জাকির তালুকদারের সাক্ষাৎকার



জাকির তালুকদারের জন্ম ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২০-ই জানুয়ারিনাটোর জেলার আলাইপুরে। পেশায় চিকিৎসক। উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। পেশা জীবনের বাইরে সাহিত্য চর্চাকেই তিনি ধ্যান-জ্ঞান মনে করেন। নব্বই দশকে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দেয় বাংলাসাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক হিসেবে। ছোটগল্পউপন্যাসপ্রবন্ধছড়াকিশোর সাহিত্যঅনুবাদসম্পাদনাসবমিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩২ টি। কুরসিনামা’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে তিনি কাগজ কথাসাহিত্য’ পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর থেকে ঘরোয়া সাহিত্য সম্মাননা-২০০৫’, নাটোর থেকে মহারানী ভবানী সাহিত্য পদক-২০০৮’, ‘বগুড়া লেখকচক্র পুরষ্কার-২০০৯’ ‘মুসলমানমঙ্গল’ উপন্যাসের জন্য চিহ্ন সম্মাননা-২০১১ এবং পিতৃগণ’ উপন্যাসের জন্য জেমকন সাহিত্য পুরস্কার-২০১২পান। কথাসাহিত্যে পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার

 

সাক্ষাৎকারটি  ২০১২ খ্রিস্টাব্দে গ্রহণ করেছেন কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন

 

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আমরা জানি আপনার শুরুটা হয়েছিল ছড়া দিয়ে। আপনার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ দুটি হলো তিনতিড়ি’(১৯৮৯) ও নাইমামা কানামামা’(১৯৯৫)। দুটিই ছড়ার বই। তো আপনি গল্পে কিভাবে আসলেন ?

 

জাকির তালুকদারঃ ব্যাপারটি স্রেফ উপলব্ধির। বলা যায় আত্ম-উপলব্ধিরও। আমি ১৯৯৬ সালে চাকরি নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যাওয়ার পরে যে জীবন দেখলামবলা চলেযে জীবনের মধ্যে প্রবিষ্ট হলামমনে হলো সেই জীবনকেতার সকল মাত্রাসহ তুলে আনা সম্ভব একমাত্র কথাসাহিত্যে। তাই সেই দিকেই মনোনিবেশ করি। তার মানে এই নয় যে আমি ছড়া বা সাহিত্যের অন্য মাধ্যমকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমি আমার জন্য কথাসাহিত্যকেই উপযুক্ত মনে করেছি। আর কিছু নয়

 

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আপনার ইতোমধ্যে ছয়টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আরও একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। আপনার প্রথম দিককার গল্পগুলোর সাথে এখনকার গল্পগুলোর পার্থক্য কোথায় কোথায় বা তাদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ আছে কি-না ?

 

জাকির তালুকদারঃ শুধু শুরুর দিকের নয়প্রত্যেক গল্পের সাথেই আরেকটি গল্পের পার্থক্য রয়েছে। কারণ প্রতিটি গল্পের বিষয় আলাদা,ট্রিটমেন্ট ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই আঙ্গিকও আলাদা। সেই অর্থে প্রত্যেকটি গল্পই পৃথক। তাছাড়া আমি নিজে কোনো নির্দিষ্ট আঙ্গিকবা গদ্যভঙ্গিতে আবদ্ধ থাকতে চাই নি কখনো। এই আবদ্ধ থাকাটিকে অনেকে নিজস্বতা বলে চালাতে চান। আমাদের মিডিয়া এবং বিজ্ঞ আলোচকরাও এইভাবেই ভাবতে এবং প্রচার করতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটি নিজের লেখা নিজে বার বার নকল করা। প্রতিটি গল্প এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টিযদি সেটি সত্যিকারের গল্প হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রত্যেকের আলাদা না হয়ে উপায় নেই

আর বিরোধের কথাবিরোধ বোধকরি নেই। আছে বিবর্তন। পূর্ণতার দিকে যাত্রাপথের আকাক্সক্ষাজনিত বিবর্তন এবং পরিবর্তন

মোজাফ্ফর হোসেনঃ দেখা যায়অনেক সময় জীবনের ওজনহীনঅতি সাধারণ কোন ঘটনাও চমৎকার গল্প হয়ে উঠেছে। উদাহরণ স্বরুপ হেমিংওয়ের ক্যাট ইন দ্য রেইন’ গল্পের কথা বলা যেতে পারে। আমার প্রশ্নটা অন্যখানে। প্রমথ চৌধুরী ছোটগল্প সম্পর্কে বলেছিলেন- আমার মতে ছোটোগল্প প্রথমে গল্প হওয়া চাইতারপরে ছোটো হওয়া চাইএ ছাড়া আর-কিছুই হওয়া চাই নে।’ আপনার কাছে বিষয়টি কিভাবে ধরা দেয় ?

