জ্যোতি পোদ্দারের গদ্য ।। নীলে নীল আর সবুজে সবুজ রাজা পাহাড়



এই রেঞ্জের একপাশে যতীনটিলা গোবিন্দটিলা আর ফকিরাটিলা—আরেকটু এগিয়ে গেলে তাওয়াকুচা, নকশী—তারপর বিস্তৃণ রাংটিয়া বনভুমি; তারই মাঝে দিয়ে যে সীমান্ত সড়ক চলে গেছে এঁকেবেঁকে সেটি কালোপীচের সড়ক।কোমরে বেল্ট বাঁধার মতো করে পুরো উপশৈল অঞ্চল বেঁধে রেখেছে এই কালো সড়ক। কর্ণঝোড়া ও মালাকোচা বিট বায়ে রেখে পীচপথে কিছুদূর এগুলেই হাতের ডানের কোনাকুনিই পথই রাজা পাহাড়ের পথ। শেরপুরের রাজা পাহাড়। 

প্রতিটি বিট তল্লাটে ভেজিটেশনের সুলুক সন্ধানের জন্যেই আজ বেড়িয়ে পরেছে বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি। আমি সেই দলে লেজ হয়ে ঘুরছি। শরতের নির্ভার আকাশ থাকলেও গরমে জীবন জেরবার।

বন কেটে বনায়ন আর পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন দু'টিই বন-বন্যপ্রাণী-বনবাসীর স্থানিক আচরণিক ও বাস্তুতান্ত্রিক মনোভঙ্গির বিরোধী। পাহাড় কেটে ঘরই শুধু নয়—নানা অঞ্চল থেকে আগত বিশেষ করে নদীভাঙন এলাকা থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষ এই অঞ্চলে বসতি করেই শুধু ক্ষান্ত হচ্ছে না: জীবন জীবিকার জন্য যে ফসলিজমির প্রয়োজন সেটিও পাহাড় কেটে কেটে আবাদের জায়গা তৈরি করে নষ্ট করছে বনের সংস্কৃতি। এ ছাড়াও আছে ক্ষমতাবানদের লিজের বিস্তর জমিন।

 

অ্যাকাশিয়ার দাপটে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে খুব। শ্বাস ঘ হয়ে আসে। সব গাছ পরিবেশবান্ধব হয় না। জ্বালানীর লাকড়ি হিসেবেই  একদা ইপিলইপিল, মিনজিয়াম, অ্যাকাশিয়ার মতো দ্রুত বর্ধনশীল গাছের অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলাদেশে। সেই অ্যাকাশিয়া এখন নিজেই জাঁকিয়ে বসেছে শুধু বনের উপনিবেশক হিসাবে নয় নাগরিক সমাজের ঘরের নানা আসবাবপত্রের রূপে হাজির।

বিট অফিসের পাশপাশে তাই গাছের বৈচিত্র কম। বলতে গেলে পুরো এলাকাজুড়ে মনোকালচারের বিস্তার যদিও সুফল প্রকল্পের অধীনে বনের বৈচিত্র আনার চেষ্টা জারি রেখেছে বন বিভাগ। 

বন কেটে বনায়ন আর পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন দু'টিই বন-বন্যপ্রাণী-বনবাসীর স্থানিক আচরণিক ও বাস্তুতান্ত্রিক মনোভঙ্গির বিরোধী। পাহাড় কেটে ঘরই শুধু নয়—নানা অঞ্চল থেকে আগত বিশেষ করে নদীভাঙন এলাকা থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষ এই অঞ্চলে বসতি করেই শুধু ক্ষান্ত হচ্ছে না: জীবন জীবিকার জন্য যে ফসলিজমির প্রয়োজন সেটিও পাহাড় কেটে কেটে আবাদের জায়গা তৈরি করে নষ্ট করছে বনের সংস্কৃতি। এ ছাড়াও আছে ক্ষমতাবানদের লিজের বিস্তর জমিন।

