রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশে পালা পার্বণের শেষ নাই। যদিও কথায় আছে বার মাসে তের পার্বণ কিন্তু হিসেব করলে তেরোর সীমানা ছাড়িয়ে তিন তেরং ঊনচল্লিশ পার! যেমন বোশেখের প্রথম দিন হালখাতা দিয়ে বছর বন্দনা বা নববর্ষ পালন করা হলেও–ওই শুরুর আগে আরেকটা শুরু লোকসমাজে প্রচলিত ছিল। যাকে বলে সলতে পাকানো।
তোর দুয়োরকে এলম বাবা
গাইতে ঘেঁটু গান
আমার ঘেঁটুর বিয়ে দিব
ওই বদ্দমান (বর্ধমান)।
ঘেঁটু ঘুর ঘুর ঘুর
আমার ঘেঁটুর বিয়ে দুব বহুত দূর।
ফাগুন সংক্রান্তি হলো ঘেঁটু সংক্রান্তি। ফাগুন সংক্রান্তিতে পাড়ায় পাড়ায় শুরু হতো ঘেঁটু গান। কোথাও পয়লা চৈত্র থেকে। তবে ওই ফাগুন সংক্রান্তির সকালে পুজো। বাঁকুড়া পুরুলিয়া সাবেক বর্ধমান বিশেষ করে পশ্চিম বর্ধমান, দুই ২৪পরগণা, বীরভূমের কোথাও কোথাও বসন্তের মাঝামাঝি অর্থাৎ এই মধুমাসের শেষ দিন ঘণ্টাকর্ণ বা ঘেঁটু পুজো হতো। কৃষিকেন্দ্রিক সমাজের লৌকিক দেবতা। পুজোয় পুরোহিত নেই, লাগে না। বাড়ির কর্ত্রী বা কোন একজন এয়ো এই লৌকিক ঠাকুরের পুজো করেন।মজার কথা ঘেঁটু কোথাও পুরুষ কোথাওবা নারী রূপে পূজিত হন। লোককথায় তিনি শিবানুচর।শীতলা যেমন হাম বসন্তে রোগের উপশম করেন তেমনি ঘেঁটু বা ঘণ্টাকর্ণ তুষ্ট হলে খোস-পাঁচড়া প্রভৃতি চর্মরোগ হয়না। তখনকার দিনে খোস-পাঁচড়া, দাদ চুলকানির আধিক্য ছিল। বিশেষতঃ শীতের মরশুমে ছোটরা চান করতে চাইতো না, করলেও তা নেহাতই কাক চান।
সাঁঝের আগেই বের হতো নাচ গানের দল। দলের সবাই পুরুষ। একজন কিশোরকে মেয়ে সাজানো হতো। সে নাচুনি। নাচতো ঢোল, ঢুবকি আর গানের তালে তালে। এ গান অনেকটা ছড়ার গান; অদ্ভুত সুরের গান। নাচ বা নাচের অঙ্গভঙ্গি কোমর দোলানি অনেক সময় শালীনতার সীমায় আবদ্ধ থাকতো না। এই গান হতো পথে পথে গৃহস্থের ঘরের উঠানে ―
পোদ্দার ঘরকে গেলম রে ভাই
পোদ্দার বলে বসো
আমার ঘেঁটুর বিয়ে হবে
গয়না নিয়ে এসো।
ঘেঁটু ঘুর ঘুর ঘুর
বেনা গাছে কড়ি আছে
বিয়ে দিব তুর।।
তেমনি একই ছড়ার গানে নাপিত ঘরে যায়। তাকে বলে আলতা নিয়ে আসতে। বামুন ঘর যায়। তাকে বিয়ে বসাতে বলে। শাঁখা পলা আনতে বলে শাঁখারীকে। তাঁতীকে কাপড়ের ফরমাশ করে। একই ছড়ায় কেবল কথা পাল্টিয়ে জানিয়ে দেয় যে বিয়ের কড়ি আছে "ওই বেনা গাছে।" আবার একই সুরে ―
ঘেঁটু ঘুর ঘুর ঘুর বাদ্যি বাজে
তাই শুনতে পলুই নাচে
আয়রে পলুই জুয়া খেলি।
জুয়া খেলায় হারলম
ছ’পণ কড়ি জিতলম।
ছ’পণ কড়ি একই গোড়া
তাই নিয়েছে হরি চোরা।
হরি চোরা লখিন্দর
হাল বলদ বার কর।।
কৃষিজীবী মানুষ। তাদের বিনোদনে তাদের লোক গানে কৃষি উপকরণ হাল বলদের কথা উঠে এসেছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। তেমনি কৃষি জীবনে ঢেঁকির গুরুত্ব অসীম। সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে ঢেঁকির গানটি এইরকম―
ও ধান ভানিব গো মাড়োয়ালির সনে
ঢেঁকি দিয়ে ধান ভানি শুন সকল জনে।
ঢেঁকিটা বলছেরে ভাই আমি নারদের নাতি
অষ্টাঙ্গ থাকতে সবাই ন্যাজে মারে নাথি (লাথি)।
পই দুটো বলছেরে ভাই আমরা দুটো ভাই
ঢেঁকি দিয়ে ভানে ধান রাধাকেষ্ট গাই।
