আমার জন্মশহর সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়াতে। পড়াশোনার সুবাধে বগুড়াতে বেশ সময় কেটেছে, তারপর এখন ঢাকাতে কাটছে। রমজান মাস মানে বুঝি সেই ছোটবেলা। ছোটবেলার পবিত্র রমজান মাসের স্মৃতিগুলো এখনো চোখের সামনে জলছবি হয়ে ভাসে। কোন চিত্রশিল্পী হয়ে রংতুলিতে স্মৃতিগুলো মনের ক্যানভাসে আঁকতে ভীষণ ইচ্ছে করে। তখন কনকনে শীতের মাঝে রোজা হতো । চারিদিক কুঁয়াশা। লেপের মাঝে নিজেকে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমাতাম। ঘুমানোর আগে মাকে বলতাম, 'মা আমাকে সেহরীর সময় ডাক দিয়ো'।
মা বলতো, 'এখন ঘুমিয়ে পর। ডাক দিবো।'
মা ঠিকই ডাক দিতো। আমি শুনেও প্রতিউত্তর দিতাম না। মা হয়তো ভাবতো, ছোট মানুষ। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
সকালে উঠে কান্না করে বলতাম,' মা আমাকে ডাক দিলে না কেনো। আমি কিছু খাবো না।'
মা বলতো, 'তোকে ডাকছি। তুই উঠিসনি।'
আমি বলতাম, 'না তুমি ডাকোনি' বলেই কান্না করতাম।
সেদিন যদি শুক্রবার থাকতো তাহলে কান্নার সময়টা বেড়ে যেতো। অনেকদিন আবার উঠতাম। দেখতাম মা চাদর গায়ে জড়িয়ে রান্না করছে। আমি মার পাশে গিয়ে বসতাম। চুলায় লাকরি দিতাম। আগুনও পোহাতাম।
মা বলতো, 'একটু দূরে গিয়ে বস। শরীর পুড়ে যাবে।'
একটি টুল নিয়ে চুলা থেকে একটু দুরে যেতাম। সে সময়টা সেহরী খেয়ে ফজর নামাজ পড়তে যেতাম। কতকদিন বাড়িতে নামাজ পড়েই ঘুমাতাম।
খুব ছোট সময় দিন দুই রোজা থেকেছি। মা বলতেন ছোটদের দিনে দুই রোজা। সকাল থেকে দুপর–আবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা। ছোটবেলায় যখন রোজা রাখতে পারতাম না। সেদিন দুপুরের আজানে ইফতার করতাম। নামায পড়তাম মসজিদে গিয়ে জামাতের সহিত। যখন বোঝতে শিখেছি তারপরে মনে হয় রোজা কখনো ভঙ্গ করিনি।
রমজান মাসে বিকেল বেলার দৃশ্যটা অসাধারন। আমাদের বাড়ি বিশ্বরোডের পাশেই। গ্রামটিতে বাসস্ট্যান্ড আছে। ভালোই বাজার লাগে। হরেক রকমের ইফতারি বসে। বাবার সাথে ইফতারি কিনতে যেতাম। বিকেল হলে বাবা নিয়ে যেতেন সেখানে। কখনো কখনো মেসওয়াক খোঁজতে বের হতাম। বিশ্বরোডের পাশে সারি সারি গাছ। শিশুগাছ, কড়ি গাছ। আমি হাতের নাগালে পেতাম না। বাবা ডাল ভেঙ্গে মেসওয়াক করাতেন। কতদিন শিশু গাছের ডাল কেটে মেসওয়াক বানাতাম। গ্রামে একটি নদী আছে। নদীটির নাম মুক্তাহার। নদীর পাশে একটি রাস্তা আছে। সেখানে বাবলা গাছ ছিলো। বাবাকে নিয়ে সেখান থেকে মেসওয়াক নিতাম। পাশেই নানাবাড়ি নিমগাছ ছিলো। সেখান থেকে নিমের ডাল দিয়ে মেসওয়াক বানাতাম। আটাশলী নামে একটা গাছ ছিলো। সেটার মেসওয়াক নাকি অনেক ভালো। বাড়ির পাশে নামদার ভাইয়ের ঝোপ-জঙ্গল ছিলো। সেখান থেকে আটাশলীর মেসওয়াক সংগ্রহ করতাম।