তাছাড়া ফি বছর আইল কেবলই সরে সরে যায় আর কাটা পড়ে পাহাড়। খাড়া পাহাড় কয়েক বছরেই সমতল ভূমি। সেই দিকের নজর কর্তাব্যক্তিদের নেই। অথচ পৃথিবী জুড়ে  জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরির্বতন মোকাবেলার জন্য বন ও বন্যপ্রানীর সপ্রাণতা জরুরি। অরণ্য পল্লবিত হবার সাথেই রয়েছে আমাদের বেঁচে থাকার গাঁটছড়া বন্ধন।

ঝুলগাও-এ প্রান্তিক মানুষের জন্য নতুন করে গড়ে উঠেছে গুচ্ছবসতি। একটি টিলার কোমরের দিকে ফালা করে কেটে যে চাতাল হয়েছে সেখানেই নতুন টিন শেডের দুই রুমের পাকাঘর। এ্যাটাচড বাথরুম। দশ পরিবারের জন্য সমন্বিত যৌথ উঠান।

পাশেই সড়ক। বনকে বনের হাতে ছেড়ে না দিয়ে আমরা বরং বনের ভেতর গড়ে তুলছি লোকালয়। দখল করছি ফানা-ফ্লোরার বেঁচে থাকার বিকশিত হবার বংশবৃদ্ধি করার নিজস্ব চাতাল।

কথা হচ্ছিল রাজা পাহাড় নিয়ে। একটির সাথে অন্যটি এমন নির্ভরশীলতায় জড়িত যে এক বলতে গিয়ে আরেক প্রসঙ্গ ঢুকে পড়ে। যদিও সেটি সমগ্রের অংশ। যাক যা বলছিলাম। সড়কের ডানেই  রাজা পাহাড়। প্রতিবেশী টিলার চেয়ে এই রাজা পাহাড় গড়নে আলাদা। অন্য টিলাগুলো চূড়ার বেড় খুব একটা প্রশস্ত নয়। কিন্ত রাজা পাহাড় উঁচু যেমন তেমনি প্রশস্ত তাঁর সমতল চাতাল। শতাধিক হেক্টর জমি নিয়ে এই তল্লাটের বড় মালভুমি।চারপাশে ঢাল নেমে গেছে অনেকদূর—সেখানেই সে পা ডুবিয়ে স্নাত হয়েছে ঢেউফার খরস্রোতা জলে।

রাজা পাহাড়ের বাইদে ধান চাষ, ছবি-লেখক 

মেঘালয় রাজ্যের পোড়াখাসিয়ার পাহাড়ের ঝোরা  এই ঢেউফার আঁতুরঘর। সিংগাবরুনা ইউনিয়নের হাড়িয়াকোণা-বাবেলাকোণা দিয়ে মালাকুচা ছুঁয়ে রাজা পাহাড়ের পা ঘেষেই এই ছোট্ট নদীটি বয়ে গেছে অনেকদূর।স্থানিক নদীগুলো অন্য অঞ্চলে ঢুকলেই নাম হারায়। গতি হারায়। ঢেউফা তেমনই। বর্ষায় তীব্র স্রোতে তিনি যৈবতি কন্যা। নদীর কুল ধর্ম থেকে তিনি তখন বিচ্যুত হ না। জলের তোড়ে পাড় ভাঙে। বন্যায় ডুবে তখন ক্ষেত খামার। ক্ষীণ দেহ তখন ঘোলা জলের দশাসই বেঢপ শরীর। পাহাড়ি স্রোতের দাপট জলের ঘুর্ণিতে। আবার শুকা মৌসুমে থুরথুরে বুড়ি। একলাফে এপাড়া ওপাড়। ঢেউফার শরীরে তখন এখানে সেখানে ভেজা ভেজা মোটা বালির বালুচর। মাঝে ছোট্ট জলধারা। ঠাণ্ডাকাঁচের স্বচ্ছ জল।

অন্য টিলার চেয়ে এই টিলা অনন্য। উচ্চতায় আকাশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিগন্ত জুড়ে নীল আর নীলে নীলে নীলাভ আকাশ। হাত বাড়ালেই যেনো ছুঁয়ে ফেলা যাবে সাদা মেঘের চলন্ত ভেলা। অন্য দিকে প্রসারিত দুই হাত জুড়ে সবুজ আর সবুজে সবুজে সবুজাভ নানা বৃক্ষ পরিবার। 

