সেইন্ট মার্টিন ।। নভেরা হোসেন



এবার ডিসেম্বরে দারুন শীত পড়েছে, গত বছরও অনেক শীত পড়েছিল। লোকজন বলাবলি করছে প্রত্যেকবার শীতের প্রকোপ বাড়ছে কিন্তু স্থায়িত্ব কম। গ্রীন হাউস এফেক্টের কথা বহুদিন ধরে শুনে আসছে অন্তরা। মেডিক্যালে পড়ার সময় অনেক জার্নাল পড়ার অভিজ্ঞতটা হয়েছে তখন এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল। ডেইলি স্টারের কাভার স্টোরিটা পড়ার পর কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে, মোবাইলে ফেইসবুক খুলতেই এক গাদা বার্তা এসে টুং টাং করছে। শুক্রবারটাই ওর ছুটি। হাসপাতালে রোস্টার ডিউটি করে ঘুমের সমস্যা হয়ে গেছে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়ে সবাই যখন বিসিএসের জন্য চেষ্টা করেছে অন্তরা তখন স্কয়ার  হাসপাতালে চাকরি নেয়, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে চাকরি করার কথা ভাবে নি। অসীমের সাথে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার  সময় থেকে বন্ধুত্ব। অসীম বিসিএস দিয়ে মুন্সীগঞ্জে চলে যায়, ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ডি করার জন্য ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসে। খুব ধুমধাম করে ওদের বিয়ে হয়। অন্তরা এম রহমান গার্মেন্টসের মালিকের মেয়ে। সারা শহরের গণ্য-মান্য লোকজন আসে বিয়েতে। বিয়ের পর ভালোই দিন কাটে দুজনের। অন্তরার বাবার দেয়া ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে দুজন সংসার সাজিয়ে নেয়। হাসপাতালের ব্যস্ততার মাঝেও সুন্দর একটা সময় কাটে। বিয়ের পরের সময়টাই অন্তরার কাছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় বলে মনে হয়। কেমন একটা ঘন প্রেম অসীমের প্রতি। শারীরিক-মানসিক আকর্ষণ। নিজের একটা জীবন, পরিপূর্ণতা। মাকে হারিয়ে একটা বেপরোয়া জীবন কাটিয়েছে ছোটবেলা থেকে। বাবা ব্যস্ত, বাড়ির গভর্নেসের কাছে থাকতে হয়েছে। 

হাসপাতাল থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন।

কি করছো? খেয়েছো? আর পড়তে হবে না একটু ঘুমাও। 

অসীম হাসতো, আমিতো বাসায় বসে আরাম করে পড়ছি, তুমি হাসপাতালে ডিউটি করতে করতে ক্লান্ত।  

অসীম এম ডি না করে এফসিপিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। সারা রাত জেগে পড়াশোনা করে সকালে  বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। রাতে দেখা হয় খাবার টেবিলে। ছুটির দিনগুলোতে বাইরে ঘুরতে চাইলেও পড়াশোনার চাপের কারণে অসীম সব বাতিল করতে থাকে। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা। তার যেন দম ফেলার সময় নাই, পড়া ছাড়া বাকি সব  করছে জোর করে।  নাওয়া-খাওয়ার সময় নাই, অন্তরার  সাথে কথা বলার সময় নাই। ফোন সব সময় সাইলেন্ট মোডে রেখে দেয়। অন্তরা  হাসপাতাল থেকে জরুরি  কারণে ফোন করলেও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না, আর উত্তর পেলেও বহু ঘন্টা পর অসীম একটা মেসেজ পাঠিয়ে দায় সারে। অসীম সব সময়েই পড়ার পোকা। মেডিক্যালে পড়ার সময় অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতো, এনাটমি ক্লাসে অন্যকে সাহায্য করতো। ওর এই সিরিয়াসভাবটা অন্তরাকে প্রথম আকর্ষণ করে কিন্তু বিয়ের পরে এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায়। অন্তরা সরকারি চাকরিতে না ঢুকে ঢাকায় থাকতে চায় যাতে অসীমের সাথে প্রেমটা ভালো করে করতে পারে কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অসীমের  কোনো সময় নাই। এফসিপিএস পরীক্ষা এগিয়ে আসলে অসীম দিন-রাত পড়ার ঘরে থাকে, উদভ্রান্ত অবস্থা। অন্তরা কিছুদিন বাবার বাসায় গিয়ে বাবার সাথে সময় কাটিয়ে আসে। অসীম একবার ফোনও করে না, অন্তরাই ওর খোঁজ নেয়ার জন্য ফোন করে কিন্তু তেমন কোনো সাড়া পায় না। অসীমের  কোনো কিছুতে  ভ্রূক্ষেপ নেই, অন্তরার উপস্থিতি যেন সে ভুলে গেছে বা ওর থাকা না  থাকাকে গ্রাহ্য করছে না ।

অন্তরা অন-লাইনে একটা বিজ্ঞাপন দেখে ঠিক করে রাঙামাটি বেড়াতে যাবে। একটা প্যাকেজ ট্যুরে চলে যায়। দলটি রাঙামাটি পর্যটন মোটেলে ওঠে, হোটেলটা কাপ্তাই লেকের একদম ধার ঘেঁষে, রাতে অপূর্ব দেখায় যেন পানির উপর ভাসমান দ্বীপ। প্যাকেজ ট্যুরে ত্রিশজনের একটা দল। সেখানে রানা আহমেদের সাথে পরিচয়। রানা নেসলে কোম্পানিতে বেশ ভালো পদে চাকরি করছে, বিবাহিত, এক মেয়ে ঈপ্সিতা। রানার স্ত্রী শান্তা মেয়েকে নিয়ে আমেরিকাতে গেছে ইমিগ্রেশনের  কাজে। অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে রানা রাঙামাটিতে ঘুরতে চলে এসেছে। প্রথম দিন খাওয়ার টেবিলে অন্তরার পাশের চেয়ারে বসে খেলেও খুব একটা কথা হয় নি। পরদিন কাপ্তাই লেকে নৌকায় ওঠার সময় হাত ধরে অন্তরারকে উঠতে সাহায্য করে। রানার হাতের স্পর্শে অন্তরার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হয়, ও নিজেই অবাক হয়ে যায়, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের স্পর্শ ওর মধ্যে প্রতিক্রিয়া করেছে ভেবে অবাক হয়। হয়তো প্রথম দিন থেকেই অবচেতন মনে রানার একটা ছায়া এসে পড়েছে যা ও নিজেই বুঝতে পারে নি। এরপর কথাবার্তা হয়। বাকি তিনদিন রাঙামাটিতে দুজনের আলাপ বেশ জমে ওঠে।  

রানা নানা রকম মজার ঘটনা বলে। একবার অস্ট্রেলিয়াতে ভিক্ষুক দেখেছে, ওর কাছে ডলার চেয়েছে। ভারতের এলাহাবাদে কুম্ভ মেলায় নাঙ্গাদের সাথে নিজেও নাঙ্গা হয়ে, কপালে তিলক দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। অন্তরা বেশ আনন্দ পায় রানার কথাবার্তায়, বলার ভঙ্গিটা বেশ আকর্ষণীয়। অন্তরা মুগ্ধ হয়ে শোনে, অনেকদিন পর যেন খোলা হওয়াতে শ্বাস নিতে পারছে। ঢাকার বাঁধা-ধরা জীবন, হাসপাতাল, অসীমের নির্লিপ্ত আচরণ সব ওকে ক্লান্ত আর মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তুলেছে।    

ঢাকায় ফিরে দুজনের যোগাযোগটা আরো বেড়ে যায়। অন্তরার হাসপাতালের কাজ শেষ হলে রানা এসে উপস্থিত। ধানমন্ডির রেস্তোরাঁগুলোতে সময় কাটছে দুজনের। গাড়ি আগেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে রানার গাড়িতে করে রাতে বাসায় ফিরছে।  

প্রথম কিছুদিন অসীম খেয়াল করে না, অন্তরা কখন আসে কখন যায়। হঠাৎ একদিন ভাবে বাইরে খাবে, ফোন করে অন্তরাকে। হাসপাতাল থেকে অন্তরা জানায় আজ সম্ভব না, কাজ আছে, আর কলিগদের কোনো অনুষ্ঠান আছে রাতে।  

অসীম বলে তোমার হাসপাতালের সময় কি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে? 

