দুপুরের ঝাঁঝালো রোদ। মানুষ ও বাসের গরমে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত! সেই কখন থেকে বসে আছি বাসে। গুলিস্থান থেকে শাহাবাগ আসতেই প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল। রাস্তায় ভীষণ জ্যাম। এর মধ্যে আবার কেউ কেউ সইতে না পেরে বাস থেকে নেমেই স্রেফ হাঁটা ধরেছে।
এই অসহ্য গরমে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। সিট থেকে কিছুক্ষণের জন্যে যে উঠে দাঁড়াবো তারও কোন উপায় নেই। এই জ্যামের মধ্যেও এখনো বাসে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই। আসলে মানুষকে তার নিজের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে কত কষ্ট সইতে হয়। আমি হলে হয়তো এতক্ষণে মাথা ঘুরেই পড়ে যেতাম। মনে মনে ভাবি আর অস্থির চোখে জানালা গলিয়ে রাস্তার ভাবগতিক দেখার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর বাসটার শরীর একটু নড়ে উঠতেই মুহূর্তেই সিন্ধান্তটা বদলে ফেললাম। যদিও যাওয়ার কথা ছিল কলাবাগান কিন্তু এর বেশ আগেই নেমে গেলাম সিটি কলেজ।
ক'দিন হলো সেমন্তীর সাথে দেখা করার কথা মাথায় আসছিলো। কিন্তু নানান ঝামেলায় আর দেখা হয়ে ওঠেনি। দেখা যাক, সেমন্তীকে ফোনে পাওয়া যায় কিনা। আজকাল ওকে ফোনে পাওয়াটাও মুশকিল হয়ে পরেছে!
- হ্যালো, অপলা, বলো। শুনছি। কেমন আছো তুমি?
- ভালো। আমি এখন তোমার এলাকায় আছি। তুমি আছো, না চলে গেছো?
- কোথায় এখন? আছি তো। মাত্র স্কুল ছুটি হয়েছে।
- ধানমন্ডি ৩। আমি কি তোমার স্কুলের ওদিকে আসবো?
- হ্যাঁ, চলে আসো। স্কুলে ঢোকার মুখের সেই রাস্তাটায় আসো তুমি। আমি ওখানেই দাঁড়াচ্ছি। আসতে কতক্ষণ লাগবে তোমার?
-এই ধরো ১৫ মিনিট।
-ঠিক আছে, আসো।
সেমন্তীর সাথে মাস দুয়েক আগেও দেখা হয়েছিল একবার, তাও আবার কয়েক মুহূর্তের জন্য। ওর তাড়া ছিল বলে বেশিক্ষণ থাকেনি ও। তখন ও বোরখা পড়া ছিল। আজ সে খয়েরী রঙের কামিজ পড়েছে। মুখে ক্লান্তির একটা ছাপ থাকলেও হাসিখুশি ভাবটা এখনও রয়ে গেছে।
স্কুল থেকে ১০মি: হেঁটে গেলেই ওর বাপের বাড়ি। বাড়িতে মা আর ছোট দুই ভাই-বোন ছাড়া কেউ থাকে না। বাকী ভাইগুলো যে যার মতো বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে।
প্রতিদিন স্কুল শেষে বাপের বাড়ি চলে আসে সেমন্তী। ওখানেই দুপুরের খানা সেরে নেয়। বিশ্রাম নিয়ে এরপরই বাসায় ফেরে ও।
-তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে, সেমন্তী! বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন তোমার।
- বিশ্রাম তো নেই। কিন্তু এই কয়েক মাস হলো শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এই তো কিছুদিন আগেও পিরিয়ড হয়ে গেল এখন আবার নতুন করে পিরিয়ড শুরু হয়েছে। বাচ্চাটা অ্যাবরশান হওয়ার পর থেকেই নানান জটিলতা লেগেই আছে শরীরে।' জানালো সেমন্তী।
সেমন্তীর সাথে পরিচয় আমার অনেক আগে থেকে। তা ও বাইশ- তেইশ বছর তো হবেই। কী শান্ত -স্নিগ্ধ মেয়ে ছিল ও। এখনো সেই রকমই আছে। একটুও বদল হয়নি। 'দেশ থিয়েটারে'র সাথে জড়িত ছিলো ও। আমার সাথে ওর পরিচয় থিয়েটার থেকেই। প্রায় সময়ই ওদের বাসায় খাওয়া হতো আমার। এখনো মনে আছে, বেশ ক'দিন আমরা পা'য়ে হেঁটে শাহাবাগ থেকে ওদের মোহাম্মদপুরের বাসা অব্দি চলে গিয়েছিলাম। ওকে দেখে তখন আমার বেশ অবাক লাগতো, সেই রাত দশটার সময় পিজি'র ওখান থেকে বাসে করে মোহাম্মদপুর চলে যেতো ও। অবশ্য ওদের এলাকাটা রাত বারোটা পযর্ন্তও বেশ জমজমাট থাকতে দেখেছি। আমাদের এলাকার মতো ভুতূড়ে হয়ে যেতে নি কখনও।
সেমন্তীকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম বিয়ের পর কেমন যেন মিইয়ে গেছে মেয়েটি। মুখে হাসি হাসি ভাবখানা আছে ঠিকই কোথায় যেনো একটা তীব্র যন্ত্রণা রয়ে গেছে। দেখলাম, ভাতটা খেয়েই বাসায় যাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে ও।
-মাত্র তো খাওয়া দাওয়া সারলাম। বিশ্রাম নিয়ে এরপর না হয় বের হই।, বললাম আমি।