এখানে বৈচিত্র আছে। চোখ ক্লান্ত হয় না। চোখ আর মনের সাথে হাত উঁচিয়ে আঙুলে গোনে নিতে পারছি এই তো লতা—নীললতা, কচু, সারি সারি হলুদ বন, গুচ্ছগুচ্ছ শটির ঝোপ আর ঝাঁক বেঁধে বেড়ে ওঠা তেতুল-বনতেতুল,বেল-বিষবেল, আম, জাম, গামা, জিগা, কাঁঠাল, চাপিলাইশ আর ডেওয়া—এ ছাড়াও আমলকি হরিতকি বয়েরার মতো রয়েছে  ঔষুধী গাছের বিস্তার।

আমি সব গাছ চিনি না। বইপড়া নামগুলো দিয়ে জীবন্ত গাছকে আর চিনতে পারি না। মুখস্ত করে পরীক্ষার ফাঁড়া কাটিয়েছি বটে—যে বৃক্ষ আমার প্রতিবেশি আমার বেঁচে থাকার আগাম শর্ত তাকে না চিনেই পার করে দিচ্ছি জীবন।

শহীদ ভাই বৃক্ষবান্ধব। বৃক্ষের মুখোমুখি হলেই গড়গড় করে বলে দেন বৃক্ষের চৌদ্ধ গোষ্ঠির ঠিকুজি। সব মনে রাখতে পারি না। অনভ্যাসে কিছু মনে থাকে কিছু মাথার উপর দিয়ে শূন্যে মিলায়।

এই যেমন তেলাকুচা লতা। বাঁশের কঞ্চির বেড়া পেলেই তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। আগে কখনো চোখ মেলে দেখিনি।আর আর নানা লতার পাশেই কী সুন্দর সে বেড়ে উঠেতেলাকুচার ফুল ধবধবে সাদা। ফল প্রথমে সবুজ সবুজ। পাকলে টুকটকে লাল। সবুজ লতায় সাদা ফুল আর লাল ফলের সমাহারে কঞ্চির বেড়ায় ছড়ানো দেহ মেলে দেয় তেলাকুচা। অযত্নে বেড়ে উঠলেও এ ঔষুধিগুণ আঙুলের কড় ধরে ধরে বলে দিলো ফকির শহীদ।

যে আমি ডায়াবেটিসের বাড় বাড়ন্তে সব সময় ত্রাহি অবস্থায় থাকি—আমারও নাকি তেলাকুচার কাণ্ডসহ পাতা ছেঁচে সকাল বিকাল রস খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে সমস্বরে জানালেন শহীদ আর সুজয়।এমন কী তেলাকুচার সাদা ফুল ও টকটকে লাল ফলও নাকি সমান উপকারি!

যে আমি ডায়াবেটিসের বাড় বাড়ন্তে সব সময় ত্রাহি অবস্থায় থাকি—আমারও নাকি তেলাকুচার কাণ্ডসহ পাতা ছেঁচে সকাল বিকাল রস খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে সমস্বরে জানালেন শহীদ আর সুজয়।এমন কী তেলাকুচার সাদা ফুল ও টকটকে লাল ফলও নাকি সমান উপকারি!

আমাদের যে মনোভঙ্গি তা এ্যালোপেথিক দ্বারা আচ্ছন্ন। এই মন আধুনিকতা দ্বারা তাড়িত। শাসিত। যত বেশি প্রাণ ও প্রকৃতি নির্ভর তত বেশি সে আদিম—তুকতাক বিশ্বাসী কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তি। ধুনিক ব্যক্তি সদরের ব্যক্তি হতে চায়। বটিকা বা সালশায় তার বিশ্বাস নেই। তাই আমদের যাপনে কবিরাজ নাই। চরক মুনির আর্য়ুবেদ সংহিতা সরে গেছে সেল্ফের আড়ালে।

