মুক্তিযুদ্ধের বৈরী সময়ে “জয় বাংলা” স্লোগানটি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। কোন অপারেশন বা সম্মুখ যুদ্ধে জয়ের পরপরই যোদ্ধারা “জয় বাংলা” বলে গগণ বিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠতো। তবে এই স্লোগানটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামেও ব্যবহৃত হয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। উৎস সূত্রে এটি প্রথম কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের তার “পূর্ণ-অভিনন্দন” কবিতায় ব্যবহার করেন। কবিতাটি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কারাবরণকারী মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তি উপলক্ষে লেখা হয়। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্ব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ডাকা সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমানের উচ্চারণে স্লোগান হিসেবে প্রথম শোনা যায়। পরবর্তীতে ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান স্লোগানটি ব্যবহার করেন। তবে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের পর স্লোগানটি জনপ্রিয়তা পায়।
এছাড়াও বর্ষীয়ান মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী “স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ” কিংবা “আজাদ বাংলা জিন্দাবাদ” স্লোগানটি ব্যবহার করতেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান ব্যবহার হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। হয়তো “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”–এর সাথে মিল থাকায় এই স্লোগান জনপ্রিয়তা না হবার পিছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য–মুক্তিযুদ্ধে “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” স্লোগানটিও ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও ইতিহাস পরম্পরায় এই স্লোগানটিকে রাজাকারদের স্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাছাড়াও জঙ্গিকার্যক্রমে এই স্লোগানের প্রত্যক্ষ ব্যবহার দেখা যায়। ঈমানী চেতনায় জাগ্রত মুসলমান এবং ইসলামী রাজনীতিতে যুক্ত ব্যক্তিরা এই স্লোগানকে এখনও আঁকড়ে আছে–এবং সন্দেহাতীত ভাবে ভবিষ্যতেও থাকবে। হয়তো সাম্প্রদায়িকতার জন্যও সচেতন ভাবে এই স্লোগানকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে দূরে রাখা হয়ে থাকবে।
সম্প্রতি “
দামাল” সিনেমায় রাজাকারের মুখে “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়েছে। সিনেমাটির ট্রেইলার প্রকাশ হবার পর থেকেই নেটদুনিয়ায় বেশ জোরেশোরেই আলোচনা হচ্ছে–কেন “নারায়ে তাকবীর” রাজাকারের মুখে ব্যবহার করে ইসলামকে ছোট করা হচ্ছে! এই পক্ষের লোকরা যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছেন কমান্ডার সালেহ চৌধুরীর (১১ নভেম্বর ১৯৩৬ – ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭) “ভাটি এলাকার মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার” বইয়ের উদ্ধৃতি। সেখানে সালেহ চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, শহীদ জগতজ্যোতি দাসের (২৬ এপ্রিল ১৯৪৯ – ১৬ নভেম্বর ১৯৭১, বীর বিক্রম, কমান্ডার "দাস পার্টি") মতো হিন্দু মুক্তিযুদ্ধারাও মুক্তিযুদ্ধে “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” স্লোগান দিতেন। জ্যোতির মতে এই স্লোগানে নাকি শক্তি পাওয়া যেত–তিনি জোর দিয়ে আরও বলেছেন, হারামজাদারা কি আল্লাহ্কে কিনে নিয়েছে নাকি? এখানে আরও একটা বিষয় উল্লেখ করাবার মতো, অনেক স্বসস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার বয়ানে শোনা যায়, তারা সম্মুখ যুদ্ধে মর্টার ও ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মোকাবেলা করাবার আগে “নারয়ে তাকবীর” ধ্বনী দিতেন। যা শহীদ জ্যোতি বীর বিক্রমের বক্তব্যের সাথে মিলে যায়।
সালেহ চৌধুরী তাঁর বইতে আরও উল্লেখ করেছেন, “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” ধ্বনী শুনে তিনি চমকে যান এবং স্টেনগান হাতে ঘাটের দিকে দ্রুত দল নিয়ে বেরিয়ে যান। গিয়ে দেখেন জ্যোতি গলা ছেড়ে বাকিদের সাথে “নারায়ে তাকবীর” দিচ্ছে। এখানে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য–এক. “নারায়ে তাকবীর” রাজাকারদের ধ্বনী ভেবে তিনি কাছাকাছি রাজাকারদের উপস্থিতি অনুমান করেছিলেন। দুই. মুক্তিরা শত্রুদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং তাকবীর দিচ্ছে–ভেবে তিনি অস্ত্র হাতে ঘাটের দিকে বেরিয়ে গিয়েছেন। কোনটা সত্যি সালেহ চৌধুরী বেঁচে থাকলে তার সত্যতা পাওয়া যেতো।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন আদর্শ ও মননের লোকের অংশগ্রহণ ছিল। কেউ যেমন দেশকে সাম্প্রদায়িকতার বাইরে একটি সমআধিকারের দেশের স্বপ্নে যুদ্ধ করেছেন (যেটাই মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র) তেমনই অসংখ্য মুসলমান নিজেদের ধর্মের ওপর অবিচল থেকেই পাকিস্থানি শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি চেয়ে যুদ্ধ করেছেন। ঠিক একই ভাবে ভারতীয় আগ্রাসন থেকেও মুক্তির পথ খুঁজেছেন। সেসব মুসলমানসহ বহু মুসলমানের মুখের ধ্বনি ছিল “নারায়ে তাকবীর”।
দামাল সিনেমায় হয়তো প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়েই ইসলামকে ছোট করবার মানসিকতা থাকতে পারে–আবার নাও থাকতে পারে। হয়তো সংখ্যাগুরুর মনোভাবকে প্রাধান্য দিয়ে সিনেমার সংলাপ সাজানো হতে পারে। সে যাই হোক না কেন ইতিহাসের পাতায় মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত সব স্লোগানকেই স্থান দেওয়া উচিত। কারণ স্বাধীনতার পর “জয় বাংলা” স্লোগানটিও অনেক অন্যায় কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। জয় বাংলা বলে রক্ষী বাহিনী খুন করেছে, “জয় বাংলা” বলে ছাত্রলীগ মানুষ হত্যা করেছে, “জয় বাংলা” বলে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে, “জয় বাংলা” বলে টেন্ডারবাজি হয়েছে, “জয় বাংলা” বলে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে। তাই বলে স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহৃত “জয় বাংলা”র অবেদন এতটুকু কমেনি। তবে “নারায়ে তাকবীরে”র বেলায় তা কেন সত্য হবে।?
লেখা: আকাশ মামুন।
0 Comments