গড়টা বলেরে ভাই আমার নাম হরে
যতলোকে ধান ভানে আমি রাখি ভরে।
মুখশ লাইট বলেরে ভাই আমার সামায় বাঁধা মুখ
আমার এঁটো খেয়ে সবার চাঁদ পারা মুখ।
কুলোটা বলে আমার মুখে ফুঁস ফুঁস;
যতলোকে ধান ভানে আমি ওড়াই তুষ।
সিকেন্নড়ি বলেরে ভাই মুখে বাঁধা কানি
যতলোকে ভানে ধান সুড়ুক সুড়ুক টানি।
ঘেঁটু দলের নাচনির পোশাক খুবই সাধারণ। একটু রঙ চঙে শাড়ি ঘাগরার মতো করে পরা। ঘটি হাতা জামা বা আঁটো ব্লাউজ এবং একটি ওড়না। নাকে ঝুটা নথ বা আকর্ণ টানানোলক। চুড়ি, কানে বড় বড় দুল। পায়ে ঘুঙুর। মাথায় ফুল। গলায় কাগজের মালা। হাতে ঝোলানো রুমাল। এক হাতে, দু'হাতেও! ব্যাস্ আর কিছু না। রঙিন ওড়নাটা মাথায় বুকে। এই ওড়নার আবরণ ঠিক আব্রু নয়,নাচের ঘোরে অনেকটা যেন বেখেয়ালি বেআব্রু হবার জন্যেই। যা দেখে সিটি পড়ে তালি বাজে,আদায়ের ঝুড়িতে চাল আনাজ পয়সা উপচে পড়ে। অতি উৎসাহী কোনো হঠাৎ বাবু একটা টাকা সেফটিপিন দিয়ে জামায় এঁটে দেয়। বাজনা বলতে ওই ঢোল, কত্তাল, খঞ্জনি, বড়জোর একটা কমদামি হারমোনিয়াম। তাও সব দলের জোটে না।
ঘেঁটুর দল যায় এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। উঠোনে উঠোনে নাচ গান। সঙ্গে যায় পাড়ার ছেলে মেয়েদের দল। তারাই ভ্রাম্যমাণ দর্শক শ্রোতা। ঘেঁটু দলের একজনের হাতে থাকে একটা খড়ের তৈরি মোটা দড়ি। বিনুনি পাকানো। ঘেঁটু গানে পাই―
আশেপাশে নেয়াল দড়ি
ঘেঁটু যাচ্ছে গেরস্তের বাড়ি।।
বছর পঞ্চাশ ষাট আগেও দেখা যেতো লোক বিনোদনের এই দৃশ্য। বাড়ির গিন্নির পিছনে মেয়ে বৌরা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ঘেঁটু গান শুনতো। নাচ দেখে মুখ টিপে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তো। নাচ গান শেষে চাল কলা মূলো পয়সাও দিতো। মূল গায়েনের সঙ্গে দোয়ারীরা ধুয়ো ধরতো। আর সেই তালে তাল মিলিয়ে ঘাগরা দুলিয়ে নাচুনির নাচ―
ফুল গাছেতে নিলম ছড়ি
পাখ পালালো গুড়ি গুড়ি।
ধর পাখ কদ্দুর যায়
লাল ব্যোম্ ছুটে যায়।
লাল ব্যোমের গুমগুমোনি
ছোটে ডোম, ছোটে ডোমনি।
গুমগুমিয়ে ভাঙবো দাঁত
ঘেঁটু আসলো চোত মাস।।
এই লাল ব্যোম্ কেন? কেন গুমগুমোনি? আসলে এ ছড়ার গান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরে রচিত। তখন কোলকাতার হাতিবাগানে বোমা পড়ার খবর গাঁয়ের মানুষের মুখে মুখে। দেখছে আকাশে ঘন ঘন উড়ছে উড়াকল (উড়োজাহাজ)। সে কথাই লোককবির কথায় ও সুরে ধরা পড়েছে।
ঘাট থেকে ঘেঁটু বা ঘাটু। এ ঘাট ও ঘাট ঘুরে ঘুরে গান। নদীমাতৃক বাংলা। বিশেষ করে ওপার বাংলা। সেখানকার লোকসংস্কৃতিতে নদী নৌকো ঘাট থাকবেই। যেমন সেখানকার লোক গানে আছে "কাঁধের গামছা থুইয়া যাও।"তেমনি আছে "ঘাটে বান্ধিয়া নৌকো পান খাইয়া যাও।" কিন্তু আমার আলোচ্য মধ্য বাংলা। বিশেষতঃ মধ্য রাঢ়ের ঘেঁটু গান ও ঘেঁটু পুজো। গান সারা মাস জুড়ে। বিচিত্র সুরে লোকছড়ার গান―
চোত মাসের চতুর্দশী
ঘেটুর কপালে চন্দন ঘসি।
ঘসতে ঘসতে পড়লো ফোঁটা
ও বুড়ি তোর সাত ব্যাটা।
সাত বেটা তোর সাতান্তর
এক ব্যাটা তোর মাগান্তর।
মাগান্তরের ভাই রে
ফুল তুলতে যাই রে!
