লীলাবতী ।। হুমায়ূন আহমেদ-পর্ব ৩ ও ৪

  



৩য় পর্ব 

কার্তিক মাসের সকাল সিদ্দিকুর রহমানের গায়ে ঘিয়া রঙের চাদর ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে তিনি কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন তার দৃষ্টিতে একধরনের মুগ্ধতা আছে মুগ্ধতার কারণ এই বছর শিউলি গাছে ফুল ফুটেছে হাজার হাজার ফুল গত বছর এবং আগের বছর গাছে কোনো ফুল ফুটেনি শিউলি গাছ মাঝেমধ্যে ফুল দেয়া বন্ধ করে এটা তার জানা ছিল না

ফল গাছের ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায় সব আমগাছে প্রতিবছর মুকুল আসে না ফুল গাছের ক্ষেত্রে এই ব্যাপার কখনো ঘটে নাফুল ফুটানো তাদের জন্যে বাধ্যতামূলক সিদ্দিকুর রহমান দাঁড়িয়ে আছেন শহরবাড়ির সামনে এই বাংলো ধরনের বাড়ি তার দাদা খান বাহাদুর হামিদুর রহমান বানিয়েছিলেন বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ফুলার কটেজ পূর্ববঙ্গ ও আসামের প্রথম লে. গভর্নর ফুলার সাহেবের নামে বাড়ি বাড়ির ডিজাইন করা হয়েছিল গভর্নর সাহেবের ইংল্যান্ডের বাড়ির ছবি দেখে 

বাড়ির সামনে তিনি চেরিগাছও লাগিয়েছিলেন গাছগুলি বাঁচে নাই হামিদুর রহমানের ধারণা ছিল বাড়ি দেখে ফুলার সাহেব মুগ্ধ হবেন শুধু তার এক রাত থাকার জন্যে কেউ এত আয়োজন করবে এটা নিশ্চয়ই তিনি ধারণা করে বসে ছিলেন না ফুলার সাহেবের ময়মনসিংহের নেত্রকোনার অতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসতে চাওয়ার পেছনের কারণ পাখি শিকার সাহেব নিরামিষাশী হলেও পাখি শিকারের প্রচণ্ড নেশা ছিল রাজকার্যের বাইরে তিনি পাখি শিকারের জন্যে অনেক সময় বের করতে পারতেন 

খান বাহাদুর হামিদুর রহমান গভর্নর সাহেবের পাখি শিকারের জন্যে বিপুল আয়োজন করিয়েছিলেন এই উপলক্ষে তিনি সুসং দূর্গাপুরের মহারাজার কাছ থেকে নান্দিনা নামের একটা মাদি হাতি কিনে নেন গভর্নর সাহেব হাতির পিঠে চড়ে শিকারে যাবেন তার জৌলুসাই আলাদা জামালপুর থেকে কারিগর এনে দুটা পালকি বানানো হয় যে-সব জায়গায় হাতি যাবে না সে-সব জায়গায় পালকি যাবে মুন্সিগঞ্জ থেকে একটা বজরা কিনে আনেন নদীতে বজরা বাধা থাকবে বজরায় পান ভোজনের ব্যবস্থা 

বরফকলের বরফস্কচ হুইস্কি সাহেবরা মদ্যপান ছাড়া কোনোরকম খেলাধুলাই করতে পারেন না বাঙালির যেমন পান-সুপারি সাহেবদের সেরকম বরফ-মদ গভর্নর সাহেবের পছন্দের খানা তৈরির জন্যে কোলকাতার আলীপুর থেকে একজন ফিরিঙ্গি বাবুর্চি আনা হয় বাবুর্চির নাম হর্নথন লেফটেনেন্ট গভর্নর ফুলার শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে পাখি শিকারে আসেন নি তিনি স্বদেশী আন্দোলনকে কঠিন হাতে দমন করতে গিয়ে কংগ্রেসী নেতাদের সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেন তাকে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয় লর্ড মিন্টো ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন 

গভর্নর সাহেবের পদত্যাগে ভারতবর্ষে যে মানুষটি সবচে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি সম্ভবত খান বাহাদুর হামিদুর রহমান অনেকের ধারণা লাট সাহেব তাঁর বাড়িতে আসেন নি এই শোকে সেই বছরই তাঁর মৃত্যু হয় তাঁর একমাত্ৰ সন্তান হাসানুর রহমানের বয়স তখন মাত্র দশ অতি দ্রুত পরিবারটি ধ্বংসের মুখোমুখি এসে পড়ে নানান পাওনাদার এসে জুটে একজন এসে জোর করে হাতি নিয়ে চলে যায় একজন নিয়ে যায় বজরা জমিজমা নিয়েও দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা মামলা শুরু করে দেন 

বিস্ময়কর ঘটনা হলো বালক হাসানুর রহমানের পাশে সে সময় যে মানুষটি এসে দাঁড়ায় সে ফিরিঙ্গি বাবুর্চি হর্নথন তার মুখে একটাই বুলি— I will kill all the bastards বন্দুকসে গোলি মারদুঙ্গা হর্নথন এই বাড়িতেই মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যান গ্রামের মানুষরা তাকে ডাকত হন্টন সাহেব হন্টনের আগে একটি বিশেষণও ব্যবহার করত— পাগলা পাগলা হন্টন 

বাড়ির নামও লোকজন পাল্টে দিল বাংলো বাড়ির নাম হয়ে গেল— শহরবাড়ি এই বাড়ির সামনে এসে দাড়ালে অঞ্চলটাকে শহর মনে হয় গ্রাম মনে হয় না কাজেই বাড়ির নাম শহরবাড়িকুয়াশার ভেতর দিয়ে রোদ এসেছে কুয়াশা ভেজা রোদ সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে রোদের দিকে মুখ ফিরালেন পাগলা হন্টন শেষ বয়সে এই কাজটা করতিঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকত সিদ্দিকুর রহমানের শৈশবের একটা বড় অংশ কেটেছে এই মানুষটার আশেপাশে সে হড়বড় করে সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে যেত বালক সিদ্দিকুর রহমান ইংরেজি কিছুই বুঝত না কিন্তু মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনতো 

গল্পের ফাঁকে ফাঁকে পাগলা হন্টন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান করত কিছু কিছু গান সিদ্দিকুর রহমানের এখনো মনে আছে— I adore thee l Serve thee Fall before thee সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন পাগলা হন্টন সাহেবের কথা মনে হলেই তার মন খারাপ লাগে এও এক রহস্য তার কত প্ৰিয়জনই তো মারা গেছেন তাদের কথা এরকম হুটহাট করে মনে আসে না আর মনে এলেও মন খারাপ হয় না 

তিনি ডাকলেনসুলেমান! 

সুলেমান সঙ্গে সঙ্গে বললজি 

আজি কী বার

বিষুদবার 

আজ তো রমিলার স্নানের দিন 

জি

নতুন সাবান আছে না

জি 

রমিলাকে সপ্তাহে একদিন স্নান করানো হয় এই স্নান তিনি নতুন সাবান ছাড়া করেন না খুবই আগ্রহ করে তিনি সাবানের মোড়ক খুলেন কিছুক্ষণ গন্ধ নেন 

রমিলার ঘরের জানালা খোলা জানালা দিয়ে রোদ এসে খাটে পড়েছে তিনি সাবধানে রোদে হাত রাখলেন তার ভাবটা এরকম যেন এটা রোদ না আগুন আগুনে হাত রাখলে পুড়ে যাবে তিনি আঙুল বন্ধ করছেন এবং ফাঁক করছেন আঙুলের ফাঁক দিয়ে রোদ খাটের চাঁদরে পড়ছে এবং বন্ধ হচ্ছে সুন্দর লাগছে দেখতে 

তিনি কিছুক্ষণ এই খেলা খেললেন দূর থেকে কইতরী তাকে লক্ষ করছে কইতরীর চোখে কৌতূহল এবং ভয় তার সামান্য মনখারাপ হলো কইতরী তারই মেয়ে অথচ মায়ের ভয়ে সে অস্থিরতিনি হাত ইশারায় মেয়েকে ডাকলেন কইতরী ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা তো অনেক বড় হয়েছে সুন্দরও হয়েছে যতই দিন যাবে এই মেয়ে ততই সুন্দর হবে মাগোতোমার ব্যাপজান কই জানোনা খোঁজ নিয়া বাইর করতে পারবোহুঁ তোমার বাপজানরে বলো তালা খুঁইল্যা আমারে যেন বাইর করে আইজ আমার মাথা ঠিক আছে আইচ্ছা 

তোমার বয়স কত হইছে মা

এগার 

মাশাল্লাহতার খুব ইচ্ছা করছে মেয়েকে একটা প্রশ্ন করতে লজ্জায় করতে পারছেন না একটা বিশেষ সময় থেকে মেয়েরা যে শারীরিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়তার দুই মেয়ে কি তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেকোনো মা মেয়েদের এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পান না তিনি পাচ্ছেন কারণ তিনি সাধারণ মা না। তিনি পাগল মা 

কইতরী এখনো দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় মার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে ভালো লাগলেও তার চোখ থেকে ভয় যায়নি 

তোমার ভাইন জাইতরী কই

শহরবাড়িত 

তারেও ডাক দিয়া আনো তোমরার দুই ভইনের মাথাত আমি তেল দিয়া দিব 

আচ্ছা 

তোমার ভাই মাসুদ কই

জানি না 

তারেও খবর দেও অনেক দিন তারে দেখি না 

আচ্ছা খবর দিব 

কইতরী চলে যাচ্ছেরমিলা মুগ্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন এত মুগ্ধ হয়ে ছেলেমেয়ের দিকে তাকানো ঠিক না নজর লেগে যায়। বাপ-মায়ের নজরকঠিন নজর রমিলা মনে মনে বললেনআল্লাগো মাফ করো মাকুন্দগো আমার নজর যেন না লাগে তিনি নজর না লাগানোর জন্যে অন্যদিকে তাকাতে চেষ্টা করছেন কিন্তু মেয়ের উপর থেকে নজর সরাতে পারছেন না মেয়ে যে ফ্রকটা পরে আছে তার রঙ সুন্দর– হলুদ 

হলুদ মেয়েদের রঙ এই রঙ পুরুষের জন্যে নিষেধ কেন নিষেধ কে জানে! ভালো মুনশি মাওলানা পেলে জিজ্ঞেস করে দেখতেন যখন তার মাথা ঠিক থাকে তখন অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করে কথা বলার মতো একজন কেউ যদি থাকত! 

