‘তুফান’ এর ফার্স্ট লুক যখন সামনে এসেছিল, তখন থেকেই এর বিরুদ্ধে অভিযোগ- ‘কেজিএফ’ এর নকল, ‘অ্যানিমেল’ এর নকল। তারপর যখন ‘উরাধুরা’ গানটা প্রকাশ পেলো, তখন তো অভিযোগের শেষই ছিল না। শাকিব খান এবং রায়হান রাফি উভয়েই অভিযোগ তথা গালাগালগুলো প্রাপ্য। নইলে কেন রণবীর কিংবা যশের লুক ধার করতে হবে? কেন পোশাক-আশাকে মিল রাখতে হবে? আর প্রীতম হাসান যখন ‘মরার কোকিল’ আর ‘বান্ধবী লতিতা’ গানের সুরের সংমিশ্রণে একটা জগাখিচুড়ি বানিয়ে নিয়ে আসে, তখন কেন সেটা ছুড়ে ফেলে দিলো না? নাকি অনুমতি নিয়েই বানিয়েছিল?
মানুষ যদি সজ্ঞানে অভিযোগ, নিন্দা, কটাক্ষ, গালাগাল ইত্যাদি অর্জন করতে চায়, তখন কিছু বলার বা করার থাকে না। ও ভালো কথা, রায়হান রাফি আরেকটা অপকর্ম করেছেন নব্বইয়ের দশকের ঢাকা দেখানোর কথা বলে কলকাতা দেখিয়ে। আচ্ছা, ছবির এই অংশটুকুর শুটিং কি ঢাকায় করা উচিত ছিল না? যেটা উচিত কাজ, সেটা না করলে তো তিতা কথা শুনতেই হবে। আসলে আমি চেয়েছিলাম ছবিটার প্রশংসা করতে। কারণ, ছবিটা আমার কাছে ভালো না শুধু, খুবই ভালো লেগেছে। যদি ভালো না লাগতো, তাহলে যে সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেটা করতাম না। আসলে ভালো একটা জিনিস যদি কেউ এমন কিছু জিনিস দিয়ে বিতর্কের মুখে ঠেলে দেয়, যেগুলোর দরকার ছিল না, যেগুলো চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যেত- তাহলে কষ্ট লাগে।
‘তুফান’ সিনেমার গল্পের গাঁথুনি অত্যন্ত মজবুত এবং নিখুঁত। থ্রিলার গল্পের নিজস্ব এবং আলাদা একটা ‘চরিত্র’ আছে। যে চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ছোট কোনো শব্দ, বাক্য বা জিনিস দিয়ে বড় অর্থ প্রকাশ করা। ক্ষেত্রবিশেষে সেই ‘ছোট’র উপরে পুরো গল্প দাঁড় করিয়ে দেওয়া। মিমির একটা সংলাপ আছে। পরিচালককে সে বলে, এডিটিংয়ের সময় সে প্যানেলে থাকবে। সংলাপটা যখন সে দেয়, তখন অন্য দশটা সাধারণ সংলাপের মতোই মনে হয়। কিন্তু সিনেমা হল থেকে বের হতে হতে যখন আপনি সংলাপটার কথা স্মরণ করবেন, তখন আপনার মনে হবে- কী দুর্দান্ত একটা থ্রিলার গল্প দেখলাম। আর যদি সংলাপটা আপনি স্মরণ করার প্রয়োজন মনে না করেন, তাহলে মনে হবে- ধুর, গল্পের কোনো আগা মাথা নেই।
‘তুফান’ এর গল্প দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা সংলাপের উপর। সংলাপটা চঞ্চল চৌধুরীর। তিনি বলেন, অন্যদের কাছে তুফানের একটা ছবি থাকলেও তার কাছে আছে তিনটা। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, তুফানের সঙ্গে তার সম্পর্ক অন্যদের চেয়ে অন্যরকম। তবে সংলাপটা ‘তুফান-১’ এর জন্য প্রযোজ্য না। প্রযোজ্য ‘তুফান-২’ এর জন্য। তার মানে এই সিনেমাটার গল্প বোনা হয়েছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। দর্শক যদি কোনো কারণে বুননটা ধরতে না পারেন, গোটা সিনেমাকেই এলোমেলো মনে হবে। আমি যে খুব বুজুর্গ দর্শক, তা না। তবে আজকাল আমি থ্রিলার উপন্যাসই বেশি লিখছি। আর লিখতে গিয়ে যেসব বিষয়ে গভীর থেকে গভীরতম মনোযোগ দিই, এই ছবির পরিচালককেও সেসব বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী হিসেবেই পেয়েছি। যে কারণে গল্পের গাঁথুনি নিয়ে কোনো সমালোচনা করতে পারছি না। অথচ কী সানন্দ সমালোচনাই না করেছিলাম ‘রাজকুমার’ দেখে!