 

জাকির তালুকদারঃ ‘গল্প হওয়া চাই’ পর্যন্ত একমত আছি। গল্প বলতে আমি শুধুমাত্র আখ্যানকে বোঝাচ্ছি না। কিন্তু ছোট বা বড় হওয়াকে আমি কোনো শর্ত হিসাবে মেনে নিতে রাজি নই। অন্তত শব্দসংখ্যা বা পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচার এক্ষেত্রে অমূলক বলেই আমি মনে করি। আর প্রমথ চৌধুরী নানা কারণে আমাদের শ্রদ্ধেয়। তবে গল্পকার হিসাবে নয়। ছোটগল্প সম্পর্কে তাঁর বলা কথাটিকে বেদবাক্য মনে করার কোনো কারণ আমি দেখি না

 

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আপনার বেশির ভাগ গল্পই ঘটনা নির্ভর। একটি বিশেষ ভাব বা মুড নির্ভর গল্প (যেমন- অ্যা অয়েল লাইটেড প্লেস’ কিংবা মাই ফাদার সিটস ইন দ্য ডার্ক’) আপনার কাছ থেকে আমরা খুব একটা পাইনি। এর কারণটা কি?

 

জাকির তালুকদারঃ আমি আগে ব্যাপারটি ভেবে দেখি নি। প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে সত্যিসত্যিই আমার এই দিকটিতে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। ভালো করে নিজেকে পুনঃপাঠ করলে হয়তো কারণটা বুঝতে পারব। প্রশ্নের আকারে হলেও একটি দিক ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে পুরো গল্প মুডনির্ভর না হলেও গল্পের অগ্রসরমানতার ক্ষেত্রে মুডনির্ভরতার বিভিন্ন চিহ্ন অনেক গল্পেই ছড়িয়ে আছে

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আপনার বেশ কিছু গল্প পাঠ থেকে আর একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি- আপনার গল্প যতটা না থট প্রভোকিং তার থেকে বেশি হার্ট-প্রভোকিং। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

 

জাকির তালুকদারঃ এই পর্যবেক্ষণটি বোধহয় সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ চিন্তার উদ্রেক যদি না-ই করল তাহলে আর লেখার দরকারটা কীমননে অবিরত খোঁচা যদি না-ই দিতে থাকলতাহলে লেখা তো অর্থহীন। তবে বিষয়টা যদি এমন হয় যেআমি গল্প দিয়ে আগে পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করিতারপর তাকে বিশ্লেষণে উদ্বুদ্ধ করিসেটি হতে পারে। তবে প্রকৃত শিল্পের বৈশিষ্ট্য কিন্তু প্রথমে তা হৃদয়কে স্পর্শ করবে

নেহায়েত মগজের ব্যায়ামকে যারা গল্পের নামে চালিয়ে দেনআমি খুব চেষ্টা করে তাদের থেকে আলাদা হয়েছি

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আপনার গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তব জীবনে সখ্য কেমনআপনার বাস্তব জগত না কল্পনা জগত- কোন জগতে তাদের আনাগোনা বেশি?