তিনি খাট থেকে নামলেন তার হাঁটতে ইচ্ছা করছে ঘরের তালা না। খোলা পর্যন্ত তিনি ঘরের ভেতরই কিছুক্ষণ হাঁটবেন বলে ঠিক করলেন ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়া এবং ফিরে আসা 

তার ঘরটা বেশ বড় ঘরের একমাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে হলে একশ তিনি কদম পা ফেলতে হয় বেশির ভাগ সময়ই তিনি হাঁটেন চোখ বন্ধ করে খাটটা ছাড়া এই ঘরে অন্যকোনো আসবাব নেই কাজেই চোখ বন্ধ করে হাঁটতে অসুবিধা হয় না বরং একটা সুবিধা হয়চোখ বন্ধ করে হাটলে তিনি অনেক রকম গন্ধ পান 

পশ্চিমের দেয়ালের কাছে গেলে কাঠ পচা গন্ধ এবং ন্যাপথিলিনের গন্ধ পান যখন উত্তর দেয়াল ঘেঁসে হাঁটেন তখন পান আতরের গন্ধ পূর্বদিকের জানালার কাছে এলেই নাকে আসে কাঁচা ঘাসের গন্ধ 

সিদ্দিকুর রহমান ঘরের তালা খুলতে খুলতে বললেনভালো আছ

রমিলা মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললেনহু 

সিনান করবেগরম পানি দিতে বলবআজ বিষ্যুদবার 

সিনান সইন্ধ্যাকালে করব আজ সিনান কইরা নয়া একটা শাড়ি পরব। 

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হয়ে তাকালেন একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন— নয়া শাড়ি কেনজিজ্ঞেস করলেন না 

রমিলা স্বামীকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেলেছিলেন এখন মাথা আরো নিচু করে গুটিসুটি পাকিয়ে ফেললেন 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনরান্না করতে মন চায়রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে দিতে বলব?

না মেয়ে দুটির মাথায় তেল দিয়ে দিব 

বসবে কোথায়

এক জায়গায় বসলেই হবে 

আমি কি থাকব আশেপাশে

দরকার নাই আমার শরীর আজ ভালো 

বিশেষ কিছু কি খেতে ইচ্ছা করেইচ্ছা করলে বলো ব্যবস্থা করি তোমার যখন মাথা ঠিক থাকে না তখন তো খেতে পারো না আজ আরাম করে খাও 

সইন্ধ্যাকালে খাব 

রমিলা হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় চলে এসেছেন সিদ্দিকুর রহমান তার পেছনে পেছনে আসছেন রমিলাকে তালা খুলে বের করা ঠিক হয়েছে কি না-বুঝতে পারছেন নারমিলা সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে না বারান্দার শেষ মাথা পর্যন্ত সে এসেছে চোখ বন্ধ করে 

রমিলা! 

জি 

তোমার শরীর কি আসলেই ঠিক আছে

হুঁ রমিলা মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়ে স্বামীর দিকে সরাসরি তাকালেন ফিসফিস করে বললেনআপনাকে একটা কথা বলব আইজ রাইতে একটা ঘটনা ঘটব 

কী ঘটনা

সেইটা আপনেরে বলব না ঘটনা ঘটনের পরে আপনের দিল খোশ হইব এই জন্যেই আমি নয়া শাড়ি চাইছি 

নতুন শাড়ির ব্যবস্থা করতেছি শোনো রমিলাআমি তোমার আশেপাশেই আছি মাথার মধ্যে উনিশ-বিশ কিছু যদি টের পাও আমারে ডাকবা 

আচ্ছা 

রমিলা খুব যত্ন করে দুই মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিলেন চুল টেনে ফিতা দিয়ে বেঁধে দিলেন মেয়েদের বুদ্ধি পরীক্ষার জন্যে কয়েকটা সিমাসা দিলেন কঠিন সিমাসা বুদ্ধি থাকলে ভাঙানো যাবে বুদ্ধি না থাকলে না 

বলো তো মাজিনিসটা কীকহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে, নাই তাই খাচ্ছথাকলে কোথায় পেতে

জইতরী-কইতরী দুজন একসঙ্গে বললপারব না 

আচ্ছা আরেকটা ধরি 

জইতরী বললপ্রথমটা আগে ভাঙাও 

রমিলা বললেনসবগুলা পরে একসঙ্গে ভাঙায়ে দিব এখন আরেকটা শোনোআকাশে উড়ে না পক্ষী উড়ে না জঙ্গলে, এই পক্ষী উড়ে শুধু শনি মঙ্গলে 

পারব না 

তাহলে এটা ভাঙাও মহাকবি কালিদাসের অতি আজব কথা নয় লক্ষ তেঁতুল গাছের কয় লক্ষ পাতা

পারব না 

দেখ এইটা পার কি-নাতিন অক্ষরে নাম তার বৃহৎ বলে গণ্য পেটটা তাহার কেটে দিলে হয়ে যায় অন্ন 

কইতরী আনন্দিত গলায় বললএইটা পারব এটা ভারত। ভারতের পেট কাটলে হয় ভাত 

হইছে মাতোমার খুব বুদ্ধি 

কইতরী বিড়বিড় করে বললমাতুমি কি ভালো হয়ে গেছরমিলা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললেনএখন ভালো মন্দ হইতে কতক্ষণ! 

কইতরী বললশহরবাড়ি যাইবা

না 

কইতরী বললতেঁতুল খাইবাগাছ পাকনা তেঁতুল 

রমিলার তেঁতুল খেতে ইচ্ছা করছিল নাতারপরেও বললেনআনো দেখি 

দুই মেয়েই দৌড়ে চলে গেল লোকমানকে দেখা যাচ্ছে সে অনেকক্ষণ থেকেই আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছে পরপুরুষের সামনে পর্দা করা উচিত। কিন্তু লোকমান তাকে মা ডাকে পুত্রের সামনেও কি পর্দার বিধান আছেরমিলা মাথায় শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে লোকমানকে ইশারায় কাছে ডাকলেন লোকমান প্রায় ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল 

কেমন আছ লোকমান

আম্মাভালো আছি 

ঘরদোয়ার বড়ই অপরিষ্কার ঝাড় পোছ দেও কুটুম আসব 

কে আসব আম্মা

রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে বললেনযখন আসব তখন জানিবা এখন সামনে থাইকা যাও রমিলা চোখ বন্ধ করলেন তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ভোঁতা ধরনের চাপ ব্যথা লক্ষণ মোটেই ভালো না এই ব্যথা বাড়তে থাকবে তারপর হঠাৎ করেই ব্যথা বোধ থাকবে না শুরু হবে ভয়ঙ্কর সময় যে সময়ের কোনো হিসেব তার কাছে থাকবে না রমিলার উচিত অতি দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা তার মন খারাপ লাগছেমেয়ে দুটি আগ্রহ করে তেঁতুল আনতে গিয়েছে এই তেঁতুল তারা দিতে পারবে না তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে মেয়েদের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন এই তো তাদেরকে দেখা যাচ্ছে মেয়ে দুটাই তো সুন্দর হয়েছে কইতরী একটু বেশি সুন্দর শুধু যদি চুল কালো হতো! এই মেয়ের চুল লাল মেয়েদের লাল চুল ভালো না লাল চুলের মেয়েদের দিকে জিন-পরীর নজর থাকে বলে আমারো যেন তালাবন্ধ করে আমার মাথা নষ্ট হইতে শুরু করছে 

জইতরী-কইতরী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল 

রুমিলা ক্লান্তগলায় বললেনতোমরা সাজগোজ কইরা থাকবা বাড়িতে কুটুম আসতেছে

কইতরী বললকুটুম কে মা

রমিলা বললেনতোমাদের বড় ভইন তার নাম লীলা লীলাবতী 

তোমারে কে খবর দিছে মা

কেউ খবর দেয় নাই। আমি আগে আগে কিছু কিছু জিনিস জানি ক্যামনে জানি বলতে পারব না রমিলা তেঁতুল হাতে নিয়ে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হলেন চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে আর দেরি করা ঠিক না 

লীলা ট্রেনের জানালায় মাথা রেখে বসে আছে তার চোখে চশমা চশমা নড়বড় করছে মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় আলগা হয়ে নিচে পড়ে যাবে খপ করে হাত বাড়িয়ে ধরার সময় পাওয়া যাবে না কারণ তার দুটা হাতই বন্ধ সে মাথা রেখেছে হাতের উপর ট্রেন ঝড়ের গতিতে চলছে প্ৰচণ্ড বাতাস। বাতাসে লীলার চুল উড়ছে অল্প স্বল্প বাতাসে চুল উড়ে যখন মুখের উপর পড়ে তখন তার খুব বিরক্তি লাগে এখন বিরক্তি লাগছে না বরং উল্টোটা হচ্ছেখুবই ভালো লাগছে ভালো লাগার সঙ্গে খানিকটা ভয় যুক্ত হয়েছে— মাথার উপরের জানালা খটখট করছে ট্রেনের ঝাকুনিতে ধুম করে যে-কোনো সময় হয়তো মাথার উপর পড়বে 

লীলার বয়স একুশ তার মুখ লম্বাটে গায়ের রঙ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না মাঝে মাঝে তাকে খুব ফরসা লাগে আবার কখনো মনে হয় শ্যামলা সব মানুষের চেহারায় কিছু বিশেষত্ব থাকে লীলার বিশেষত্ব হচ্ছেতাকে দেখেই মনে হয় সে খুব কথা বলে আসলে ব্যাপারটা উল্টা লীলা খুবই কম কথা বলে তবে অন্যরা যখন কথা বলে সে সারাক্ষণই মুখ টিপে হাসতে থাকে এবং এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় এ-ধরনের কথা সে আগে কখনো শোনেনিভবিষ্যতে শোনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ যা শোনার এখনি শুনে নিতে হবে। 

ট্রেনের বাকুনিতে লীলার ঘুম-ঘুম লাগছে সে বেশ কষ্ট করে জেগে আছে সামনের স্টপেজটাই নান্দাইল রোড তাকে নামতে হবে নান্দাইল রোডে ট্রেন সেখানে মাত্র দুমিনিটের জন্যে থামবে এই নিয়েও কিছু সমস্যা আছেতাকে ট্রেনের যাত্রীরা বলেছেমেইল ট্রেন নান্দাইল রোডে থামে না যদি সত্যি সত্যি না থামে তাহলে বিস্ময়কর ব্যাপার হবে সে টিকিট কেটেছে নান্দাইল রোডের ট্রেন না থামলে টিকিট কেন দেয়া হবেলীলার সঙ্গে এমন কিছু মালপত্র নেই একটা বড় সুটকেসএকটা হ্যান্ডব্যাগ। হ্যান্ডব্যাগ সে হাতে করে নামাবে সুটকেস নামাঝে মঞ্জুমামা মঞ্জুমামা এখন উপরের বার্থে শুয়ে হাঁ করে ঘুমুচ্ছেন ট্রেনের গতি কমে এলে তার ঘুম ভাঙাতে হবে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন টেনশনে তার গলার স্বর চিকন হয়ে যাবে এমনিতে তার গলার স্বর ভারীশুধু টেনশনের সময় গলা চিকন হয়ে যায় 

লীলা ভেবেই পায় না একটা মানুষ সারাক্ষণ এত টেনশনে কী করে থাকে! তার চেয়েও আশ্চর্য কথাএত টেনশন নিয়ে একটা মানুষ যখন-তখন কী করে ঘুমিয়ে পড়ে?