আমার সংসারজীবন প্রায় ১৭ বছরের। মানে আসছে সেপ্টেম্বরে ১৭ বছর হবে। তবে আমার বউয়ের সঙ্গে আমার (সিনেমা-সংক্রান্ত) পছন্দের পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল। যেহেতু সে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছে এবং বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই শিক্ষকতা করছে, তাই বাংলা ছবির প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। বাংলা গল্প-উপন্যাসের প্রতিও না। তবে সে ইংরেজি ভাষার প্রচুর বই পড়ে, প্রচুর সিনেমা দেখে। শাকিব খানের ব্যাপারে কয়েক বছর আগেও তার মন্তব্য ছিল- ‘এমনিতে নায়কের মতোই, কিন্তু অভিনয়ের সময় সালমান খানকে নকল করে।’এখানে বলে রাখা ভালো, দর্শক হিসেবে সে দুর্দান্ত। সিনেমার কোনোকিছুই তার চোখ এড়ায় না। কিন্তু আমার এড়ায়। যে কারণে গল্পের অনেক মোচড় সম্পর্কেই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হয় তার কাছে।
আমাদের প্রায় ১৭ বছরের দাম্পত্যজীবনে আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি ২টা। ‘প্রিয়তমা’ এবং ‘তুফান’। প্রিয়তমা’ দেখে সে মুখটুখ পানসে বানিয়ে বলেছিল- ‘ভালোই।’ আর ‘তুফান’ দেখে সে যে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছে, সেটাকে মুগ্ধতা না বলে বিস্ময় বলাই শ্রেয়। যেহেতু বিশ্বখ্যাত থ্রিলার উপন্যাসগুলো তার পড়া, থ্রিলার ছবিগুলো তার দেখা, অতএব আমি ধরেই নিয়েছিলাম সে একশটা দোষ ধরবে। কিন্তু হলো উল্টোটা। তো রিভিউতে নিজের কথা বলতে গিয়ে বউয়ের কথা নিয়ে আসার কারণ- গল্পের যেসব মারপ্যাঁচ আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে মানে আমি বুঝতে পারিনি, সেগুলো বুঝেছি বউয়ের সহায়তায়। অতঃপর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, ‘তুফান’ এর গল্পটা একটা মজবুত এবং নিখুঁত থ্রিলার গল্প।
শুরুতেই বলছিলাম ‘উরাধুরা’ গানের কথা। সংশ্লিষ্টরা মূল সুরকারকে ক্রেডিট দিলে মামলা থেকে বেঁচে যান। কিন্তু তাতে দর্শক-শ্রোতার কোনো লাভ হয় না। তারা মূলত নকল সুরের গানটাই শোনেন। ‘উরাধুরা’ গানের সুরের ক্ষেত্রে কাকে কাকে যেন ক্রেডিট দিয়ে রায়হান রাফি বা প্রীতম হাসান মামলা থেকে বেঁচেছেন। কিন্তু দিনশেষে এটাই সত্য- গানটার সিংহভাগ সুরই চুরি করা। আর এই হুজুগেই ‘দুষ্টু কোকিল’ গানের সুরকেও নকল বলা হয়েছে। কিন্তু যতগুলো প্রমাণ সামনে এসেছে, আমি প্রত্যেকটা মেলানোর চেষ্টা করেছি। মেলেনি। তার মানে ‘দুষ্টু কোকিল’ গানটা নকল সুরের গান না। আর ‘নদীর বুকে চর’ এই অংশটার মতো ক্যাচি সুর সর্বশেষ কবে শুনেছিলাম, মনে পড়ে না। অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর।
সিনেমার প্রথম গানের শিরোনাম- ‘আসবে আমার দিন’। হাজারবার শুনলেও এই গান আমার ভালো লাগবে না। একেবারেই নিরামিষ একটা গান। হাবিবের গানটা যে খুব আমিষযুক্ত, তাও না। আর টাইটেল গানটা পাস মার্ক পাওয়ার মতো। সুরটা ক্যাচি হলে, কণ্ঠটা জেমসের হলে নাম্বার বাড়িয়ে দেওয়া যেত। নিদেনপক্ষে ‘পাওয়ার ভয়েস’ এর সজল হলেও চলতো। ভয়েস- এর কথা যখন আসলো, শাকিব খানের ভয়েস নিয়ে একটু বলা যাক। মূলধারার সিনেমার নায়কদের মধ্যে রোশানের ভয়েস অনন্য, অসাধারণ। শুভ’র ভয়েসও মন্দ না। আর অন্যদের ভয়েস চলনসই। এই কথা নায়করাজ রাজ্জাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, সালমান শাহ’র ক্ষেত্রেও, শাকিব খানের ক্ষেত্রেও। তবে চিল্লানোর দৃশ্যগুলোতে শাকিব খানের ভয়েস বাঘের গর্জনের মতো লেগেছে। অসাধারণ!
