জর্জিয়ার আকাশে ১৮৯৩ সালে ফুটেছিলো এক নক্ষত্র—ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মায়াকোভস্কি । যে নক্ষত্র আজও একইভাবে দেখিয়ে যাচ্ছে পথ—শিল্প-সাহিত্যের, শ্রেণিহীন বিপ্লবের। ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির জন্ম ১৯ শে জুলাই ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ সোভিয়েত রাশিয়ার দক্ষিণ জর্জিয়ার বাগদাদিতে। অল্প বয়সে পিতাকে হারিয়ে মা এবং বোনদের সাথে মস্কোতে বসবাস শুরু করেন। এ সময়েই তাঁর ভেতরে রোপিত হয় বিপ্লবী চেতনার বীজ। পরবর্তীতে যার প্রভাব দেখা যায় জীবন এবং কর্মে। সাইত্রিশ বছরের জীবনে তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী, কবি, নাট্যকার ও অভিনেতা।
ভ্লাদিমিরকে বলা হয় অক্টোবর বিপ্লবের কন্ঠস্বর। কিশোর বয়সেই তিনি নানান সমাজতান্ত্রিক বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতেন। পিতার মৃত্যুর পর স্ব-পরিবারে মস্কোতে চলে আসেন। মূলত মস্কোতেই মায়াকোভস্কির রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। মস্কো আসার পর মার্ক্সবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন। বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর। ১৯০৭ সালে জিমনেশিয়াম স্কুলে সোশাল ডেমোক্রেটদের গোপন পাঠচক্রের সদস্য হন। পারিবারিক অভাব অনটনের কারনে কিছুদিন পরেই জিমনেশিয়াম স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯০৯ সালে সমাজতান্ত্রিক নানান বিক্ষোভে অংশ নিতেন। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন। এ সময় তিনি আরও একটি কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন—জেল থেকে নারী বন্দীদের লুকিয়ে বের করে আনতেন। যা ছিল আইন পরিপন্থি। বয়স কম থাকায় কারাভোগের মেয়াদ কিছুটা কমে যায়। ১৯১০ সালে কারামুক্ত হন। ১৯২০ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে জেলে থাকা সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তাঁর বিপ্লব এবং কবিতা ছিলো আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে। এই আন্দোলনের মুখপত্রের নাম ছিলো “A slap in the face of public test” বা জনরুচির মুখে থাপ্পড়। এখানেই সর্বপ্রথম কবির ‘রাত্রি’ এবং ‘ভোর’ কবিতা দুটি প্রকাশিত হয়।
রুশ তরুণী তাতিয়ানার সাথে প্যারিসে দেখা হয় ১৯২৮ সালে । তিনি ছিলেন একজন মডেল কন্যা। মায়াকোভস্কি মাতাল হয়ে উঠেন তাতিয়ানার প্রেমে। বহু অনুরোধ করেন তাতিয়ানাকে রাশিয়া ফিরে আসার জন্য। কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন তাতিয়ানা।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে । ১৯১৪ সালে ফিউচারিষ্টগণ রাশিয়ার বিভিন্ন শহর ভ্রমন করেন। তাঁদের চলাফেরা এবং বেশভূষা ছিলো অদ্ভুত রকমের। মায়াকোভস্কি নিজ হাতে তৈরি একটি হলুদ শেমিজ পরে ঘুরে বেড়াতেন। যা হোক, ভ্রমন শেষে মস্কো ফিরে দেখেন স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন তাঁরা। কিছুদিন পরেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মায়াকোভস্কির অবস্থান যুদ্ধের বিপরীতে। তিনি এ সময়ে তাঁর রচিত ‘মা এবং জার্মানদের হাতে নিহত একটি ‘সন্ধ্যা’, ‘যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে কি’, এবং ‘আমি এবং নেপোলিয়ান’ – কবিতাগুলো ‘লুবক’ ও ‘নভ’ নামক জার্নালে প্রকাশিত হতে থাকে। অন্যদিকে ‘ট্রাউজার পরিহিত মেঘ’, ‘যুদ্ধ এবং পৃথিবী’, ‘মানব’, ‘শিড়দাঁড়া বাঁশি’ এবং ‘ঘড়ির কাটা একটা পেরিয়ে’, কবির উল্লেখযোগ্য কিছু বিখ্যাত কবিতা। ১৯১৬ সালে ম্যাক্সিম গোর্কীর সহায়তায় বের হয় মায়াকোভস্কির কবিতা সংকলন। ১৯১৮ সালে নেপচুন স্টুডিও থেকে নির্মিত হয় মায়াকোভস্কি অভিনীত তিনটি নির্বাক চলচ্চিত্র। যেগুলোর চিত্রনাট্য কবির লেখা। ১৯২২ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত কবি ঘুরে বেড়ান ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কিউবা। এই কয়েক বছর তিনি ছিলেন “Let Art Front“ এর সদস্য। যারা বিশ্বাস করতো ‘ঘটনার সাহিত্য শিল্পের নয়’। ১৯২৭ সালে তাঁদের প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়। ১৯২৮ সালে কবি নিজেই অভিমান করে সরে যান পত্রিকাটির দায়িত্ব থেকে। ত্যাগ করেন “Let Art Front”।