অন্তরা শুনে হাসে। 

তুমি সেটা লক্ষ্য করো? আমি কখন আসি, কখন যাই। 

 অসীম বলে, ভীষণ ব্যস্ত তাই সব লক্ষ্য করতে পারি না। তবে তুমি অন্যরকম আচরণ করছো কিছুদিন ধরে বুঝতে পারি।  

অন্তরা বলে এখন কাজ আছে রাখি। পরে কখনো যাবো।  

 অসীমের মন খারাপ হয়, এতদিন পর দুজন বাইরে খেতে চাইলো কিন্তু অন্তরা ব্যস্ততা দেখাচ্ছে।  

এখন অন্তরার মনে শুধু রানা। ওর মনে নানা স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকে, রানাও দিন দিন অস্থির হয়ে ওঠে। দেখা করার জন্য দুজন নানাভাবে সময় বের করে। দুজন দুজনকে পান করে গ্লাসের পর গ্লাস। এক গ্লাস ফুরিয়ে গেলে আরেকটির জন্য তৃষ্ণা। অন্তরা অসীমকে অনেক ভালোবেসেছে কিন্তু রানার সাথে যে রসায়নটা হয়েছে তা যেন আরেকরকম। সারাক্ষণ একটা ঘোর ঘোর অনুভূতি। এই নতুন অনুভূতির ফেনিল উষ্ণ জলে দুজন ভেসে চলেছে। প্রেম নতুন রূপে ধরা দিয়েছে অন্তরার মনে। অসীমের ব্যস্ততা, স্পর্শহীনতা, অনাগ্রহ ওর মধ্যে জেদ তৈরী করে। খুব অভিমান আর রাগের জন্ম হয়। রানা-অন্তরা দুজন দেখা করে রানার ফ্ল্যাটে। অন্তরা যেন এক অনাস্বাদিত অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চারপাশের মানুষজন, বাড়ি-ঘর, গাছপালা, প্রকৃতি ওর কাছে নতুন অর্থ নিয়ে, নতুন সুষমা নিয়ে উপস্থিত হয়।   

এফসিপিএস পরীক্ষা দেয়ার পর অসীম কিছুটা ভারমুক্ত হয়। অনেকদিনের চাপ থেকে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় অন্তরাকে নিয়ে সময় কাটানোর কথা ভাবে। অন্তরাকে বলে চলো কোথাও বেড়াতে যাই। অনেকদিন দুজন ভালো করে সময় কাটাই না, কথা হয় না, দেখা হয় না।  

অন্তরা কোনো উত্তর দেয় না।

অসীম আবার বলে চলো দূরে কোথাও যাই। বিয়ের পর শুধু ইন্ডিয়া ঘুরলাম। কাশ্মীর, ওহ খুব সুন্দর জায়গা। গুলমার্গ, সোনামার্গ, পাহালগাম অদ্ভুত সুন্দর সব জায়গা। বরফের চাদরে ঢাকা পৃথিবীতে বেগুনি ল্যাভেন্ডার ফুটে থাকে থরে থরে। ওখানে তুমি অনেক জীবন্ত হয়ে উঠেছিলে। যেন একটা কাশ্মীরি মেষ-পালক মেয়ে। চলো আবার যাই ওখানে, ফেরার পথে কলকাতা ঘুরে আসবো, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে কলকাতার মাটির ভারে চা খাবো।

 অন্তরা কোনো কথা বলে না, নিঃশব্দে ছুরি দিয়ে সালাদ কাটতে থাকে।  

 দেশের বাইরে না হলে ভেতরেই যাই, সেন্ট মার্টিন প্রবাল-দ্বীপ কখনো যাই নি।  

 অন্তরা রান্না ঘর থেকে লেটুস পাতা ধুয়ে এনে আবার সালাদ কাটে।  

 অসীম অধৈর্য হয়ে বলে তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না? 

অন্তরা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে এখন সময় নাই বেড়াতে যাওয়ার। হাসপাতালে নানা ঝামেলা শুরু হয়েছে, এখন সম্ভব না।   

বুঝলাম, তোমার হাসপাতালের ঝামেলা আমি জানি, একটা ছুটি নাও। অনেকদিনতো ছুটি নাও নি।  

 না এখন ছুটি নেয়া সম্ভব না।  

 কেন সম্ভব না? আমি এডমিনিস্ট্রেশনের ডাক্তার জামিলকে বলছি, উনি করে দিতে পারবে।  

না না এখন না।  

 কেন? 

 অন্তরা চুপ করে থাকে।  

 নাকি তুমি আমার সাথে যেতে চাইছো না? 

যেতে চাইবো না কেন? 

 তোমার আচরণে তেমন মনে হচ্ছে ।  

 অসীম আমার এখন হাসপাতালের অনেক চাপ, আর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এম ডিতে ভর্তি হবো, পড়াশোনা আছে। এখন কোথাও যাবার মতো অবস্থায় নাই। 

আর তুমি বললেই আমার যেতে হবে? এতোদিনতো আমার বিষয়ে নীরবতা পালন করেছো। পাশের ঘরে ঘুমিয়েছো, আমার মনের কি অবস্থা, কি রকম আছি জানতে চেয়েছো একবার? 

 আমিতো পরীক্ষার জন্য অস্থির হয়ে ছিলাম, একজন ডাক্তার হয়ে বোঝো না কেন আমি পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। 

 বুঝি কিন্তু বাড়াবাড়ি কোনো কিছুই ভালো ফল তৈরী করে না।  

আমার পরীক্ষার বিষয়টিকে ব্যবহার করে কি কি করেছো তা ভেবেছো আমি জানি না।  

কেন, কি করেছি? 

 তুমি বলো কি করছো ইদানিং? 

 কি করবো? 

যা ইচ্ছা তাই করেছো। বড়োলোকের আদরের দুলালী স্বেচ্ছাচারিতা করছো। আমাকে বোকা ভেবেছো, কিছুই বুঝি না? দিন-রাত ফোনে কথা বলো, অনেক রাতে বাসায় ফেরো। এসব ভেবেছো খেয়াল করি নাই? 

 তাই? খুব ভালো। তোমার সময় আছে এসব খেয়াল করার?  

লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, ভেবেছি হয়তো একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছো, এ থেকে নিজেই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এখন দেখছি তা নয়, আমাকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছো। 

অন্তরা শান্ত গলায় বলে আমাকে সন্দেহ করছো? খুব ভালো। এতটা সময়ে কখনো আমার খোঁজ নাওনি, ভালো করে কথা বলো নি, কোথাও বেড়াতে যাও নি, এমনকি বাবা আমাদের ডাকলেও তুমি যাও নি। চরম বিষন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছো, এটা কখনো ভেবেছো?