- না রে ভাই আমার সেই সুযোগ নেই। বাসার কর্তার কড়া নির্দেশ, ছয়টার মধ্যেই ঘরে ফিরতে হবে। না হলে ফোনের ওপর ফোন করে অস্থির করে তুলবে আবার।
-আমার কিছু কেনাকাটা আছে, তেমন কিছু না পন্ডসের একটি বেবি পাউডার নিবো। জানালাম আমি।
দেখলাম সে তড়িঘড়ি করে পরনে জড়ানো খয়েরী রঙের কামিজের ওপর একটা বোরখা চড়িয়ে নিলো। ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে ওকে। হাত উল্টে ঘড়ি দেখে নিচ্ছে বারবার।
সেমন্তী কখনো সংসার পাতার স্বপ্ন দেখে নি। পারিবারিক কলহ,বিবাদ আর অনাচার দেখেই হয়তো বিয়ের ওপর বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল ওর। তাই বলে, তার এমনতর সিন্ধান্ত পাড়া-প্রতিবেশী আর আত্মীয়রা মেনে নেবেই বা কেন। বয়স হয়েছে অথচ দিব্যি ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছে, তা তো আর মেনে নেয়া যায় না! তাই বিয়ে হচ্ছে না বলে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনদের নানান টিপ্পনী সইতে সইতে একেকটি দিন পাড় করতে হতো ওকে। ছোট ভাইদের বিয়ে হয়ে গেছে অথচ বড় বোন বিয়ে করছে না। যে যেভাবে পারছে আড়েঠাড়ে নানান কটূ কথা শুনিয়ে যাচ্ছে সেমন্তী 'র মা'কে। ওর মা'ও যেনো এত ভার আর নিতে পারছিলেন না। শেষমেষ এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই বিয়ে করতে রাজি হতে হলো সেমন্তীকে।
স্বামী ব্যাংকে চাকরী করে। স্বামীর ও বয়স হয়েছে। ব্যাটে-বলে কাউকে পচ্ছিলো না বলে বিয়ে করা হয় নি এতো দিন। কাজেই বিয়ের শুরু থেকেই বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাবতে হয়েছিল ওদের। বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় অনেক চেষ্টার পর কাংঙ্খিত সেই ভ্রুণের আগমন ঘটলো সেমন্তী'র গর্ভে। কাজেই অনাগত সন্তানকে নিয়ে ওদের আনন্দের শেষ নেই। প্রতিদিন হাত দিয়ে অনুভব করে পেটের বাচ্চাটিকে। বাচ্চা যখন পেটের মধ্যে নাড়াচাড়া করে তখন সেমন্তী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নাড়াচাড়ার কোন শব্দ না পেলেই অস্থির হয়ে ওঠে ও। এদিকে বাচ্চার বয়স যখন সাত মাস হতে চলল নাড়াচাড়ার গতিও যেনো ধীর হতে লাগলো। সাথে সাথে যে গাইনী ডাক্তারের ফলোআপে ছিল সে, বিষয়টি জানানো হলো ওনাকে । তাৎক্ষণিকভাবে চেক আপ করানো হলো সেমন্তীকে। জানানো হলো বাচ্চার হৃদপিণ্ড পরিপূর্ণভাবে সুগঠিত হয়নি। যে কোন সময দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। করোনার তীব্র প্রকোপ চলছে তখন। সাত মাস পর বাচ্চার নাড়াচাড়া যখন একেবারেই থেমে গেলো তখন অ্যাবরশান করার সিদ্ধান্ত নিলো ডাক্তার। সেমন্তীর তলপেট কেটে মৃত বাচ্চা বের করে নিয়ে আসা হলো শেষ পর্যন্ত।
আমি সেমন্তীর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সেই ফোলা ফোলা মুখ আর ভাসা চোখ দুটো যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে অদ্ভুতভাবে। চোয়ালের সাথে বসে গেছে যেনো মুখোমণ্ডলের দু'পাশ। বির্বণ মুখে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে বাসের জানালা ঘেঁষে হেলান দিয়ে বসে আছে সেমন্তী।
-বাচ্চাকে কি ঢাকাতেই কবর দেয়া হয়েছিল? জানতে চাইলাম আমি।
- আমাদের বাসা থেকে কিছু দূরেই এক কবরস্থানে মাটি দেয়া হয়েছে ওকে। জানো, কোন বিশেষজ্ঞ গাইনী ডাক্তারকে দেখালে ও হয়তো পৃথিবীর আলো দেখতে পেতো। কতবার বিশেষজ্ঞ একজন গাইনী ডাক্তারকে দেখানোর কথা বলেছি আমি। একবারের জন্যও আমার কথার কর্ণপাত করেনি আমার স্বামীর পরিবারের লোকজন। উল্টো ওর বড় বোন এখনও গলা উঁচিয়ে শুনিয়ে দেয়, যে আসবার সে এমনিতেই আসে। সেজন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দরকার পরে না। আমরাও তো বাচ্চার মা। আর তাছাড়া তোমার বয়স হয়েছে। এই বয়সে বাচ্চার এমন জটিলতা হবেই। এই বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সেমন্তী। 'এখন ও এক বছরে পড়তো, জানো।',দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও।
- তুমি ওকে দেখতে যাও না?