১৯২৫ সালে বিপ্লবী লেলিনের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান কবি রচনা করেন ৩০০০ পঙক্তির এক মহাকাব্য। যা পরবর্তীতে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। পাঁচ বছর পর বলশয় থিয়েটারে কবি যখন আবৃত্তি করলেন কবিতাটির তৃতীয় অংশ উপস্থিত শ্রোতাগণ প্রায় বিশ মিনিট ধরে করতালিতে আচ্ছন্ন করে রাখেন। ১৯২৯ সালে চারখন্ডে প্রকাশিত হয় ‘মায়াকোভস্কি রচনা সমগ্র’। এই বছরই পুঁজিবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে তার লেখা নাটক ‘ছারপোকা’ মঞ্চায়িত হয়। ১৯৩০ সালে মঞ্চায়িত হয় ‘স্নানাগার’। নাটক দুটি নিয়ে প্রবল প্রতিক্রিয়া জানায় রুশ প্রলেতারিয়েত শিল্পীগণ। ১৯৩০ সালে মায়াকোভস্কির উপর অত্যন্ত ভয়াবহ রাজনৈতিক অভিযোগ আনা হয়। সোভিয়েত সংবাদপত্রে শুরু হয় ‘মায়াকোভস্কি নিপাত যাক প্রচারণা’।
ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি ছিলেন আপাদমস্তক একজন আবেগী প্রেমিক। প্রথম প্রেমিকা হিসেবে এলসার নাম পাওয়া যায়, যার সাথে স্বল্পস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তরুণী এলসার সাথে কবি যখন ব্রিক দম্পত্তির বাসায় যান লিলিয়া ব্রিক বলেন, “তিনি কবির অনেক আচরনেই বিরক্ত হতেন তবুও তারা বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।” অন্যদিকে লিলিয়া ব্রিকের স্বামীও কবিকে পছন্দ করতেন বলে জানা যায়। সাহিত্যের সাথে এই পরিবারের কোন সংযোগ ছিলো না। সেই সন্ধ্যায় কবি তাঁর অপ্রকাশিত ‘ট্রাউজার পরিহিত মেঘ’ লিলিয়া ব্রিকের উদ্দেশ্যে পাঠ করে শোনান। লিলিয়া ব্রিকের সাথে এক বছর প্রেম স্থায়ী হয়েছিলো। এই সময়ে কবি যতগুলো কবিতা লিখেছেন সবগুলোই লিলিয়া ব্রিককে উদ্দেশ্য করে। কবিতাগুলোতে উচ্ছ্বাস, বিরহ, আশা-হতাশা, জীবনবোধের কথা ধ্বনিত হতো। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কবি এবং ব্রিক দম্পত্তি কবির জন্য রাষ্ট্রকর্তৃক বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাটেই একসাথে বসবাস করেন।
১৯২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যান কবি। পরিচয় হয় এলি জোন্সের সাথে। এলি ছিলেন একজন দোভাষী। পরিচয় থেকে প্রেম। ভ্রমণ শেষে কবি দেশে ফিরে আসেন। এর কয়েক মাস পর এলি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। যদিও এই প্রেমের কথা দুজনই গোপন রেখেছিলেন। কন্যা পেট্রেসিয়ার সাথে কবির একবারই দেখা হয়েছিলো। সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে গেলে পেট্রেসিয়া রাশিয়া বেড়াতে যান। বিপুল আতিথেয়তায় তাঁকে গ্রহণ করে কবির ভক্তগণ। তখন থেকে নিজের নামের সাথে পিতার নাম যুক্ত করেন। রুশ তরুণী তাতিয়ানার সাথে প্যারিসে দেখা হয় ১৯২৮ সালে । তিনি ছিলেন একজন মডেল কন্যা। মায়াকোভস্কি মাতাল হয়ে উঠেন তাতিয়ানার প্রেমে। বহু অনুরোধ করেন তাতিয়ানাকে রাশিয়া ফিরে আসার জন্য। কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন তাতিয়ানা। এক সময় কবি নিজেই প্যারিস যাওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলেন। সেই পথ আটকে দেন লিলিয়া ব্রিক। সোভিয়েত উচ্চ মহলে লিলিয়ার বেশ ভালো সংযোগ ছিলো। ফলে কবিকে ভিসা দিতে মানা করেন তিনি। তারপর কবির আরও দুজনের সাথে প্রেম হয়। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ছিলো নাতালিয়া। কবির আত্মহত্যার পর অনুমান করা হয় সর্বশেষ প্রেমিকা ভেরোনিকা পোলোনস্কয়াকে জীবন সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভেরোনিকা কবির প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। ইতোপূর্বে তিনি বেশ ক’জন পুরুষের কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাই স্বামীকে ছেড়ে কোনমতেই কবির কাছে আসতে চাননি। ধারনা করা হয় এতে কবি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। তবে নাতালিয়া বলেন, ভেরোনিকা নয়, কবি তাতিয়ানাকে পুনরায় দেখতে না পেলে মাথার খুলিতে পিস্তল ঠেকানোর কথা বলেছিলেন।