তোমার বিষয়টা আমি বুঝি না তাতো নয়। তোমাকেতো আজকে চিনি না। যখন মেডিক্যালে ভর্তি হলে প্রথম দিন থেকেই চিনি। কিন্তু এই দু’বছর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, জানোতো পড়া নিয়ে আমি কেমন অস্থির থাকি। 

 অসীম সব কিছুর একটা সীমা আছে, সেই সীমা যখন অতিক্রান্ত হয়ে যায় তখন সেখান থেকে আর কিছুই আশা করা যায় না। 

 মানে? আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।  

 কেন বুঝতে পারছো না, এতটা দিন আমি একা একা নিজের সাথে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমার গুরুত্ব কমে গেছে আমার কাছে। এটা ভাবলে ভুল করবে যে আমি সব সময় একই রকম থাকবো, একই মেজাজে থাকবো। তোমার আচরণে একই রকমভাবে সাড়া দেবো। মানুষের মন এতো সহজ বিষয় না। ইটস এ কমপ্লেক্স ফেনোমেনা।  

 তুমি এসব কি বলতেছো? বুঝতে পারছো? ভেবে বলছো? 

 এখন ভাবার কিছু নাই তুমি যা ইচ্ছা ভাবতে পারো।  

 তোমার কাউন্সিলিং দরকার। আবোল-তাবোল বকছো। আমি স্বীকার করছি এই দু বছরে তোমাকে খুব কম সময় দিয়েছি, নিজের ক্যরিয়ার নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। তার মনে এই নয় তোমাকে ছাড়া অন্য কিছু ভেবেছি, অন্য কারো সাথে জড়িয়ে পড়েছি। শুধু আমার কাজটাই করেছি, আর ঘরের কিছুই করি নাই, তাতো নয়, আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করে যাচ্ছি।  

অসীম জীবনটা বইয়ের মুখস্ত বিদ্যা না। যেমন করে ভেবেছো, সাজিয়েছ তেমন করেই চলতে থাকবে, এর কোনো উত্থান-পতন নাই।  

 তা থাকবে না কেন? 

 কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে বলে মনে হয় না। তুমি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছো।  

অন্তরা ভাবলেশহীনভাবে সালাদ কাটা শেষ করে কুলসুমকে রাতের খাবার দিতে বলে টেবিলে।  

 অসীম মুখ কালো করে সোফায় বসে থাকে।  

 কি ব্যাপার বসে আছো কেন খেতে আসো।  

 অসীম কোনো জবাব দেয় না।  

 অন্তরা নিজের প্লেটে একটু ভাত আর মাছ ভাজা নিয়ে খেতে শুরু করে।  

অসীম না খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্তরাকে বুঝতে পারছে না, এই কটাদিনে ও এতটা বদলে গেছে, চোখের ভাষা পড়া যাচ্ছে না। কোনো গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েছে অন্তরা, অসীম মাথার চুল টানতে শুরু করে। এটা কি করেছে ও? কেন এতটা আত্ম-বিলোপ ঘটেছিলো। এই দুবছরে একবারও অন্তরার কথা ভাবে নি সে। যেন অন্তরা ওকে আগে যেমন ভালোবাসতো সব-সময় তেমনি বাসতেই থাকবে। এটা একটা শাশ্বত বিষয়। কিন্তু আসলেতো তা নয়। ভালোবাসা কোনো শাশ্বত বিষয় নয়। সময় মানুষকে বদলে দেয়, মানুষের মনের জটিল ব্যাকরণ কোনো তত্ত্ব মেনে চলে না। অসীম ভাবলো তবু এভাবে অন্তরাকে হারাতে পারবে না সে। ততক্ষনে অন্তরা খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকে ফোনে কথা বলছে। কাকে যেন বলছে আমি ওকে একদম সহ্য করতে পারছি না, একদম না।  

অসীম ঘরে ঢুকতেই অন্তরা বললো ঠিক আছে পরে কথা বলছি। 

 অসীম বিছানায় এসে অন্তরাকে কাছে টানতে চায়। অন্তরা বিছনায় উঠে বসে ।  

 প্লিজ তুমি এমন করো না, আমার কাছে তোমার গুরুত্ব অনেক। আমরা দুজন ভালো বন্ধু, আসো আমাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলি।  

আমার কোনো সমস্যা নাই, কথা বলার কিছু নাই।  

এটা বললেতো হবে না। আমি একটা ভুল করেছি, সেজন্য তুমি কষ্ট পেয়েছো, এখন আমি ক্ষমা চাচ্ছি। অসীম অন্তরার হাত ধরতে চেষ্টা করে।  

 অন্তরা ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়, চরম বিরক্তি নিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।  

 প্লিজ সোনা আমাকে বোঝার চেষ্টা করো, তোমাকে অনেক ভালোবাসি, খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে যে শাস্তি দিতে চাও দাও, অসীম অন্তরার ঠোঁটে চুমে খেতে চায়, অন্তরা অসীমের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। 

 অসীমের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে ।  

 অন্তরা কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে দেয়। অসীমের জেদ চেপে যায়, ঝটকা দিয়ে অন্তরার গায়ের কম্বল সরিয়ে চুমু খেতে থাকে। অন্তরা হাত দিয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। অসীম অন্তরাকে প্যাঁচিয়ে ধরে। অন্তরা চিৎকার করতে শুরু করে, হাত-পা ছুড়তে থাকে। অসীমের শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে, অন্তরার উপর জোর খাটিয়ে মনের সব রাগকে প্রকাশ করে।  

 সকালে কুলসুম এসে কলিং বেল বাজাতে থাকে। অসীম উঠে দরজা খুলে দেয়। অনেক্ষন ধরে গোসল করে, নাস্তা করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। অন্তরা কম্বল গায়ে জড়িয়ে বহুক্ষণ শুয়ে থাকে। কুলসুম এসে দরজা ধাক্কাতে থাকে, আপা উঠবেন না? নাস্তা খাবেন না? বারোটা বাজে।  

অন্তরার চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে। অসীম ওকে জোর করতে পারলো? রাগে, অপমানে মুষড়ে পড়ে। নিজেকে একটা পরিত্যক্ত গাছের মতো মনে হয়, যার ডালপালা ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। কাণ্ড কুড়াল দিয়ে কোপানো হয়েছে, পাতারা সব ঝরে পড়েছে ভিজে মাটিতে। অনেক কষ্টে বিছানা ছেড়ে উঠে গোসল করে। ওর শরীরে কেউ যেন বিছুটি লাগিয়ে দিয়েছে। মনের বাইরে শরীর এ যেন কল্পনাও করতে পারে না অন্তরা। অসীমের অধিকার আছে ওর প্রতি, ওর শরীরের প্রতি। কিন্তু রানার সাথে পরিচয়ের পর সব বদলে গেছে। অন্তরাকে  না বুঝে, ওর না চাওয়ার অর্থ বুঝতে চেষ্টা না করে অসীম রাতভর ওকে  উপভোগ করলো। ওর ভেতর ভীষণ রাগ আর আক্রোশ তৈরী হয়। ঘুম থেকে উঠে অন্তরা সামনের সপ্তাহে সেইন্ট মার্টিনের প্রবাল দ্বীপ রিসোর্টে রুম বুকিং দেয়।  অসীমকে ফোন করে বলে আমি সেইন্ট মার্টিনে হোটেল বুকিং দিয়েছি, বাসায় আসো কথা হবে।

 অসীম অন্তরার পরিবর্তনে অবাক হয়ে যায় কিন্তু খুশি হয়। বলে খুব ভালো হয়েছে, তুমি এখন ছুটি নিয়ে নাও। 

 অন্তরা আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেয়।      

একটু পরেই রানাকে ফোন করে বলে আমি আর অসীম সেইন্ট মার্টিন যাচ্ছি ওখানে প্রবাল দ্বীপ রিসোর্টে উঠবো, তুমিও যাবে আমাদের সাথে।  

 কেন তোমাদের মধ্যে আমি যাবো কেন?