- শুধু একবারই গিয়েছিলাম দেখতে। এরপর থেকে আর যেতে ইচ্ছে করে না। ওর কবরের পাশে গেলে ভীষণ যন্ত্রণা হয় আমার! আমি যাই না, আমার হাজব্যান্ড যায়। ওখানে আমার ননদের ও কবর আছে তাই একসাথে ওদের দেখে আসে ও।'
সেমন্তী আগের মতো আর ফেইসবুকেও থাকে না। বন্ধুদের সাথে আগের মতো আর ফোনে কথা বলে না। ওর জগৎ বলতেই এখন স্কুল আর বাসা। কোন একদিন নাকি এফবিতে কে যেনো বাজে কিছু ছবি পাঠিয়েছিল, সেই থেকে পাল্টে গিয়েছিলো বাসার পরিস্থিতি। তাই এই ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পেতেই ফেইসবুকে বসাও বন্ধ করে দিয়েছে ও। সেমন্তী ওর মোবাইল ঘেটে ওদের পারিবারিক কিছু ছবি দেখাচ্ছিলো আমায়। সেই সুবাদে ওর স্বামীকে এক নজর দেখতে পেলাম আমি। লম্বায় ওর সমান প্রায়। সাদামাটা চেহারা। এক মুখ ভর্তি দাড়ি। বয়সে ওর সমসাময়িক হবে বলেই মনে হলো।
-আচ্ছা, তুমি ওর সব বন্ধুদের চেনো, যাও ওদের বাসায়?
খুব অবাক হয়েছে বলেই মনে হলো সেমন্তীকে।
- কী আশ্চর্য! যাবো না কেনো। কোথাও তেমন ঘুরতে নিয়ে যায় না ঠিকই, তবে বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ীতে কোন অনুষ্ঠান হলে আমরা একসাথেই যাই। কিন্তু কোন বন্ধুর সাথে তেমন মিশতে দিতে চায় না ও। তা ছেলে বন্ধু হোক কিংবা মেয়ে বন্ধু হোক।
- আচ্ছা, একটা কথা বলতো। সে তোমার ফেইসবুকে পাঠানো ঐ বাজে ছবি দেখতে পেলো কি করে?
- ও আমার মোবাইল নিউজ শোনার জন্যে ব্যাবহার করতো, ফেইসবুক লগ আউট করা ছিলো না বলে ছবিগুলো ওর চোখে পরে যায়। এর পর থেকেই তো শুরু হলো নানান খবরদারি। এসব আর ভালো লাগে না বুঝলা। একে শরীর ভালো না এর মধ্যে এই রকম একটা বাজে চাপ! কোন কোন সময় বাসায়ও ফিরতে ইচ্ছে করে না আমার। সংসার টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে এই অত্যাচার মেনে নিতে হচ্ছে আমাকে!
- তুমি তোমার স্বামীর ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড জানো। তোমাকে ব্যাবহার করতে দেয় ওর মোবাইল?
- না, দেয় না। আফসোসের সুরে বলল সেমন্তী। আমিও এসব নিয়ে আর আগ্রহ দেখাই না। তবে ওর বন্ধু ও কলিগদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে, অথচ আমার বেলায় নানান প্রশ্নের মুখে পরতে হয় আমাকে। বন্ধুদের সাথে এত কিসের কথা আরও কত কিছু বলে! তাই আমিও বাসায় ফোনে আর কারো সাথে তেমন কথা বলি না।
- এভাবে চাপে থাকলে তো তোমার এবারো বড় কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাবে! আমার কথা শোন,কারো ওপর ভরসা না করে তুমি নিজেই একজন বিশেষজ্ঞ গাইনী ডাক্তারের সাথে কথা বলো।
- ওর আর ওদের ভাই-বোনদের হাবভাব আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না। আমার যেভাবে হোক পরবর্তী বাচ্চাটা পৃথিবীতে আমার আনতেই হবে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
এই ভগ্নপ্রায় শরীরে এখনো সেমন্তী বাচ্চার স্বপ্ন দেখে। যতটা না সেমন্তীর স্বপ্ন তার চাইতে স্বামী ও তার পরিবারের চাপটাই যেনো বেশি! একটা মানুষের জীবনের কোন মূল্য নেই যেনো এখানে। মাঝেমধ্যে ভাবি, সেমন্তী ও আমার মধ্যে ফারাক কী খুব বেশি! ঠিক কোথায় যেনো এক সূতোয় গাঁথা পড়ে গেছি আমরা দু'জন!
0 Comments