আরো শীতে আরো স্মৃতি জমবে বলেই হয়ত বেঁচে থাকি ।। আফসান বেগম


শীত এক স্মৃতিঋতুর নাম। পুরোনো স্পর্শ কিংবা বিস্মৃত-প্রায় গানের মতো অগোচরে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। হিমালয়ের পায়ের কাছে দেশের প্রান্তিক শহরের যে রাস্তাগুলোতে শৈশব-কৈশোরের ছাপ লেগে আছেসেখানে শীত ছিল দীর্ঘহেমন্ততো বটেই বসন্তকেও গ্রাস করত। শীতের স্মৃতির ভিতরে তাই শিউলির নৈঃশব্দ্যধান মাড়াইয়ের তুমুল ছোটাছুটি থেকে বীজ ধানের কোমলতার বসবাস। সুখের সময় বুঝি পরে গিয়ে দুঃখের স্মৃতি হয়! সব শীত জমে গিয়ে মনের মধ্যে হয় জমাট বরফ।

কাঞ্চন নদীর আগাগোড়া মোড়ানো হাঁটু পানি তখন শীতল। অভ্যাসবশত ফ্রকের ঝুল টেনে ধরে নেমে দাঁড়ালে দুই হাঁটুতে ঠকাঠক। সামনে তাকালে পারদুটো কুয়াশায় বিলীন। পানি থেকে দুই হাত উঁচুতে সমান্তরাল ঘোলা ঢাকনাসমেত নদীর সীমানার সীমাহীনতার দিকে তাকিয়ে বারকয়েক মনে হয়েছিলজীবন এত রহস্যময় কেনকিরিটিহোমস বা ব্যোমকেশ তখন রহস্যের প্রেমে ফেলেছে কিন্তু জীবনে এত রহস্য তো সয় না! মায়ের খিটখিটে মেজাজের দিনে কখনো নদীর দিকে চোখ রেখে ভেবেছিলামএকদিন তীর বরাবর হাঁটা দেবো। কে জানে এই নদীর কোনদিকে পাহাড় আর কোনদিকে সমুদ্র!

ভাবনাই সারহাঁটা দেয়া হয়নি কখনো। বরং এক গাদা কুয়াশায় রেলব্রিজের পকেটে পা ঝুলিয়ে নিচে ব্রিজের পিলারে বাধা পেয়ে ভাগ হয়ে এগোনো পানিকে কতবার প্রশ্ন করেছিপাহাড় থেকে আসছ নাকিসমুদ্রে যাচ্ছকত দিন লাগবেআমি কি ততদিনে বড়ো হবোঅনেকটা বড়ো হয়েছিলাম শেষে। ব্রিজের পকেটে পাশে বসেছিল আরো কেউ। ছোটো ছোটো হাসি-লজ্জায়ঝোলানো পায়ের ব্যাকগ্রাউন্ডে বিভক্ত হতে থাকা পাহাড়ী ঢলের ফেনিল শরীর দেখে মনে হয়েছিলসব পানি সমুদ্রে গেছেসবকিছু সার্থক।

আমরা যত বড়ো হইমা হয় তত একা। নিস্তব্ধ শীত-জমানো দুপুরে নির্দিষ্ট বিরতিতে উল-কাটার ছোট্ট ঘষার শব্দ। প্রত্যেকের নতুন সোয়েটার হচ্ছেমাফলারও। আগের বছরেরটা চলে যাচ্ছে যার নেই তার গায়ে। মা বুনেই চলেছেন। ইস একটা ঘর পড়ে গেছেমায়ের বিরক্তি কানে আসততারপর টেনে খোলা লাইন চারেক। কোকড়া উলসমেত কোল থেকে পড়ে মেঝেতে গড়াতো রঙিন উলের বল। কাটার যাতায়াতে আহ্নিক গতি তার গায়ে। কখনো মায়ের চিৎকার শুনে ছুটে আসতে হতোঅ্যাই সুইটিতোর বিড়াল সরাউলের গোল্লাটা শেষ করে দিল।