মঞ্জুমামা লীলার আপন মামা না লীলার মায়ের খালাতো ভাই নয়াপুরে তার একটা ফার্মেসিএকটা টি স্টল এবং রেডিও সারাই-এর দোকান আছে কোনো দোকান থেকেই তেমন কিছু আসে না। এই নিয়ে তার মাথাব্যথাও নেই ব্যবসা পাতির খোঁজখবর নিতে গেলে তার টেনশন হয় বলেই তিনি কোনো খোঁজখবর করেন না 

দিনের বেশিরভাগ সময় তার স্কুলজীবনের বন্ধু পরেশের চায়ের দোকানে বসে থাকেন দোকানের পেছনে চৌকির উপর শীতল পাটি পাতা থাকে ঘুম পেলে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েন 

মঞ্জুমামার বয়স পয়তাল্লিশ এখনো বিয়ে করেন নিতবে বিয়ের কথা চলছে পত্রী নয়াপাড়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা মাঘ মাসের ছয় তারিখে বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে তার পরও স্থানীয় মানুষজনের ধারণাএই বিয়ে শেষ পর্যন্ত হবে না 

আগেও কয়েকবার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছেশেষ পর্যন্ত বিয়ে হয় নি মঞ্জুমামাকে লীলা নিয়ে এসেছে তার চড়নদার হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় যাচ্ছেবয়স্ক একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে থাকা দরকার এই মানুষটাকে লীলার খুবই পছন্দজানালার বাইরে বিপুল অন্ধকার হঠাৎ-হঠাৎ দুএকটা বাতি জ্বলতে দেখা যায় বাতিগুলিকে লীলার কাছে মনে হয় জিনের চোখ বাতিগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে বাতিগুলি স্থির না চলন্ত ট্রেনের কারণে হঠাৎ গাছের আড়ালে পড়ে বাতি উধাও হয়ে যাচ্ছেআবার হুট করে অন্ধকার থেকে বের হচ্ছে আলোর রঙও একরকম নাকোনোটা গাঢ় লালকোনোটা হালকা হলুদ কোনোটা আবার নীলাভ সবগুলি বাতির রঙ এক হওয়া উচিত সবই তো কেরোসিনের আলো রঙের বেশ-কমটা কি দূরত্বের জন্যে হচ্ছেপরীক্ষা করতে পারলে হতো লীলা পরীক্ষাটা করতে পারছে নাকারণ সে চোখই মেলে রাখতে পারছে না 

লীলা নিশ্চিতকিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে মজার কোনো স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে মঞ্জুমামাও উপরের বার্থে ঘুমিয়ে থাকবেন তারা নান্দাইল রোড স্টেশন ছাড়িয়ে অনেকদূর চলে যাবে একসময় মঞ্জুমামার ঘুম ভাঙবে তিনি চিকন গলায় বলবেনধুনছে আমারে! তুলা ধুনা ধুনছে ও লীলাএখন করি কীলীলা বলবেচলুন মামা আমরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি 

মঞ্জুমামা অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলবেনতোর মাথায় কি কিরা ঢুকছেট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পড়লে তুই বাঁচবিতোকে সঙ্গে নিয়ে বের হওয়াই ভুল হয়েছে এইজন্যে শাস্ত্ৰে আছে পথে নারী বিবর্জিতা 

কোন শাস্ত্ৰে আছেকোন শাস্ত্ৰে আছে জানি না 

কথা বলিস নাচুপ করে থাক 

ধুনছেরে আমারেধুনছে হায় খোদা এ কী বিপদ! ট্রেনের গতি কি কমে এসেছেঘটাং ঘটাং শব্দ এখন হচ্ছে না তার বদলে শো শো শব্দ হচ্ছে লীলা বুঝতে পারছে সে ঘুমিয়ে পড়েছেতবে কিছুটা চেতনা এখনো আছে এক্ষুনি সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে সে স্বপ্ন দেখছেশুরুতে এই বোধটা থাকবে 

লীলা এখন দেখছে সে হাতির পিঠে বসে আছে হাতিটা দুলতে দুলতে এগোচ্ছে স্বপ্ন দেখা তাহলে শুরু হয়েছেলীলা ইচ্ছা করলেই স্বপ্ন নষ্ট করে জেগে উঠতে পারে স্বপ্ন নষ্ট করতে ইচ্ছা করছে না হাতির পিঠে চড়তে ভালো লাগছে আরো কী কাণ্ডবাদ্য-বাজনা হচ্ছে! কারা যেন আবার পিচকিরি দিয়ে রঙ ছিটাচ্ছে লাল-নীল রঙ চোখে-মুখে লাগছে রঙ উঠবে তোহাতির মাহুত লীলার দিকে তাকিয়ে বললতাড়াতাড়ি নামোতুফান হচ্ছে মাহুত শুদ্ধভাষায় কথা বলছে গলার স্বর মঞ্জুমামার মতো। লীলা বললনামব কীভাবেএকটা সিঁড়ি লাগিয়ে দিন-না! মাহুত রাগী গলায় বললআরে বেটি তুফান হচ্ছে এই বলেই ধাক্কা দিয়ে সে লীলাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগল লীলার ঘুম ভেঙে গেল সে অবাক হয়ে দেখে আসলেই তুফান হচ্ছে 

ট্রেন থেমে আছে কামরায় কোনো বাতি নেই। যাত্রীরা জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে ছোট একটা বাচ্চা কাঁদছে একজন একটা টাৰ্চলাইট জ্বালিয়েছে টাৰ্চলাইটের আলো ক্ষীণ সেই ক্ষীণ আলোও আবার কিছুক্ষণ পরপর নিভে যাচ্ছে 

লীলা বললমামাআমরা কোথায়

মঞ্জু বিরক্ত গলায় বললআরে গাধা— ড্রাইভার জঙ্গলের মাঝখানে ট্রেন থামিয়ে দিয়েছে আরে ব্যাটাতুই কোনো স্টেশনে নিয়ে গাড়ি থামা জংলার মধ্যে ট্রেন থামালিএখন যদি ডাকাতি হয়

ডাকাতি হবে কেন

দেশ ভরতি হয়ে গেছে ডাকাতে ডাকাতি হবে নাআজকাল ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হলে কী হয়আশেপাশের চার-পাঁচ গ্রামের লোক চলে আসে সাহায্য করার বদলে তারা করে লুটপাট সুন্দরী মেয়ে থাকলে ধরে নিয়ে যায় পাটক্ষেতে 

লীলা বললমামাশুধুশুধু টেনশন করো না তো! কিচ্ছু হবে না 

মঞ্জু বিরক্ত গলায় বললকিছু হবে না তুই জানিস কীভাবেমিটমিটি করে এতক্ষণ যে টর্চলাইট জ্বলছিল সেটিও নিভে গেল কামরার ভেতর গাঢ় অন্ধকার মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেই আলোয় যাত্রীদের ভীত মুখ দেখা যাচ্ছে লীলার জানালার পাশে হুড়মুড় শব্দ হলো লীলা চমকে উঠে বললমামাকী হয়েছে

মঞ্জু বললগাছ ভেঙে পড়েছেআর কী হবে! ঝড়ের মধ্যে গাধা-ড্রাইভার জঙ্গলে ট্রেন দাঁড় করিয়েছে দেখিস পুরো জঙ্গলই ট্রেনের উপর ভেঙে পড়বে পুরো ট্রেন পাটিসাপটা হয়ে যাবে 

ভাইআপনাদের কারো সঙ্গে দেয়াশলাই আছেদেয়াশলাই থাকলে জ্বালান তো! দেয়াশলাই-এর কাঠি জ্বলেই নিভে গেল ট্রেনের জানালা বন্ধতার পরও হু-হু করে বাতাস ঢুকছে 

যাত্রীদের মধ্যে একজন (টর্চের মালিক) মঞ্জুমামাকে লক্ষ করে বললআপনেরা যাইবেন কই

মঞ্জু বললতা দিয়ে আপনার কীআমাদের যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবো 

লীলা বললআমরা নয়াপাড়া যাব 

কোন নয়াপাড়ানান্দাইল নয়াপাড়া

হুঁ 

এইখান থাইক্যা খুব কাছে উত্তরে হাঁটা দিলে দশ মিনিটের রাস্তা শিয়ালজানি খাল পার হইলেই… 

মঞ্জু বললএই যে বৃদ্ধ! চুপ করে থাকেন বুদ্ধি দিবেন না আপনার কথা শুনে ঝড়ের মধ্যে হাটা দেই আর ডাকাতের হাতে পড়ি! 

একটা ভালো পরামর্শ দিলাম 

আপনাকে পরামর্শ দিতে হবে না মরা ব্যাটারিওয়ালা টর্চ নিয়ে যে রওনা হয় আমি তার পরামর্শ নেই না 

নান্দাইল রোড ইষ্টিশনে নামলে চার মাইল রাস্তা 

চার মাইল কেনচল্লিশ মাইল হলেও নান্দাইল রোডেই নামব আপনি চুপ করে বসে থাকেন 

জি আচ্ছা। 

আপনার যদি খুব বেশি ইচ্ছা করে আপনি নিজে নেমে হাঁটা দেন 

ঝড় কমে এসেছে এখন শুধু মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু ট্রেন নড়ছে না মঞ্জু বললব্যাপারটা কী

লীলা বললমামা টেনশন কোরো না তো! সময় হলেই ট্রেন ছাড়বে মঞ্জু গলা নামিয়ে বললড্রাইভার কাজটা ইচ্ছাকৃত করছে কি না কে জানে! ইচ্ছাকৃত করবে কেনএদের যোগসাজস্য থাকে বেকায়দা জায়গায় ট্রেন থামায় আগে থেকে বোঝাপড়া থাকে ডাকাত এসে সব সাফা করে দেয় মামাতুমি জানালাটা খুলে দাও এসো বৃষ্টি দেখি মঞ্জু বললবৃষ্টি দেখতে হবে না যেভাবে বসে আছিস সেইভাবে বসে থাক তুই রবি ঠাকুর না যে বৃষ্টি দেখতে হবে বাতাস আবারো বাড়তে শুরু করেছে কিছুক্ষণ পরপর দমকা হাওয়া

মঞ্জু হতাশ গলায় বলল— ধুনছে আমারে ভালো বিপদে পড়লাম দেখি! 

ভাইআপনাদের মধ্যে যাদের কাছে ছাতা আছে তাদের কেউএকজন ড্রাইভারের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আসেন নাঘটনা কী 

আফনে নিজে যান 

আমি যাব কীভাবেআমার সাথে মেয়েছেলে আছে দেখেন নাএইটা আপনাদের কীরকম বিবেচনা! 