ফুলে ফুলে জড়াবো
চন্দন কাঠ চেলাবো।
চন্দন কাঠের একই গোঁড়া
তাই নিয়েছে হরি চোরা।
হরি চোরা লখিন্দর
বাঁশ লাঙ্গল বার কর।
বার করেছি বার করেছি
এগু হালে হাল ধরেছি।
সে হাল কোথাকে যায়!
অসুন (রসুন) ঘাটাতে যায়।।
অসুনঘাটা আঁকাবাঁকা
মামীর কাণ্ডারী বাঁকা।
এক কাণ্ডা নেব রে
ভাসুর বাঁধা দেব রে।
ভাসুর শ্বশুর দুনিয়া
কড়ি আনগা গুনিয়া।
কড়ির চোটে কোড়া ওঠে
রাজার ঘরের ন্যায় বটে।
কার ন্যায় কার দায়
রাজার কন্যে যায়।
হাঁস নেব জোড়ে জোড়
পয়রা (পায়রা) নেব বত্রিশ জোড়।
আয় পয়রা ডাক দিয়ে
ধোবাঘাটার জল খেয়ে–
মোষ পড়লো দড়াম দিয়ে।।
দীর্ঘ দীর্ঘ এই ছড়ার গান। এ গানে আছে সাত ব্যাটার কথা। ব্যাটা মানেই নড়ি। আপৎ কালের ভরসা। এ ব্যাটা না হলে অন্য ব্যাটা খেতে দেবে। সাত ব্যাটা সাত রকম, সাতান্তর। এক ব্যাটা গরিব। সে মাগান্তর। মেগে খায়।
ছড়ার গানের কথা লতিয়ে লতিয়ে যায়। অনেক সময় অর্থহীন মনে হয়। কিন্তু কোথায় যেন লুকিয়ে আছে কৃষিজীবী মানুষের যাপন কথা। তাইতো বলে "বাঁশ লাঙল বার কর।" আবার কোথাও আছে কৃষ্ণ কথা। অসুনঘাটা বা রসুনঘাটা আসলে গঞ্জ। সেখানে হাট-বাজার। গ্রামীণ বানিজ্য কেন্দ্র। আর সেখানেই কৃষ্ণ। ওইযে বলে না, "কানু ছাড়া গীত নাই।"
অসুনঘাটা আঁকাবাঁকা
মামীর কাণ্ডারী বাঁকা।।
এই মামীর কাণ্ডারী কেষ্ট ছাড়া আর কে? আবার তৎক্ষণাৎ মহাভারতের অনুসর্গ। হস্তিনাপুরে পাশা খেলা।
ভাসুর বাঁধা দিব রে।
ভাসুর শ্বশুর দুনিয়া
কড়ি আনগা গুনিয়া।
কড়ির চোটে কোড়া ওঠে
রাজার ঘরের ন্যায় বটে।
কার ন্যায় কার দায়
রাজার কন্যে যায়।
একটু ভেবে দেখলেই ভেসে ওঠে কপট পাশাখেলায় হেরে রাজার কন্যে দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে পাণ্ডবদের বন গমনের চিত্র।
আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি এই ঘেঁটু গান পথে পথে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে নেচে কুঁদে সংগ্রহ করা হতো চাল আনাজ পয়সা। কখনও যৌথ রান্না কখনোবা সংগৃহীত দ্রব্য ভাগ করে নেওয়া। এভাবেই প্রান্তিক মানুষের কোনও রকমে দিন গুজরান। চোত মাস। ক্ষেতমজুরের কাজ নেই। ঘরে ঘরে অভাব। অনটন। ফসল এখন জোতদারের আর সম্পন্ন চাষীর গোলায়। ক্ষেতমজুরের আর কতটুকু সঞ্চয়! তার হাতে কাজ থাকলে তবেই পেট ভরে। মেয়েরা কাঠকুটো শাকপাতা গেঁড়ি গুগলি জোগাড় করে। এ বাড়ি ও বাড়ি পাট ঝাঁট দিয়ে অল্প কিছু সংস্থান করে। মরদরা জঙ্গল থেকে ঝাঁটি কাঠ এনে বিক্রি করে যা পায় তাতে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়না। তবু ওরই মধ্যে এই দুঃখের বারমাস্যায় তাঁদের গান সুর বেঁচে থাকে। অজান্তে উর্বরা করে দেশীয় সংস্কৃতিকে।
