স্বপ্নের পিছু ছুটে চলা জীবন

নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে লেখক

পৌঁছাবার কথা ছিল মধ্যরাতে, প্লেন দেরি করায় অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘ ট্রানজিট। বিমান বন্দরে ক্লান্তি আর ফেলে যাওয়া জীবনের বিষন্নতা নিয়ে পায়চারি, অলস বসে থাকা-সাথে ঝিমুনি। শুধু বিষন্নতা না­-স্বপ্নকে ছোঁয়ে দেখতে আকাঙ্ক্ষিত অপেক্ষমান জীবনের হাতছানির অজানা পুলকও ছিল। তবে ট্রানজিটের ঝক্কি না হলে হয়তো ভালো হতো। ওইতো কথায় বলে অনেক জ্বালে তবে না মিষ্টি।  

অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে পুরো ষোল ঘন্টা পর এসে নামলাম ডুরহাম, নর্থক্যারলিনা। দেশ ছেড়ে আসা আর দীর্ঘ যাত্রাপথ আর পথের সাথীদের গল্প না হয় আজ তোলাই থাকুক। আজ শুধু র‍্যালের গল্প। গাড়িতে আসতে আসতে চারপাশের সবুজ খুব প্রশান্তি দিলো, উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথ, কোলাহলহীন শান্ত শহর, কিছুটা আপন আপন লাগলো এই শহরটাকে। ছোট বোনের বাসায় এসে উঠলাম, আমাকে নামিয়ে দিয়েই ভাই ছুটলেন ল্যাবে, ব্যস্ত জীবন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এখানে ছুটতে হয়। দেশে তখনো মধ্যরাত। ফ্রেস হয়ে বোনের কল্যানে ছোট খাটো একটা ভূরিভোজন। দুদিন প্লেনের খাবারে জিভের স্বাদ চলে গিয়েছিল, ভাত হৃদয় জুড়িয়ে দিলো। খুব ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে, এসেই একটা পরিচিত পরিবেশ-আপন মানুষ পেলাম।  

নতুন বন্ধুদের সাথে লেখক

এক কাপ কড়া দুধ চা খেয়ে একটু পথের গল্প। খুব বেশি সময় আর চোখ খোলা রাখা গেলো না। কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা, প্রায় মধ্যরাত হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলো, অনেকক্ষন লাগলো বুঝতে কোথায় আছি, সিলিং ফ্যানটা উধাও, চারদেয়ালে অন্য রং, জানালার ওপাশে অপরিচিত গাছ, ল্যাম্পপোস্টে অন্য আলোর খেলা, শুনশান একটা শহর। ক্লান্তি এবং প্রচন্ড বিষন্নতা ঘিরে ধরলো একই সাথে। 

যখন সন্ধ্যা নামে 

শহর আমার না, আমি শহরের না, এই দেশের না। আমার দেশটা আট হাজার মাইল দূরে। আমাদের ঘড়ির কাটা আর একলয়ে ঘুরবে না, একসাথে আর কখনো চাঁদ উঠবে না, বৃষ্টি নামবে না। চাইলেই আমি আমার ঘরটায় ছুটে যেতে পারবো না। আমার শৈশব, দুরন্ত কিশোরবেলা, যৌবনের উচ্ছ্বাস, ভুলে ভরা হাজারো গল্প, একটু একটু করে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া, ইট পাথর ঠাসবুনোটের শহর, সব, সব বহু দূরে ফেলে এসেছি আমি। মনটা হুহু করে উঠলো। ক্লান্তি আর বিষন্নতা নিয়েই বাইরে চোখ রাখলাম। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় জ্বেলে শহর ঘুমাচ্ছে।  শুধু মাঝে মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো কি যেন ডেকে যাচ্ছে। সারা দিনের চলার শেষে আকাশেরও বুঝি ক্লান্তি পেয়েছে। স্থির দাঁড়িয়ে ঝিমিয়ে নিচ্ছে, মেঘেদের ছুটা নেই, তারারা স্থির। ভিতরটা কেমন অকারণের খালি খালি লাগলো। মনে পড়ে গেল অর্ণবের গান-