এমন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভারের কাছে কেউ খোঁজ নিতে যাবে বলে লীলা ভাবেনি একজন সত্যি সত্যি রওনা হলো সে খবর যা আনল তা ভয়াবহলাইনের উপর বিরাট একটা গাছ পড়ে আছে। লাইনের ফিস প্লেট উঠে গেছে ময়মনসিংহ থেকে রেসকিউ ট্রেন না আসা পর্যন্ত এই ট্রেন নড়বে না। কামরার ভেতর গাঢ় অন্ধকার এক-একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছেআলো ঝলমল করে উঠছেসঙ্গে সঙ্গে লীলা দুহাতে কান চেপে ধরছে বজ্রপাতের শব্দ তার সহ্য হয় না প্রচণ্ড ভয় লাগে 

লীলার মনে হলোআল্লাহ ভালো ব্যবস্থা করেছেনপ্রথমে আলোর সংকেত পাঠাচ্ছেনতারপর পাঠাচ্ছেন বাজের শব্দ। উল্টোটা হলে লীলার জন্যে খুব সমস্যা হতো ঝড়বৃষ্টির সময় সারাক্ষণ দুহাতে কান চেপে ধরে রাখতে হতো 

ভইনআপনে নয়াপাড়া কার বাড়িতে যাইবেন

প্রশ্নটা কে করেছে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। লীলার ধারণা হলো টর্চওয়ালা বুড়ো 

লীলা বললসিদ্দিকুর রহমান সাহেবের বাড়িতে যাব 

উনি আপনের কে হয়

আমার বাবা উনাকে চেনেন

উনারে চিনব না আপনে কী কনউনি অঞ্চলের বিশিষ্ট ভদ্ৰলোক অতি বিশিষ্ট ভদ্রলোক আপনেরে যেটা বললাম সেটা করেন— ঝড়বৃষ্টি থামলে উত্তরমুখী হাঁটা দেন পাঁচ মিনিটের রাস্তা 

আচ্ছা আমরা তা-ই করব মঞ্জু বিরক্ত হয়ে বললহুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না লীলা হুটহাট সিদ্ধান্ত আমার ভালো লাগে না এই বুড়ো প্ৰথমবার বলেছে দশ মিনিটের রাস্তাএখন বলছে পাঁচ মিনিট এই বুড়ো খবরদারতুমি আর মুখ নাড়বে না লীলা উত্তর দিল না বেঞ্চে পা উঠিয়ে আরাম করে বসল হুটহাট সিদ্ধান্ত অন্যের ভালো না লাগলেও তার ভালো লাগে বাবাকে দেখতে আসার এই সিদ্ধান্তও হুট করে নেয়া সিদ্দিকুর রহমান নামের মানুষটা ভয়ঙ্কর খারাপএই কথা জ্ঞান হবার পর থেকেই সে শুনে আসছে এই মানুষটা তার প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করেছে অসহায় সেই মেয়ে মনের দুঃখে মরেই গেল লোকটা কোনোদিন খোঁজ নিল না সেই মেয়েটার ফুটফুটে একটা কন্যাসন্তান একা এক বড় হচ্ছে মামার বাড়িতে তার খোঁজেও কোনোদিন এলো না

লোকটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে দুঃখকষ্টে সেই স্ত্রীরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাকে চিকিৎসাও করাচ্ছে না ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখছে এমন একজন মানুষকে হঠাৎ দেখতে আসার পেছনে কোনো কারণ নেই লীলা তাকে দেখে কী বলবোবাবা বলে বুকে ঝাপিয়ে পড়বেএমন হাস্যকর কাজ সে কোনোদিনও করবে না তবে কী করবে তাও জানে না আবার বিদ্যুৎ চমকাল লীলা দুহাতে কান চেপে বসে আছে বজ্রপাতের প্রতীক্ষা

সিদ্দিকুর রহমান খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেনতাঁর হাতে পাঁচ-ব্যাটারির একটা টর্চ টর্চ জ্বালালে আলো বহুদূর পর্যন্ত যায় মাঝে মাঝে তিনি জানালার ওপাশের জামগাছে আলো ফেলছেন ঝড় যেভাবে বাড়ছে জামগাছের ডাল ভেঙে টিনের চালে পড়বে তবে আতঙ্কিত হবার মতো কিছু না গাছের ডাল জানান দিয়ে ভাঙবেবেশ কিছু সময় ধরে মড়মড় শব্দ হবে ঘর ছেড়ে বের হবার সময় পাওয়া যাবে 

সিদ্দিকুর রহমান ভয় পাচ্ছেন নাএকধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন তিনি এতক্ষণ পা মেলে বসে ছিলেনএইবার পা গুটিয়ে বসলেন চাপা গলায় ডাকলেনলোকমান! ডেকেছেন একজনকেকিন্তু দুই ভাই একসঙ্গে সাড়া দিল। 

দুজনই চেঁচিয়ে বললজি মনে হয় তারা ডাকের জন্যে অপেক্ষা করছিল 

সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেনঝড়ের গতি কেমন

এইবার লোকমান জবাব দিল ভীত গলায় বললগতিক ভালো না। টিনের বাড়িতে থাকা নিরাপদ না চলেন পাকা দালানে যাই শহরবাড়িতে গিয়া উঠি 

ভয় লাগতেছে

লোকমান জবাব দিল না 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনভয়ের কিছু নাই কপালে মৃত্যু থাকলে মৃত্যু হবে। পাকা দালানে থাকলেও হবেআবার মাটির ভিতরে পঞ্চাশ হাত গর্ত খুঁড়ে বসে থাকলেও হবে ঠিক না লোকমান

জি ঠিক 

গোয়ালঘরের গরুগুলির দড়ি খুলে দাও 

জি আচ্ছা 

সুলেমানকে বলো হুক্কা ঠিক করে দিতে ঝড়-তুফানের রাতে হুঙ্কা টানতে আরাম সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার জন্যে অপেক্ষা করছেন। হুক্কা আসতে সময় লাগবে হুঙ্কায় পানি ভরতে হবে টিক্কায় আগুন দিতে হবে অপেক্ষা করতে কোনো অসুবিধা নেই চুপচাপ অপেক্ষা করার চেয়ে কারো সঙ্গে গল্প করতে করতে অপেক্ষা করা সহজ তার গল্প করার লোক নেই তিনি যাদের সঙ্গে সব সময় ঘোরাফেরা করেন তারা হ্যাঁ-নার বাইরে কোনো কথা বলে না নিজের ছেলেমেয়েরাই বলে না রমিলা সুস্থ থাকলে সে হয়তো কিছু গল্পটল্প করত। সিদ্দিকুর রহমান ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলেনরমিলা যখন সুস্থ ছিল তার সঙ্গে গল্প করেছে কিনা তেমন কিছু মনে পড়ছে না হয়তো রমিলাও গল্প করত না

লোকমান গোয়ালঘরের গরুগুলি ছেড়ে দিয়ে ফিরে এসেছেচাপা গলায় কেশে সে তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে 

লোকমান! 

জি 

ভিতরে আসো লোকমান ঘরে ঢুকল সে ভিজে চুপসে গেছে তার গা বেয়ে পানি পড়ছে সে অল্প অল্প কঁপিছে 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনবৃষ্টির পানি কি বেশি ঠাণ্ডা

জিঅত্যধিক ঠাণ্ডা 

এটা খারাপ লক্ষণঝড় আরো বাড়বে বড় ঝড়ের আগে বৃষ্টির পানি অত্যধিক ঠাণ্ডা হয় গোয়ালঘরের গরুগুলি ছেড়ে দিয়েছ

জি 

গরুগুলি কী করলঘরেই আছেনা ছুটে বের হয়ে গেছে

বাইর হইয়া গেছে 

এটাও খারাপ লক্ষণ 

পশুপাখিরা গতিক সবচে ভালো বোঝে ঝড়ের সময় গরুর গলার দড়ি খোলার পরেও সে যদি নড়াচড়া না করে তাহলে বুঝতে হবে ঝড় তেমন জোরালো হবে না আবার যদি দড়ি খোলামাত্র ছুটে বের হয়ে যায় তাহলে মহাবিপদ 

সুলেমান হুক্কা নিয়ে এসেছে সিদ্দিকুর রহমান নল হাতে নিয়ে আস্তে টান দিলেন তামাকটা ভালো অতি সুঘ্ৰাণ লোকমান এখনো দাঁড়িয়ে আছে সিদ্দিকুর রহমান তাকে চলে যেতে না বলা পর্যন্ত সে যাবে না তিনি কিছু বললেন না একমনে তামাক টেনে যেতে লাগলেন ঘরের টিনের চালে প্ৰচণ্ড শব্দ হচ্ছে পেরেক উঠে গেছে বলে মনে হচ্ছে বাতাস বড় একটা ধাক্কা দেবে আর চাল উড়ে যাবে খাটে বসে থেকে তিনি মাথার উপর ঝড়ের আকাশ দেখতে পাবেন 

লোকমান! 

জি 

বোবাপ্ৰাণী ছাড়াও আরো এক কিসিমের মানুষ আছে যারা ঝড়-তুফানের গতিক বুঝতে পারে তারা কারা বলো দেখি

জানি না 

পাগল মানুষ বুঝতে পারে ঝড়-তুফান ভূমিকম্প এইসবের খবর পাগলের কাছেও আছে তোমার চাচিআম্মারে যদি জিজ্ঞেস করো সে বলতে পারবে পাগল হওয়ার কিছু উপকারিতাও আছেঠিক না লোকমান

লোকমান কিছু বলল না মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল তার বুক এখন ধড়ফড় করা শুরু করেছে চাচাজি অনেকক্ষণ তাকে সামনে দাড় করিয়ে রেখেছেন এই কাজটা তিনি যখনই করেন তখন বুঝতে হয় চাচাজি নাখোশ হয়েছেন। সিদ্দিকুর রহমান হুক্কায় লম্বা টান দিয়ে নল একপাশে রেখে খাটে পা বুলিয়ে বসলেন তাঁর গলার স্বর হঠাৎ বদলে গেল ভারী হয়ে গেল তিনি বললেনআজকে ঝড়-তুফানের রাত আমার বড় ছেলে মাসুদ বাড়িতে নাই সে কোথায় গেছে তুমি জানো

জানি 

কোথায় গেছে

কুদ্দুস মিয়ার বাড়িতে। 

সেখানে সে কী করেমাসুদ ভাইজানের গানবাজনার শখ ঐখানে গানবাজনা করেন তাহলে এই ঘটনা আজ প্রথম না আগেও সে গিয়েছে ঐ বাড়িতে রাত কাটিয়েছে 

জি তোমরা দুই ভাই এই ঘটনা জানতাআমারে কিছু বলো নাই 

লোকমান জবাব দিল না চুপ করে রইল 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনকুদ্দুস মিয়ার কি কোনো সেয়ানা মেয়ে আছে

জি আছে 

মেয়ের নাম কী

পরী পরীবানু

সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার নিলে কয়েকটা টান দিয়ে শান্ত গলায় বললেনএখন ঘটনা বোঝা গেল। আমার ছেলে গানবাজনার অজুহাতে সেয়ানা মেয়ের গায়ের গন্ধ শুঁকতে যায় একটা বয়সের পরে সেয়ানা মেয়ের গায়ের গন্ধের জন্যে যুবক ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে এটা জগতের নিয়ম তবে সব নিয়ম সব জায়গায় চলে না লোকমান শোনোতোমারে একটা কাজ দিতেছি— ঝড় কমলে কুদ্দুস মিয়ার বাড়িতে যাবে তাকে আর তার মেয়ে পরীবানুকে নিয়ে আসবে 

জি আচ্ছা 

আর আমার পুত্ৰকেও ধরে নিয়ে আসবে গানবাজনা কী শিখছে তার একটা পরীক্ষা হবে জি আচ্ছা 

এখন সামনে থেকে যাও। লোকমান হাঁপ ছেড়ে বাঁচল দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল সিদ্দিকুর রহমান খাট থেকে নামলেন। আলমিরা খুলে রমিলার ঘরের চাবি বের করলেন তিনি খানিকটা লজ্জা পাচ্ছেন গোয়ালঘরের গরগুলির কথা তার মনে হয়েছে কিন্তু পাগলাস্ত্রীর কথা মনে হয় নাই যখন গরুর গলার দড়ি খোলা হয়েছে তখন রমিলার ঘরের চাবিও খোলা উচিত ছিল রমিলা ঘরের এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসেছিল তালা খুলে সিদ্দিকুর রহমান ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মাথায় ঘোমটা দিল

সিদ্দিকুর রহমান বললেনকেমন আছ গো বউ

রমিলা নিচু গলায় বললভালো আছি 

বিরাট ঝড়-তুফান শুরু হয়েছে ভয় পাইছিলা

হুঁ 

ডাক দিলা না কেন

রমিলা জবাব দিল না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনচলো পাকা ঘরে যাই টিনের এই ঘরের অবস্থা ভালো না যে-কোনো সময় চাল উড়ে যাবে 