 যাবে কারণ আছে। 

 কি কারণ বলো। 

একটা বিষয় ভেবে দেখলাম আমার আর তোমার মাঝে অসীম বিরাট এক বাধা। ও কাল জোর করে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক চাহিদা মিটিয়েছে। ওর উপস্থিতি আর চাই না আমাদের মাঝে। 

কিন্তু আমরাতো এভাবে ভালোই আছি। দুজনতো দুজনকে পাচ্ছি। 

 না একবার যখন অসীম বুঝে গেছে আমার মনোভাব তখন শান্তিতে থাকতে দেবে না।  

 কিন্তু আমারতো আমেরিকায় শান্তাদের ওখানে যাওয়ার প্ল্যান। এই সময়ে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার কথা ভাবতে পারছি না। আর আমি কেন যাবো? ওখানে গিয়ে খারাপ লাগবে।  

 তুমি কেন যাবে সেটা পরে বলছি। এখন নাস্তা খাবো, পরে কথা বলছি।  

 তুমিতো আমাকে বিশ্বাস করো তাই না? 

হু বিশ্বাস করি।   

তাহলে চিন্তা করো না, দুজনের পথ কণ্টকমুক্ত রাখার জন্য যা করার তাই করবো।  

 অন্তরার স্বরটা কেমন অন্যরকম লাগে, যেন খাদের নিচ থেকে কথা বলছে। একটু অচেনা, অস্থির, যন্ত্রণাদগ্ধ। রানা সারাদিন অফিসে টেনশনে থাকে।

সামনের সপ্তাহে সেইন্ট মার্টিনের প্রবাল রিসোর্টে যাচ্ছে অসীম আর অন্তরা। রানাকেও একই হোটেলে বুকিং দিতে বলে অন্তরা। কিছুটা দোদুল্যমানতা নিয়ে হোটেলে বুকিং দেয় রানা। এখন মৌসুম চলছে, হোটেলে রুম পাওয়াই কঠিন। তারপরেও একটা সিঙ্গেল রুম পাওয়া যায় নন-এসি।  

 গ্রীন লাইনের ভলভো কোচ ছাড়ে রাত আটটায়। অন্তরা, অসীম মাঝের দিকে। রানা একেবারে শেষের দিকে। রানার সাথে একই বাসে যাওয়াতে অন্তরা সারাক্ষন অস্থির হয়ে থাকে। তেমন একটা কথা বলছে না, মুখ শক্ত করে রাখে।

অসীম বলে তোমার কি হয়েছে? মুখ এমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে।  

না, জার্নিটা দীর্ঘ লাগছে।  

 তাই? আগে বলতে—আমরা প্লেনে আসতাম কক্সেস বাজার পর্যন্ত তারপর মাইক্রো নিয়ে টেকনাফে যেতাম। 

 না আমার বাস জার্নি খারাপ লাগে না। একটু চোখ বন্ধ করে থাকি, মাথাটা ধরেছে।  

 ট্রাই টু এনজয়, চারপাশ দেখো। কি সুন্দর প্রকৃতি। এর কাছে এলে নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে।  

 আমার ভালো লাগছে অসীম—অন্তরা অসীমের হাতটা ধরে।  

  তুমি যদি মনমরা হয়ে থাকো তাহলে কেমন হয়।  

কই আমিতো মনমরা হয়ে নাই, ভালো লাগছে।  

 চিপস খাও।

 দাও। 

বাস কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বিরতি হোটেলে থামে। অসীম ওয়াশ রুমে গেলে অন্তরা রানাকে ফোন করে বলে, প্লিজ মন খারাপ করো না, ওখানে গিয়ে তোমার রুমে আসতেছি ।  

 রানা বলে আমি না এলেই ভালো হতো। অসীমকে সহ্য করতে পারছি না। তুমি ওর পাশে বসে আছো, নিতে পারছি না। 

 একটু কষ্ট করো আমাদের এই সমস্যাটা থাকবেনা।  

সেইন্ট মার্টিনে গিয়ে সব বলবো।  

 ওকে রাখছি। 

 সারাটা পথ তিনজন মানুষের তিনরকম অনুভূতিতে কাটে। কেউ কারো মনের কথা জানতে পারে না, শুধু ভেতরে ভেতরে নানা রকম কল্পনার ফানুস।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অসীম ভাবে যাক অন্তরা ওকে আবার আগের মতো করে অনুভব করছে, না হলেও অন্তত কাছে থাকছে, ওর ইচ্ছাকে মূল্য দিচ্ছে। ওই দিন অসীমের জোর-জবরদস্তিমূলক আচরণের পর অন্তরা যেমন প্রতিক্রিয়া করেছিল তা দেখে অসীম ভয় পেয়ে গেছিলো, যদি অন্তরা ওকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে অন্তরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। অসীম ভেবেছে অন্তরা হয়তো রাগে-দুঃখে, অসীমের এতদিনের নিস্পৃহ আচরণের জন্য নিজেকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছিল কিন্তু এখন ওর প্রতি পূর্বরাগ ফিরে এসেছে। পরদিন মুরগির বিরিয়ানি রান্না করলো, ক্যাপসিকাম আর বেগুন দিয়ে সালাদ করলো যা অসীমের অসম্ভব প্রিয়। নিজে থেকেই  সেইন্ট মার্টিনে যেতে চেয়েছে। অসীম ভাবে অন্তরার মনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে কিন্তু এখন আবার সব আগের  মতো। গ্রীন লাইনের জাহাজের  বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফেনিল সমুদ্র দেখতে দেখতে অসীম কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এক ঝাঁক গাংচিল জাহাজের পাশে পাশে উড়ছে। জাহাজের যাত্রীদের ছুড়ে দেয়া চিপস উড়ে উড়ে খাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। অসীম পাশে দাঁড়িয়ে অন্তরার ছবি তুলতে থাকে।  দূর থেকে রানা দেখছে আর একটার পর একটা সিগারেট খেতে থাকে, ব্যাগ থেকে বের করে বিয়ারের কৌটা শেষ করে। ভেতরে ভেতরে অসম্ভব যন্ত্রনা পাচ্ছে। ওর ইচ্ছে করছে এক ধাক্কা দিয়ে অসীমকে সমুদ্রের নীল জলে ফেলে দিতে। অন্তরা কেন ওকে এই শাস্তি দিচ্ছে? রানা জাহাজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। 

প্রবাল দ্বীপ রিসোর্টের সাজসজ্জা বেশ সুন্দর। বৃক্ষময়, সারা হোটেলের দেয়াল সবুজ লতা দিয়ে ঘেরা, মাঝে মাঝে প্রবাল বসানো। রুমে ঢুকে অন্তরা কিছুক্ষন শুয়ে থেকে অসীমকে বলে আমার খুব বমি পাচ্ছে, মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে, ওষুধের বাক্স খুঁজে পাচ্ছি না। প্লিজ দেখো কোনো ওষুধের দোকান পাও কিনা।     

আশেপাশেতো ওষুধের দোকান নেই, বাজারে থাকতে পারে। রিসিপশনে জিজ্ঞেস করতে হবে ।  

প্লিজ একটু কষ্ট করে নিয়ে আসো, শরীর খুব খারাপ লাগছে। 

আচ্ছা চিন্তা করো না, যাচ্ছি, কিন্তু ওষুধের বক্সটা ব্যাগে দেখেছিলাম মনে পড়ছে।    

কি জানি এখনতো পাচ্ছি না, মনে হয় আসার আগে কাপড় কমাতে গিয়ে বের করেছিলাম পরে ঢুকাতে ভুলে গেছি।  

আচ্ছা আমি একবার দেখি বলে অসীম ব্যাগের সব জিনিস বের করে দেখে বাক্স নেই।  

অসীম বাজারের জন্য বের হলে অন্তরা দ্রুত রানার রুমে যায়। রানা অন্তরাকে দেখে প্রথমে রেগে যায় তারপর দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। চুমু খেতে খেতে অস্থির হয়ে ওঠে। রানার মনে হয় কিছু সময়ের জন্য অন্তরাকে সে হারিয়ে ফেলেছিলো এখন খুঁজে পেয়েছে।  

 অন্তরা বলে রানা তোমার কি অসীমের প্রতি রাগ হচ্ছে না? 