জাকির তালুকদারঃ চরিত্রের বীজটা আহরণ করি বাস্তব থেকে। তবে সেটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে কল্পনা এবং অন্যবিধ বাস্তবতার সাথে মিলিত হয়ে। যেমন আজগর আলির হিসাববিজ্ঞান’ গল্পের আজগর আলি। অন্য একটি পত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি। কিছুটা তুলে ধরে বলছি। নব্বই দশকের শুরুতে একদিন রাজশাহী থেকে নাটোরে যাচ্ছিলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটে বাস জ্যাম আটকে আছে। বিনোদপুরে তখন রাস্তার দুই ধারে মাছ-মাংস-সবজি-কাঁচামালের বাজার বসে। বিশেষ করে সকালের দিকে। সেখানে খাল-বিল সেঁচে আনা টাটকা সব দেশী মাছ পাওয়া যায় বলে মৎসপ্রিয় মানুষের বেশ ভিড় হয়। বিশেষ করে ছুটির দিন সকালে। বাস জ্যামে আটকে আছে। আর বাসের জানালা দিয়ে আমার চোখ আটকে আছে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের মুখে। তার পরনে হাতাওয়ালা হ্যান্ডলুমের পুরনো গেঞ্জিলুঙ্গি। বাম কাঁধে গামছা। রাস্তার দুই পাশে কোনো-না-কোনো কনস্ট্রাকশনের কাজ হয়। তাই রাস্তায় ইটের টুকরো খুব একটা দুর্লভ নয়। সেই রকম একটা ইটের ওপর বসে আছেন বৃদ্ধ। তার সামনে একটা খালি ডালি। আর হাতে কয়েকটা একটাকা এবং দুটাকার নোট। বোধহয় পাশের কোনো গ্রাম থেকে শাক-পাতা বা তরকারি বা মরশুমি ফল বেচতে এসেছিলেন। যেহেতু ডালি এখন শূন্যতাই ধারণা করাই যায় যে তার জিনিসগুলি বিক্রি হয়ে গেছে। বৃদ্ধ হাতের নোটগুলি খুব যতœ করে গুনলেন। একটা একটা করে গুনলেন। টাকা গোনার সময় মানুষের মুখে-চোখে একধরনের বাড়তি মনোযোগ এবং আত্মপ্রসাদও ফুটে ওঠে। বৃদ্ধের মুখেও সেই ছাপ। টাকা গুনতে গুনতে ঘোলাটে চোখদুটোকে আরও কাছে নিয়ে যাবার জন্য নিজের অজান্তেই তার মাথা অনেকখানি নুয়ে এসেছে টাকার নোটগুলির দিকে। সমস্ত মুখটিতেই একটু বাড়তি চকচকে ভাব। টাকা গণনা শেষ করার পরে এবার মাথাটা সোজা হলো। সামনে তাকিয়ে আছেন সোজাসুজি। কিন্তু আমার মনে হলো কিছুই দেখছেন না তিনি। হিসাব করছেন মনে মনে। বেচাবিক্রির পালা শেষ। এবার তাকে কিনতে হবে। সেই কেনার জিনিসগুলির তালিকা নিজের মনে মনে আরেকবার ঝালাই করে নিচ্ছেন। আমি তো জানি না তার কেনার তালিকায় কি কি আছে। হয়তো কিনতে হবে কেরোসিনস্ত্রী বা পুত্রবধূর কোনো কাপড় বা চাহিদার জিনিসিপান-সুপারিনাতি-নাতনির বায়না করা জিলিপি বা কোনো খেলনাহয়তো চাল-ডালও। সেই সঙ্গে হয়তোবা রয়েছে পাড়ার মুদির কাছে বাঁকিযা আজকে হাট থেকে সদাইপাতি সেরে ফিরে গিয়ে শোধবার কথা। কিন্তু তার হাতের নোটগুলির দিকে তাকানো আর মনে মনে হিসাব করার পরবর্তী ভঙ্গি বলেই দিচ্ছে এই টাকা তার এই সময়ের আশু করণীয়গুলির জন্যও যথেষ্ট নয়। বৃদ্ধের বলিরেখাময় মুখের ওপর কী আরও নতুন বলিরেখা যোগ হচ্ছে! তার বুক মোচড়াচ্ছে নিশ্চয়ই। আর তাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমার বুকও মোচড়াতে থাকে। নিজের মানসিক অবস্থা কল্পনা করে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। ঐ বৃদ্ধ কি ঢুকে পড়েছেন আমার বুকের মধ্যেনাকি আমিই ঢুকে পড়েছি ঐ বৃদ্ধের বুকের মধ্যেএদিকে জ্যাম ছুটে গেছে রাস্তার। আমাদের বাসের চাকাও গড়াতে শুরু করেছে। আমি জানালা দিয়ে আকুল চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকি বৃদ্ধের দিকে। তাকে যতক্ষণ দেখা যায় চোখ দিয়ে ততক্ষণই শুষে নিতে চাই তার অবয়বতার সমস্ত নড়াচড়াতার মুখে বলিরেখাগুলির ওপর আরও নতুন ভাঁজপড়ার চিহ্নগুলি

তারপরে আর কোনোদিন সেই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়নি। হবার কথাও নয়। কিন্তু বৃদ্ধের সেই মুখ আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। কেনহঠাৎ-ই উত্তর পাওয়া যায়। আবি®কৃত হয় এক নিষ্করুণ সত্য। কোনো এক মুহূর্তে আমি চমকে উঠে খেয়াল করি যে আসলে ঐ বৃদ্ধের মুখ আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে আমার জনকআমার পিতার মুখের কথা। আশৈশব আমি আমার পিতাকে দেখে আসছি ঐভাবে প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতির অসামঞ্জস্য নিয়ে গলদঘর্ম হতে। তাকে প্রতিনিয়ত দেখেছি হাতে সঞ্চিত ও উপার্জিত মুদ্রাগুলি নিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের তুলনায় তার অপ্রতুলতা নিয়ে অপ্রস্তুত থাকতে। দেখেছি কখনো কখনো উদাস দৃষ্টিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে। দেখেছি কখনো কখনো পুরোপুরি ভেঙেও পড়তে

তারও বছর দশেক পরের কথা। চাকরিসূত্রে আমি দিনাজপুর জেলায়। সপ্তাহের ছয়টি দিন সেখানে থাকি। বৃহস্পতিবার বিকালে পার্বতীপুর থেকে তীতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে নাটোরে আসি। শনিবার ভোরে সেই একই ট্রেনে কর্মস্থলে যাই। সেই সময় আমি দেখলাম ধানকাটা দলের মানুষদের। ধানকাটার মৌসুম এলেই এই মানুষরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে নিজেদের গ্রামগুলিকে পুরুষশূন্য করে। নিজেদের এলাকায় মঙ্গা। কাজের সংস্থান নেই। আর তারা কাজ বলতে জানে ক্ষেত-ফসলের কাজ। সেই কাজের সন্ধানে তারা বেরিয়ে পড়ে দলে দলে। চলে যায় নাটোর-রাজশাহী-কুষ্টিয়ায়। ভিড় করে নিজের শ্রম বিক্রির লাইনে- মোক ন্যান বাহে! মুই ধান কাটিবার কামত আইছঁ

