মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ রাজাকার


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। বিভিন্ন পেশা বয়স, ধর্ম-বর্ণ গোত্রের মানুষ এতে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। ঠিক তেমনই বড় একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। যারা পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে ছিল না। পাকিস্তানিদের সাথে সেসব দেশ বিরোধীরা মিলেই ধর্মের দোহাই দিয়ে যুদ্ধটাকে ভিন্ন খাতে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েই রইলধর্মযুদ্ধের রূপ নিল না।  কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বামপন্থী ধারার রাজনীতি যে বয়ান তৈরি করল তাতে সুচতুর ভাবে মুসলিমদেরকে রাজাকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। এবং দাঁড়ি টুপিকে তার প্রতীক দেওয়া হলো। যদিও রাজাকার কিংবা পাকিস্তানি সেনাদের পোশাক দাড়ি-টুপি নয়, নির্দিষ্ট খাকি ইউনিফর্ম ছিল। 

যাই হোক বামপন্থীদের তৈরি করা সে বয়ান স্বাধীন দেশের সাহিত্য ও সিনেমাতে গ্রহণ কর্মা হলো। ফলে সিনেমাতে রাজকারের চরিত্র চিত্রায়নে দাঁড়ি টুপি তসবিই মুখ্য হয়ে উঠলো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুল ইতিহাস হিসেবেই সেটাকে গ্রহণ করে নিল। এ কথা সত্য কিছু ইসলামপন্থী দলের লোক একাত্তর পাকসেনাদের সাহায্য করে মুক্তিদের বাড়ি চিনিয়ে দিতো তবে সবাই যে দাঁড়ি-টুপি ওয়ালা ছিল তা নয়। কেউ কেউ সাধারণ বেশভূষাতেও একই কাজ করেছে। তবে কোন সিনেমা বা সাহিত্যে তা খোঁজে পাওয়া দুষ্কর।

 

সংখ্যায় কম হলেও হিন্দু এবং খ্রিষ্টানদের কেউ কেউ যে রাজাকার ছিল সেটা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যেতে থাকল। সে হিন্দু রাজাকারদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাও বনে গেল। সম্প্রতি দামাল ছবিতে রাজাকারের মুখে নারায়ে তাকবীর ধ্বনিও দেওয়া হয়েছে। অথচ ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় ভাটি অঞ্চলে জগতজ্যোতি দাসের মতো হিন্দু মুক্তিযুদ্ধারাও মুসলমানদের সাথে গলা মিলিয়ে নারায়ে তাকবীর দিয়েছে। 

এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক কয়েক জন হিন্দু ও খ্রিস্টান রাজাকারের নাম। তবে এর বাইরেও অনেক আছে নিশ্চয় যাদেরকে খোঁজে বের করা ইতিহাসের দায়। একদিন সত্য ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। 

বরিশালের বাম নেতৃ মনিষা চক্রবর্তীর বাবা এডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী এবং ঠাকুর মা ঊষা রাণী চক্রবর্তী একত্ত্বরে রাজাকার ছিলেন। সরকারি নথিতেই ২০১৯ সালে তা ওঠে আসে। ওই তালিকায় বরিশালের ২৬ জন হিন্দু রাজাকারের তথ্য উঠে আসে। যাদের মধ্যে ৫ জন নারী ছিল। তবে এডভোকেট তপন কুমার চর্কবর্তী এখন ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বরিশালের এডভোকেট প্রমোদ সেন গুপ্তের নামও এ তালিকায় আছে। তিনি বরিশাল জেলা শান্তি কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন।

সাওতাল এবং গারোরা সরাসরি পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আর চাকমারা নেয় পক্ষে সাথে মিজোরাও ছিল। মগরা নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে আবার পাকিস্তানীদের বার্মায় পালাতেও সাহায্য করেছে। এটা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্তগোষ্ঠী প্রধানের নির্দেশ মেনে উপজাতিরা পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে নিজেদের স্বায়তশাসন টিকিয়ে রাখার চিন্তা থেকে। তবে এর বাইরেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছে। 

চাকমা গোষ্ঠী প্রধান ত্রিদিব রায় রাজাকার ছিলেন। ১৯৭২ সালের দালাল আইনে তার নাম অন্তর্ভূক্ত হয়।  ত্রিদিব রায় ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২সালে পাকিস্তানে মারা গেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা উপজাতির ৫০তম রাজা ছিলেন। ১৯৫৩ সালের ২ মে থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি রাজা ছিলেন। বিশুদ্ধানন্দা মহাথেরোও স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন। তবে তার নাম রাজাকারের নথি থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। যিনি ২০০৫ সালে একুশে পদকও পান। পিনাকী ভট্টাচার্যের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম বইতে উল্লেখ আছে।

 

খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও রাজাকারের তালিকার বাইরে নয়। রঞ্জনা বিশ্বাসের গবেষণায় উঠে এসেছে গোপালগঞ্জের প্রিয়লাল বাডৈ আর শ্যমুয়েল মাঝি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। দুজনেই শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন প্রিয়লাল বাড়ৈয়ের কুখ্যাতি এতই বেশি ছিল যে লোকে তাকে খান সাহেব বলে ডাকতো। 

 

এতো গেলো নির্দিষ্ট জেলার হতে গোনা কয়েকটি নাম। সারা বাংলাদেশের তালিকা করলে সেটা নিশ্চয় দীর্ঘই হবে। আর ইতিহাসের দায় মেটাতে নিশ্চয় একদিন সেসব স্বাধীনতা বিরোধীদের নাম সবার সম্মুখে আসবে। 


Post a Comment

0 Comments