আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের রাঙ্গামাটি পার্বত্য অঞ্চলে! শৈশব থেকেই পাহাড়ের পরিবেশেই আমার বেড়ে ওঠা। জন্মের পর থেকেই দৃঢ় পাহাড়কে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেখান থেকেই শিখেছি জীবনে কি করে দৃঢ়তা আনতে হয়–বেঁচে থাকতে কি ভাবে অটল দাঁড়াতে হয়। ধূসর পাহাড় যেমন দৃঢ়তা শিখিয়েছে–তেমনি পাহাড়ের সবুজ শিখিয়েছে কোমল হতে। আর উন্মুক্ত নীল আকাশ শিখিয়েছে বিশাল হতে।
পাহাড়ে এখনও খুব বেশি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। রাজধানী চাঁদের আলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঝাড়বাতি-বিদ্যুতের আলোয় ঝলমলে করে–পাহাড়ের বড় অংশ এখনও চাঁদের আলোর জন্য অধীর প্রতীক্ষা করে। এখনও কুপির আলো রাতের অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করে হেরে যায়। দপ করে নিভে যায় কুপি–সাথে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমী মানুষগুলোও রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে যায়। শান্তি খুঁজে–বিশ্রাম নেয় পরের দিনের পরিশ্রমের জন্য তৈরি হয়। আলো যেমন ঘরে ঘরে পৌঁছায়নি তেমনি অর্থ-বিত্ত আর জৌলুসের ছোঁয়াও থেকে গেছে ব্র্যাত্য। বেঁচে থাকতে নিজেদের ন্যূনতম আহারের সংস্থান করাটাই এখানে জীবন।
তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি–২০০৩ সাল! একটি মাত্র সাদা শার্ট ছিল–স্কুল ড্রেস! অদল বদল করবো সেই শার্টটা ছিল না! সপ্তাহান্তে পরিষ্কার করে সেই শার্টেই আবার পরের সপ্তাহ। ছিল না কোন ব্যাগ। বইগুলো বগলদাবা করে স্কুলে যেতাম। ছাতাও ছিল না, বৃষ্টি পড়লে গাছের নিচে দাঁড়াতাম। পলিথিনে বই মুড়িয়ে কলার পাতা-কঁচুর পাতায় মাথা ঢাকতাম। ছিল না স্কুলে যাওয়ার মতো ভালো জুতা। রাবারের সেন্ডেল পরেই স্কুলে যেতে হতো।
সেই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। অর্ধদিন স্কুল–টিফিন টাইমেই স্কুল ছুটি! ছুটির পরে আমরা ক’জন বন্ধু মিলে একটি ডুবায় গোসল করতে নেমে গেলাম। জামাকাপড় খুলে দিগম্বর হয়ে গোসল করতে নেমেছি! ঘন্টা খানিক দাপাদাপি-ঝাপাঝাপির পর পাড়ে ওঠে দেখি আমার স্কুল ড্রেসটা একটা গরু মুখে নিয়ে চিবাচ্ছে! কি করবো বুঝতেছি না। পরে বন্ধুরা মিলে কোন রকম গরুর মুখ থেকে শার্টটা বের করি–কিন্তু ড্রেসের অবস্থা একদম বাজে–শতছিন্ন! জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে–দাদার ঘরের চালের মতো। মন ভরা কষ্ট নিয়ে খালি গায়ে বাড়ি ফিরলাম। মা কে সব ঘটনা খুলে বললাম, মা একটু বকা দিল–অভাবের সংসার। পরে মা বাবাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলে। বাবা রাগ করেনি–তবে বলছে নতুন জামা কিনে দিতে একটু সময় লাগবে। পুরো এক সপ্তাহ স্কুল ড্রেসের অভাবে স্কুলে যাওয়া হয়নি! বাবা কলা ছড়া বিক্রি করে হাট থেকে একটি নতুন জামা কিনে দেয়। তারপরই স্কুলে যেতে পারি।
অভাব কি জিনিস সেই শৈশব থেকে বুঝেছি। মা-বাবার হাড়ভাঙ্গা কষ্ট দেখেছি। অতীত আমাকে বার বার কাঁদায়–তবে শিক্ষা দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনটা এখনও বড্ড অগোছালো। কোন কিছুই সাজানো হয়নি। তবে আশায় আর স্বপ্নে দিন, মাস, বছর চলে যায়–আধাঁর কেটে আলো আসুক এই প্রত্যাশা।
0 Comments