অসমাপ্ত প্রেমের কবিতা
সুদূর এথেন্স, খাজুরাহো আর হৃদয়পুরের বাঁকে--
অজন্তা থেকে ইলোরার পথে পথে খুঁজে ফিরি প্রেম!
অনন্তিকা হে ! কতটুকু কাছে এলে ভালোবাসা হয়
বলো ! আর কতদূর হেঁটে গেলে আরশি নগর পাবো !
নদীর জন্য সাগরের মতো নিজেকে উজাড় করে
দিয়েছি তোমাকে, হাতে হাত রেখে বুকের কোঠরে বুক,
চোখে চোখ রেখে চোখের ভেতরে গড়েছি চক্ষুকাল !
ঠোঁটের গভীরে বুনেছি অযুত ফুলের শস্য খেত,
ঝিনুকের দেহে মুক্তোর মতো জাপটে নিয়েছি সব,
মেঘের কান্না বৃষ্টির মতো অঝোরে ঝরেছি আমি;
তবুও বুঝি নি হৃদয় ছুঁয়েছে কখন বেদনা-বন।
বেহুলা জীবন অবোধ্য স্রোতে ভেসে যায়, ভেঙে যায়।
বলো, কতটুকু কাছে এলে প্রেম আসে-ভালোবাসা হয়!
জীবন জমিন জুড়ে দুপুরের তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ;
চুরি হয়ে যায় বসন্তগুলো। কুহক কাব্যকাল।
ফুলহীন ফাগুনের দিন, দুঃসহ কালোরাত।
কষ্টকলমে তোমাকে পাবার জন্য কবিতা লিখি।
তুমিই ভেনাস, ট্রয়ের পোড়ানো প্রত্নচিহ্ন নিয়ে
বুকের ভেতরে গড়েছ প্রেমের ঘর! তবুও তো আমি
হোমারের মতো অন্ধ দুচোখে তোমাকেই খুঁজে ফিরি !
প্রেমহীন
যে শহরে আমার প্রেমিক নেই
সে শহর কখনো আমার নয়
সে শহর শুধু ঘৃণার শহর
যে শহরে প্রেমিক হারিয়ে যায়
সে শহরে কী করে জীবন বাঁচে!
তোমাদের চকচক শহরের
বুকে জমে আছে ক্লেদ, ঘৃণা
খকখক করে নিয়ত কাশছে
উপছে পড়ছে রক্ত-বমি-কফ
এ শহর প্রেমহীন দুরারোগ্য।
এখানে আমার প্রেমিক থাকে না
তাই ক্ষুব্ধ হয়ে আছে রাজপথ
পথে পথে হরতাল–অবরোধ
শুধু মৃত্যু-জ্যাম–ভুল সিগন্যাল
ভীষণ দূষণ ভোরের বাতাসে।
কোথায় আমার প্রেমিক? কোথায়
লুকিয়ে রেখেছো, হে ভাঙন বলো!
মিথ্যা, তুমি বলো! দুঃসময়, বলো !
ফিরিয়ে দাও প্রেমিক! প্রেমফুলে
শহরকে সাজাবো মৃত্যুর আগে।।
অসমাপ্ত নকশীকাঁথা
নিয়তির নীল-লাল সুতো দিয়ে
এফোঁড় ওফোঁড় করেছ জীবন
আঙুলে সূচ ফুটিয়ে রক্ত ঝরিয়েছ
ফোঁটা ফোঁটা রক্ত থেকে কখন ফুটেছে
রক্তজবা, বুঝতে পারিনি
বেদনার বুটি দিয়ে আলপনা আঁকা
নকশীকাঁথার জমিনে ফুটে থাকা সেই রক্তজবা
বিষাদ বৈশাখ হয়ে আজ আমাকে কাঁদায়
তোমার রেখে যাওয়া সেই সে অসমাপ্ত নকশীকাঁথা
জীবনের রঙিন সুতোয় বারবার রিপু করি
কত যে বৈশাখ আসে, ঘরে ঘরে হালখাতা
পার হয়ে যায় পৌষের সকাল, পিঠাপুলির উৎসব
পথে পথে ছড়ানো বেদনাচূর্ণ, হাঁটতে হাঁটতে
বিরাণ বুকে জড়িয়ে নিই সে দুঃখকাল
কান্নায় জড়ানো ভালোবাসার সুতোয় বোনা
সেই নকশীকাঁথায় একটি ফুলও আঁকতে পারিনি আর
তোমার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত সে নকশীকাঁথা
মেলায় হারানো পাতার বাঁশি হয়ে কাঁদে
সূর্যদীঘি ছুঁয়ে জেগে ওঠা সে যেন আমার
রৌদ্রভেজা বিষণ্ন বাংলাদেশ!
