ঈদুল আযহায় যতগুলি ওয়েব সিরিজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পেরেছে সেসবের মধ্যে ‘মাইসেলফ অ্যালেন স্বপন’ অন্যতম। সিরিজটির শুরু থেকে শেষ অব্দি দর্শকদের অপেক্ষায় রাখিয়েছে–এরপর কি? এর পর কি? ক্যামেরার কাজও ছিল চমৎকার, ক্লোজ সর্ট থেকে নিয়ে লং শর্ট সবই ছিল প্রয়োজন অনুযায়ী। কক্সবাজারের প্রত্যন্ত লোকেশন, নাফ নদী কিংবা ঢাকার অলিগলি সবই গল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়েছিল। মিথিলা আর নাসির উদ্দিন খান ছাড়া প্রধান চরিত্রে পরিচিত মুখ আর কাউকেই কাস্ট করা হয়নি কিন্তু সবাই নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মাদকের গল্প, প্রতারণা, লোভ আর যৌনতা নিয়ে সিরিজের কাহিনী। সিরিজের প্রথম থেকেই প্রতারণা শুরু হয়েছে। স্বপন রূপী নাসির উদ্দিন বন্ধুর টাকা মেরে দেয়, প্রতারণা করে নিজের যমজ ভাইকে হত্যা করে পুলিশের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসে, তারপর ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করে নিজেকে তার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেয়, নিজের ছেলের সাথে প্রতারণা করে পরিচয় গোপন রাখে। দেখানো হয়েছে পাচার কিংবা কিভাবে কর ফাঁকি দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যায়। কিন্তু মূলত সেই প্রতারণার গল্পের আড়ালে বর্তমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনের অপব্যবহারই এই সিরিজের মূল উপজীব্য হয়ে বেশি বেজেছে।
ফ্রয়েডের মতে মানুষের সব কাজের পিছনে প্রকাশ্য অথবা সুপ্ত যৌনচেতনা কাজ করে। এই সিরিজের কেন্দ্রিয় চরিত্র নাসির উদ্দিনের প্রকাশ্য যৌনচেতনাই দর্শকদের টেনে রেখেছে। নিজের অবচেতন যৌন চেতনা দর্শকরা হয়তো নাসির উদ্দিনের ভিতর দেখতে পেয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় কেন্দ্রিয় নারী চরিত্র মিথিলার যৌন চেতনা ততটা প্রকাশ্য নয়–তাই বলে যে অনুপস্থিত ছিল তা বলা যাবে না। কারণ প্রাথমিক শঙ্কা, ঘৃণা আর প্রতিবাদের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে যখন ঘুমের আগে শোবার ঘরের দরজা খুলে দেয় মিথিলা তার মধ্যে সুপ্ত যৌন চেতনার খোঁজ পাওয়া যায়।
তবে মিথিলা যখন জানতে পারলো সে নকল স্বামীর সাথে একই ঘরে থাকছে, শুচ্ছে–ঘুমাচ্ছে, বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের একজন রক্ষণশীল নারী হিসেবে তার ভিতর যে অনুশোচনা বা প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবার কথা ছিল সেটা তার অভিনয় ফোটে উঠেনি–কিংবা পরিচালক মিথিলার কাছ থেকে সে অভিনয়টা আদায় করে নিতে পারেননি। নাসির উদ্দিনেরও কিছু কিছু জায়গায় অভিনয়ের সাথে অভিব্যক্তি কম সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। অতটুকু বাদ দিলে তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন।
সিরিজের একটা পর্যায়ে এসে মিথিলা নাসির উদ্দিনকে ভালোবেসে ফেলে বলেই প্রতীয়মান হয়। কান্টের নীতি অনুযায়ী এ ভালোবাসা শর্তহীন নয়–শর্তসাপেক্ষ। কারণ মিথিলা যখন জানতে পারে তার আসল স্বামী–স্বপনের যমজ ভাই বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে তখন নিজের আর মেয়ের নির্ভরতা আর নিরাপত্তার জন্যই স্বপ্নকে সে মেনে নেয়–ভালোবাসে। স্বপনও তাকে সুন্দর ভবিষ্যৎ আর অর্থ-বিত্তের লোভ দেখায়। তাতেই শায়লা নামী মিথিলা সব ভুলে টানাটানির সংসার থেকে হাঁপ ছাড়তেই লোভের ফাঁদে পড়ে নীতি থেকে বিচ্যুত হয়। সেই যে নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছিল সে আর কখনও নীতির বৃত্তে ফিরতে পারেনি। সিরিজের এক পর্যায়ে স্বপনের ছেলে যখন জানায় যে তার বাবাই শায়লার স্বামীকে হত্যা করেছে, শায়লা প্রতারিত হয়েছে তাতেও মিথিলার ভিতর প্রতিবাদী নীতি সত্ত্বা জাগ্রত হয় না। হয়তো উপমহাদেশীয় নারীদের অসহায়ত্ব আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাই এক্ষেত্রে কাজ করে থাকবে। গল্পকার সেই বলয় ভেঙ্গে নীতি শাস্ত্রের পাঠ নিতে পারেননি। তাইতো মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও মিথিলা স্বপনকে তার স্বামী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছে।
স্বপনের লোভ, বিত্তবৈভব আর নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তার ছেলে জাদু জীবন দেয়। ছেলের মৃত্যুও তার ভাবাবেগে প্রবল ভাবে নাড়া দিতে পারে না। আর ব্যস্ততম ঢাকার রাস্তায় মৃত ছেলেকে নিয়ে মাক্রবাসে করে বাড়ি ফেরার দৃশ্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার–যা গল্পকে দুর্বল করে দিয়েছে।
লেখা: আকাশ মামুন
0 Comments