আমাদের মধ্যে আছে নেউল বাগ্দী। আদি বাড়ি মানকর। পানাগড়ের জামাই। এখন এখানেই বসবাস। ঘেঁটু গানের ভাণ্ডার আছে ওর কাছে। নিমাই বাগ্দী, সন্ন্যাসী বাউরী ছিদাম বাউরী এরা ছিল দোয়ারী। তাদের কাছে পেয়ছি অনেক গান। ঘেঁটু গান যে আসলে খানিকটা পেটের দায়ে ছিল তা ওরা বেশ মর্মে মর্মে জানে। বোঝেও।
ফাগুন সংক্রান্তিতে ঘেঁটু পুজো। খোস-পাঁচড়া চুলকানির দেবতা। তিনি ঘণ্টাকর্ণ। অথচ লোকগানে, কথায় ঘেঁটু দেবী। ঘরের মেয়ে। তার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সংক্রান্তির ভোরবেলা গেরস্তের উঠোনে গোবর মাটি লেপা। ঘেঁটুকে তুষ্ট করার উপকরণ খুব সামান্য। বাড়ির গিন্নি পাঁচ বা সাতটি গোবরের ছোট ডেলি করে তার উপর গুঁজে দেয় ঘেঁটু ফুল বা ভাটফুল। এগুলো একটা পাতায় রেখে সুতো দিয়ে তিন,পাঁচ বা সাত পাক পেঁচিয়ে দেয়। উপরে হলুদ রাঙা কাপড় দেয় জড়িয়ে। তাতে সিঁদুর আর কাজলের ফোঁটা। তারপর সেটা সদর দরজার পাশে রেখে দেয়। আরো একটু পাশে রাখে ছুতো পোড়া হাড়ি বা মালসা আর মুড়ো ঝাঁটা। ছড়া কাটে।
ধামা বাজা কুলো বাজা;
দুয়োরে এল ঘেঁটু রাজা।।
আসল কথা হলো কুলোর বাতাস দিয়ে খোস পাঁচড়া বিদেয় করা। তারপর বেলা গড়ালে গাঁ বাইরে ডোবায় ফেলে দেওয়া। চান করে বাড়ি ফেরা। এই হলো ঘেঁটু পুজো। আর ঘেঁটু বিদায় করে সন্ধ্যেবেলা হরির থানে (তুলসী তলায়) নাম সংকীর্তনের মাঝে বাতাসা পাটালি দিয়ে হরির লোট দেওয়া। হরির লোট বা হরির লুট হলো কীর্তন চলাকালীন বাতাসা পাটালি ছুড়ে দেওয়া। যে যা পার লুটে নাও বা কুড়িয়ে নাও। এখানেও আমরা একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার নিদর্শন দেখতে পাই।
পণ্ডিতেরা বলেন, এই লোকপুজো বা লোকগানের ধারনাটির শুরু মোটামুটি ষোড়শ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি বা তারও কিছু আগে। একসময় আমাদের রাঢ়বঙ্গে এই গান প্রান্তিক মানুষজনদের কাছে খুব জনপ্রিয় বিনোদন ছিল। আগেই বলা হয়েছে মূলত ছেলেদের নৃত্য গীত দলে কোনো একজনকে নর্তকী সাজিয়ে ঘেঁটু গান গাওয়া হতো। তবে শুনেছি কোথাও কোথাও মেয়েদেরও ঘেঁটু দল ছিল। একসময় গ্রামের এপাড়া ওপাড়ায় ঘেঁটু গানের দল ছিল। প্রতিযোগিতা হতেও দেখেছি। ইনাম দিতো বাবুরা। আর এই ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে নাচানোর পেছনে কেউ কেউ সমকামিতার গন্ধ পেয়ে থাকেন। তাঁদের দোষ দেখিনা। আমিও ছেলেবেলায় মেয়ে সাজা নাচুনিকে নিয়ে আদিরসাত্মক রঙ্গ রসিকতা করতে দেখেছি। এ দিয়ে বাংলাদেশে একটা সিনেমা হয়েছে “ঘেটুপুত্র কমলা”।
