জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা ।। মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া


যুদ্ধের অনেককাল পরে যুদ্ধে শহীদ শরীফের স্ত্রী এসেছে শরীফের অধিনায়ক কর্নেল শফির কাছে। শরীফের স্ত্রী শফিকে বলছেন- "ভাইএকাত্তরের আগেই আমি মা-বাবাকে হারিয়েছি। মামার কাছে মানুষ। শরীফ আর আমি কারমাইকেল কলেজে একই সাথে পড়তাম। কাঁচা বয়সের ভালোলাগা। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগে ১৬ মার্চ আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করি। শরীফের বাড়ি রংপুরে। বদরগঞ্জ থানার কাঁচাবাড়ি গ্রামে। শরীফের মা-বাবা আমাকে ঘরের বৌ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন না। তবুও মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। আমাদের আলাদা থাকতে হতো শ্বশুর-শ্বাশুড়ির নির্দেশে। 

একটা কাজের জন্য আপনার কাছে এসেছি। আপনার যত কষ্টই হোক না কেনশরীফের কবরটা আমাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার জন্য নয়নিয়াজের জন্য। না-দেখা বাবার কাছে ওর অনেক জিজ্ঞাসা। আমি যার কিছুরই জবাবই দিতে পারি না।

এপ্রিলের প্রথম দিকেই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল শরীফ। আমাকে বলে গেল কিছুদিন অপেক্ষা করতে। অক্টোবর মাসের এক গভীর রাতে দরজায় টোকার শব্দ। অন্ধকার নিঝুম রাত। পাড়াশুদ্ধ সবাই ঘুমিয়ে। দরজা খুলতেই দেখি শরীফ। সেই-ই প্রথম রাত আমরা এক সঙ্গে কাটালাম। সে রাতে আমরা একটুও ঘুমাইনি। শেষরাতে শরীফ বিদায় চাইল। সে যে সে-রাতেই চলে যাবেআগে আমাকে একটুও বলেনি। আমি বললামএকটু পরে যাও। ও বাঁধা শুনল না। আমি বললামতুমি তো ডিম পছন্দ করো,একটা ডিম ভেজে দিচ্ছি। অন্তত ডিমটা খেয়ে যাও। সময় লাগবে না। উঠানের ওপরে এক চিলতে রান্নাঘর। পাটখড়ি দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে কড়াইয়ে ডিম ছেড়েছিদেখি ও চলে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরলাম। রাখতে পারলাম না কিছুতেই। ও চলে গেল। এসে দেখি ডিমটা পুড়ে গেছে।

দু'গাল বেয়ে পানি পড়ছে শরীফের স্ত্রীর। তবুও বলে চলছে-দেশ স্বাধীন হলো। আমার জীবনেও পরিবর্তন এলো। শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলাম। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করলাম। নিয়াজ এলো কোলে। শরীফের ছেলেকে বুকে নিয়ে নিজের দু'টি দুর্বল পা নিয়ে টলতে টলতে জীবনের নিঃসঙ্গ পথ চলতে শুরু করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলামঅনার্সে প্রথম শ্রণী পেলামমাস্টার্সেও প্রথম শ্রেণী পেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা শুরু করলাম। নিয়াজ বড় হতে লাগল।

নিয়োজকে আমি শিশুকাল থেকে একটি ডিমও খেতে দেইনিনিজেও খাইনি। পা পা করে অনেকটা পথ চলে এসেছি। আমার নিয়াজ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ক'মাসের ভালোবাসা আর ক'দিনের বিবাহিত জীবনের বন্ধু শরীফকে হৃদয়ে নিয়ে চলেছি। একটা অর্থ করবার চেষ্টা করেছি জীবনের। যুদ্ধের বিভীষিকা আমার চেয়ে বেশি বোঝার লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। ভাইএকটা কাজের জন্য আপনার কাছে এসেছি। আপনার যত কষ্টই হোক না কেনশরীফের কবরটা আমাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার জন্য নয়নিয়াজের জন্য। না-দেখা বাবার কাছে ওর অনেক জিজ্ঞাসা। আমি যার কিছুরই জবাবই দিতে পারি না। 

 

Post a Comment

0 Comments