আমি এইখানেই থাকব 

এইখানে থাকবা

জি 

কেন

এই ঘর ছাইড়া কোনোখানে যাইতে আমার ভালো লাগে না 

ভালো লাগালাগির কিছু তো নাই বউ ঝড়-তুফানের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়

ঝড়-তুফান শেষ হয়েছে আর হবে না 

আর হবে না

না

সিদ্দিকুর রহমান কান পাতালেন আসলেই তো তাইশো শো শব্দ শোনা যাচ্ছে না শুধুই বৃষ্টির শব্দ। 

রমিলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে পাগল মানুষের হাসি-কান্না কোনো ব্যাপার নয় পাগল মানুষ কারণ ছাড়াই হাসে কারণ ছাড়াই কাদে 

তবু সিদ্দুিকুর রহমান অভ্যাসবশে জিজ্ঞেস করলেনহাসো কেন বউ

রমিলা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললবাড়িতে কুটুম আসতেছে আমার মনে আনন্দএইজন্যে হাসতাছি 

কুটুমটা কে

সেটা আপনেরে বলব না রমিলা এখনো হাসছে 

সিদ্দিকুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন 

খাড়াইয়া আছেন ক্যান

সিদ্দিকুর রহমান রমিলাকে তালাবন্ধ করে চলে এলেন রমিলা ঠিক আগের জায়গায় গুটিসুটি মেরে বসে গেল এখন সে আর হাসছে না রাত চারটা বাজে ফজরের আজানের বেশি দেরি নেই এখন ঘুমোতে যাবার অর্থ হয় না সিদ্দিকুর রহমান ঠিক করলেনঅজু করে বারান্দায় বসে ভোরের প্রতীক্ষা করবেন ফজরের নামাজের পর তুফানে গ্রামের কী ক্ষয়ক্ষতি হলো তা দেখতে বের হবেন ইতিমধ্যে মাসুদ চলে আসবে তার বিষয়ে ব্যবস্থা কী নেয়া যায় সেটাও ভাবা দরকার সিদ্দিকুর রহমান বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন 

তার পাশেই সুলেমান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনতুফান কি কমেছে

সুলেমান বললজি। মাঝে মাঝে বড় রকমের ঝড়-তুফান হওয়া ভালো বন্যার সময় কী হয় দ্যাখোজমিতে পলি পড়েফসল ভালো হয় ঝড়-তুফানেরও সেরকম উপকার আছে সুলেমান কিছু বলল না যেভাবে বসে ছিল সেইভাবেই বসে রইল সিদ্দিকুর রহমান ভেবেছিলেন সুলেমান বলবেঝড়-তুফানের কী উপকার আছেতখন তিনি উপকার ব্যাখ্যা করবেন সুলেমান কিছু জানতে চাইল না বলে তাঁরও বলা হলো না অবিশ্যি ঝড়-তুফানের কী উপকার তিনি জানেন না ভেবে বের করতে হতো জটিল জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে তার ভালো লাগে নানান কাজ-কর্মে তিনি ব্যস্ত থাকেন চিন্তার সময় পাওয়া যায় না। দিনের কিছুটা সময় যদি আলাদা করে রাখা যেত তাহলে ভালো হতো এই সময় তিনি চিন্তা করবেন। আর কিছু করবেন না 

সুলেমান! 

জি

চা বানাওচা খাব 

জি আচ্ছা 

একটা পাতলা চাদর এনে আমার গায়ে দিয়ে দাওশীতশীত লাগছে 

জি আচ্ছা 

চা বানিয়ে আনার পর যদি দেখ আমি ঘুমিয়ে পড়েছিতাহলে আমাকে ডাকবে না 

জি আচ্ছা 

লোকমােন কি মাসুদকে আনতে গেছে

জি 

পাখি কিচিরমিচির করতেছেশুনতেছ

জি 

তুফান শেষ হয়েছে এইজন্যে এরা আনন্দ করতেছে এ তার গায়ে ঠোকর মারতেছে পশুপাখিরা মারামারি কামড়াকামড়ি করে আনন্দ প্রকাশ করে পশুপাখির জগতের নিয়মকানুন বড়ই অদ্ভুত সুলেমান শোনোআমার গায়ে চাদর দেয়ার দরকার নাই শীত-শীত ভাবটা ভালো লাগতেছে 

জি আচ্ছা

সুলেমান চা বানিয়ে এনে দেখেসিদ্দিকুর রহমান ঘুমোচ্ছেন ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে সে চায়ের কাপ পাশে রেখে আগের ভঙ্গিতেই বসেই পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান পড়ল সুলেমান ভেবে পেল না সে এখন কী করবে চাচাজিকে ডেকে তুলবেতিনি বলেছিলেন তার ঘুম যেন ভাঙানো না হয় সুলেমান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সিদ্দিকুর রহমানের ঘুম ভাঙল ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পর তিনি চোখ মেলে দেখলেন অসম্ভব রূপবতী অপরিচিত একটি তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে তরুণীর মুখ হাসিহাসি চোখে বিস্ময় তাকে চোখ মেলতে দেখেই তরুণী তার দিকে ঝুঁকে এসে বললবাবাআমি লীলা লীলাবতী আপনার কি শরীর খারাপ

সিদ্দিকুর রহমান জবাব দিলেন না মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন লীলাবতী অসঙ্কোচে তার বুকের উপর হাত রাখল সিদ্দিকুর রহমানের দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল কতদিন পর নিজের মেয়েকে দেখছেন কী সুন্দর মেয়ে! তাকে অবিকল দেখাচ্ছে কিশোরী আয়নার মতো আবার সে আয়নাও নাঅন্য কেউ মেয়েকে কিছু বলা দরকার কোনো কথা মনে আসছে না আহারে! মেয়েটা খবর দিয়ে কেন এলো না! খবর দিয়ে এলে তিনি সুসং দুর্গাপুর থেকে ভাড়া করে হাতি আনতেন। স্টেশন থেকে মেয়ে আসত হাতিতে চড়ে সঙ্গে থাকত বাদ্যবাজনা আহারে! মেয়েটা কেন আগে খবর দিল না

আচ্ছা এটা কি সম্ভব যে পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্নে ঘটছেকেউ তাঁর কাছে আসে নি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছাপূরণ জাতীয় একটি স্বপ্ন দেখছেন আগেও এরকম হয়েছে। দুপুরবেলা ঘুমুচ্ছিলেনস্বপ্নে দেখলেনআয়না এসেছে সে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল উদ্বিগ্ন গলায় বললজ্বর কি বেশিতিনি বললেনহুকপালে হাত দিয়ে দেখো আয়না বললকপালে হাত দিতে পারব না আমি হলুদ বেটেছিহাতে হলুদ তারপরেও আয়না কপালে হাত দিল তিনি নাকে কাঁচা হলুদের গন্ধ পেলেন তার ঘুম ভেঙে গেল কপালে হলুদের গন্ধ কিন্তু চলে গেল না সেই গন্ধ সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকল 

লীলা কি সত্যি এসেছেসত্যি কি মেয়েটা তার বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেসে তার মায়ের মতো কপালে হাত রাখল না কেনসিদ্দিকুর রহমান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেনতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তাদের ঘিরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে কোনো রকম মানসিক দুর্বলতা প্রকাশ করা ঠিক না তিনি অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সহজগলায় বললেনপরিশ্রম করে এসেছি ভিতরের বাড়িতে যাওহাত-মুখ ধোও

 

 

৪র্থ পর্ব 

সব জায়গার আলাদা গন্ধ আছে এই জায়গার গান্ধটা বুনো লতাপাতার কষটা কড়া গন্ধ তার পরেও লীলার কাছে মনে হলোকেমন যেন আপনআপন গন্ধ যেন অনেক দিন আগে গভীর কোনো জঙ্গলে সে পথ হারিয়ে খুব ছোটাছুটি করেছিল 

পথ হারানোর দুশ্চিন্তায় সেই গভীর বনের কিছুই লীলার মনে নেইকিন্তু লতাপাতার গন্ধটা নাকে লেগে আছে অনেক দিন পর আবার সেই বুনো ঘাণ পাওয়া গেল লীলা নিজের মনেই বলল— বাহভালো তো! নিজের মনে কারণে অকারণে বাহভালো তো বলা লীলার অনেক দিনের অভ্যাস গন্ধটা কিসের কাউকে জিজ্ঞেস করলে হতো লীলা তেমন কাউকে দেখছে না টিন এবং কাঠের প্রকাণ্ড বাড়িটা প্ৰায় ফাঁকা তবে এই ফাকাও অন্যরকম ফাকামনে হচ্ছে এ-বাড়ির লোকজন কাছেই কোথাও বেড়াতে গেছে সন্ধ্যায়সন্ধ্যায় ফিরে আসবে তখন খুব হৈচৈ শুরু হবে বাড়ির এত বড় উঠেন 

এই উঠোনে ছসাতজন শিশু কাদা মেখে ছোটাছুটি না করলে কি মানায়কেউ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদবেকেউ হাসবে সবুজ গেঞ্জি পরা প্রচণ্ড বলশালী একজন লোককে দেখা গেল গভীর কৌতূহলে আড়চোখে লীলাকে দেখছে চোখে চোখ পড়তেই লোকটা চট করে চোখ নামিয়ে ফেলল মেঝের দিকে তাকিয়ে খাম্বার মতো হয়ে গোল যেন সে ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ করেছে এই অপরাধের শাস্তি হলো মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা 

লীলা বললআপনার নাম কী

লোকটা মেঝে থেকে চোখ না তুলে বলল, এই বাড়ির আর লোকজন কোথায়

চাচাজি ছাড়া এইখানে আর কেউ থাকে না 

বাকিরা কোথায় থাকে

শহরবাড়িত থাকে 

শহরে থাকে

জি না। এইখানেই থাকেশহরবাড়িত থাকে 

আপনার কথা বুঝতে পারছি না শহরবাড়িত জিনিসটা কী

সুলেমান আঙুল তুলে দেখাল যে-জায়গাটা দেখাল সেখানে ঘন বাঁশের জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। সুলেমান বলতে পারল না যেশহরবাড়ি হলো শহরের মতো বাড়িসে-বাড়িতে সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ছেলেমেয়েরা থাকে বেশি কথা বলার অভ্যাস তার নেই চাচাজির বড় মেয়েটির সামনে কী কারণে যেন তার খুব অসহায় লাগছে 

সুলেমানের সঙ্গে কথা বলে লীলা খুব মজা পাচ্ছে লোকটা এখন পর্যন্ত একবারও চোখ তোলে নি মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা আঙুল তুলে শহরবাড়ি কোনদিকে দেখিয়েছে সেই আঙুল সঙ্গে সঙ্গে নামায় নি অনেকক্ষণ তুলে রেখেছে লীলা বললআপনি মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন কেনআমার সঙ্গে যখন কথা বলবেন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন জি আচ্ছা আমার সঙ্গে যে-মানুষটা এসেছেন উনি সম্পর্কে আমার মামা হয়উনি কোথায়জানি না উনাকে খুঁজে বের করুন উনার খুব ঘনঘন চা খাবার অভ্যাস উনাকে চা বানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন চাপাতাচিনিদুধ সব উনার সঙ্গে আছে ভালো চা ছাড়া উনি খেতে পারেন না বলে এই অবস্থা উনাকে চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবেন নাজি পারব আপনি কিন্তু এখনো একবারও আমার দিকে তাকান নি আমি কেসেটা জানেন তোআমি আপনার চাচাজির মেয়েযেহেতু আমার বাবাকে আপনি চাচা ডাকছেন— এখন আমি সম্পর্কে হচ্ছি আপনার বোন বোনের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায় 