রেতের বেলা একলা এখন

জিরোচ্ছে সব শহরতলী

চোখ দুটো খুব পড়ছে মনে

এই কথাটা কেমনে বলি

পরদিন ওয়ালমার্ট, প্রবাসজীবনের প্রথম স্টপেজ। খুঁটিনাটি হাজারো জিনিস, চাল-ডাল, সাবান-শ্যাম্পু হাড়ি-পাতিল কি ওঠেনি ট্রলিতে! সব কিছু নিজের এখানকার আস্তানায় এনে রাখা। সামনের এক বছরের জন্য লিজ নেয়া শেয়ারড বাসাটা তখনো শূণ্য, বাকি দুই রুমমেট অন্য শহরে। ছিমছাট ছোট্ট সুন্দর একটা বাসা, বেশ খোলামেলা, পেছনে পোর্চ ঘেঁষা এক চিলতে উঠোন,বেগুনী রঙের অচেনা ফুলে ভরা গাছ দিয়ে আড়াল করা, শান্ত আবাসিক এলাকা। বাসার দরজা খুললেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে একটা ল্যাম্পপোস্ট,  আমার রুটিন তার জানা। পাশেই মেইলবক্স, জগতে আমার জাদুর বাক্স, কত চিঠি আসে প্রতিদিন। বেশিরভাগই অবশ্য অফিশিয়াল, তবে হুটহাট শরতের বাতাস নীল খাম নিয়ে আসে, গোটা হরফে আমার নাম লেখা থাকে খামে, দিনটা হঠাত সুন্দর হয়ে যায়। পাঁচ মিনিট হাটা পথ শেষে বাসস্ট্যান্ড। আবারো লাল বাস, প্রাক্তন; তবে এবার পাশে সাদার ছোপ, একেবারে ঘড়ি ধরে ছুটে চলা, প্রায়ই আমায় পেছনেই রেখে যাওয়া উলফলাইন।

বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে লেখক

প্রথম দিনগুলো গেলো হাজারো আনুষ্ঠানিকতায়, এক দালান থেকে আরেক দালানে ছোটা, ডিপার্ট্মেন্ট, প্রফেসর, আইডি, ব্যাংক, হেলথ ইন্সুরেন্স। ধীরেসুস্থে মানিয়ে নেয়া, তালে তাল মেলানো। অতীত হাতড়ে বাসা গোছানো, বাজার সদাই, একার রান্না, ঘড়ি ধরে ছোটা জীবন। ওরিয়েন্টেশন, হাজারো অচেনা মানুষ, বিভিন্ন দেশ ভাষার কলকাকলি। প্রতি মুহূর্তে শুধু মনে হওয়া, “আমি এখানে কেনো! মানাচ্ছে না, এক্কেবারে মানাইছে না রে।তারপর নিজেকেই বোঝানো,“আমি এখানে, এটাই অনেক, এখানেই আসতে চেয়েছি বহুদিন ধরে, এটাই নতুন পথের শুরু।

র‍্যালের আবাসিক এলাকার মনোরম প্রকৃতি

শহরে হাটতে বেশ লাগে, দুধারের গল্প আর কুশিলব আমার বড় প্রিয়। আগস্টে বেশ গরম ছিল, বিশেষ করে দিনের বেলায়। গুটিগুটি পায়ে শীত আসছে, বেশ একটা ঠান্ডা বাতাস, সকালে ঘাসের উপর শিশিরের প্রলেপ। গাছের পাতারা রং বদলাচ্ছে, অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ, ছাতিমের মাদকতা ভরা। শরতের পেঁজা তুলোয় ছাওয়া আকাশটা মাঝে মাঝেই মুখ গোমড়া করে রাখে। পাখিদের ওড়াউড়ি আর কাঠবিড়ালির দুরন্তপনা পথজুড়ে। ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে জীবনানন্দের চিল যেমন ঘরে ফিরে, আমাকেও তেমনি ফিরতে হয়। এখনো এখানে দিন দীর্ঘ, তবু বাসায় ফিরতে ফিরতে দিন ফুরোয়। কিংবা দিন ফুরিয়ে আসলেই ফিরি হয়তো, শুধু নিজের কাছে কার ফিরতে ইচ্ছে করে! তবুও ফিরতে হয়, শঙ্খ ঘোষের মতো-

তেমনি আবার ফিরতে হবে সত্যি
নিজের নিজের মন খারাপের গর্তে

দিন শেষে নতুন একটা ঠিকানার সামনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকি, মেইলবক্সে উঁকি দেই। ল্যাম্পপোস্টের মলিন আলো, আকাশে মিটিমিটি তারা, আস্তানার বাইরে ঝিঝির গান, মন শুধু অতীতে ঘোড়া ছোটায়। জীবনের সবচেয়ে অপ্রিয় কাজ, দরাজা খুলে অন্ধকার বাসায় ঢোকা, আলো জ্বেলে একটা দীর্ঘশ্বাস, ধীর পায়ে স্বপ্ন বোঝাই ব্যাগ কাধে নিজের রুমে ফিরি। মনে মনে হিসেব চলে, ভোর হলো কি বাংলাদেশে, সেই আসল পৃথিবীটায়...

 

লেখকঃ জান্নাতুন নাঈম রুমী

পিএইচডি গবেষক, নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট  বিশ্ববিদ্যালয়, র‍্যালে, আমেরিকা।   

Post a Comment

0 Comments