কথা হচ্ছে এই গান হলো মূলত লোক ছড়ার গান। ওই ছড়ার গানে পরিশীলিত কথা খুঁজা বাতুলতা। পূর্বাপর সম্পর্কও বড়ো একটা থাকে না। থাকার কথাও নয়। তবে অবশ্যই জীবনের কথা থাকে। জীবন যাত্রার আশা আকাঙ্ক্ষার কথাও থাকে। তেমনি একটি ছড়ার গান যা আমি পেয়েছি আমার খুব ভালো বন্ধু শ্রীমতি চক্রবর্তীর কাছ থেকে। লক্ষ্য করুন এ গানের চলন।
ঘেঁটু যায় ঘেঁটু যায় ওই রঙে
কোথায় মা ঘরের গিন্নি।
ঘরের গিন্নি শুনে বুজে(ঝ)
ভবানীপুরের হাট বুজে।
ভবানীপুরের কালাপানি
বাপ থাকতে ব্যাটাকে মানি।
ব্যাটা গেল হাড়ি গড়ে
এ বুড়ি তোর ভগ্গ(ভগ্ন) দাস
তুই করলি চত্তি মাস।
চত্তি মাসে চতুর্দশী
বুড়ির কপালে চন্দন ঘসি।
ঘসতে ঘসতে পড়লো ফোঁটা
এক ঘেঁটু যার সাত ব্যাটা।
সাত ব্যাটা মাদু-রে
ফুল তুলতে যায় রে!
ফুলের মধ্যি কি কি পায়
দুধের গন্ধ আদা পায়।
আদা ধরে মারলাম টান
দিয়ে দিন আমাদের ঘেঁটুর দান।
অর্থাৎ পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিন। আর পাঁচ ঘর ঘুরতে হবে তো! আর তাঁরই দেওয়া একটি ছড়ার গানে দেখি―
আয়রে ঘেঁটু নড়ে
ষষ্ঠীর উপর চড়ে।
ষষ্ঠীর নাম ভ্যাবলাঘাটি
তার উপরে কদমাটি।
কদমাটি নড়ে চড়ে
সতীন কাঁটার মুখ পোড়ে।।
এই সতীন কাঁটার কথা আমরা আরও অনেক ব্রতকথা লোক ছড়ায় পেয়েছি। তাই ঘেঁটু গানের কথায় সতীন কাঁটার উল্লেখ দেখে অবাক হইনা। আর একটা কথা, ঘাটে ঘাটে নাও থামিয়ে গান হোক আর যাই হোক আমাদের এই রাঢ়ীয় অঞ্চলে তো তেমন নৌকোঘাট নেই। তবু এখানের রুখু শুখু জমি। টাঁড় মাটিতে ঘেঁটুর ছড়া ও গানে ঘাটের কথা আছে। হ্যাঁ ওইযে আগেই লিখেছি–
ধোবাঘাটার জল খেয়ে
মোষ পড়লো দড়াম দিয়ে।।
এখানে ধোবাঘাটা বা ধোবিঘাট নদী না হয়ে পুকুরেও হতে পারে। কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু প্রায় সব গানের আসর শেষে ওই দুটি পদ থাকবেই। সঙ্গে সঙ্গে দলের লোকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর সঙ্গে আনা খড়ের তৈরি মোটা বিনুনির আকারের দড়াটি ধুপধাপ করে মাটিতে আছড়ায়। দর্শকরা হৈ হৈ করে ওঠে। মেয়েরা উলুধ্বনি করে। সেখানকার মাটিতে জল ছিটায়। পাওনাগণ্ডা নিয়ে ঘেঁটুর দল আরেক বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
আধুনিক নগর সভ্যতার চাপে পড়ে বাংলার লোকসংস্কৃতি আজ কোণঠাসা হতে হতে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ঘেঁটু গান, নাচ, ঘেঁটু পুজোও তেমনি গ্রাম জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
0 Comments