 হুম অনেক রাগ হচ্ছে। আমি এভাবে তোমাকে দেখতে চাই না।  

 কিভাবে চাও? 

 শুধু তোমাকে চাই, সেখানে অন্য কেউ থাকবে না। 

 আমিও তাই চাই। আমি চাই অসীমকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিতে।  

 মানে? 

 মানে কি সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি তোমার আছে।  

 কিন্তু এটাতো ভয়ঙ্কর ব্যাপার।  

 আমি যা বলছি দুজনের কথা ভেবেই বলছি। খুব ঠান্ডা মাথায় ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।  

  তুমি পাগল হয়ে গেছো? জানো এটা কত মারাত্মক একটা কথা।  

 হুম জানি, আমার কাছ থেকে তুমি এটা আশা করো নি, কিন্তু ঐদিনের পর সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। অসীম আমাকে জোর করে দারুন ভুল করেছে। আমার অনিচ্ছার মূল্য সে দেয় নাই। এর মাসুল ওকে দিতে হবে। একজন যখন শারীরিক সম্পর্ক করতে চায় না, তাকে জোর করার অধিকার কারো নাই। সে স্বামী হলেও না। 

কিন্তু আমার খুব ভয় লাগছে, দুজনেই দারুন বিপদে পড়বো। রিসোর্টের লোকজন আমাদের দেখেছে।  

 এখন আর পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নাই। আমি সব কিছু ভেবে রেখেছি। 

কিন্তু এটা করা কি খুব জরুরি? অসীমের উপস্থিতিতেও আমরা দুজনকে পাচ্ছি। হয়তো কম, কিন্তু সব কিছু চলছে।  

ভয় পাচ্ছো কেন? কোনো বিপদ হবে না। অসীম আমাকে কখনো ছাড়বে না। আমি তোমাকে পুরোপুরি পেতে পারবো না।  

 একটু বোঝার চেষ্টা করো আমরা এরকম বিপদজনক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।  

 তুমি কি আমাকে চাও? 

হুম চাই।  

তাহলে আমাকে সাহায্য করো। অন্তরা শীতল গলায় বলে। 

রানা কিছু ভাবতে পারছে না, যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মাঝে মাঝে অসীমের প্রতি দারুন রাগ হচ্ছে আবার একটা ভয় এসে ওকে ঘিরে ধরছে। অন্তরাকে পাওয়ার জন্য ও যেন সব কিছু করতে পারবে। অন্তরা বলে আমি একটা ইনজেকশন এনেছি, ওটা পুশ করতে হবে অসীমের শরীরে, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। খুব সহজ।  

তারপর?

তারপর অসীম অসুস্থ হয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, শ্বাস কষ্ট শুরু হবে, অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে। অক্সিজেন দিতে দেরি হলে কলাপ্স করবে। হার্ট ফেল করবে। কেউ বুঝতে পারবে না কিভাবে মৃত্যু হলো। 

কিন্তু রিস্ক থেকে যায়।  

 এইটুকু রিস্ক নিতেই হবে।   

আজ রাতে তোমাকে যখন মেসেজ দেবো রুমে আসবে, দরজা আমি খুলে দেব। ইনজেকশন দেয়া হলে গেলে সোজা রুমে চলে যাবে। এখানে সিসিটিভি নেই, সুতারং চিন্তার কিছু নাই। সকালের জাহাজে টেকনাফ গিয়ে ঢাকা চলে যাবে।  

এতে সন্দেহ হবে।  

 না হবে না, আমি সব কিছু সামলাবো, চিন্তা করো না।  

এখনো ভেবে দেখো আমরা ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছি।  

এতো ভয় পেলে কিছু করতে পারবে না জীবনে। প্লিজ আমাকে সাহায্য করো, অন্তত পাশে থাকো অন্তরা রানার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।  

রানা অন্তরার ঠোঁটে গভীর চুমু খায়।  

 অন্তরা রুমে এসে দেখে অসীম তখনও আসে নি।  

রাতে অন্তরা রানাকে আবার মেসেজ পাঠায়। পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন করা হয়েছে, প্রথম রাতে নয়, দ্বিতীয় রাতে ঘটনাটা ঘটবে। 

ঐদিন রাতে অসীম ওষুধ নিয়ে এসে দেখে অন্তরা শুয়ে আছে চিন্তিত মুখে।  

কি অবস্থা? এখনো খারাপ লাগছে? 

 হুম একটু কম, ওষুধটা রেখে দেই আবার মাথা ধরলে খেয়ে নেবো।  

কেন তুমি না বললে মাইগ্রেনের প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে।  

হুম হচ্ছে একটু কম।  

তাহলে খেয়ে নাও, আরেকবার শুরু হওয়ার আগে।  

অন্তরা পাতা থেকে একটা ওষুধ ছিড়ে নিয়ে খেয়ে নেয়। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে রিসোর্টের রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে নামে।  

পরদিন সকালে সেইন্ট মার্টিনের নীল জলে দুজন সাঁতার কাটে, দুপুরে রূপ চাঁদা, কালা চাঁদা ফ্রাই দিয়ে কালোজিরা চালের ভাত খায়।  

অন্তরা কেমন লাগছে খাবার? 

দারুন, অনেকদিন পর মনে হয় এমন তাজা মাছের স্বাদ পেলাম। রূপ চাঁদা এমনিতেই আমার প্রিয়। দুজনে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে বের হয়। 

হুমায়ুন আহমেদের সমুদ্র বিলাসের অবস্থা দেখে অসীম বলে আমাদের এখানে কোনো কিছুর যত্ন নাই, একটা কিছু শুরু হয় কিন্তু কিছুদিন পর মুখ থুবড়ে পড়ে। 

রানা রুম থেকে বেশি বের হয় না, সন্ধ্যায় বিচের বালুতে বসে হুইস্কি খায়। প্রায় টালমাটাল অবস্থায় রুমে ফিরে আসে।  

রিসোর্টের লনে সামুদ্রিক মাছের বার্বিকিউ হচ্ছে। বার্বিকিউর পোড়া গন্ধ সারা হোটেলে ছড়িয়ে পড়ে। অন্তরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুলার আগুনে মাছের ঝলসানো দেখতে থাকে। অসীম নিঃশব্দে এসে অন্তরার ঘাড় স্পর্শ করে, অন্তরা চমকে ওঠে। 

কি ভাবছো?