কুয়াশা গাঢ়তর হতো। রাতে হাড়কাঁপানো শীতের কুণ্ডলী আকাশ থেকে ঢেলে দিত কেউ। তুলোপেটানো খুলে বানানো লেপ মুখে চেপে ফুঁপিয়ে রাত পার হতো কখনো। হুমায়ূনের 'আয়নাগল্পে আয়নার মেয়েটার খুব শীত লাগছেকাপড় নেইখাবার নেই। ভোরের দিকে আবছায়া রাস্তায় খেজুরের র...সবলে হাঁক দিত কেউ। এক ভোরে কোনো বাড়ি থেকে কান্নার রোল উঠেছিল। ঢাকা-ফেরত বাস ঘুরঘটি কুয়াশায় উলটে পড়েছে খাদেগৃহকর্তা আর নেই। ঠোঁটের নড়াচড়ায় ড্রাগনের মতো কুয়াশা-বাতাস ছেড়ে বড়োরা আলাপ করেকী লাভ হলো এই বাসেট্রেনই ছিল ভালো। সরু পাড়ের বাদামি কাশ্মিরী শাল জড়িয়ে কেউ বলেকী বলোকয়েক দিনেই যমুনা সেতু হবেসাত ঘণ্টায় ঢাকা! রাজধানী ক্রমাগত ডাকে। তখন বোঝা যেতদূরত্ব কী জিনিস। আগের দিনের দৈনিক পত্রিকা বিকেলে বাইরের বারান্দায় গড়াগড়ি খেত। কুয়াশায় ধোঁয়া মেশানো টাটকা চায়ের সঙ্গে বাসি খবর মেলে মায়ের চন্দমল্লিকা উপচানো বারান্দায় বাবার স্বগতোক্তিএই মিলিটারি গভর্নমেন্ট কি আর সরানো যাবে! তারপর আমাকে দেখে প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞাসাকাল যে উপন্যাসটা পড়ছিলেশেষ হলোগলা সাধলে না আজ?

স্কুল-ফাইনাল শেষ হতো ভয়াবহ শীতে। রংপুরের নানিবাড়ি-দাদিবাড়ি ঘোরার উত্তেজনায় কে পাত্তা দেয় শীতকে তখন! কেটে নেয়া ধানের গোড়ায় খোঁচা খেয়ে খেয়ে দিনভর ডাংগুলিচোট্টামির ঝগড়ায় পণ্ড কখনো। ওদিকে বাঁশে ঝোলানো পিতলের বিশাল হাড়ি উঠোনের মাঝখানে সিদ্ধ ধানের গন্ধ ছড়িয়ে উপুড় হতো। ধোঁয়া-ওঠা সোনালি গুপ্তধন যেন! ঠান্ডা হতে না হতেই পায়ে পায়ে ছড়াতো মেয়েরা। চড়ুই-শালিকদেরও থাকত তাপ হারানোর প্রতীক্ষা। বাটি ভরা কাউনের ফিরনি ফেলে রেখে আমি শখের পাহারাদার। ইচ্ছে করে তাদের পেটে বেশি করে ধান চালান করতে দিতাম।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ দূষণেও বাতাস তার শীত শীত গন্ধ হারায় না। নাকে আসতেই চমকে মনে হয়হায় হায়আমার সেই দিন নেই! বুকে এমন মোচড় দেয় যেন এই প্রথম জানলামপরিবার উবে গেছেধান ছড়ানো সাদা মাটি-লেপা বিস্তৃত উঠোনে ভাগাভাগির দেয়াল উঠেছে আড়াআড়িতিন স্তরওলা ছাতিম গাছ কাটা পড়েছে. . . শুধু শীতটাই টিকে আছে আপনজনের মতো। গন্ধে গন্ধে জানাতে চায়সন্ধ্যার এই বাতাসটা আসে দিনাজপুর বা রংপুর থেকে। 

আসে জাহাঙ্গীরনগর থেকেও। শীত-উপদ্রুত তারুণ্য আমার! জাঁকিয়ে পড়া শীতে ক্লাসের পরে অলস দুপুরে হলের মেয়েরা দরজা খুলে রেখে তীর্যক রোদকে ঘরে আনততারপর ওম-খাওয়া সাদা লেপ গায়ে যে যার বিছানায়। জানালার বাইরে কুয়াশার তলে বুজে থাকা গোলাপি শাপলার গায়ে শিশির জমত। অকবিতাই শিশিরের শব্দ শুনিনি কখনো। শাপলা থেকে চোখ তুলে শুধু নকসায় পরিযায়ী পাখির চলন দেখেছিআবিষ্কার করেছি দুটো লাইন, 'কণ্ঠে তোমার পরাবো বালিকাহংস সারির দোলানো মালিকা।'

শীতের গন্ধ নিয়ে হেমন্ত ঘোরাফেরা করেশীতও আসবে জানা কথা। তবে কে জানত বয়স বাড়তে বাড়তে শীতের গন্ধে সহোদরদের মৃত্যুর গন্ধও মিশে যাবে! আরো শীতে আরো স্মৃতি জমবে বলেই হয়ত বেঁচে থাকি।


Post a Comment

1 Comments

  1. শীত আসবে বলে তৈরি হই সবাই। গরমের দেশে শীত এক হিরণ্য অনুভব। ফসলের ঋতু। ঋতু ঋণ শোধেরও।
    প্রাক শীতে শীতকে নিয়ে এই অন্যরকম আলোচনা বেশ লাগলো।

    ReplyDelete