কয়েক সপ্তাহ এই রকম মানুষদের সাথে দেখা হতে থাকে। পরিচয় হয় ছবরুদ্দিআলেকালিমকবের হোসেনদোস্ত মহম্মদদের সাথে। তাদের মধ্যে একজন আজগর আলিও। আজগর আলির সাথে দেখা হয়েছিল অবশ্য ফিরতি পথে। সে একমাস ধানকাটার কাজ করে মজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। ট্রেনে যে সিটটিতে বসেছিলসেটি আমার জায়গা থেকে একটু দূরে। কিন্তু তার মুখ দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম দশ বছর আগের মতো আরও একবার। বিনোদপুরের সেই বৃদ্ধ! সেই একই ভঙ্গিতে হাতের মুঠোয় একশো-পঞ্চাশ-দশ-বিশ টাকার নোট গুনছে। তারপর মুখ উঁচিয়ে হিসাব করছে মনে মনে। হিসাবের খাতায় খরচের খাতের সাথে উপার্জনের টাকার কোনো সামঞ্জস্য বিধান করতে পারছে না। ফলে প্রতিবার টাকা গোনার পরে আরও বেশি উদাস হয়ে পড়ছে। আরও শূন্যতা ভর করছে ঘোলাটে দুই চোখে

তারপর দুই সপ্তাহ একটানা বুক মোচড়ানিচোখের পানি ফেলানিদ্রাহীনতার সাথে সাথে জন্ম নিল গল্প- আজগর আলির হিসাববিজ্ঞান

মোজাফ্ফর হোসেনঃ চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে আপনি কি সবসময় আপনার আদর্শকে চরিত্রগুলোর উপর চাপিয়ে দেন নাকি কখনো কখনো আপনার আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের ইচ্ছা মতো চলার সুযোগ করে দেন?

 

জাকির তালুকদারঃ চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে শেষের পথটিই কাম্য হওয়া উচিত। যেমন বালজাক নিজের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে বিকশিত হতে দিয়েছেন। তারাশঙ্কর তার নিজের বিশ্বাস এবং উদ্দেশ্যের বিপরীতে চলতে দিয়েছেন হাঁসুলি বাঁকের উপকথার মানুষজনকে। তবে নিজের আদর্শ এবং পক্ষপাতের কথা বলার মতো চরিত্রও সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। তবে দেখতে হবে শেষ ট্রিটমেন্টটা কোনদিকে যাচ্ছে। চলতি এবং ভবিষ্যতের বাস্তবতাকে না মেনে স্বপক্ষকে জোর করে জিতিয়ে দেওয়ার ঘটনা গৌণ লেখকরা অহরহ ঘটিয়ে থাকেন

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আখতারুজ্জান ইলিয়াসের আশংকা – ‘ছোটগল্প কি সত্যিই মরে যাচ্ছে’- একবিংশ শতকের শুরুতে এসে সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিয়েছে। আপনি নিজেও আপনার গল্পকথা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আশির দশকের পরবর্তী সময়ে ছোটগল্পের নাজুক পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন। বাংলা ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

 

জাকির তালুকদারঃ এই প্রপঞ্চটি নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রথমেই সবিনয়ে বলে নিতে চাই যেআখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সমীকরণটি ছিল ভুল। ছোটগল্পের জন্ম এবং মৃত্যুকে তিনি পুঁজিবাদের সাথে সমান্তরাল করে দেখেছেন। এভাবে দেখাটা যান্ত্রিক। এভাবে দেখতে গেলে প্রাগ্রসর সমাজে অনুন্নত শিল্প-সাহিত্যকিংবা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা সমাজে উন্নত শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না

ছোটগল্পের বেঁচে থাকা না থাকা নির্ভর করে অন্তত তিনটি জিনিসের ওপরে। একটি হচ্ছেলেখকরা আর ছোটগল্প লিখবেন কি না। দ্বিতীয়টি হচ্ছেপাঠক ছোটগল্প পড়বেন কি না। আর তৃতীয় হচ্ছেসমাজ ছোটগল্প লেখার বা ছোটগল্পকে ধারণ করার অনুপযোগী হয়ে উঠেছে কি না

