জাতিসংঘ কর্তৃক ২০২২-২০৩২-এই দশ বছরকে “আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০১৯ সালে “আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ” পালন করা হয়। পৃথিবীর ক্ষয়িষ্ণু নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠির ভাষাগুলোর সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টিই এর লক্ষ্য।
পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশে নৃ-গোষ্ঠী আছে ৫০টি—ভিন্ন ভাষা আছে ৪০টি আদিবাসী গোষ্ঠীর। চাকমা, বম, কন্দ, চাক, ঠার, তঞ্চঙ্গ্যা, মান্দি, হাজং, খাসি, খাড়িয়া, খিয়াং, খুমি, কোচ, কোল, মারমা, ম্রো, লসাই, আম্বিয়া, মণিপুরি, মৈতৈ, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, মুন্ডা, কানপুরি, মাহলে, কুড়ুখ, পাংখোয়া, মালতো, পাত্র বা লালেং, রাখাইন, সৌরা, মাদ্রাজি, সাঁওতালি, তেলুগু, ককবরক, গুর্খা, রেংমিটচা, কোডা, লিঙ্গাম, উড়িয়া, উর্দু ও সদরি যার আলাদা বর্ণমালা আছে। বর্তমানে আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে তাদের গ্রহণ করতে হয়েছে এবং শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা প্রচলিত হয়েছে। ফলে যেসব আদিবাসী ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে তারা তা চর্চা করবার সুযোগ পাচ্ছে না। অনুসন্ধানে দেখা গেছে চাকমা জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ তা লিখতে কিংবা পড়তে জানে না। মান্দি ভাষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। এর বড় কারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার প্রচলন। আদিবাসী সমাজেও সাহিত্য হচ্ছে—তবে তার বেশির ভাগই বাংলায় রচিত। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের মৃত্যুতে এই হারিয়ে যাওয়া আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে।
ইউনেস্কোর মতে কোদা, মেগাম ও পাংখুয়া এই তিনটি ভাষা মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে। যে কোন সময় হারিয়ে যেতে পারে। আর বিপন্ন তালিকায় আছে বম, চাক, চিন, খাসি, ম্রু, কুরুক্স, প্নার ও সৌরা ভাষা।
তবে আশার কথা হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে ৫টি আদিবাসী ভাষায় (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সারদি ও মান্দি) প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিকল্পনায় আছে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বম, কোচ, ওরাওঁ, হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষায় প্রাথমিক চালু করার। কিন্তু নানাবিধ সীমাবদ্ধতায় তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অথচ একুশের দাবি ছিল মাতৃভাষায় কথা বলা ও শিক্ষা গ্রহণ করবার অধিকারকে উচ্চকিত করা। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেই দাবি মিটালেও অন্য ভাষার ক্ষেত্রেও কেন একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তা প্রশ্ন রেখে যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাষা কমিশন আছে যা নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাকে রক্ষা করার সাথে সাথে সেই ভাষাভাষী মানুষেদের নিজ ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা নেবার অধিকারসহ সকল সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করে। আমাদের চল্লিশটি আদিবাসীগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও ইতোমধ্যে এগারটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এখনই দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিপন্নপ্রায় ভাষাগুলোসহ অন্য ভাষাগুলোও বিলুপ্ত হবে কালের বিবর্তনে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গঠিত হবার মধ্য দিয়ে ভাষা কমিশন গঠন করা সহজ হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। যে উদ্যোগের ফলে শুধু আদিবাসী ভাষাই রক্ষা পাবে না—নিশ্চিত হবে নিজেদের ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিচিত্র। এতে করে তাদের শিক্ষার ভিত্তি যেমন মজবুদ হবে তেমনই রক্ষা পাবে ভাষাগুলো। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সাথে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বাংলা একাডেমীও যুক্ত হতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রক্ষা পেতে পারে আদিবাসী ভাষাগুলো—রক্ষা পেতে পারে ভাষা বৈচিত্রের সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি একুশের উদ্দেশ্য ও চেতনা।
0 Comments