পৃথিবী জোড়া প্রেমের কবিতা
প্রেম থেকে বিগলিত ঘৃণা
লেপ্টে থাকে পৃথিবীর চোখে
তোমরা যাকে ভালোবাসার কাজল বলো
প্রেমহীন পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে ভেনাসের বুকে
প্রেমের পাখিরা পথ ভুলে চলে গেছে বরফের দেশে
আমি মিছে শুধু হারানো পালক খুঁজে ফিরি
প্রেমের বেদিতে জীবনকে খুন করে
খুনের আগুনে পুড়ে নিখাদ প্রেমিক হয়ে ওঠে
প্রতিটি মানুষ, আর–
প্রেমকে টুকরো টুকরো করে একটি মায়াবী ছুরি
জীবনটাই একসময় হয়ে যায় দ্বিখণ্ডিত রুটি
যাকে তোমরা নিয়তি বলো
একবার এক মৎস্যকন্যার প্রেমে পড়েছিলাম
আমাকে শিখিয়েছিল সমুদ্রের সাথে জলক্রীড়া
সেই থেকে আমি মীনজাতক, অথচ জলাতঙ্কে ভুগি
পৃথিবীতে আমার কোনো প্রেমিক নেই
আমার দুহাতে অসহ্য পাথর ঝুলিয়ে দিয়েছে নার্সিসাস
আমি শত চেষ্টা করেও তোমাকে ছুঁতে পারছি না
তবুও বুকের পকেটে লুকিয়ে রেখেছি সোনার আপেল
তোমার সঙ্গমে আমার মরণ
আমি যখন তোমার ঠোঁটে চুমু দিই, আলিঙ্গন করি
তখন বৃষ্টির মতোই বিলীন হয়ে যাই মাটির শরীরে
আমার চারপাশে সহস্র সুন্দর
সোনার আপেল আমি কার হাতে তুলে দেব...
বনফুল প্রেম
তুমি যখন ছাদ বাগানে হ্যাভেন রোজের সাথে
আমি তখন বনফুলের সঙ্গীবিহীন রাতে
অনাদরে ফুটে থাকি অশেষ জোছনাতে
চাঁদের মেয়ে বুকের ভেতর পদ্য হয়ে মাতে
রাতের পাখি ফুলের মালা জড়িয়ে দেয় হাতে।
তুমি যদি নাই বা আসো কি এসে যায় তাতে!
মাটির সোঁদা গন্ধ ভুলে বাঁচে কি আর দেশ!
তোমার ছাদে কিইবা আছে সবুজ শোভার লেশ
আমার আছে ধুলোয় মাখা বৃষ্টি অনিঃশেষ
আনন্দ আর আলোয় বাঁচি চির অনিমেষ
তুমি এখন কফির কাপে ধুসর স্মৃতির রেশ
তোমায় ভুলে এইতো আমি ভালোই আছি বেশ!
একজন মিস্ট্রেস ও একটি ঘড়ি
বহুদিন ঘড়ি পরা হয় না আমার। কেননা একজন আমার নিত্যদিনের ঘড়ি হয়ে ওঠে। জানালা দিয়ে তাকে দেখি প্রতিদিন বের হতে । হাতে মেরুন রঙের ভেনেটি ব্যাগ, নীল শাড়ি পরে মাথায় প্রিন্টের ছাতা, কখন সে বের হয়, অদৃশ্য ঘড়ি আমাকে তা বলে দেয়। বুঝতে পারি, আমার অফিসে যাবার সময় হয়েছে। আমি প্রস্তুত থাকি। বের হই, তার পিছে পিছে হাঁটি। কোনোদিন সে হয়ত তা দেখে কিনা, আমি জানি না। কিছুদূর হাঁটতেই দুজনের পথ দুটি দিকে চলে যায়। আমার তাড়া থাকে অফিসের। কোনো দিন ভুল হয় না, দেরি হয় না পৌঁছতে আমার। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক সে যেন আমার অফিসের হাজিরা খাতা হয়ে ওঠে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে আমাদের কলেজের হিস্ট্রির মিস্টেস। কিন্তু মিস্ট্রেস প্রতিদিন নীল শাড়ি পরে কেন! তার কি একটাই শাড়ি, নাকি তার সব শাড়ি নীল রঙের! কোনোদিন তা জানা হয়নি আমার।
কখন সে ফিরে আসে, আমি জানি না। আমি অনেক রাত করে বাড়ি ফিরি। বাড়িতে ঢোকার আগে দেখি রাস্তার ওদিকটায় সেই বাড়িটি নিঝুম। শুধু একটি জানালা খোলা থাকে। ভেতরে নীল আলো। নিশ্চয়ই ওটা তার ঘর! জানি না, তখনও সে জেগে থাকে কিনা! নাকি, আমার ফেরার প্রতীক্ষা করে থাকে!
এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ দিন। একদিন তাকে আর বের হতে দেখি না। জানলা দিয়ে তাকিয়েই থাকি। কিন্তু আমার প্রতীক্ষা ফুরোয় না। তার অসুখ করেছে কিনা আমি জানি না, অথবা কোনো অঘটন! জানা হয় না, আমি বেরিয়ে পড়ি। সেদিন অফিসে পৌঁছাতে আমার দেরি হয়ে যায়। সে আমার জন্য বড় লজ্জার। অফিসের বস জিজ্ঞেস করেন–এখন কটা বাজে? আমি বলি, আমার ঘড়িটি হারিয়ে গেছে। রাতে ফিরে এসে তোরঙ্গে তুলে রাখা ঘড়িটি খুঁজে পাই। দেখি, আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমার ঘড়িটি জং ধরে গেছে।
পরদিন ছিল শুক্রবার। ছুটির দিনের প্রতিটি সকালের মতো আজও নিশ্চয়ই তাকে ছাদে দেখা যাবে! কিন্তু জানালা খুলতেই দেখি ছাদটি ফাঁকা। অতঃপর–ঘর থেকে বের হই। ওই বাড়িটির দিকে যাই। কী আশ্চর্য, আমি যতবার বাড়িটির দিকে এগোতে থাকি, ততবার বাড়িটি পিছিয়ে যায়। আমার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আমি আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকি। সামনে কুমারিকা নদী। নদীর কাছে এসে হাঁটতে থাকা বাড়িটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে নদীর ভেতর।
ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত আমি বহু কষ্টে বিড়িতে ফিরি। তারপর ঘরে ঢুকে দেখি আমার টেবিলে পড়ে আছে মার্বেল পেপারে মোড়ানো একটি সুদৃশ্য প্যাকেট। প্যাকেটটি খুলতেই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে চকচকে রোল গোল্ডের একটি ঘড়ি।
একটি দীর্ঘ প্রেমের কবিতার খসড়া
তুমি আমার দিগন্ত-দীঘল কবিতা হয়ে আছো তাই
তোমাকে নিয়ে দীর্ঘ প্রেমের কবিতা লেখা হলো না
না পাওয়া থেকেই তো কবিতার জন্ম
দুঃখগুলো সাঁতার কাটতে কাটতে সমুদ্রে পৌঁছে যায়
শব্দগুলো উড়তে উড়তে পাখি হয়ে যায়
তোমাকে পেয়েছি তাই আমার পথ ফুরিয়ে আসে
কবিতাগুলো ক্রমশ ছোট হতে হতে বিন্দুতে মিলায়
সাদা-কালো দিন ছাড়া আমার রঙিন আকাশ থাকে না
তোমাকে নিয়ে হাইকু ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না
এত ভালোবাসা-প্রেম, এত তৃষ্ণা-মোহ
শরীরে শরীরে শান্তির সমাধি হয়ে ঘুমিয়ে থাকে
একটি দীর্ঘ প্রেমের কবিতা লেখার কথা ছিল
আমি কিছুতেই লিখতে পারি না আর
এই লিখতে না পারার বেদনা নিয়ে শোকাহত আমি
কালো ব্যাজ পরে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।
উপহার
উপহার যত ছোট্ট হোক তা অনেক দামি
এ কথাটি তোমাকে বুঝাতে বুঝাতে
একটি জীবন পার করে দিয়েছি তো
তুমি কি জানো–
কখনো কখনো একটি সেপটিপিন
একটি দেশলাই, এমনকি একটি টুথপিক
জীবনের জন্য কত জরুরি?
তুমি আকাশ নেবে, নাও
পাহাড় নেবে, সমুদ্র, তাও নিতে পার
এসব কিনতে পয়সা লাগে না
জীবন তো একটি সোনার কৌটা
যে কৌটায় ভরা থাকে ভালোবাসা নামের হীরা
দুঃখ নামের অমূল্য কিছু জহরত
প্রেমের পয়সা দিয়ে যা কিনে নিতে হয়
সম্পূর্ণ একটি জীবনই তোমাকে দিয়েছি
আর কি নেবে বলো!