আমি নিজে যে সংশয় প্রকাশ করেছিলামতা ছিল লেখকদের দিক থেকে ছোটগল্প রচনায় উপযুক্ত মনোযোগের অভাব লক্ষ করে। ছোটগল্পের নিবিষ্ট লেখকের সংখ্যা সত্যি সত্যিই অনেক কম আমাদের দেশে। আমাদের বেশিরভাগ লেখকের মধ্যে লেখার প্রতি পূর্ণ মনোযোগের অভাব টের পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই আদৌ সচেতন নই যে বাংলাভাষাবাংলাসাহিত্য এবং বাংলা-সম্পর্কিত সবকিছুর দায়-দায়িত্ব এখন বাংলাদেশের মানুষের। ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালি নিজস্ব স্বাধীন একটি রাষ্ট্র অর্জন করেছে। তাই কোনো দেশের একটি প্রদেশে বসবাসকরী বাঙালি বা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করা বাঙালিদের তুলনায় আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য হাজার গুণে বেশি। সেই দায়িত্বের উপলব্ধিটা আমাদের রাজনীতিবিদদের নাইব্যবসায়ীদের মধ্যে নাইশিক্ষক-কর্মচারিদের মধ্যে নাইএমনকী লেখক-শিল্পীদের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে নাই। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম থেকে গদ্যলেখক বের হচ্ছে না বললেই চলে। যারা লিখতে আসছেনতারাও এতটাই শৌখিন যে সেই মনোভঙ্গিটা বিরক্তির উদ্রেক না করে পারে না। আর পাশাপাশি আমাদের মিডিয়া বসে আছে সৎ সাহিত্যকে ধ্বংস করার বড় বড় উপাদান সাজিয়ে নিয়ে। মুদ্রিত মিডিয়া ছোটগল্পের চাইতে কলাম চাইছে বেশিআর ইলেকট্রনিক মিডিয়া চায় নাটক। দুটোই অর্থকরী এবং প্রতিভাহীনদের সামনে টেনে আনার কারবারি। এমনও অনেক সদ্য তরুণ ছেলেমেয়েকে পাওয়া যাবেযাদের লেখা গল্প কোনো পত্রিকায় ছাপার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে নাকিন্তু এদিকে অনায়াসে তার লেখা গোটাদশেক নাটক টেলিভিশনে প্রচার হয়ে গেছে। টাকার সঙ্গে সে পাচ্ছে গ্ল্যামারও। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলিতে বহু বছর ধরে লিখে চলেছেনএমন অনেক লেখকেরই কোনো ছবি আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু টেলিভিশনের নাটকের কুশিলব-নাট্যকারদের চাররঙা ছবিতে সেইসব দৈনিকই সয়লাব। এই রকম পরিস্থিতিতেএইসব সস্তা এবং স্থূল প্রলোভন এড়িয়ে গল্পলেখার কষ্টসাধ্য কাজটি করতে যাবেএমন সমৃদ্ধ মননের এবং মেধার তরুণ তো বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে একসময় গল্পলেখকের সংখ্যা আরো কমে যাবে। এমনিতেই উৎকর্ষের দিক থেকে উঁচুমানের গল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্করএই ধারা অব্যাহত থাকলে কিছুদিন পর সংখ্যার দিক থেকেও তা হবে অপ্রতুল। ফলে হুমকির মুখে তো ছোটগল্প অবশ্যই

তবে ছোটগল্প মরে যাওয়ার আশু কোনো লক্ষণ নেই। ইংরেজিরুশফরাসি বা স্প্যানিস ভাষার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম- আরবিফারসিহিন্দি এমনকী নেপালি এবং ছোট ছোট আফ্রিকান ভাষাতেও এখন জোরে-শোরে ছোটগল্প লেখা চলছে। মানে এবং সংখ্যায় সেগুলি উল্লেখযোগ্য। কাজেই বাংলাতেও ছোটগল্পের আশুমৃত্যুর আশংকা বা ভীতি থেকে আমরা সরে আসতে পারি

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আপনার পঠন-পাঠন থেকে বিশ্ব সাহিত্যে বাংলা ছোটগল্পের অবস্থান কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?

জাকির তালুকদারঃ এই তুলনা করতে যাওয়া বা তুলনামূলক অবস্থান নির্ণয়ের যোগ্যতা আমার নাই। তাছাড়া আমি মনে করিতুলনা করা যায়ও না। কারণ একটি দেশের বা ভাষার সাহিত্য আরেকটি দেশের সাথে মেলানো যায় না। এটি করা যেত যদি প্রতিযোগিতার বন্দোবস্ত থাকত। তাহলে একটি সার্বজনীন মানদণ্ড খাড়া করা থাকত। কিন্তু মেশিনটুলস-এর বা ফুটবল-ক্রিকেটের সার্বজনীন মানদণ্ড দাঁড় করানো গেলেও শিল্প-সাহিত্যের মানদণ্ড দাঁড় করানোর চেষ্টা করাটাই বোকামি। যদিও এই রকম বোকামির চেষ্টা অনেক হয়েছে অতীতে। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রকে বলা হয়েছে বাংলার স্যার ওয়াল্টার স্কটমাইকেলকে বলা হয়েছে বাংলার মিলটন। রবীন্দ্রনাথকেও এই রকমই কিছু একটা বলার প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছিল। গোলামির মানসিকতা থেকে এইসব করা হয়। আবার বিপরীতক্রমে আধিপত্যের মানসিকতা থেকেও এই রকম চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বেশ সফলতার সাথেই। এই মানসিকতারই ফলশ্রতি বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ। তবে আমাকে যদি একথা জিজ্ঞেস করা হয় যে বাংলা ছোটগল্পের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমি গর্ববোধ করি কি নাতাহলে উত্তর হচ্ছে- আমি অবশ্যই গর্ব বোধ করি

মোজাফ্ফর হোসেনঃ এখন দেখা যায় লেখকরাই সাধারণত সিরিয়াস সাহিত্য পড়ে থাকেন। আমাদের দেশের সাধারণ পাঠকরা বই পড়েন বিনোদনের জন্যে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেটার্গেট রিডার হিসেবে কাদেরকে সামনে রেখে আপনি গল্প লেখেন?