সুলেমান এই প্রথম একটু নড়ল চোখ তুলে এক ঝলক লীলাকে দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলল লীলা মনে মনে হাসল সুলেমান নামের খাম্বা টাইপ মানুষটা যে লীলার এই কথায় অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাবে তা লীলা জানত যেরকম ভাবা হয় ঘটনা সেরকম ঘটলে বেশ মজা লাগে এই বাড়িতে শুধু চাচাজি থাকে আর কেউ থাকে না— কথাটা মিথ্যা কিছুক্ষণের মধ্যেই লীলা তার প্রমাণ পেল দুটা বেণি দুলানো মেয়েকে দেখা গেল সারাক্ষণই আড়াল থেকে তাকে দেখছে হাত ইশারা করে কাছে ডাকলেই তারা সরে যাচ্ছে 

এই মেয়ে দুটি কেবাড়ির শেষ মাথায় একটা ঘরে একজন মহিলাকে দেখা গেল। মহিলা লীলাকে দেখে ভয় পেলেন বলে মনে হলো। মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোনায় সরে গেলেন। মাথায় বড় করে ঘোমটা দেয়ায় তার কপাল ঢাকা পড়েছে। চোেখও খানিকটা ঢাকা পড়েছে। তবু বোঝা যাচ্ছে তিনি খুবই কৌতূহল নিয়ে লীলাকে দেখছেন। লীলা বললস্লামালিকুম মহিলা জবাব দিলেন না মহিলাকে ভালোভাবে দেখতে হলে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে লীলা দরজার কাছে গিয়ে খুবই অবাক হলো দরজার কড়ায় ভারী একটা তালা ঝুলছে মহিলাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে 

লীলা আবারো জানালার কাছে ফিরে গেল বিস্মিত গলায় বললএই যে শুনুন! আপনি কি একটু সামনে আসবেনআপনার সঙ্গে কথা বলব মহিলা আড়াল থেকে বললেনআমি সামনে আসব না গো মা আমার লজ্জা লাগে আপনাকে তালাবন্ধ করে রেখেছে কেনআমার মাথার ঠিক নাইএই জন্যে তালাবদ্ধ কইরা রাখে পাগল-মানুষকখন কী করি তার কি ঠিক আছেলীলা বুঝতে পারছে এই মহিলা কে তারপরেও সে বোকার মতো বললআপনি কেআমি মাসুদের মা মাসুদটা কেমহিলা জবাব দিলেন না আড়াল থেকেই শব্দ করে হাসলেন ভদ্রমহিলার অনেক বয়স কিন্তু তিনি হাসলেন ঝনঝনে কিশোরীর মতো গলায় লীলা বললআমার নাম লীলা আমি জানিতুমি লীলাবতী কীভাবে জানেনআমি তোমারে খোয়াবে দেখেছি খোয়াবে তোমারে যত সুন্দর দেখেছি তুমি তার চেয়েও সুন্দর তয় গায়ের রঙ সামান্য ময়লামা গোগায়ের রঙ নিয়ে মনে কষ্ট রাখবা না লীলা বললআমার কোনো কষ্ট নাই মহিলা বললেনগায়ের রঙ নিয়া কষ্ট সব মেয়ের আছেতোমারও আছে গায়ের রঙ ঠিক করনের উপায় আছে তুমি জানতে চাইলে বলব

 লীলা বললআচ্ছা কী উপায়

মহিলা হেসে ফেললেন হাসতে হাসতে বললেন— গায়ের রঙ নিয়া তোমার যদি কষ্ট না থাকতরঙ ঠিক করনের উপায় জানতে চাইত না 

আপনার বুদ্ধি ভালো 

পাগলের বুদ্ধি মা পাগলের বুদ্ধির কোনো ভালো-মন্দ নাই 

গায়ের রঙ ঠিক করনের উপায়টা বলব

বলুন 

জ্যৈষ্ঠমাসে কালো জামের রস সারা শইল্যে মাখবা সেই রস শুকাইয়া যখন শইল্যে টান দিব তখন কুসুম কুসুম গরম পানিতে গোসল করবা 

একবার করলেই হবেনা যতদিন কালোজাম পাওয়া যায় ততদিন করবা ইনশাল্লাহ রঙ ফুটব 

আপনি সামনে আসুনআড়াল থেকে কথা বলছেন আমার ভালো লাগছে না সামনে এসে মুখের ঘোমটা সরান 

সামনে আসব না মা 

কেন আসবেন না

আমার লজ্জা করে 

আমি আপনার মেয়ে মেয়ের সঙ্গে কিসের লজা! 

আমি পাগল-মানুষ পাগল-মানুষ সবেরে লজ্জা করে নিজের মেয়েরেও লজ্জা করে তুমি তো আমার নিজের মেয়ে না

আপনার সঙ্গে কি সবসময় আড়াল থেকে কথা বলতে হবে

জানি না মা গোতুমি এই বাড়িতে কয়দিন থাকবা

আমি বাবাকে দেখতে এসেছিলাম দেখা হয়েছেকাজেই কালপরশু চলে যাব

আইচ্ছা তোমারে আমার খুবই মনে ধরেছে পাগল হওনের পর থাইক্যা কাউরে মনে ধরত না এই প্ৰথম মনে ধরল এখন যাওনিজের মনে বেড়াও বাড়ির পেছনে বাগান আছেবাগান দেইখ্যা আসো

বাগান আপনি করেছিলেন

না তোমার পিতার বাগান 

গ্রামের বাড়ির বাগান ঝোপেঝাড়ে ভরতি থাকে লীলা অবাক হয়ে দেখল বাগানটা বাকবীক করছে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কেউ এসে বাট দিয়ে শুকনো পাতা সরিয়েছে সবই দেশী ফুলের গাছ নানান জাতের জবা ফুলের গাছ কামিনী গাছকাঠগোলাপের গাছবেলি ফুলের গাছ বাঁশের বেড়া দেয়া অনেকখানি জায়গায় গোলাপের চাষ করা হয়েছে গ্রামের মানুষজন শখ করে গোলাপবাগান করে না এখানে করা হয়েছে প্রচুর গোলাপ ফুটেছে। লীলা মুগ্ধ হয়ে গেল মাঝামাঝি জায়গায় বাঁধানো কুয়া কুয়া শহর এবং শহরতলির জিনিস গ্রামে পুকুর কাটা হয়কুয়া কাটা হয় না কুয়ার পাড় বাঁধানো লীলা তার অভ্যাসমতো বললবাহ ভালো তো! বাগানের শেষপ্রান্তে বেদির মতো বানানো হয়তো বসে বিশ্রাম করার জায়গা এই জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ভরতি বাগান দেখাশোনার দায়িত্বে যে আছে সে নিশ্চয়ই এখানে আসে না 

লীলা বেদিতে বসল সঙ্গে এক কাপ চা থাকলে ভালো হতো বেদিতে বসে নিরিবিলি চা খাওয়া যেত তার সামান্য মাথা ধরেছে যেভাবেই হোক মাথা ধরাটা দূর করতে হবে দূর করতে না পারলে মাথার এই যন্ত্রণা একসময় খুব বাড়বে তার নিজের জগতটা এলোমেলো করে ফেলবে বাগানের খোলা হওয়ায় হয়তো উপকার হবে 

লীলা বেদিতে পা তুলে বসল তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে শুয়ে পড়লে ক্ষতি নেইকেউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে না বাড়ির পেছনের এই জায়গাটার তিন দিকেই জঙ্গল একদিকে বাঁশঝাড়বাকি দুদিকে আমকাঁঠালের বন এত ঘন করে কেউ আম-কাঠালের গাছ লাগায় না মনে হচ্ছে ইচ্ছা করেই বন তৈরি করা হয়েছেযেন বাগানের দিকে কারো চোখ না যায় লীলা শাড়ির আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল মাথার উপরের আকাশ এখনো কালো হয়ে আছে বড় কেটে গেছেআকাশের মেঘ এখনো কাটে নি 

শুয়ে শুয়ে মেঘলা আকাশ দেখতে ভালো লাগছে গত রাতটা নানান ঝামেলায় কেটেছে একফোঁটা ঘুম হয় নি এখনো যে ঘুম পাচ্ছে তা নাঝিমঝিম লাগছে বেলা কত হয়েছে তাও বোঝা যাচ্ছে না তার হাতে ঘড়ি নেই তবে বেলা বেশি হয় নি এ বাড়িতে সে এসে পৌছেছে ফজরের আজানের পরপর খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানিক সময় পার হয়েছে এই একঘণ্টায় অনেক কিছু ঘটে গেল বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো প্রথম দেখাটা কেমন হবে এ নিয়ে সে অনেককিছু ভেবেছিল

বাস্তবের সঙ্গে ভাবনা কিছুই মেলে নি তার বাবা বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন সে বাবার কাছে ঝুঁকে এসে বলেছিলবাবা আমি লীলালীলাবতী আপনার কি শরীর খারাপতিনি তার দিকে তাকালেন তাঁর দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল কি না লীলা বুঝতে পারল না আধো-অন্ধকারে চোখের বিস্ময় ধরা পড়ে না তবে তাঁর চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছিল সেটা দেখা গেছে চোখের জল অন্ধকারেও চিকচিক করে হঠাৎ কোনোরকম কারণ ছাড়া সে বাবার জন্যে তীব্র মমতা বোধ করল কোনোরকম কারণ ছাড়া— কথাটা ঠিক হলো না বাবার চোখের জল একটা কারণ হতে পারে মানুষের চোখের জল তীব্র অ্যাসিডের মতো ক্ষমতাধর কঠিন লোহার মতো হৃদয়ও এই অ্যাসিড গলিয়ে ফেলে লীলা অসঙ্কোচে তার বাবার বুকের উপর হাত রাখল 

মানুষটা একটু কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেলেন মেয়ের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন বাবা-মানুষটা যেরকম হবেন বলে লীলা ভেবেছিল মানুষটা মোটেই সেরকম না রোগা ছোটখাটো একজন মানুষ মুখের চামড়া শক্তআবেগশূন্য মানুষ— যারা হাসেও নাকাদেও না— তাদের মুখের চামড়া শক্ত হয়ে যায় তবে মানুষটার চোখ বড় বড় আল্লাহ যেসব মানুষকে বিস্মিত হবার জন্যে পৃথিবীতে পাঠান তাদের চোখ বড় বড় করে দেন কে জানে লীলার বাবাকে তিনি হয়তো বিস্মিত হবার জন্যে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন লীলা তার বাবার একটি ব্যাপারে খুবই অবাক হয়েছে আবেগকে অতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা যার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তিনি মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে সহজ গলায় লীলাকে বললেনপরিশ্রম করে এসেছভেতরের বাড়িতে যাও হাতমুখ ধোও যেন লীলা এ-বাড়িতে প্রায়ই আসে তার এই আসা নতুন কিছু না ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ হচ্ছে 

লীলা চোখ মেলে দেখল তার মাথার উপর চিল উড়াউড়ি করছেদুটা সোনালি রঙের চিল চিল আকাশের অনেক উপরে উড়ে এই দুজন নিচে নেমে এসেছে চিলের গলার আওয়াজ এত কৰ্কশ হয় তাও লীলা জানত না সে ধড়মড় করে উঠে বসল। তখনি মনে হলো সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম বেশিক্ষণ হয় নি। হয়তো পাঁচ মিনিট কিংবা দশ মিনিট। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে সে দীর্ঘসময় বেদিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘুমাবার জন্যে জায়গাটা খুবই আরামের। লীলা বাড়ির দিকে রওনা হলো। মঞ্জু মামার খোঁজ নেয়া দরকার— বেচারা তার চা পেয়েছে কি না কেউ কি আছে তার সঙ্গেনাকি সে একা একাই ঘুরছেমঞ্জুর পা কেটেছে তিনি শহরবাড়ি নামের পাকা দালানের বারান্দায় মোড়ায় বসে আছেন তাঁর সামনে আরেকটা মোড়া সেই মোড়ায় তাঁর কেটে যাওয়া পা রাখা আছে নয়-দশ বছরের একটি মেয়ে কাটা পায়ের চিকিৎসা করছে বেশ গুছিয়েই করছে সে একটা কুপি জ্বলিয়েছে কুপির আগুনে কাপড় পুড়িয়ে ছাই বানাচ্ছে সেই ছাই পায়ের কাটা জায়গায় যত্ন করে লাগিয়ে দিচ্ছে মেয়েটার মুখ গোল মায়া-মায়া চেহারা মঞ্জু মেয়েটির আদর-যত্নে মোহিত হলে বললেননাম কী গো মা তোমারকইতরী কইতর থেকে কইতরীবাহ সুন্দর নাম! 