গ্রামীন সমাজে যে শ্রেণিটি নানা রোগ নির্নয় ও বোগের নিদান জানতো—জানতো কোন গাছের ছাল দিয়ে বা পাতা বেটে বটিকা তৈরি করে খেলে রোগের উপশম শুধু নয়—রোগের কার্যকারণের উৎপত্তির সন্ধান ও বিনাশ করার নিদানও জানতো সে শ্রেণি বৈদ্য নামে পরিচিত ছিল। সে আর নেই। টাইটেল শুধু রয়ে গেছে বংশ পরম্পরায়।  কার্যনির্বাহ নেই শুধু রয়েছে টাইটেল। ধ্বনি থেমে গেলেও যেমন প্রতিধ্বনি থেকে যায় তেমনি বৈদ্যের বৈদ্যপনা নেই—রয়ে গেছে একটি বর্ণ। একটি কাস্ট। জাতিবাদি ধারণা। কার্যবিহীন বিচ্ছিন্ন টিকি। 

রাজা পাহাড় কেন রাজা তার ঐতিহাসিকতা জানা না গেলেও লোকমুখে নানা বয়ান হাজির। তবে একথা যথার্থ যে,এই উঁচু পাহাড়ের সমতলে একদা ছিল আচিক মান্দিদের বসতি। ছিল গারোদের পূজা মন্ডপ। এই তল্লাট তো গারো হাজং কোচদের তল্লাট। হয়তো গ্রামপ্রধান যাকে গারোরা নকমা নামে ডাকে—তার বসত ভিটি ছিল এই পাহাড়েহয়ত ছিল গ্রাম শাসনের ব্যবস্থাপনার মন্ডপ যেখান থেকে তামাল উত্তরাঞ্চলের শাসনকার্য় পরিচালিত হতো।

এও হতে পারে রাজা পাহাড়ের উপত্যকা ঘিরে গারো ছাড়াও ছিল হাজং ও কোচদের প্রশস্ত জনপদ। শেরপুর অঞ্চল একদা কোচ রাজাদের শাসিত অঞ্চল ছিল। তাদের প্রধানকেও বলা হতো গাঁওবুড়ো। হয়তো এই রাজা পাহাড় ছিল সেই গাঁওবুড়োদের প্রশাসন কেন্দ্র।

আজ আর ঠিক করে বলার কোন উপাত্ত নেই। স্থানিক মানুষের স্থানান্তরে অতীতের অনেক কথাই দিশা হারায়।নতুন বসতিরা অতীতের কোন সংযুক্ততা খুঁজে না। কিংবা জীবনের তাগিদেই রাখতে চায় না । এমনটিই হয়েছে এই রাজা পাহাড়সহ অন্যান্য অঞ্চলে।

নামকরণ যেভাবেই হোক না কেন—হোক সে নকমা পরম্পরা বা গাঁওবুড়া পরম্পরা থেকে, বাঁধন আরেং জানালেন, এই পাহাড় আদিবাসী জীবন জীবিকা ও সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত বলে তিনি মনে করেন”। মান্দির ইতিহাস ঐতিহ্যে সন্ধানে নিয়োজিত বাঁধন আরেং শুধু বাংলা নয়লিখছেন নিজ ভাষা আচিকে রোমান হরফে।

নানা কথা লোকমুখে উচ্চারিত হলে রাজা পাহাড়ের পাদদেশে একদা একটা জলাশয় ছিল। ঢেউফার সাথে জড়িয়ে ছড়িয়ে। কালের গর্ভে শুকিয়ে গেছে। গারো ও কোচদের কাছে সেই জলাশয় ছিল পবিত্র জলকুন্ডুআত্মার বাসস্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। এই জলাশয়ের জল ছিল শ্রদ্ধার-পবিত্রতার প্রতীক। কাজেই প্রাত্যহিকতার কাজ কেউই এই জল ব্যবহার করত না। এই মিথ বা জনশ্রুতি এখন গারোদের ভেতর ক্ষীন রেখার মতো জারি আছে।