 

জাকির তালুকদারঃ শেষের অংশটির উত্তর আগে বলি। আমি কোনো টার্গেট রিডার সামনে রেখে গল্প লিখি না। গল্প লেখা হয়ে যাওয়ার পরে ঠিক করি গল্পটির পাঠক কারা হতে পারেন। তখন সেই ধরনের পত্রিকাতে ছাপতে দেই। সবসময় সেই পত্রিকা নির্বাচন যে সঠিক হয়এমন দাবিও অবশ্য করা যাবে না। আর টার্গেট রিডারের কথাই যদি ওঠেতাহলে বলব যে আমার ইচ্ছা পৃথিবীর পঁচিশ কোটি জীবিত বাঙালিই আমার লেখা পড়ক। আর প্রশ্নের প্রথম অংশে যে কথাটি বলা হয়েছেকেবলমাত্র লেখালেখির সাথে জড়িত ব্যক্তিরাই সিরিয়াস সাহিত্য পাঠ করে থাকেনতাদের বাইরে সিরিয়াস সাহিত্যের কোনো পাঠক নেই- এমন কথা বোধহয় সর্বাংশে সত্যি নয়। বাংলাদেশে অন্তত কয়েক হাজার সিরিয়াস পাঠক রয়েছেন। তবে বিনোদন-দানকারী লেখকদের সামনে এখন বড় দুঃসময়। কারণ বই পড়ার চাইতে বিনোদনের অন্য অনেক উপায় এখন আমাদের সমাজে সহজলভ্য। সেসব ছেড়ে বই পড়তে যায় না কেউ। বিনোদনলেখক এবং তাদের প্রকাশকদের বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণায় আদাজল খেয়ে লাগা দেখে এটি আরো ভালো বোঝা যায়

আমরা দেখতে পাচ্ছিবর্তমানে পুঁজিই নির্ধারণ করছে সবকিছু। তাইতো মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থের পিছনে ছুটছে। এখন এই যখন পরিস্থিতি তখন সাহিত্যচর্চা মানেই সময়ের উল্টো স্রোতে চলা। এই পথে না আছে অর্থনা আছে ফিল্ম স্টারদের মতো রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জনের সম্ভাবনা। এসব জানা সত্ত্বেও আপনি জাগতিক অনেক অর্জনকে উপেক্ষা করে লেখালেখি করছেন। যথেষ্ট শ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে লিখেছেন মুসলমানমঙ্গল’ ও পিতৃগণ’ এর মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস। এই যে এতো শ্রমএতো ত্যাগএতো সাধনা এসব কাদের জন্যে। অন্য ভাবে বলতে গেলেআপনি লেখেন কোনো?

আমি তো এই প্রশ্নটি উল্টো তোমাদেরই করতে চাই। আমি লিখিকারণ এ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর কথা ভাবি নি কখনো। কিন্তু তোমরা তো একেবারেই তরুণ। তোমাদের এখনো অন্য পথ বেছে নেবার সময় এবং সুযোগ রয়েছে। সেই তোমরা কয়েকজন কেন তারকাখ্যাতি বা অর্থের পেছনে না ছুটে এই কাজে মনপ্রাণ সঁপে দিতে চাও?

অন্যরা এটাকে কিভাবে নিয়েছে জানি নাতবে আমি আমারটা বলতে পারি। খুব সহজ করে বলতে গেলে আমি- গাইতে পারি নাআঁকতে পারি না তাই লেখার চেষ্টা করি। শিল্পের এই একটি শাখায় নিজেকে কিছুটা হলেও উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। আর কঠিন করে বলতে গেলে- জীবনকে আমি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাইজানতে চাইঅনুভবে আনতে চাইআর এর জন্যে সাহিত্যের কোনো বিকল্প আমার জানা নেই। থাকলে হয়ত লিখতাম না

 

মোজাফ্ফর হোসেনঃ এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি- বাংলাদেশের সাহিত্যে একটা নোংরা রাজনীতির উপস্থিতির কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আপনি এই রাজনীতি থেকে নিজেকে কতটা মুক্ত রাখতে পেরেছেন বলে মনে করেনআর আপনি কখনো এই নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছেন কিনা?

 

জাকির তালুকদারঃ যেদিন থেকে ঠিক করেছি যে লেখালেখিই হবে আমার জীবনের প্রধান কাজসেদিন থেকেই নোংরা রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে আমাকে। প্রত্যেককেই হতে হয়। যদি সে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে সম্মত না হয়। আমাদের সাহিত্যের প্রধান প্রতিষ্ঠানসমূহপ্রধান প্রধান মিডিয়া এবং প্রধান আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত ব্যবস্থাটিকে বজায় রাখার জন্য কাজ করে চলেন। যে লেখকরা এই ব্যবস্থাটিকে দার্শনিকভাবেবা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমেবা অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে চ্যালেঞ্জ করেনতাকে একযোগে কোণঠাসা করাটা হয়ে দাঁড়ায় এদের প্রধান কাজ। এই কাজটি করে এরা মূলত দুইভাবে। একটি হচ্ছে সেই কমিটেড ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লেখকের নামে কুৎসা রটানো। তার উৎকৃষ্ট রচনার নিকৃষ্ট সমালোচনা করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে নৈঃশব্দ দিয়ে সেই লেখককে বিস্মৃত রাখার চেষ্টা করা। আমি তাই যখনই এদের শিকার হইতখনই বুঝে নিই যে আমি ঠিক পথে আছি। তবে এদের সব ধরনের নোংরামির একটাই উত্তর আমার জানা আছে। তা হচ্ছে নিজের কাজের প্রতি আরো বেশি নিবেদিত হওয়া। আরো ভালো লেখা… আরো ভালো লেখা

