যে খোঁজে অবাক শূন্যতায় সম্পর্কের দাগ ।। যযাতি দেবল



তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলায় ১৯৫৫ সালে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ সেখানেই। তারপর চলে আসেন দূর্গাপুরে। কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতায়। বর্তমানে অবসর জীবন পার করছেন। ইতোপূর্বে ভ্রমণ সাহিত্য ও উপন্যাস লিখলে অখ্যাত স্টেশনের ফেরিওয়ালা তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বইটি পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যযাতি দেবল

 

তারাশংকরের কবিতায় কিছু মায়াছবি আছে।সেই ছবিগুলি অদ্ভুত সরলতায় ঘেরা স্বপ্নের সুতোয় ঠাসবুনোট। তাই তার বুকের ভিতরে কেউ কিছু ভাঙে আর গড়েএই ভাঙাগড়ার খেলা দেখতে দেখতে সে নম্রস্বরে বলে তোমার সমস্ত পাওনা অঘ্রাণে মেটাবো। অর্থাৎ ফস‍লের মাসে। পরক্ষণেই তার ঋজু উচ্চারণ 'দেবতার মেঘ হতে রাজি নই।

 

অন্বেষণ অমরাবতীজীবনই তার প্রিয় আবদার। কবিতার পরতে পরতে অনুভব করে অদৃশ্য শিকলের। অবাক শূন্যতায় খুঁজে পায় সম্পর্কের দাগ। আসলে তারাশংকরের কবিতা বুঝতে বোদ্ধা হবার দরকার পড়ে না। দরকার ভালবাসাপ্রীতি দিয়ে চেনা। কারণ প্রতিটি কবিতাই প্রীতি দিয়ে লেখা। তা বলে তার কবিতা নয় শুধু সমর্পণ। সে পা দেবেনা ঋণের ফাঁদে। বরং আশ্চর্য দৃঢ়তায় স্পষ্টবাক্ "যতই সহজলভ্য হোক কোন মূর্খ ঋণ নিতে যাবে...?" আসলে কবি "স্বপ্নচারা রোপণ করে তৈরি কাদায়।" সে উদাসীন কিছুটা বাউলের মতো। কক্ষচ‍্যুত ধুলোকেও সারসত‍্য ভাবে। "এজন্য কবি নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও দরজা ছুঁয়ে পড়ে আছে আজীবন। যা চৈত্রের খড়কুটো হয়েও সেটি অনির্বাণ আলো হতে পারে।

 

শহরে থাকলেও কবি "শীতের তুমুল ধুলোমাঠভাঙা রোদকুয়াশার মায়া নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। আর অক্লেশে শহরকে বলে দেয় "আমার মাথার ঘাম পা পর্যন্ত ফেলে দিয়ে সেরেছি প্রণামী।"

 

সম্ভ্রম জাগানো তার অক্ষরের স্তূপ। অথচ তার মধ্যেই তাঁকে ছুঁয়ে যায় তারুণ্যের চাপল‍্যস্মৃতিধার্য হয়ে থাকে "সবুজ স্কার্টের মুচকি হাসি।" এবং একইসঙ্গে বলে ওঠে

'বন্ধু তোদের সঙ্গ পেলে

আবার ডুবে ভাসতে পারি।'

আবার তারপরেই জলদ উচ্চারণে বলে দেন "একবার সম্মতি দাও। ছুঁয়ে দেখি কতটা উত্তাপশুনে দেখি বাজে কোন রাগ আজন্ম অতৃপ্তি নিয়ে প্রতি অঙ্গে লাগুক দহন।"

 

তারাশংকরের এক পা গাঁয়ে এক পা শহরে আবার কখনও চেনা গাঁ শহর ছেড়ে দূরেদূর বিদেশে দেশান্তরেসব মিলিয়ে মিশিয়ে সে তৈরি করতে চায়খুঁজে নিতে চায় সহনীয় পৃথিবী। কবিতার মরমী পাঠক সহজেই আবিষ্কার করে নিতে পারবেন অবশ‍্যম্ভাবী মাধ‍্যাকর্ষনের টানঅনন্ত যাত্রা। যে জানে কোনো যুদ্ধে জয় নেই সেই সত্য।

 

'অখ্যাত স্টেশনের ফেরিওয়ালাকবি তারাশংকর সময় সচেতন। জানে বর্তমান সময়ের এই অদ্ভুত আঁধারকে। জানে কারা অন্ধকারকে আলো ভাবতে প্ররোচনা দেয়। তীব্র শ্লেষে বলেন সংখ্যা মানেই আধিপত্য। জানে অশিক্ষিতের অহংকারের ক্ষয়িঞ্চুতাকে। কিন্তু আশাবাদী তাই তার দৃঢ় উচ্চারণ "অন্ধকারেই জ্বালতে হবে আলো"। 

 

তাইতো 'কালরাত্তিরকবিতায় পাই "আগুন জানে কোনটা পোড়া কোনটা ভিজে" এখানেই এক আশ্চর্য সমাপতনে স্পর্শ জাদুর দাগ মুছে যায় যা "আসলে এক কালরাত্তির সবকিছু খায়।" 

 

কবির ভিতরে বসত করে একটি বাউল মন। 'তার চোখ খুঁজে ফেরে দারুণ দহন দিনে বৃষ্টি ভেজা ঠোঁট।সে এক ছুটে যায় গাঁয়ে গঞ্জেকাটোয়া লোকালেরসিকের জমাটি আসরে।

 

একইসঙ্গে না ভাবা কথারা কবিতার শরীর নিয়ে বহিরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে স্বচ্ছন্দে বলে দেন "তোমার কোনো চিহ্ন পড়ে নেই।"

 

এ বইয়ের প্রতিটি কবিতায় রয়েছে উদ্ধৃতিযোগ্য লাইন। কবিতার বহুমাত্রিকতা এ বইয়ের বিশেষত্ব। তাইতো স্বচ্ছন্দে বলে দেয় অনেকবার পুড়েও আবার আগুন ছুঁয়েছি। এবং একইসঙ্গে আমার মনে হয়তার কবিতার ধ্রবপদ–

'প্রণামে মেটেনা তৃষ্ণা প্রণাম তো আত্মীয়তা নয়'

"সময় তা জানে

যে কবির কাছে ঋণী তারও কাছে তুচ্ছ এ প্রণয়।"

শেষ কবিতায় সমাপ্তি টানে প্রশ্ন দিয়েই

"পুড়েছি তো কি হয়েছে

আগুনের কাছে যাবনা তা কি হয়?"



Post a Comment

2 Comments

  1. এ আমার পরম প্রাপ্তি। অভিভূত হলাম প্রিয় কবি। অজস্র ভালবাসা তোমাকে আর শুক্লপক্ষ কে

    ReplyDelete
  2. সুন্দর সব বিশ্লেষণ। যযাতি পড়েছে মনোযোগ দিয়ে, যেমনটি পড়া উচিত একঠি কবিতা সংকলন। অন্তর থেকে যে শব্দগুলি পাক দিয়ে ওঠে তাই সত্যের মাপকাঠি। এমন পাঠক পাওয়াও তো কবির সৌভাগ্য।

    ReplyDelete