তুমি কি সিদ্দিক সাহেবের কেউ হও

মেয়ে হই 

বলো কী! 

তুমি সিদ্দিক সাহেবের মেয়ে

উনার মেয়ে হয়ে আমার পায়ের ময়লা পরিষ্কার করছ এটা কেমন কথা

কিছু হবে না 

মঞ্জু খুশি খুশি গলায় বললেনকিছু হবে নাএটা ঠিক বিখ্যাত একটা কবিতা আছে— বাদশা আলমগীর কুমারে তাহারে পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির কবিতাটা জানো

জি না! 

আমিও তো মাত্র দুই লাইন জানিধুনছে আমারে তুলা ধুনা করছে মঞ্জু হতভম্ব হবার মতো মুখভঙ্গি করলেন 

কইতরী এই দৃশ্য দেখে এতই মজা পেল যেহেসে কুটি কুটি হলো মঞ্জু বাচ্চা মেয়েটির হাসি দেখে আনন্দে অভিভূত হলেন তার কাছে মনে হলো— ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে এ বাড়িতে আসা সার্থক হয়েছে আরেকটি মেয়েকে দরজার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে মঞ্জু একবার বললেনএই তুমি কেমেয়েটি কথা শুনে প্রায় উড়ে চলে গেল লীলা শহরবাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল মাঝপথ থেকে ফিরে এলো অবাক হয়ে মূল বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল শূন্য বাড়ি লোকজনে ভরতি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘটনা ঘটেছেসবার চোখে-মুখে সংশয় 

বাড়ির খুঁটি ধরে তরুণী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পাচ্ছে লীলাকে ঢুকতে দেখে মেয়েটি চোখ তুলে লীলার দিকে তাকাল লীলা সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বললবাহসুন্দর তো মেয়েটি! 

সিদ্দিকুর রহমানের বাড়ির উঠানে বিচারসভা বসেছেলোকমান কিছুক্ষণ আগে কুদ্দুস মিয়া এবং তার মেয়ে পরীবানুকে নিয়ে এসেছে সিদ্দিকুর রহমানের বড় ছেলে মাসুদ তাদের সঙ্গে এসেছে আশপাশের কৌতূহলী কিছু লোকজন চলে এসেছে মসজিদের ইমাম সাহেব এসেছেন ফুটফুটে দুটি মেয়ের একটিকে দেখা যাচ্ছে সে খুঁটির আড়ালে দাঁড়িয়ে এই মেয়েটির মনে হয় লজ্জা বেশি 

সিদ্দিকুর রহমান তাঁর আগের জায়গাতেই আছেন ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন তাকে সামান্য বিরক্ত মনে হচ্ছে লীলা তার বাবার পাশে দাঁড়াল সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন— যাওভেতরে যাও এইখানে দাড়ানোর দরকার নাই লীলা দাঁড়িয়েই রইলনড়ল না সিদ্দিকুর রহমান হাত-ইশারায় মাসুদকে ডাকলেন মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো ভয়ে তার শরীর কাঁপছে ফর্স মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সে তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে না সে তাকাচ্ছে লীলার দিকে এই মেয়েটিকে সে চিনতে পারছে না অপরিচিত একটি তরুণী মেয়ের সামনে তাকে কী শাস্তি দেয়া হবে কে জানে!তার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে কাঁদতে পারছে না 

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে লীলা ছেলেটাকে চেনে নাআগে কখনো দেখে নি তারপরেও সে স্পষ্ট বুঝলএই ছেলেটা সম্পর্কে তার ভাই তাদের দুজনের মা ভিন্ন হলেও তারা ভাইবোন ছেলেটার ভীতমুখ দেখে লীলার মায়া লাগছে বেচারা এত ভয় পাচ্ছে কেনভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ কি সে করেছে

নিতান্তই বালক চেহারার একজন ভয়ঙ্কর কী করতে পারেএর বয়স কত হতে পারে ষোল সতেরো না-কি আঠারোসিদ্দিকুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেনতুমি নাকি ইদানিং গান-বাজনা শিখছএই প্রশ্ন করতে করতে তিনি আধশোয়া অবস্থা থেকে বসা অবস্থায় চলে এলেন তার গলার আওয়াজ শান্ত 

যেন তিনি তার ছেলের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন পড়াশোনার খবর যেভাবে নিতে হয় সেভাবেই গান-বাজনার খবর নিচ্ছেন কথার জবাব দাও না কেনগান-বাজনা নাকি শিখছ

জি 

গান দুএকটা শিখেছ

জি না 

তাহলে কি বাদ্য-বাজনায় আছ

জি 

কী শিখছ

তবলা

ছেলেপুলে বখাটে হয়ে গেলে প্রথম শিখে তবলা 

তবলা শিখেছ

জি 

কতটুকু শিখেছি

মাসুদ জবাব দিল না 

সিদ্দিকুর রহমান লোকমানের দিকে তাকিয়ে বললেনদৌড় দিয়া যাওকুদ্দুসের বাড়ি থেকে তবলা আর বাঁয়া নিয়ে আসো আমার পুত্ৰ তবলা কেমন শিখেছে তার পরীক্ষা হবে এত কষ্ট করে একটা বিদ্যা শিখেছে দেখি সেই বিদ্যার কী অবস্থা! 

লীলার হাসি পাচ্ছে শুরুতে তার বাবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল— ভয়ঙ্কর কোনো বিচার হবে এখন সে-রকম মনে হচ্ছে না মনে হচ্ছে পুরো বিচার ব্যবস্থার মধ্যে হালকা মজা আছে খুবই আশ্চর্যের ব্যাপারএকজন আবার সত্যি সত্যি দৌড়ে তবলা আনতে গেছে সবচে ভালো হয় ছেলেটা যদি চমৎকার তবলা বাজিয়ে সবাইকে হতভম্ব করে দেয় সেটা মনে হয় বেচারা পারবে না কারণ সে থারথার করে কাঁপছে 

এত ভয় পাচ্ছে কেন

লীলার ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে সে বলে— এত ভয় পােচ্ছ কেনউনি তোমার সঙ্গে মজা করছেন তোমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করার চেষ্টা করছেন হাসি-তামাশা গায়ে না মাখলেই হয় 

সিদ্দিকুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় ডাকলেনমাসুদ! মাসুদ ক্ষীণস্বরে বললজিতবলা এমন কঠিন বিদ্যা যে এটা শেখার জন্যে মানুষের বাড়িতে রাত কাটাতে হয় এটা জানতাম না তুমি কি সারারাত তবলা বাজাওনাকি তবলা শেখার পাশে পাশে কুদ্দুসের মেয়েটার সাথে তবলা বিষয়ে কথা বলেকুদ্দুসের মেয়ে যেহেতু গান-বাজনার মধ্যে আছে সেও নিশ্চয়ই তবলা বিষয়ে জানে এই মেয়েতুমি জানো নাপরীবানু কিছু বলল না খুঁটির আড়ালে চলে গেল তোমার নাম কীপরীবানু জবাব দিল না পরীবানুর বাবা কুদ্দুস ভীত গলায় বললজনাবআমার মেয়ের নাম পরীবানু 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনমেয়ে যেমন সুন্দরনামও সুন্দর এই মাসুদপরীবানু সুন্দর মেয়ে নামাসুদ পুরোপুরি পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর কিছু যে আসছে সে বুঝতে পারছে কতটা ভয়ঙ্কর সে-সম্পর্কে তার ধারণা নেই সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেনমাসুদ যাওপরীবানুর পায়ে কদমবুসি করে বলো— তুমি আমার মা এটা বলতে দোষের কিছু নাই 

মেয়েছেলে মায়ের জাত বয়সে ছোট মেয়েকেও মা ডাকা যায় যাওদেরি করবা না দেরি আমার ভালো লাগে না পরীবানু এখন থেকে তোমার মা লীলার কাছে মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা এখন আর হাসিতামাশা রসিকতার পর্যায়ে নেই বাড়াবাড়ি ভালো জিনিস না 

সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাসুদ পরীবানুর কাছে এসে বসে পড়ল হাত দিয়ে পা স্পর্শ করল নাতবে মুখ বিড়বিড় করে বললআপনি আমার মা পরীবানু কাঁদছে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে নাতবে শরীর কাপা দেখে বোঝা যাচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান বললেনশাস্তি সামান্য বাকি আছেআমার এই ছেলে লজার মাথা খেয়েছে তার এখন লাজলজা নাই যে-মেয়ের সঙ্গে ভাব ভালোবাসার চেষ্টা করেছে তারেই মা ডাকতেছে

সুলেমানএখন আমার বেহায়া ছেলেরে কানো ধরে সারা গ্রামে একটা চক্কর দেবার ব্যবস্থা করো ন্যাংটা করে চক্কর দেয়াবে গায়ে যেন একটা সুতাও না থাকে লজ্জা যখন নষ্ট হয়েছে পুরোপুরি নষ্ট হোক দেরি করবা নাএরে ন্যাংটা করো এইখানেই করো মেয়েরা উপস্থিত আছে তাতে কোনো অসুবিধা নাই মেয়েদের মধ্যে একজন এখন সম্পর্কে তার মা হয়মার সামনে পুত্র নগ্ন হতে পারে এতে লজ্জা নাই 

লীলা অবাক হয়ে দেখলসত্যি সত্যি সুলেমান নামের লোকটা মাসুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যে-ভঙ্গিতে এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে নগ্ন করার কাজটা সে করবে 

লীলা সুলেমানের দিকে এক পা এগিয়ে কঠিন গলায় বললসুলেমান শুনুনখবরদার! যথেষ্ট হয়েছে সুলেমান থমকে দাঁড়াল হতভম্ব হয়ে তাকাল একবার লীলার দিকে আরেকবার সিদ্দিক সাহেবের দিকে সিদ্দিক সাহেব এখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছেন বাতাসের কারণে সিগারেট ধরানো যাচ্ছে না দেয়াশলাই বারবার নিভে যাচ্ছে তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আশেপাশে কী ঘটছে না-ঘটছে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই মাসুদ মেঝেতে বসেছিল লীলা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল 

