন্তু তা হচ্ছে বলে মনে করেন কি ?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালঃ হচ্ছেতো। আমার বই জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করে রেফারেন্স তুলে ধরেছেন প্রয়াত আইন মন্ত্রি আবদুল মতিন খসরু, আমার লেখা পড়ে শেখ হাসিনা ডেকে নিয়ে প্রশংসা করেছেন। আমার বই সাংবাদিকরা খবর তৈরির জন্য খোঁজেন, গবেষকরা তথ্য নিচ্ছেন। প্রকাশকেরা পুণঃমুদ্রণ করছেন। পাঠকেরা প্রশংসা করছেন। এসব কি মূল্যায়ন না?
আর পুরস্কার? সেটা ভিন্ন বিষয়। বঙ্গবন্ধু আমার মনে-প্রাণে। বঙ্গবন্ধু আমার আদর্শ। বঙ্গবন্ধুর জন্য বাংলাদেশ পেয়েছি, বঙ্গবন্ধুর জন্য বিশ্বে বাঙালি হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর জন্য বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলা ভাষায় সাহিত্য করি।
4 Comments
আপনারে নির্বাচন না করা দুক্ষজনক!
ReplyDeleteসামনের বছরও যদি না পান তাইলে হয়তো বাংলা একাডেমি বঞ্চিত থাকতেই হইবো।
ReplyDeleteদুলাল ভাইয়ের কবিতায় পাওয়া উচিত।
ReplyDeleteবঙ্গবন্ধু গবেষণায় আলাদা কোন পুরষ্কারই থাকা উচিত না। যা হবে সব সাহিত্যে।
ReplyDelete