প্রেমের প্রসন্ন কবিতা
তুমি জিজ্ঞেস করলে
কাজল পরলে তোমাকে কেমন মানাবে
আমি কোনো উত্তর দিইনি
কেননা কাজলবিহীন তোমার দুটি চোখ
সে তো গভীর সমুদ্র–
যেখানে প্রতিদিন ডুবে মরি আমি
তুমি জিজ্ঞেস করলে
কোন টিপ পরবে তুমি, লাল নাকি কালো
আমার উত্তর না পেয়ে হয়ত ভেবেছ
আমি টিপ পরা মেয়েদের পছন্দ করি না
না গো, তা কখনো নয়
আমি তোমার চন্দ্রদীপ মুখের দিকে
তাকিয়ে থেকে শুধু ভেবেছি
টিপের কি দরকার
তুমি তো পৃথিবীর মতো একটি উজ্জ্বল টিপ হয়ে
আমার বুকের দেয়ালে সেঁটে আছো
তুমি জিজ্ঞেস করলে
তুমি শাড়ি পরবে নাকি সালোয়ার কামিজ
আমি নিরুত্তর থেকেছি
কী বলবো বলো
শাড়ী পরলে তুমি বিনোদিনী
আর সালোয়ার কামিজ পরলে তুমি রাজকন্যা
আমার যে দুটিই চাই
এ কথা বলতে চেয়েও বলতে পারিনি
কোনো প্রয়োজন নেই সুন্দরকে ঢেকে রাখার
বরং তুমি নগ্ন হও আরও নগ্ন হও–
শুধু আমার জন্য
তুমি জিজ্ঞেস করলে
কোন কালারের লিপস্টিক পরবে
গোলাপী, লাল, নাকি খয়েরী
আমি কিছুই বলতে পারিনি
তুমি কি জান না
ঠোঁটে রঙ লাগানো আমার একটুও পছন্দ নয়
কেননা লিপস্টিক দিয়ে যদি ঢেকে রাখো ঠোঁট
আমি কী করে সেখানে রাখবো আমার অমল চুম্বন
আমি মুহূর্তে মুহূর্তে তোমার ঠোঁট
লক্ষ কোটি চুমুতে ভরে দিতে চাই
বরং একটুখানি আলতা দিও পায়ে
তুমি যদি আলতা পরো
তোমার গোলাপরঙা পায়েও আমি চুমু দিতে পারি
এতটা চুপ করে থাকি তোমার কাছে
ভেবো না আমি বোবা হয়ে গেছি
একবার ছুঁয়ে দেখো
কত কথা, হাজার প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে যাবে
শিহরণ শিহরণে।
ও বন্ধু আমার
দুয়ার বন্ধ রাখো তুমি
তবু ঢুকে পড়ি তোমার ঘরে
লুটিয়ে পড়ি বিছানায়
তুমি জানো না, জানো না বন্ধু
কী সে আজব প্রেমের যাদু!
কতদূরে আমরা এখন
তবু কত কাছে আছো তুমি
জড়িয়ে নিই বুকের বৃক্ষে
হৃদয়ের এই দীর্ঘ লতায় পাতায়
কেমন করে, জানো কি তা ?
যখন তুমি একলা ঘরে
আয়নায় দেখো নিজের মুখচ্ছবি
পারদ জুড়ে আয়নায় থাকি
লেপ্টে থাকি তোমার চোখে-মুখে
তুমি কি তা বুঝতে পারো!
লোহার সিন্দুক গোপন ঘরে
লুকিয়ে থাকো যেখানে তুমি
সুতোশঙ্খ শাপের মতো
অদৃশ্য এক পাখির মতো আমি
সেখানটাতে পৌঁছে যে যাই!
হাওয়ায় হাওয়ায় মিশে থাকি
তোমার নিবিড় নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসে
গাঢ় ঘুম আর জাগর স্বপ্নে
জেগে থাকি দেহের দেহলিতে
কেমন করে মুখ ফেরাবে !
এই লেখকের আরও লেখা...
2 Comments
অসাধারণ! বার বার পড়তে ইচ্ছে করছে! কবির জন্য শ্রদ্ধা অতল...
ReplyDeleteকী চমৎকার প্রতিটি কবিতা !
ReplyDeleteঅনবদ্য।