মোজাফ্ফর হোসেনঃ লিখে আয় রোজগার করার বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

 

জাকির তালুকদারঃ খুব ভালো হয় যদি লেখালেখি থেকেই জীবনযাপনের ন্যূনতম ব্যয়টুকু অন্তত উঠে আসে। তাহলে আর অন্য কাজ করে সময় নষ্ট করতে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে সিরিয়াস সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমনটি এখনো সম্ভব নয়। বাঙালি জাতির গড় মনন এখনো এতটা উঁচুতে ওঠে নি যেএই জাতি তার শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল ব্যক্তিত্বদের দুধে-ভাতে রাখবে। বাঙালি উচ্চমূল্যের ভরণ-পোষণ দিয়ে যাবে প্রতারক রাজনীতিকদেরছ্যাঁচ্চোড় আমলাদেরজনবিচ্ছিন্ন সামরিক কর্তাদেরসিনেমা-নাটকের সুদর্শন গর্দভ এবং গর্দভীদেরখেলার মাঠের দশ দলের মধ্যে দশম স্থান অধিকার করা খেলোয়াড়দের। কিন্তু প্রকৃত লেখকদের জন্য কিছু করবে না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই লেখালেখি করতে আসা। লেখার জন্য যে অসম্মানজনক সম্মানী বরাদ্দ করা আছেতা অবশ্যই আদায় করে নিতে হবে। তবে টাকার জন্য লিখতে গেলে যে জিনিস লিখিয়ে নেওয়া হবেতা লেখা প্রকৃত লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়

মোজাফ্ফর হোসেনঃ লেখক হিসেবে এ পর্যন্ত আপনার জীবনের সেরা অর্জনটার কথা যদি জানতে চাই তাহলে কি বলবেন?

 

জাকির তালুকদারঃ নিরন্তর আত্মসমালোচনা করতে শেখা

মোজাফ্ফর হোসেনঃ হুমায়ুন আহমেদ-এর মতো জনপ্রিয় লেখকদের যেমন ভক্তের অভাব নেই আবার তেমনি নিন্দুকেরও অভাব নেই। আপনি কোন দলে?

জাকির তালুকদারঃ আমার পঠনতালিকায় তিনি বা তার মতো কেউ নেই। আমার কোনো কর্মকাণ্ডে তারা প্রাসঙ্গিক নন। আমি যাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করিপণ্ডিত-নিরক্ষর নির্বিশেষেসেইসব আলোচনায় তারা নেই। আমাদের আড্ডাতেও কখনোই তাদের নাম উচ্চারিত হয় না। মোটকথা আমার কোনো কিছুতেই তাদের কোনো ছায়াপাত নেই। আমার কাছে তারা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। সেক্ষেত্রে নিন্দুক বা ভক্ত কোনো দলেই আমার পড়ার কথা নয়

মোজাফ্ফর হোসেনঃ গল্পলেখার প্রথম দিকে বা আজ অব্দি বিশ্বসাহিত্যের কোন কোন গল্পকারকে গুরু হিসেবে মান্য করেছেন?

জাকির তালুকদারঃ গল্প লেখা শেখার তো কোনো বিদ্যালয় নেই। তবে পাঠ্যপুস্তক রয়েছে অসংখ্য। আমার পূর্বজ সকল বাঙালি লেখকের গল্পই আমার কাছে পাঠ্যপুস্তক। আর বিশ্বসাহিত্য বলতে তো যৎসামান্য জানা ইংরেজির জানালা দিয়ে দেখা এবং অনুবাদ-নির্ভর বিশ্ব। শুরুর দিকে পড়ার সময় তেমন বাছবিচার করার সুযোগ ছিল না। যোগ্যতাও ছিল না। যা কিছু সংগ্রহ করতে পেরেছিপড়েছি। এখন কিছুটা বাছাই করতে শিখেছি বোধহয়। যাদের লেখা বার বার পড়িতাদেরকেই যদি গুরু হিসাবে ধরা হয় তাহলেও গুরুর সংখ্যা হবে অনেক। আমাদের বাংলাভাষায় স্বর্ণকুমারী দেবীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়সতীনাথ ভাদুড়ীসুবোধ ঘোষজগদীশ গুপ্তসৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসৈয়দ শামসুল হকআলাউদ্দীন আল আজাদশওকত আলীআবুবকর সিদ্দিকহাসান আজিজুল হকজ্যোতিপ্রকাশ দত্তআখতারুজ্জামান ইলিয়াসঅসীম রায়মহাশ্বেতা দেবীসন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের নাম তো অবশ্যই আসবে। সেই সঙ্গে আলাদা করে বলতে হবে অমিয়ভূষণ মজুমদারের নাম। কমলকুমার মজুমদার থেকেদুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যকিছু শিখতে পেরেছি বলে মনে হয় না। অন্য ভাষার লেখকদের মধ্যে রয়েছেন গোগলতলস্তয়চেখভইভান বুনিনমাক্সিম গোর্কিঅ্যালান পোআর্নেস্ট হেমিংওয়েফ্রানজ কাফকাআলবেয়ার কামুবোর্হে লুইস বোর্হেসগার্সিয়া মার্কেজমুনসী প্রেমচন্দসাদত হাসান মান্টোচেঙ্গিজ আইতমাতভ। বইয়ের র্যাকের কাছে গেলে আরো অনেকের নামই মনে পড়বে

মোজাফ্ফর হোসেনঃ আপনার পড়া কিছু প্রিয় বইয়ের নাম জানতে চাচ্ছিলাম?