নামকরণ যেভাবেই হোক না কেন—হোক সে নকমা পরম্পরা বা গাঁওবুড়া পরম্পরা থেকে, বাঁধন আরেং জানালেন," এই পাহাড় আদিবাসী জীবন জীবিকা ও সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত বলে তিনি মনে করেন। মান্দির ইতিহাস ঐতিহ্যে সন্ধানে নিয়োজিত বাঁধন আরেং শুধু বাংলা নয়লিখছেন নিজ ভাষা আচিকে রোমান হরফে

রাজা পাহাড় ঘিরে নানা লোকজ বিশ্বাস থাকা অস্বাভাবিক নয়। স্থানিক ইতিহাসের উপাত্ত সংগ্রহে না থাকার কারনে নানা কথার ডালপালার বিস্তার ঘটেছে। অথচ ইতিহাসের নানা পর্যায়ে রয়েছে গারো বিদ্রোহ। নিজস্ব অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। স্থানিক জমিদারের লেঠেল বাহিনীর সাথে তুলা মরিচ হলুদের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিংবা বাজারের তোলা” আদায় নিয়ে বচসাসংঘর্ষ যেমন হয়েছে তেমনি আপোষ মীমাংসার সহাবস্থানিক সম্পর্কও বিদ্যমান ছিল।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও এই উত্তর জনপদে মুক্তিযোদ্ধারা যে ছয়টি ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল তাঁর 'রাজা পাহাড় যুদ্ধ' বইতে লিখেছেন, রাজা পাহাড় ছিল একটি অন্যতম ঘাঁটি। তীর ধনুক লাঠি বল্লম হাতে আদীবাসি জনগোষ্ঠির গারো কোচ হাজং সহ বাঙালীদের সমন্বয়ে যে সন্মেলিত প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে কর্ণঝোড়ার ইপিআর ক্যাম্পের পতন ঘটে তখন থেকেই মূলত মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা পায় রাজা পাহাড়সহ বিস্তৃণ এই অঞ্চল।

 চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ প্রভাব এই প্রান্তিক জনজাতির উপর পড়েছে গভীরভাবে। প্রভাবের নগদ ফলে ঘটেছে সাংসারেক ধর্ম পরিত্যাগ করে যিশুর পথের পথিক হয়ে এক মানুষের দুই সংস্কৃতির জীবন যাপন।  এছাড়াও  ভূমির ব্যস্থাপনার মালিকানার যে সনাতন সম্পর্ক তা কোন শাসকই মেনে নেয়নি। গারোর ভিন্নতাকে দেখেছে সন্দেহের মোড়কে। সবাইকে এক ছাঁচে গড়বার একটা আইনি ব্যবস্থাপনা জারি ছিল সবসময়। ভিন্নতাই সৌন্দর্য—এমন ভাবনা ক্ষমতা কাঠামো মানেনি। তার ছিল নিদির্ষ্ট  নিক্তি। নিজস্ব বাটখারা। আদীবাসীর সাথে যে স্বভাবগত মাটির সম্পর্ক সেই নিক্তির মাপমাটিতে বিচারের ফলে এই প্রান্তিক জনজাতির সপ্রানতা বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছে—হচ্ছে বারবার।

সেই নিক্তির বলি এই আদীবাসি জনজাতি। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। সব ক্ষমতা কাঠামো বারবার তার জমি ব্যবস্থাপনার হাত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের জীবনবোধের নিজস্ব দার্শনিকতা ও রাজনৈতিকতা।

নকমা বা গাঁওবুড়া যে নামের কারনেই হোক না কেন এই রাজা পাহাড়আজ আর সঠিক কারণ বলার সুযোগ নে। তবে কোন সঠিক তথ্য হাজির না থাকালেও রাজা পাহাড় তার নিজস্ব জন্মদাগ নিয়ে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজকে জড়িয়ে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও এই উত্তর জনপদে মুক্তিযোদ্ধারা যে ছয়টি ঘাঁটি গেড়ে ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল তাঁর 'রাজা পাহাড় যুদ্ধ' বইতে লিখেছেন," রাজা পাহাড় ছিল একটি অন্যতম ঘাঁটি তীর ধনুক লাঠি বল্লম হাতে আদীবাসি জনগোষ্ঠির গারো কোচ হাজং সহ বাঙালীদের সমন্বয়ে যে সন্মেলিত প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে কর্ণঝোড়ার ইপিআর ক্যাম্পের পতন ঘটে তখন থেকেই মূলত মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা পায় রাজা পাহাড়সহ বিস্তৃণ এই অঞ্চল।