লীলা হাত বাড়িয়ে বললআসো আমার সঙ্গে মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল লীলা হাত ধরে তাকে নিয়ে বাগানের দিকে রওনা হলো মাসুদ এখন কাঁদতে শুরু করেছে শব্দ করেই কাঁদছে সিদ্দিক সাহেবের সিগারেট শেষ পর্যন্ত ধরেছে তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন– এ আমার বড় মেয়েআমার বড় মেয়ের কথার উপরে আর কোনো কথা নাই আজ থেকে তার কথাই খাবাড়ির শেষ কথাতোমরা ভিড় করে থাকবে না যাওযে যার কাজে যাও অতি দ্রুত লোকজন সরে গেল সিদ্দিকুর রহমান আবারো ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন 

চোখ বন্ধ করে বললেন— সুলেমানআমার বড় মেয়েকে কেমন দেখিলাবাপকা বেটি নাজিবাপকা বেটি মাসুদরে আমি ন্যাংটা করে শাস্তি দিতাম না এই শাস্তি দেয়া যায় না তারপরেও এরকম একটা শাস্তির কথা কেন বললাম জানোজি না আমার বড় মেয়ে কী করে সেটা দেখার জন্যে যেরকম করবে ভেবেছিলাম সে-রকম করেছে মাশাল্লাহ! মেয়েটা হয়েছে অবিকল তার মার মতো যেরকম চেহারাসেরকম স্বভাবচরিত্র 

সিদ্দিকুর রহমানের চোখে দ্বিতীয়বার পানি এসেছে তার বড় ভালো লাগছে সুলেমান! জিআবার জিজ্ঞেস করতেছিভেবেচিন্তে বলো এই মেয়ে বাপকা বেটি নাজিবাপকা বেটি একটা মজার কথা বলি শোনো— আমার দাদাজান একবার সন্ধ্যাকালে করলেন কীলম্বা একটা বাঁশের মাথায় একটা হারিকেন ঝুলায়ে বাশটা বাড়ির উঠানে পুতে দিলেন সবাই জিজ্ঞেস করলব্যাপার কীদাদাজান বললেনএকটা ঘটনায় আমার মনে খুব আনন্দ হয়েছে এইজন্যে কাজটা করলাম সবাই জানতে চাইলঘটনা কী

দাদাজান বললেন— ঘটনা কী আমি বলব না আমার মনের আনন্দটা সবাই দ্যাখা আনন্দের পেছনে ঘটনা জানার দরকার নাই দাদাজানের মতো আজ আমার মনেও আনন্দ হয়েছে বাশের আগায় একটা হারিকেন আজকেও ঝুলাও সুলেমান বললজি আচ্ছা কেউ যদি জানতে চায় ঘটনা কী— কিছু বলব না সব ঘটনা সবার জানার দরকার নাই সকখঘটনা শুধু আল্লাহপাকই জানবেন আর কেউ নাজি আচ্ছা রাতে বড়খানার ব্যবস্থা করো মাংস রান্নার জন্যে ফজলুরে খবর দিয়া আনো জি আচ্ছাপশ্চিমের পুকুরে জাল ফেলবহুঁফেলো জাল টানার সময় আমার মেয়েরে নিয়া যাবে সে দেখে মজা পেতে পারে জি আচ্ছা 

আজি দুপুরে আমি কিছু খাব না উপবাসে যাব রাতে বড় মেয়ের সাথে খানা খাব জি আচ্ছা উনার থাকার ব্যবস্থা কোনখানে করবলীলা থাকবে পুরনো বাড়িতে শহরবাড়িতে না আমার ঘরের উত্তরের ঘরটা তারে দেও ঘরের তালা খুলার ব্যবস্থা করো জি আচ্ছা রাত আটটা বাজে এশার নামাজ শেষ করে সিদ্দিকুর রহমান পুরনো বাড়ির বারান্দায় চাদর গায়ে বসে আছেনতার বসার জন্যে উঠানে পাটি পাতা হয়েছে পাটির উপর সতরঞ্জি বিছানো বাড়ির উঠানে মাংসের বিখ্যাত কারিগর ফজলু মিয়া মাটির বড় হাঁড়িতে খাসির মাংস বসিয়েছে শুধুমাত্র পিয়াজের রসে মাংস দমে সিদ্ধ করা হচ্ছে কাজটা জটিল আগুনের আঁচ বেশি হতে পারবে না আবার কমও হতে পারবে না হাঁড়ির মুখের ঢাকনা আটা দিয়ে আটকানো ফজলুর দৃষ্টি আটার দিকে— ফুটো হয়ে বাষ্প বের হয়ে যাচ্ছে কি-না মাছ রান্না হচ্ছে ভেতর বাড়িতে প

শ্চিম পুকুর থেকে ছটা বড় মাছ ধরা হয়েছেএকটা কাতলওজন আঠারো সের আরেকটা নানিদ মাছের ওজন সাত সের এত বড় আকৃতির নানিদ মাছ সচরাচর পাওয়া যায় না লীলার ভাগ্যে এত বড় নানিদ ধরা পড়েছে এটা একটা সৌভাগ্যের লক্ষণ কারো নাম করে পুকুরে জাল ফেললে কী মাছ ধরা পড়ে তা দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা হয়ে যায় একবার ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব এসেছিলেনতার নামে জাল ফেলার পর কয়েকটা গজার মাছ ছাড়া কিছু উঠে নি ভেতরবাড়ি থেকে লীলা বের হয়েছে সে উঠানে নেমে গেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বাঁশবাগানের দিকে বাঁশবাগানে লণ্ঠন ঝুলানো হয়েছে সে লণ্ঠন থেকে চোখ নামিয়ে তাকাল বাবার দিকে সিদ্দিকুর রহমান জানতেন তাঁর মেয়ে এই কাজ করবে চোখে যেন চোখ না পড়ে সে-জন্যেই তিনি আগে থেকেই অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন তবে মেয়ে কী করছে না করছে তা তিনি লক্ষ রাখছেন মানুষ অন্যদিকে তাকিয়েও আশেপাশের কিছু দৃশ্য দেখতে পারে। 

লীলা ফজলু মিয়ার কাছে গেল। ফজলু মিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এখন আবার লীলা তাকাচ্ছে বাঁশবনের দিকে। লণ্ঠনের ব্যাপারটা মনে হয়। মেয়ের মাথা থেকে যাচ্ছে না। মেয়ে এখন এগিয়ে আসছে তার দিকে। এখন মেয়ের দিকে তাকানো উচিত। লীলা বললবসি আপনার পাশেসিদ্দিকুর রহমান হাতের ইশারায় লীলার বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন এই মেয়ে কত সহজেই না তার সঙ্গে কথা বলছে! সিদ্দিকুর রহমান বললেনতোমার থাকার ঘর পছন্দ হয়েছেলীলা কিছু বলল না ঘর তার পছন্দ হয় নি অন্ধকার ঘরছোট জানালা বিশাল ঘরের প্রায় পুরোটা জুড়েই গাবদা এক খাট শহরবাড়ি নামের বাংলোর ঘরগুলি অনেক সুন্দর সেখানে থাকতে পারলে হতো কিন্তু তাকে বলা হয়েছে এই ঘরে থাকতে

সিদ্দিকুর রহমান বললেনতুমি যে ঘরে থাকবে সেই ঘরে তোমার মা থাকতেন লীলা বিস্মিত হয়ে বললসত্যিহ্যাঁ তোমার মা চলে যাবার পর আমি এই ঘর তালাবন্ধ করে দেই আজ তোমার জন্যে তালা খোলা হয়েছে এই গাবদা খাট মার পছন্দ ছিলহুঁ এই খাটের একটা নাম আছে— ময়ূরখাটআমার দাদা খান বাহাদুর হামিদুর রহমান সাহেব তার স্ত্রীর জন্যে বানিয়েছিলেন তবে তিনি এই খাট কখনো ব্যবহার করেন নাই কেন করেন নাইসেটা জানি না মানুষ সব জানতে চায় কিন্তু জানতে পারে না 

আমরা অল্পই জানি কিন্তু ভাব করি অনেক জানি লীলা বাবার কথায় সামান্য চমকালোসিদ্দিকুর রহমান বললেনতুমি এখন নিজের কথা বলো তোমার বিষয়ে জানতে ইচ্ছা করছে কী জানতে চানপড়াশোনা কতদূর করেছবিএ অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সামনের মাসে রেজাল্ট হবেবলে কি! পরীক্ষা কেমন হয়েছেভালো হয়েছে পড়াশোনা কোথায় করেছঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি ইডেন কলেজ থেকে তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটি তুমি পড়াশোনায় কেমনভালোইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে থার্ড হয়েছিলাম 

সিদ্দিক সাহেব তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তার চোখে আনন্দের চেয়েও যেটা বেশি তার নাম বিস্ময় সিদ্দিকুর রহমান বললেনহঠাৎ যে আমাকে দেখতে আসছ— এর পিছনে কি কোনো কারণ আছেকোনো কারণ নাই সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেনসামান্য যে পশু সেও কারণ ছাড়া কিছু করে না মানুষ তো কখনোই করে না তবে সব কারণ মানুষ নিজে জানে না অন্য একজন জানে অন্য একজনটা কেআল্লাহপাক 

মাতুমি কি নামাজ পড়ো

মাঝে মাঝে পড়ি 

কোরআন মজিদ পড়তে পারো

পারি

তোমার নাম যে লীলাবতী রাখা হয়েছেকেন রাখা হয়েছে সেই কারণ কি জানো

জানি নাআমি শুধু জানি মা সবাইকে বলে রেখেছিল তাঁর যদি মেয়ে হয় তার নাম যেন লীলাবতী রাখা হয় 

ছেলে হলে কী নাম রাখা হবে বলে নাই

না 

আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— বাঁশগাছের মাথায় হারিকেন ঝুলছে কেনসিদ্দিকুর রহমান বললেনআমার মনে খুব আনন্দ হয়েছে এটা জানানোর জন্যে বাঁশগাছের আগায় হারিকেন আনন্দ পেলে মানুষ তার আনন্দের খবর সবাইকে জানাতে চেষ্টা করেমানুষ দুঃখ পেলে কিংবা কষ্ট পেলে তার খবর কিন্তু জানাতে চায় না গোপন করে রাখে মানুষ ছাড়া অন্যসব পশুপ্রাণীজগতের নিয়ম কিন্তু ভিন্ন পশু বা পক্ষীজগতের নিয়ম হলোদুঃখ-কষ্ট চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জানাও আনন্দের খবর গোপন রাখো লীলা হেসে ফেলল 

সিদ্দিকুর রহমান বললেনমাতুমি হাসো কেনআপনার কথা শুনে হাসি আমার কথা শুনে কেন হাসলেলীলা বললকী জন্যে হেসেছি তার কারণ আমি জানি না অন্য একজন হয়তো জানেন কিন্তু তিনি তো কিছু বলেন না সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন লীলা তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে কেউ চোখের পাতা ফেলছে না মনে হয় একজন অন্যজনকে বোঝার চেষ্টা করছে



Post a Comment

0 Comments