কই কিছুনাতো, দেখছিলাম কেমন করে একটা তাজা প্রাণ আস্তে আস্তে মানূষের খাদ্যে পরিণত হয়। আদিম কাল থেকেই গুহা মানবেরা পশু-পাখি, মাছ, কীট-পতঙ্গ আগুনে ঝলসে খেতে শুরু করে। মানুষের প্রথম বার্বিকিউ পার্টি।  

তুমি সব কিছুর এতো গভীরে চলে যাও কেন? তারচেয়ে আরো হালকাভাবে দেখবে তাহলে উপভোগ করতে পারবে।  

আমি নিজের মতো উপভোগ করি। সবার পদ্ধতি একরকম নয়। তুমি যেমন তোমার পড়া-লেখা নিয়ে বুদ্ হয়ে থাকো সবাই তা করে না।  

সরি আমি তোমার সাথে যা করেছি তা অন্যায় হয়েছে, এ জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। অসীম অন্তরার কাঁধটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে প্লিজ সব ভুলে যাও, ঐদিন জেদ চেপে গিয়েছিলো। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার পিরিয়ড চলছিল আমি জোর করে করেছি। অসীম মুখটা কালো করে নিচে নামিয়ে রাখে।  

অন্তরা কাঁধ থেকে অসীমের হাতটা নামিয়ে বলে চলো খেতে যাই। 

নান রুটি, পরাটা, সালাদ, রূপ চাঁদা, কালা চাঁদা, টেক চাঁদা মাছের বার্বিকিউ দিয়ে রাতের খাবার। একটা ছেলে গিটার বাজিয়ে এই নীল মণিহার গানটা গাচ্ছে।  

অসীম বলে অনেকদিন পর সত্যিকারের বারবিকিউর স্বাদ পেলাম। রুমে ফিরে অসীম কম্বল গায়ে দিয়ে টেলিভিশন দেখতে থাকে। অন্তরা বাথরুমে গিয়ে রানাকে আসতে বলে।  

দরজায় নক হতেই অসীম দরজা খোলার জন্য উঠতে চায়। অন্তরা বলে কোক চেয়েছিলাম, মনে হয় নিয়ে এসেছে, আমি দেখছি তুমি শুয়ে থাকো। অন্তরা দ্রুত হাতে দরজা খুলে রানাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়, রানার হাতে বড় একটা কোকের বোতল। অসীম রানাকে দেখে অবাক হয় ।  

কি ব্যাপার অন্তরা উনি কে? 

অন্তরা বলে আমার ছোটবেলার বন্ধু রানা, পাশের রুমে উঠেছে সকালে দেখা হলো।  

রানা হাত বাড়িয়ে দেয়, অসীম শক্ত মুখে হাত বাড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রানা অসীমের হাত মুচড়ে ধরে। অসীম ব্যাথায় ককিয়ে উঠতেই রানা খাটে উঠে অসীমের বুকের ওপর চেপে বসে। দু পা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রাখে, অসীম ছোটার  চেষ্টা করে। অন্তরাও অসীমকে চেপে ধরে, দুজন দুপাশ থেকে চেপে ধরে অসীমের মুখ স্কচটিভ দিয়ে আটকে দেয়, হাত পেছন দিকে বেঁধে দেয় একটা নাইলনের রশি দিয়ে। টেলিভিশন চলছিল  বলে বাইরে কোনো শব্দ যায়   না। অন্তরা অসীমের হাতে একটা ইনজেকশন পুশ  করে। রানা অসীমের শরীরের উপর চেপে বসে আছে বলে অসীমের নড়াচড়ার কোনো শক্তি নেই, চোখ দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে, মুখ দিয়ে গো গো শব্দ করে। কিছুক্ষন চেপে ধরে রাখার পর অসীম ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে। অন্তরা রানাকে দ্রুত রুমে ফিরে  যেতে বলে।  

 রানা হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে ফিরে যায়।  

অন্তরা ধীরে ধীরে অসীমের বাঁধন সব খুলে দেয়, ওর গায়ে কম্বল দিয়ে দেয়। অসীম অজ্ঞানের মতো হয়ে আছে।  

 সোফায় বসে অন্তরা কিছুক্ষণ ভাবে তারপর ল্যান্ড ফোন থেকে হোটেলের রিসিপশনে ফোন করে।  

 হ্যালো হ্যালো। 

 কিছুক্ষণ রিং বাজে কেউ ধরে না।  

 আবার করার পর ধরে।  

 হ্যালো ম্যাডাম।  

 ম্যানেজার সাহেব আছেন? 

 না উনিতো রুমে চলে গেছেন।  

ওনাকে খবর দেন, আমার হাজব্যান্ড হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আমি নিজেও একজন ডাক্তার এখনই ওকে হাসপাতালে শিফট করতে হবে। 

কিন্তু এতো রাতে এখানে কোনো ডাক্তার পাবেন না, আর হাসপাতালের সুবিধাও নাই। ওনাকে কক্সেস বাজার বা চট্রগ্রাম নিয়ে যেতে হবে। কিভাবে নিতে পারবো? 

আজ রাতেতো সম্ভব না, কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সকালে নিয়ে যেতে পারবেন। 

কিন্তু ততক্ষনে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে।  

দেখি আমরা কি করতে পারি।  

অন্তরা যে ইনজেকশনটা দিয়েছে অসীমকে সেটা পয়জন জাতীয়। প্রথমে শরীরকে নিস্তেজ করে দেয়, পরে ধীরে ধীরে শ্বাস কষ্ট শুরু হবে, অক্সিজেনের অভাব দেখা দেবে। দ্রুত অক্সিজেন দিতে না পারলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।  

অন্তরা হোটেলের লবিতে গিয়ে ম্যানেজারকে দ্রুত রুমে আসতে বললে, ম্যানেজার দুজন কর্মচারীকে নিয়ে এসে দেখে অসীমের অবস্থা ভালো না, চোখ বন্ধ , শ্বাস কষ্ট হচ্ছে, বুক ওঠা-নামা  করছে। ম্যানেজার ওই রাতেই একটা ট্রলারের ব্যবস্থা করে অসীমকে টেকনাফে নিয়ে যায়, ওখান থেকে কক্সেস বাজার সদর হাসপাতলে।  দুজন ডাক্তার জরুরি বিভাগে অক্সিজেন মাস্ক আর কিছু ইনজেকশন দেয়। কিন্তু দ্রুত অবস্থা খারাপ হয়। অন্তরা বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে অসীমের পাশে। সমস্ত ঘটনা যেন চোখের পলকে ঘটে যায়। অসীম মারা যায়। অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে পুলিশ কেস হয়। পুলিশ লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যেতে চায়। অন্তরার বাবা ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের কাউকে দিয়ে সব ম্যানেজ করে বিকেলের ফ্লাইটে কক্সেসবাজার আসেন। ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছে কার্ডিয়াক এরেস্ট। কোনোরকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই মৃতদেহ অন্তরার বাবার হাতে তুলে দেয়া হয়। অন্তরার বাবা সব ব্যবস্থা করে দ্রুত অসীমের মৃত দেহ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।   

খবর শুনে অসীমের পরিবার খুব ভেঙে পড়ে। অসীমের লাশ কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্তরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কয়েকদিন অন্তরাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। অসীমের মৃত্যুর পর অন্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে যায় । কথাবার্তা কিছুটা এলোমেলো আর গভীর মনোবেদনায় আক্রান্ত হয়।  