 

জাকির তালুকদারঃ নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব’, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘রামায়ন’, ‘মহাভারত’,হোমারের রচনাসমগ্রআরব্য উপন্যাসরবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ’, সুকুমার রায়ের আবোল-তাবোল’, তলস্তয়ের পুনরুত্থান’, দস্তয়ভস্কির অপরাধ ও শাস্তি’, ‘অভাজন’, ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’, চেখভের সবগুলি গল্পগোগলের ওভারকোট’, কালিদাসের মেঘদূত’, মার্কেজের শতবর্ষের নির্জনতা’, বরিস পাস্তেরনাকের ডাক্তার জিভাগো’, আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার’, কাফকার রচনাসমগ্রহজরত আলীর নাহাজুল বালাঘ’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড় শ্রীখণ্ড’ এবং নির্বাচিত গল্প’, বিনয় সরকারের বৈঠকে’, প্লেটোর সিম্পোজিয়াম’, হাওয়ার্ড ফাস্টের সাইলাস টিম্বারম্যান’, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী’, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই’, সৈয়দ শামসুল হকের পরানের গহীন ভিতর’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যা’, হাসান আজিজুল হকের সক্রেটিস’, মাক্সিম গোর্কির আত্মজৈবনিক ট্রিলজিশঙ্খ ঘোষের জার্নাল’, হেমিংওয়ের ওল্ডম্যান এন্ড দি সি’, জেমস জয়েসের পোর্ট্রেট অফ অ্যান আর্টিস্ট অ্যাজ ইয়ং ম্যান’, মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কমলাকান্তের দপ্তর’, সৈয়দ মুজতবা আলীর টুনি মেম’, কার্ল মার্কস-এর ক্যাপিটাল’… এই রকম আরো শত নাম বলা যাবে

মোজাফ্ফর হোসেনঃ একজন লেখকের রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য থাকা কতখানি জরুরী বলে আপনি মনে করেন?

 

জাকির তালুকদারঃ রাজনৈতিক আদর্শ এবং উদ্দেশ্য না থাকলে কোনো মানুষকে কি সচেতন মানুষ বলা যায়একজন লেখককে হতে হয় সমাজের সবচেয়ে সচেতন মানুষের একজন। সচেতন এবং সংবেদনশীল। তার রাজনৈতিক সচেতনা না থাকলে কীভাবে তাকে আমরা লেখক বলে গণ্য করতে পারি। এর অর্থ এই নয় যে লেখককে অবশ্যই কোনো না কোনো দলে যোগ দিতে হবে। বরং উল্টোটাও অনেক সময়েই রাজনৈতিক সচেতনা এবং সততার পরিচয় হতে পারে। যেমন বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে এমন কোনো দল নেই যেখানে যোগ দিলে কোনো সৎ মানুষ আত্মগ্লানিতে না ভুগে দিন কাটাতে পারবেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি লেখকের দৈনন্দিন বিশ্লেষণের একটি অংশ। কোনো সৎ লেখক কখনো মন্দের ভালোতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। তিনি সবচেয়ে ভালোটার জন্যই অপেক্ষা করবেন। একই সঙ্গে মানুষকে জানাবেন সেকথাযতখানি তার সাধ্যে কুলায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লেখকের কাজ অনেকটা গুপ্ত স্যাবোটাজ’ করা। ভলতেয়ার যেমনটি করেছেন। রুশো করেছেন। ইভান তুর্গেনেভ এবং তলস্তয় করেছেন। পত্রিকায় কলামলেখকরা যেভাবে রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেনবা টেলিভিশনের টক শো-তে যে স্থূলভাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকেলেখকের কাছে সেগুলি অরুচিকর এবং জলো মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এইসব কাণ্ড দেশের মানুষের চোখ খুলে দেওয়ার বদলে বরং বিভ্রান্ত করতেই বেশি ভূমিকা পালন করে। লেখক যিনিপ্রকৃত লেখকতার রাজনীতিও হবে মানুষের কাছে গভীরতর সত্যের উন্মোচন ঘটানো। লক্ষ লক্ষ সম্পাদকীয় স্তম্ভ যা করতে পারে নাএকটি হ্যামলেট’ বা একটি ডাক্তার জিভাগো’ বা একটি সাইলাস টিম্বারম্যান’ তা করতে পারে। আমাদের বেশিরভাগ লেখকের সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিষ্কার। এই জন্য তাদের বেশিরভাগ রচনাই ক্লিশে

 

Post a Comment

0 Comments