না। রাজা পাহাড়ে কোন যুদ্ধ হয়নি। হয়েছে আরকেটু এগিয়ে কামালপুরে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অপারেশন জন্য এই পথটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি স্ট্রেটেজিক গেইট ওয়ে। খরস্রেতা নদীর অপর পাড়ের ছিল সীমান্তবর্তী হালচাটি গ্রাম। সেখানেই মুক্তিযোদ্ধরা অপারেশনের জন্য হাইড আউট করে অবস্থান করতো বাংলাদেশের ভেতর নানা জায়গায় অপারেশনের জন্য।

মুক্তিযোদ্ধা সুহৃদ জাহাঙ্গীর বলেন, "এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কামালপুর আর নকশী-ভায়াডাঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নকশী ও ভায়াডাঙ্গা ক্যাম্প থেকে যাতে করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সোলজাররা কামালপুরের দিকে অগ্রসর হতে না পারে।"

এই রাজা পাহাড়ে এখন ঘুরছে লোলুপ চোখ। দখলদারের চোখ। কিছুদিন আগে একচালা টিনের ঘরে  লালন আখড়া নামে একটি থান গড়ে উঠেছিল রাজা পাহাড়ে  সেটি বনবিভাগ গুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয়। মামলা মোকদ্দমা হয়। লালনের বরাতে দখলচোখ এখানে যে ভিত সে সময়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিল তা পারিনি।

কাজেই  নানা  ঐতিহাসিকতায় ঠাসা এই রাজা পাহাড়  ও তার তামাম অঞ্চল নিয়ে পদ্ধতিগত ভাবে কোন কাজ হয়নি বলেই চলে। সেই রাজা পাহাড়ে আজ আর কোন আচিক মান্দি নেই। উপত্যকা জুড়ে যে হাজং কোচ বসতি ছিল তাও স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। কখনো দেশভাগ অভিঘাতে কখনো সংখ্যার চাপে জাতিবাদি বিদ্বেষে।

এখন আর ভিন্নতা নেই। গফরগাঁও, সিলেট, টাঙ্গাইল বা সিরাজগঞ্জের নদী ভাঙন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষের বাস এই প্রান্তিক জনপদে। টিলা আর বৃক্ষের মাঝে বসতের গণিত অ-আদীবাসিরা জানেন না। বছর বছর বাড়ছে পাহাড় কেটে ঘর আর আইল সোজা করার কসরত যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র জলবায়ুতে।

এই রাজা পাহাড়ে এখন ঘুরছে লোলুপ চোখ। দখলদারের চোখ। কিছুদিন আগে একচালা টিনের ঘরে  লালন আখড়া নামে একটি থান গড়ে উঠেছিল রাজা পাহাড়ে  সেটি বনবিভাগ গুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয়। মামলা মোকদ্দমা হয়। লালনের বরাতে দখলচোখ এখানে যে ভিত সে সময়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিল তা পারিনি।

এখন সেখানে লীজের লেবু বাগান। মাইলের পর মাইল। বড় বড় দখলচোখের মণি এখন রাজা পাহাড়। মাইলের পর মাইল বরবটি ঝিঙ্গে করলা আর ধুন্দলের ঘের দেয়া বাগান। বাঁশের কঞ্চি দাঁড় করিয়ে করিয়ে টানা সুতার জাল দিয়ে তৈরি সবজি বাগান। বাগান দেখভালের জন্য নানা বয়সী কামলা। মাটি নিড়ানির কাজ করছে কেউ কেউ। কেউ আগাছা উপড়ে ফেলছে। রোদের তাপে শরীর বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে। ভাষার টানে মনে হলো এই কামলা স্থানিক কামলা নয়—সিলেট হবিগঞ্জ অঞ্চল থেকে আসা মানুষ এরা। 