বিষাদগ্রস্থতা, হতাশা, আবেগতাড়িত মনোভাবকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন মনোবিজ্ঞানীগণ। অধিকাংশ সময় প্রতিভাবান বা সৃজনশীলদের ক্ষেত্রে ‘বাইনোপোলার ডিজঅর্ডার’ এ ভোগতে দেখা যায়। একটি সুইসাইড নোটের কিছু অংশ পড়া যাক, “আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করছি না এবং এ নিয়ে মুখরোচক গল্প করো না। মৃত ব্যক্তিটির এসব পছন্দনীয় নয়। মা, বোন এবং সহযোদ্ধাগণ ক্ষমা করবেন, যদিও সমাধান নয় আমি কাউকেই এ বিষয়ে দোষারোপ করছি না। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না; লিলি, আমাকে ভালোবেসো। কমরেডগন আমায় দূর্বল চিত্তের ভাববেন না। প্রকৃত অর্থে, আমার ভিন্ন কিছু করার ছিলো না।”
সুইসাইড নোটের উপরের অংশটি ভ্লাদিমির মায়াকোভাস্কির। কবিকে ১২ই এপ্রিল ১৯৩০ সালে বাইরের জগতে দেখা গিয়েছিলো। এর দু’দিন পরেই তিনি আত্মহত্যা করেন। কবির প্রেমিকা ভেরোনিকা কবির ফ্ল্যাট ছেড়ে বের হতেই শোনা যায় গুলির শব্দ। ভেরোনিকা ফিরে গিয়ে দেখতে পান বুকে বুলেট বিদ্ধ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছেন কবি। কবির আত্মহত্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। যে বুলেট বের করা হয়েছিলো কবির বুক থেকে এর সাথে কবির পিস্তলের বুলেটে তারতম্য ছিলো। কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, “আত্মহত্যার ঘটনা পুরোপুরি ব্যাক্তিগত, এর সাথে জনগন এবং কবির সাহিত্য কর্মের কোন সম্বন্ধ নেই। মূলত এক প্রকার অসুস্থতা থেকে কবি একেবারেই সেরে ওঠেননি, সেই অসুস্থতার কারনেই আত্মহত্যা করেছেন”।
কারও কারও ধারনা অভিনেত্রী ভেরোনিকা কবির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করাতেই তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। তবে ভেরোনিকার ভাষ্যমতে, ১৩ই এপ্রিল কবি আত্মহত্যার কথা বলেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন মানসিক ভাবে তাঁকে দূর্বল করতেই এসব বলছেন কবি। কবির মৃত্যুর দশদিন পর সরকারি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয় আত্মহত্যা করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন কবি। ১৯৯১ সালে কবির আত্মহত্যাকালীন সমস্ত আলামত পুনরায় পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু মৃত্যুর দুদিন পূর্বে লিখা যাওয়া সুইসাইড নোটটি কবির লেখা বলেই প্রমাণিত হয়েছিলো। তাই এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। ১৯৩০ সালের ১৭ই এপ্রিল, মায়াকোভাস্কির অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। কমরেড লেলিন এবং জোসেফ ষ্ট্যালিনের পর কোন শবযাত্রায় এতো মানুষের অংশগ্রহণ বিস্ময়ের সূচনা করে। বেঁচে থাকাকালীন বিভিন্ন সময় কবি সমালোচিত হয়েছেন সোভিয়াত লেখক সংঘের। মৃত্যুর পর কবির সব প্রকাশনা বাতিল করে সোভিয়েত প্রেসে কবির নাম নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৩০ সালে কবিকে পুনরায় ধ্রুপদী সোভিয়েত কবি হিসেবে গন্য করার আগ্রহ দেখা যায়। এর পেছনে স্ট্যালিনকে পাঠানো লিলিয়া ব্রিকের একটি চিঠি বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। মায়াকোভস্কি এমন একজন কবি যাকে মূলধারার সাহিত্যে স্থান দেয়া হয়েছে। মায়াকোভাস্কির জন্মস্থানের নামকরণ করা হয়েছে কবির নামে। মস্কোতে মায়াকোভস্কির নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাদুঘর। মস্কোর ‘ট্রিয়াম্ফ স্কোয়ার’- এর পরিবর্তিত নাম হয় ‘মায়াকোভস্কি স্কোয়ার’।
এই লেখকের আরও লেখা...
0 Comments