গাজী রাকায়েত- কী দারুণ! কী দারুণ!! ফজলুর রহমান বাবু- অত ‘পশ’ চরিত্রে তাকে ভালো লাগেনি। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের দ্বিতীয় সিনেমাটার নাম যেন কী? ওই সিনেমার ‘ক্ষ্যাত’ টাইপের ভিলেনের চরিত্র তাকে বেশি মানায়। চঞ্চল চৌধুরীর চরিত্রটা নিয়ে ভয়ে ছিলাম। কারণ, ‘পরান’ সিনেমায় মজার সংলাপ বলাতে গিয়ে রায়হান রাফি পুলিশ কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন খানকে দিয়ে যে সস্তা আর ওজনহীন সংলাপ বলিয়েছেন, চঞ্চল চৌধুরীকে দিয়ে না আবার এমন সংলাপ বলান। কিন্তু না, তার সংলাপে ওজন ছিল। ভালো লেগেছে। নাবিলাকে চলনসই লেগেছে। আর মিমি? চোখ ধাঁধানো। এমন চরিত্রে এমন নায়িকারই প্রয়োজন ছিল।
‘মনপুরা’ যখন মুক্তি পায়, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকি সূর্যসেন হলে। তখন সিনেমা দেখতাম রুমমেটদের মৌখিক রিভিউ শুনে। ‘মনপুরা’র ব্যাপারে প্রথম রিভিউটা ছিল এমন- ‘পুরানা গল্প, নতুন কিছু নাই।’ অথচ সেই ‘মনপুরা’ চলে গেছে কালজয়ী বাংলা সিনেমার তালিকায়। ‘প্রিয়তমা’র যে গল্প, এই ধরনের সস্তা প্রেমের গল্পে জীবনেও আমি উপন্যাস লিখতে বসবো না। অথচ হালের সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল সিনেমা এটা। এইসব ছবির গল্পের সঙ্গে ‘তুফান’ এর গল্পের ব্যবধান রাত-দিন। তবে থ্রিলার গল্পের ভাষাটা বোঝা জরুরি। থ্রিলার পরিষ্কারভাবে কিছু বলে না। ইঙ্গিত দিয়ে যায়। ইঙ্গিতটা ধরতে না পারলে পুরো গল্পকে আবর্জনা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এবার তাহলে শেষ করি। যেতে যেতে বলি- ‘তুফান’ এর মূল সৌন্দর্য গল্প এবং শাকিব খানের অভিনয়ে। এদিকে গান তো আছেই। ‘নদীর বুকে চর, আমি কি তোর পর...’ উফ! তবে নায়কের লুক এবং পোশাকের স্টাইল নকল করার অপরাধে পরিচালককে গালমন্দ করার দরজা খোলা রাখা যেতে পারে। আরে বাপুরে শাকিব খানের চুল আর্মিকাট থাকলে সমস্যাটা কী ছিল? নব্বই দশকে কি আর্মিকাট ছিল না? পোশাকের জায়গায় পাঞ্জাবি-পায়জামা বা টি-শার্ট-জিন্স থাকলে সমস্যাটা কী ছিল? নব্বইয়ের দশক বোঝাতে ওই চুল আর ওই পোশাকই লাগবে? আমি নিজেও তো নব্বইয়ের দশক পার করে এসেছি। আমার স্টাইলটা ফলো করতে পারতো না?
0 Comments