তদারকি করছে তামাটে মতোন দোহারা গড়নের যে মানুষটি সে ছাতা নামিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতেজানালেন এটি তাদের রেকর্ডভুক্ত জমিন। পরদাদার আমল থেকেই এখানে আছেন। এখন উত্তারাধিকারি স্বত্বভোগ করছেন তিনি। এই বাগান তারই। তার কথা এসেন্ট এই তল্লাটের না। আমাদের সাথে কথা বলছেন আর একটু পর পর পরদাদার জমিনে আবাদের কাজের তাগদা দিচ্ছেন কামলাদের। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনলাম  কোন এক অর্বাচিন উত্তরপুরুষের বানানো বয়ান কী ভীষণ বুনে বুনে যাচ্ছেন রাজা পাহাড়ের জমিনে বীজ বোনার মতো করে!

শুধু রাজা পাহাড় নয়—পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত এই উপশৈলির যেখানেই যাবেন সেই একই বয়ান এই তল্লাটের বর্তমান অধিবাসীদের। সবারই রেকর্ডভুক্ত জমিন। পরদাদার আমল থেকেই এখানে আছেন। বহিরাগত শুধু গারো-কোচ-হদি-হাজং-বানাই-ডালু-বর্মণ-রাজবংশী

 সমগ্র রাজা পাহাড় জুড়ে  সবজি বাগান। পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটাপথ—মিলেছে পূর্ব-উত্তর কোনে। সেখানেই গড়ে উঠেছে বছর আটেকের একটি খানকা শরিফ। একপাশে চৌচালা টিনের মেহমান ঘর। সারা বছর খালি পড়েই থাকে। উরশের সময় মেহমান ঘর ভরাঘর। উঠান জুড়ে কালচে সবুজ ঘাস। মোলায়েম। একটি পাকুড় গাছ সবে ডালপালা ঝারা দিয়ে উপর দিকে উঠছে। ঘাসের উপর মধ্য দুপুরে গোল হয়ে পাকুড়ের ছায়া পরেছে ঘাসে।

উঠানে গাছের নীচে আমরা তখন গরম ও ক্ষুধায় চিৎপটাং। নরম ঘাসে শরীর এলিয়ে দিতেই ঝিরিঝিরি বাতাসে চোখে পাতা ভারি হয়ে উঠ পাহাড়ের জাম্বুরা খেয়ে কিছুটা দম পেলেও কোন স্বাদ পেলাম না। রস নেই বললেই চলে, পাহাড়ি জাম্বুরা একটু ঝবড়া ঝবড়া।

চারদিকে বাঁশের বেড়া। মাঝখানে একচালা নকশা করা খানকা শরিফ। পেছনের দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা একপাশে দারোগা পাগলা অন্য পাশে ফছি পাগলার সাদাকালো ফটোগ্রাফ ঝুলছে। ঢাকার পোড়াবাড়ির পাগল বাবা শাহ সুফি ফছিউদ্দিন (রাহঃ) এর এটি আশ্রয়স্থল। নতুন গড়ে ওঠা খানকা শরিফ। গুম্বজঅলা একটি ছোট্ট সিংহাসন। ঝিলমিল জড়ি দিয়ে জড়ানো। পাকা মেঝেতে এখানে সেখানে পড়ে আছে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া মোম আর আগর বাতির অবশিষ্টাংশ। 

বাঁশের বেড়ার পাশে নানা ফুলের সমাহার। করবী,গোলাপ, টগর ছোট্ট সবে বেড়ে ওঠা হাস্নাহেনা। র বেড়ার রেলিঙে ফোটা নীল নীল অপরাজিতা। আর লাল লাল কলাবতী ফুল রোদ আর বাতাসের দাপটে বারবার কাৎ হয়ে পড়ছে। পেছনে আকাশমুখী ক্রিসমাস ট্রি।

