সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ইরানের যৌথ প্রযোজনায় মুক্তি পেয়েছে "দিন: দ্য ডে" সিনেমা। বড় বাজেট আর দেশ বিদেশ মিলিয়ে ছবির চিত্রায়ন হয়। ট্রেইলার মুক্তির পর থেকেই চলচ্চিত্রটি নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনা ও আগ্রহের জন্ম দেয়। শুরু হয় মুক্তির অপেক্ষা। করোনা মহামারির কারণে সেই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয়। সব অপেক্ষার পর ১০ জুলাই মুক্তি পায় প্রেক্ষাগৃহে। মুক্তির পর বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয় সিনেমাটি। আলোচনা-সমালোচনা ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো ঢাকাই সিনেমায় দর্শকদের হলমুখিতা। দর্শকহীনতায় একের পর এক হলগুলো যখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সেই সময় ঢাকাই সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ আশাজাগানিয়া। দর্শকের হলে ফেরাতে "দিন: দ্য ডে"র ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন হারুন পাশা
স্বাধীনতার পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মূল প্রবণতাগুলোর মধ্যে ছিল পারিবারিক আর সামাজিক দ্বন্দ্ব, প্রেম, আবার কখনও এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। এ সময়খণ্ডে সিনেমা হলগুলো ছিল দর্শকে ভরপুর। কিন্তু ২০০০-২০২১ পর্যন্ত দর্শক হল আর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রবিমুখ হয়েছে। তারা দেখার মতো উন্নত চলচ্চিত্র পায়নি। বেশিরভাগ হলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর ২০২২। কেননা এ বছরে হলগুলোতে আবারও দর্শক ফিরেছে। তারা সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দর্শকের মাঝে আগ্রহ জন্মাতে ‘দিন: দ্য ডে’-র ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড়ো বাজেট, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, ভালো গল্প, চমৎকার দৃশ্যায়নসহ প্রচারণার কারণে সিনেমা মুক্তির আগেই দর্শকদের কৌতূহলী করেছিল। মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহেও হলগুলোয় চলেছে এই চলচ্চিত্র।
পারিবারিক আর সামাজিক দ্বন্দ্বের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ধারণ করে নির্মিত হয়েছে ‘দিন: দ্য ডে’। এই চলচ্চিত্রে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইতিবাচকতায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলোয় যেমন নিজ দেশের সাফল্য বা কীর্তি প্রকাশ পায় ‘দিন: দ্য ডে’-তেও এরকমটাই এসেছে। যা এর আগে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি। এটা নতুন সংযোজন। ছবির শেষ দৃশ্যে খলনায়ক খালেদ যখন বলে বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ—আর গুগলে সার্চ করলে খুঁজে পাওয়া যায় না।তখন নায়ক এজে যে উত্তর দেয় তাতে কিংবা পুরো চলচ্চিত্রেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সঙ্গে নিজ দেশকেও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এজের একটা সংলাপ এরকম : ‘বাংলাদেশ আয়তনে ছোটো হতে পারে, বাংলাদেশের বুকে অনেক জায়গা’, ...‘বাংলাদেশ মানুষকে ভালোবাসে...’।
এ সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ইন্টারপোল ধারণারও সংযোজন ঘটলো। এজে ইন্টারপোলের সহযোগিতায় অপরাধী ধরতে আফগানিস্তান যায়। দুই দশক ধরে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দর্শক ছিল গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক কিংবা দোকানদাররা। নিম্নমানের চলচ্চিত্র দিয়ে উপরের শ্রেণির দর্শক টানাই চলচ্চিত্রগুলোর উদ্দেশ্য ছিল। সর্বশ্রেণির দেখার উপযোগী ছিল না। ‘দিন: দ্য ডে’ এই দূরদর্শা কাটিয়েছে। এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর সব শ্রেণি পেশার আর সব বয়সের দর্শক হলে গিয়ে সিনেমাটি উপভোগ করছে। সর্বশ্রেণির দর্শকের উপযোগী করে যে সিনেমা নির্মাণ করা যেতে পারে তা দেখালো ‘দিন: দ্য ডে’।
‘দিন: দ্য ডে’-র ট্রেইলার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ফেসবুকে বাংলা শব্দের সঙ্গে ইংরেজি শব্দ যোগ করে পোস্ট ও ছবির ক্যাপশন দিতে দেখেছি। একটা চলচ্চিত্রের নাম যে ফেসবুকারদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা দেখা গেল ‘দিন: দ্য ডে’-র ক্ষেত্রে। নামটা তারা মন আর মগজে ভালোভাবেই রপ্ত করেছে।
‘দিন: দ্য ডে’-তে সামষ্টিক বা বৃহৎ চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। এ চলচ্চিত্রের কাহিনি সস্তা প্রেম কিংবা ক্লিশে জীবনবাস্তবতায় ঘুরপাক খায়নি—যা সচরাচর বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে দেখা যায়। চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করেছে ‘দিন: দ্য ডে’। আর এ চলচ্চিত্রে দর্শন: বেঈমানের জায়গা নাই। বাংলাদেশও যে পারে উঁচুমানের সিনেমা তৈরি করতে তা দেখালো অনন্ত জলিল। এখন দেখার বিষয় এই অনুসরণ করে আমাদের চলচিত্র কতদূর যেতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক।
0 Comments