ঘটনার পর থেকেই নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে অন্তরা, কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। রাতের পর রাত  নির্ঘুম কাটে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। অসীমের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে অন্তরার বাবা হাসপাতালে দীর্ঘ দিনের ছুটির দরখাস্ত করে দেয়। মা হারা মেয়েকে অনেক আদর দিয়ে, পরম মমতায় বড় করেছেন। যখন যা চেয়েছে দিয়েছেন, কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেন নি, অসীমকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইলো অন্তরা, অসীমের গ্রামীণ পরিবারের সাথে অন্তরাদের কোনো মিল না থাকলেও মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে অসীমকে পরিবারের সদস্য করে নিয়েছিলেন। ওদের জন্য ধানমন্ডির একটা ফ্ল্যাট দিয়ে দিয়েছিলেন। ভালোই চলছিল সব। হঠাৎ করে অসীমের এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না অন্তরার বাবা। কেন হঠাৎ মারা গেলো অসীম অন্তরার বাবার কাছে তা ধোঁয়াশাপূর্ণ। ও কি নিজেই মৃত্যুর চেষ্টা করেছিল বা কেউ ওকে কিছু প্রয়োগ করেছে মারার জন্য? অন্তরার বাবা আর ভাবতে পারে না। এ নিয়ে ঝামেলার অবসান হয়েছে এতেই তিনি কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন। মেয়ের উপর কোনো দোষারোপ আসলে তা তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না। এখন ওকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা কত যে কঠিন। অন্তরা খাওয়া-দাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছে, ঘর থেকে বের হয় না, কারো সাথে খুব একটা কথা বলে না । অন্তরার বাবা মেয়েকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায় জোর করে ওষুধ খাওয়ানো চলতে থাকে, কিন্তু ওষুধে খুব একটা সাড়া দেয় না মেয়ে ডাক্তার একটার পর একটা ওষুধ বদলাতে থাকে কিন্তু তেমন কোনো উন্নতি হয় না। অন্তরা দিন দিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। নিজের জীবনের প্রতি কোনো ধনাত্মক মনোভাব নেই। ডাক্তার বলে অন্তরা একটা কঠিন ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে, এ থেকে বের হয়ে আসতে ওর সময় লাগবে। ধৈর্য ধরতে হবে।  

ঘটনার পরের দিন রানা ঢাকা চলে আসে, পুরো ঘটনায় কিছুদিন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকে, স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় বসে থাকে। সব কিছু যেন ভোজবাজির মতো ঘটে গেছে। একটার পর একটা দৃশ্য। ওর হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, অন্তরা ওকে সম্মোহন করে সব কিছু করিয়ে নিয়েছে। রানা ভাবে এই ঘটনায় ও নিজে অপরাধী নয়, অন্তরার চাপের মুখেই সব হয়েছে। অন্তরার উপরে খুব রাগ হয়। কেন অন্তরা ওকে এমন বিপদের মধ্যে ফেললো? নিজেকেও বিপদগ্রস্ত করলো? আজ না হয় কেউ কিছু জনাতে পারে নাই কিন্তু কখনো যে এ সত্য প্রকাশ পাবে না, তাতো নয়। সব সময় মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক নিয়ে কাটাতে হবে। অন্তরা যেন ঝড় হয়ে ওর জীবনে দেখা দিয়েছে, এর শেষ পরিণতি কি রানা জানে না। অন্তরাও কি জানে? দুজনে যে স্বপ্নের জীবনের জন্য অসীমকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলো তা কি বাস্তবে রূপ নেবে? আর শান্তা, ওর মেয়ে ওদের বিষয়ে কিছুই ভাবতে পারে না রানা। তবে অন্তরার সব ক্রিয়াকলাপ ওকে অবাক করেছে। যে অসীমকে অন্তরা ভালোবেসে বিয়ে করলো তাকে সরিয়ে দিতে ওর একটুও হাত কাঁপলো না? একি শুধু প্রেমের জন্য? রানাকে পাওয়ার জন্য? তারপর আবার কি এই হিংস্রতা ফিরে আসবে না কখনো? অন্তরা কিভাবে এ ঘটনা ঘটাতে পারলো এতো ঠান্ডা মাথায়? এই ঘটনার সাথে নিজের সম্পৃক্ততার জন্যও খুব আফসোস হচ্ছে তবু কিসের যেন এক দুর্নিবার আকর্ষণ। অফিসে বসে রানা ছটফট করতে থাকে অন্তরার সাথে কথা বলার জন্য। গত দুই মাসে অনেকবার ফোন করেছে ওকে কিন্তু ফোন বন্ধ পেয়েছে বা ধরছে না। হাসপাতাল থেকে জানিয়েছে অসুস্থ ছুটিতে আছে। অন্তরার বাসায় যাওয়ার সাহস হয় নি রানার। ফেইসবুক, মেইল কোথাও অন্তরা সাড়া দেয় না।  

দীর্ঘ আড়াই মাস পর হঠাৎ অন্তরা ফোন ধরে।  

 হ্যালো। 

 হ্যালো। 

 অন্তরা কেমন আছো তুমি? 

 এইতো।  

তোমার শরীর এখন ভালো? 

 অন্তরা উত্তর দেয় না ।  

 দীর্ঘ নীরবতা। 

আমি ভালো নেই, খুব খারাপ আছি অন্তরা। 

কেন?

কেন তা তুমি ভালো করেই জানো, ওই ঘটনা আমি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। সারাক্ষন একটা আতঙ্ক ঘিরে রেখেছে।  

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।  

তোমার সাথে দেখা করবো।  

আমার ইচ্ছে করছে না রানা।  

প্লিজ আসো। কতদিন তোমাকে দেখি না।  

হুম।  

আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না তোমার? 

জানি না।  

অন্তরা এতো সব কিছু করলে আমাদের দুজনের মাঝের বাধা দূর করতে আর এখন? প্লিজ আমি রিকোয়েস্ট করছি একবারের জন্য আসো।  

 দেখি।  

 না আসো, আমি অপেক্ষা করবো। বিকাল পাঁচটায় কফি ওয়ার্ল্ডে আসো।  

অন্তরা ফোন লাইন কেটে দেয় ।  

খুব নিরুত্তাপ গলায় কথা বলে অন্তরা। যেন একজন মৃত মানুষ, নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছে জোর করে, কোনো তাপ-উত্তাপ নাই। এতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

রানা সারাদিন নানা কিছু ভাবে, শান্তা বার বার ওকে নিউইয়র্কে যেতে বলছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। অন্তরার সাথে যে সম্পর্কটা তৈরী হয়েছে, তার থেকে বের হওয়া এতো সহজ নয়। ওর জন্য গভীর অনুভূতি তৈরী হয়েছে, আকর্ষণ, ওকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা এতো সহজ নয়, অন্তরার এখন যে অবস্থা তাতে ওর কাছে থাকা দরকার কিন্তু এই দুইমাস ভয়ে, আতঙ্কে ছিল । যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। অন্তরা নীরব ছিল, অসুস্থ ছিল। এখন সময় হয়েছে ওর মুখোমুখি হওয়ার। 

রানা অফিসে সারাদিন ছটফট করতে থাকে, নানা চিন্তা এসে মনকে ভরাক্রান্ত করছে। বিকালে অন্তরা ফোন ধরে না। মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠিয়ে কফি ওয়ার্ল্ডে অপেক্ষা করে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর অন্তরা আসে, ওকে দেখে চমকে ওঠে রানা, চেনাই যাচ্ছে না।  চেহারা একদম ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য, চোখের নিচে কালো, চুল উস্কো-খুস্কো।  কমপক্ষে দশ কেজি ওজন কমে গেছে, ভীষণ প্রাণহীন। রানা উঠে হাত ধরে চেয়ারে বসায়। মুখোমুখি বসে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ।  চারপাশে চামচ, পেয়ালার টুংটাং, তার মধ্যে দুজন মানুষ বসে আছে নির্বাক।  রানা অন্তরার চোখের ভাষা পড়তে পারছে না, অচেনা, ভিন্ন জগতের এক মানুষ মনে হচ্ছে। হাতদুটো ঠান্ডা। রানা ওর হাতদুটো ধরে বলে চলো অন্য কোথাও যাই, অন্তরা নিঃশব্দে গাড়িতে এসে ওঠে। রানা চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছ। পান্থপথের জ্যাম পেরিয়ে মহাখালী হয়ে উত্তরার পথে গাড়ি চলছে। অন্তরা বলে জানালাগুলো খুলে দাও, এসিতে দমবন্ধ লাগছে। গাড়ি খুব জোরে চলছে, বাতাস এসে অন্তরার চুল আরো এলোমেলো করে দেয়। উত্তরায় একটা নিরিবিলি রেস্তোরাঁয় এসে বসে। অন্তরার গায়ে কোনো শক্তি নেই যেন, যন্ত্রচালিতের মতো চলছে ।   

এখন কেমন আছো? 