বাঁশের গেইট সরিয়ে ঢুকবার সময়েই আব্দুর করিমের সাথে আলাপ। আব্দুর করিম খানকা শরিফের খাদেম। পাশেই পরিবার নিয়ে এই নির্জনে থাকেন সত্তর বয়সী করিম। খানকার দাওয়ায় বসে বসে আমি আর শহীদ শুনছিলাম তাঁর যাপনের কথা। তাঁর বিশ্বাস আর সাহসের কথকতা।

খানকার দুইপাশে বেড়ে উঠছে দু'টি সাইকাস। ছড়ানো গা সবুজের ডাল। খেজুরের ডালের মতো পুরুষ্ট ও ঘণ পাতা। সাইকাস মূলত শোভাবর্ধনের গাছ। বাগান জুড়ে থাকে। কেউ আবার মনিরাজ বলেও ডাকে। গাছটি বিদেশি হলেও সাইকাসের চেয়ে মণিরাজ বলে ডাকাডাকিতে একটা সুখ আছে। খুব কাছের মনে হয়।

প্রচন্ড রোদের দাপটে আমাদের আর ভেজিটেশনের কাজকাম এগুলো না। খানকাতেই হত্যে দিয়ে পড়ে রইলাম। খানকা শরীফের মুখে বাঁশের চটি দিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে যে বেড় সেখানেই লতায় লতায় লতিয়ে উঠছে ঝুমকো লতা। দারুণ বাহারি রঙের ঝুমকোলতা। এইখানকার ফুলগুলো সাদা বেগুনি আর রানি গোলাপি আর টিয়া রঙের মিশ্রণ।

ঝুমকো ফুলের শরীরে ফুটে উঠে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম। একই অঙ্গে নানা বিভাব। নানা রঙের ছটায় সেই বিভাব আর আর রূপবতী হয়ে উঠে। খানকা শরীফে এই ঝুমকা লতাই আসর জাকিয়ে হাজির। যে কাউকে কাছে টানবার অসীম শক্তি এই ঝুমকোলতার। 

খাদেমে গল্পে শহীদ মনোযোগী শ্রোতা। পাশে বসলে ঝুমকোর সহস্রলতার দিকে আমার নজর। 'রাধিকা নাচোননামে যারা ঝুমকো লতাকে ডাকে তারা একেবারে ভুল নয়—দেখুন দেখুন বাতাসে  কী সুন্দর কানের দুলের মতো ঝুলছে এখানে সেখানে। হাতের পাঞ্জার মতো পাতা—প্রসশ্ত আঙুলের মতো পাতা হাতের তালু থেকে বের হয়ে আছে খাঁজ করা তিনটি মুখ। রোদে হল্কা একটু কমে এলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠবয়ে।  

পৌষে তিন দিনের ওরশ আসবেন"

 -কয় তারিখে?

-নানা পাগল আসে। পাগলের মেলা বসে। পৌষের পঁচিশ থেকে সাতাশ। তিন দিনের মেলা। মানুষে মানুষে যে মানুষের মেলা সেখানেই 'তিনি' সদা হাজির। বার রঙের নানা মানুষ সকলের ভেতর সদা হরি বিরাজমান। আসবেন....

খাদেম আগাম নিমন্ত্রণ দিয়ে দিলেন। হয়ত আসব—হয়ত না। এই সুনসান নীরবের ভেতর ছায়া ঘেরা এই খানকা শরীফ ভালোই লাগলো। খানকা মানেই তো আশ্রয়। পথিকের খানেক বিশ্রাম। দম নিয়ে আবার পথ চলা

রাজা পাহাড় নানা রঙে রঙিন। নানা বর্নে বর্ণিল। একই শরীরে ধরে রেখেছে ঝুমকো লতার মতো নানা বিভাব। নানা ঘটনা। নানা ইতিবৃত্ত। নীলে নীল আর সবুজে সবুজ রাজা পাহাড়।

 

 

 এই লেখকের আরও লেখা... 


জ্যোতি পোদ্দারের একগুচ্ছ কবিতা







Post a Comment

0 Comments