বিকাল বেলা সবাই টুপি পড়ে মেসওয়াক ব্যবহার করতাম। কতইনা আনন্দ হতো। ইফতারের পূর্ব প্রস্ততিতে আমারা নিজেদেরকে তৈরী করতাম। মা রান্না করতো। মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতাম। চুলার উপর বসে থেকে মা বলতো, তেলের বোতলটা মাচার উপর আছে নিয়ে আয়। দৌঁড়ে আনতাম। আবার কখনো বলতো পেয়াজ আন। কোনদিন বলতো। মরিচ আন। এভাবেই মার পাশে পাশে থাকতাম। বিকাল বেলা বাবা ছোলা, বুন্দিয়া, খেঁজুর নিয়ে বসতো। শরবত তৈরী করতো। সবকিছু তৈরি করে অপেক্ষায় থাকতাম ইফতারের ঘন্টা শুনতে। মসজিদ থেকে একটি আওয়াজ আসতো।
কতদিন বিদ্যুৎ থাকতো না। মা পাঠাতো নানা বাড়ি। নানাবাড়ি ছিলো পাশাপাশি। নানারা ইফতার করছে কিনা দেখতে যেতাম। আরও ফুপু বাড়ি যেতাম। খালাবাড়ি যেতাম। তারা ইফতার করলে দৌঁড়ে ছুটে আসতাম। মাকে বলতাম, মা ইফতার করেছে।
মা ইফতার করতো। আমরা ইফতার করতাম। বাবা ব্যবসার জন্য কোনো কোনো দিন বাড়ীতে আসতে পারতেন না। বিকেল বেলা তার জন্য ইফতার দিয়ে আসতাম। পরে মার সাথে ইফতার করেই চলে যেতাম মসজিদে। নামায পড়ে বাড়ি আসতাম। তারপর ভাত খেয়ে তারাবি সালাতের প্রস্ততি নিতাম। বাবার হাত ধরেই তারাবি নামাজ পড়তে চলে যেতাম। তারাবি দু'ধরনের হতো। সুরা তারাবী আরেকটি ছিলো খতম তারাবী। তখন সুরা তারাবি ছিলো। পরে খতম তারাবি চালু হয়। তারাবি নামায পড়ার সময় একসাথে কয়েক বন্ধুরা থাকলেই খিল খিল করে হাসতাম। শব্দ করে হাসতাম। নামায শেষে বড়রা ধমকিয়ে একেক জনকে আলাদা করে দিতো। পরে আর হাসি হতো না।
আহারে দিনগুলো। কত সুন্দর কাটতো। দিনগুলো খুব মনে পড়ে। পবিত্র রমজান মাসে আমার মমতাময়ী মা না ফেরার পথে চলে গেছেন। ২৮ রমজান মা চলে যায়। আর মাকে পাবো না। রোজার মাস ঠিকই পাই। কিন্তু মাকে পাই না। রহমত, বরকত, নাজাতের মাস প্রিয় মাহে রমজান। এই রমজান মাসেই আমার সন্তান জন্মগ্রহন করে। তার বয়স প্রায় চার বছর। তার সাথে এখন নতুন নতুন খুনসুটি কাটে। সে এখন বিকেল হলে ইফতার কেনার জন্য বায়না ধরে। তাকে নিয়ে বিকেল বেলা ইফতার কিনতে বের হই। তবে আগে সময় কাটতো গ্রামে। এখনতো শহরে।
শহরের রমজান মাস আমার কাছে উৎসব মুখর বেশি। অলিতে গলিতে বাড়তি দোকান। নামাজের জন্য মসজিদে ভীড়। আমার সন্তান এখন নামাজ পড়তে যাবার জন্য বায়না ধরে। সে এখন আমার সঙ্গে মসজিদে যাচ্ছে। আমার স্মৃতির ক্যানভাস দেখতে পাই, আমার সন্তানের ভেতর। আমি যেভাবে চলেছি সেই সময়ে, সেভাবেই চলছে সে। বিকেল বেলা তার মায়ের সাথে ছোট খাটো কাজ করে বেড়াচ্ছে। জীবন আমার কাছে মোহনার মৎ। সময়ের রানওয়েতে জীবন চলে তার গতিতে। সময়ের পালাবদলে মানুষের যায়গা বদল হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বদল হয়। তবে থেকে যায় সেই স্মৃতি। হৃদয়ের টান, অমলিন ভালোবাসা।
এই লেখকের আরও লেখা–
0 Comments