অন্তরা কোনো উত্তর না দিয়ে ন্যাপকিনগুলো উল্টে-পাল্টে রাখে। রানা উঠে ওর পাশের চেয়ারে ঘন হয়ে বসে চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে দেয়, গাল স্পর্শ করে। 

ওয়েটার এসে সামনে দাঁড়ালে রাতের খাবারের অর্ডার করে চিকেন ক্লিয়ার স্যুপ, সিজলিং বিফ, ভেজিটেবল রাইস, চিকেন ফ্রাই আর দুটো ঠান্ডা কোক। অন্তরার প্রিয় খাবার।  

 রানা অন্তরার কাঁধে হাত রাখে, ওর শরীরে কোনো উত্তাপ নাই, হাতদুটো ঘষে ঘষে গরম করার চেষ্টা করে। অন্তরা একটু একটু করে শক্ত হয়ে যায়, ওর চেহারায় বিষন্নতা, হঠাৎ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রানার হাতের মধ্যে মুখ দিয়ে কাঁদতে থাকে।  

এ আমি কি করলাম? কেমন করে করলাম। অন্তরা আর্তচিৎকার করতে থাকে।  

রেস্তোরাঁর লোকজন সব তাকাতে থাকে। রানা অন্তরাকে বুকের মধ্যে নিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসে, গাড়িতেও অন্তরা সিনিকের মতো দাপাচ্ছে আর কাঁদছে। একটা নির্জন রাস্তায় নিয়ে গাড়ি দাঁড় করায় রানা।  

প্লিজ লক্ষী কান্না থামাও, রাস্তার লোকজন কিছু সন্দেহ করবে, আমার বাসায় চলো। অন্তরার যেন হুঁশ নেই। বিড়বিড় করে নানা কথা বলছে, অস্পষ্ট। এতদিনের চাপা অনুভূতি অঝোর ধারায় ঝরছে। আমি সব কিছু স্বীকার করবো, থানায় যাবো, আমাকে নিয়ে চলো। এভাবে বাঁচতে পারবো না। এই মানসিক যন্ত্রণার ভার বইতে পারবো না। এভাবে আর একটা দিনও আমার পক্ষে সারভাইভ করা সম্ভব না।  

অন্তরার কথা শুনে রানা হতবিহবল হয়ে পড়ে, এতে যে তার অংশগ্রহণ ছিল এ কথাতো এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারে না। আতঙ্কে এতদিন কাটিয়েছে, ভেবেছে এতদিনে অন্তরা কিছুটা সামলে উঠেছে। কিন্তু আজ যে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ভাবে নাই। কেন যে শান্তাদের কাছে নিউইয়র্কে চলে যায় নি এতদিনে? মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। অন্তরাকে পানি খাইয়ে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।  

এখন কি করা যায় ভাবছে রানা। অন্তরা যদি পাগলামি করে তাহলে দুজনের একজনও রেহাই পাবে না। গাড়ি নিয়ে নিজের বাসায় আসে। এই অবস্থায় ওকে বাসায় পৌঁছে দেয়াটাও বিপদজনক, ও যেসব বলছে তা যদি সবার সামনে বলা শুরু করে? এতদিন কি বলে নাই? কিন্তু কোনো কথাতো ওর কানে আসে নাই, ওকে এই বাসায় রাখাও বিপদজনক। কেউ কোনো যোগসূত্র বের করতে পারে। দারোয়ানকে দিয়ে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ এনে খাওয়ায়, মাথায় পানি ঢালে। আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়, অন্তরার বাসা থেকে অনেক ফোন আসছে, ও কোনো ফোন রিসিভ করছে না। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজতে চলেছে। অন্তরার বন্ধু মনি ওদের বন্ধুত্বের কথা জানে, ওকেই ফোন করে রানা। বলে অন্তরা খুব অসুস্থ ওর ওখানে আসছে।  

মনি এতো রাতে অন্তরাকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে অন্তরাকে মনির বাসায় নামিয়ে দেয় রানা।  

অন্তরার যেন কোনো হুঁশ নেই। হঠাৎ রানার সাথে দেখা হয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে কিছুটা। বার বার বলছে আমি অসীমকে মেরেছি, আমাকে মেরে ফেলো, মেরে ফেলো।  

ওই রাতে অন্তরার বাবা এসে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরদিন অন্তরার মাথায় শক দেয়। ডাক্তারের ভাষ্যমতে অসীমের আকস্মিক মৃত্যুতে ওর মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম নিয়েছে, মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এই আঘাতটা এমন যে সে নিজেকে ওই ঘটনার জন্য দায়ী ভাবতে শুরু করেছে, অনেক কল্পনামিশ্রিত কাহিনী বলছে। যা হচ্ছে ডিল্যুশন বা বিভ্রান্তি। ওকে দীর্ঘদিন চিকিৎসায় থাকতে হবে।  

অন্তরার বাবা শিল্পপতি এম রহমান অন্তরাকে নিয়ে কানাডার বাড়িতে চলে যায়, সেখানে ওর চিকিৎসা চলতে থাকে। অন্তরার মনে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা দিন দিন বাড়তে থাকে। টরেন্টোর একটা মানসিক হাসপাতালে ওকে ভর্তি করা হয়। সেখানে অন্তরা কিছুটা অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে।  

অন্তরার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে রানা খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে, ভয় ওকে সারাক্ষন গ্রাস করে রাখে। দ্রুত নিউইয়র্কে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলে এবং সিদ্ধান্ত নেয় কোনোদিন দেশে ফিরবে না। অন্তরা নামের কারো সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল ভুলে যেতে চায়। কোন কুক্ষনে যে ওর সাথে দেখা হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত এক পঙ্কিলতায় নিয়ে ফেলেছে জীবনকে। এর থেকে যেন কোনো মুক্তি নাই। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসাবে আদালতের রায় শুনতে হয় নাই রানাকে কিন্তু নিজের মনের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আজীবন। এ কঠিন শাস্তি। নিজের কৃতকর্মের বোঝা সারাজীবন টেনে নিয়ে চলা, এ থেকে বের হওয়ার কোনো পথ কি নাই? সময় কি পারবে না এই স্মৃতি থেকে রেহাই দিতে? অন্তরার মতো ও যদি আত্মবিস্তৃত হতে পারতো, তাহলেই যেন ভালো হতো। সেইন্ট মার্টিনের নীল জলে মনের যত বিলতাকে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সমুদ্রের সফেদ ঢেউ উড়িয়ে নিয়ে যাক জীবনের যত পঙ্কিলতাকে, তা আর কোনোদিন জেগে উঠুক চায় না, সমুদ্রের বিশালতায় ঘুমিয়ে থাকুক নিষ্ঠুর অতীত।   

  

Post a Comment

0 Comments